কবিতা

পুজোর পাঁচালি

পুজোর পাঁচালি
-রুদ্র প্রসাদ

 

 

মণ্ডপে মণ্ডপে রোশনাই, সপরিবারে মা এলো,
কয়েকটা দিনের বাৎসরিক সফরই তো হ’ল;
কৈলাসের ঘর ছেড়ে, নেমে আসা এই মর্ত্যে,
সবাই দেখ কেমন যেন একেবারে গেল বর্তে!
চারদিকেই উড়ছে কেমন সাজো সাজো রবে,
কেউ কি কখনও বোঝে? বোঝে না তো সবে;
দেখনদারিতেই খালি বুঝিয়ে দেওয়ার পালা,
বোঝে না খালি পেটে থাকার কি বিষম জ্বালা!
কোথাও থাকে কোনও এক ছোট্ট কুমারী কন্যা,
কোথাও তো থাকে পড়ে, আরও এক অনন্যা;
কেউ হয় বরণীয় দেবী, মাতৃরূপে হন পূজিতা,
কেউ থাকে উপেক্ষিতা, বুভুক্ষিতা, চিরলাঞ্ছিতা!
একজনের তো অনেক, অনেক আছে আজ,
তবেই না একই অঙ্গে উঠবে ফুটে মোহন সাজ;
তবুও আকাশছোঁয়া, অন্তহীন চাহিদা যে তার,
জমকালো আড়ম্বরে দেখাবে অপরূপ বাহার!
কোথাও তো আছে পড়ে ক্লিষ্ট আরও একজন,
ভালো থাকার কথা কি কখনও ভাবে তার মন?
হায় রে! সাজগোজের তার তো নেইকো বালাই,
এই সব ভাববার কোনও উপায়ই যে তার নাই!
এদিকে কতই না উন্মাদনার মদমত্ত হর্ষোল্লাস,
মেটে অবাধে সকল সাধ, একেবারেই অনায়াস;
আর জোগান তো অঢেল, সীমাহীন, অগুণতি!
অক্লেশে মেলে চরম সুখ আর পরমতম শান্তি!
ওদিকে ধুলি-ধূসরিত, ক্লান্ত, স্খলিত, নগ্ন পায়,
রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, চিন্তায় বারেবারে ফিরে চায়;
অসমর্থ জীর্ণ, শীর্ণ দেহে টুকরো বস্ত্রও সঙ্কুলান,
অতিকষ্টেও হয় না কোনোক্রমে দিন গুজরান!
বিত্তের দম্ভে দুর্গন্ধে পূর্ণ আজ মানবতার গাত্র,
স্বার্থ ছাড়া অন্যকে করে চলে তাচ্ছিল্যের পাত্র;
‘দানবীর’ না হয়ে সব হয়েই উঠতে চায় ‘দানব’!
ধরাকে সরা জ্ঞান করাই দস্তুর, হ’ক না জান্তব!
মেকী জৌলুস আর বৈরী বৈভবী উৎকর্ষতায়,
আর্তের ক্ষীণ কণ্ঠ রোধ করে চরম নিষ্ঠুরতায়;
মিথ্যা অহং, আস্ফালনে ঘুরে বেড়ায় দাপিয়ে,
অবহেলায় পদতলে দেয় অবলীলায় দাবিয়ে!
তাণ্ডবকারী মানুষ রূপে শুম্ভ-নিশুম্ভ আছে যত,
দাপটেই চাপা পড়ে হারিয়ে যায় প্রাণ কত শত;
আরও আছে সাথে মহিষসম উগ্র প্রচণ্ডাসুর,
মায়ের গলার আজ বাজে বেহাগের করুণ সুর!
কোথাও অকাতর অজুহাতে পেট পুজো শেষে,
কোথাও আবার হাত পেটে জোটে গঞ্জনা বেশে;
কোথাও মোটা বকশিশের রীতিনীতি চমৎকার!
কোথাও শুধুই চোখ রাঙানী, ঘৃণা বা ফুৎকার!
কোথাও আবার আবিষ্ট অনেকের মাঝে, ভিড়ে,
কোথাও বা চলে সারমেয়র সাথে জীবন নীড়ে!
এদিকে একটু নজর কাড়ার বিড়ম্বিত আয়াস;
অন্যদিকে খাবার দখলের সে কি অসম প্রয়াস!
উদারতার বুলি কপচানো মানুষেরা মুখেই বলে,
তাই তো আজও মায়ের চোখ ভরে অশ্রুজলে;
মনের শিক্ষা দীক্ষায় আজ মূল্যবোধ বড়ই কম,
স্যাঁতস্যাঁতে নোনায় ধরে দাঁড়িয়ে কত বৃদ্ধাশ্রম!
কেউ করে ভিক্ষা, কেউ বা রাস্তায় বেচে ফুল,
মায়েরা খেতে পরতে নাইবা পেলে কিসের ভুল?
বাঁচার জন্য কেউ হয়তো করে আরও কত কি,
তাতে কখনও কারোরই কিছু এসে যায় নাকি?
একদিকে কৃত্রিমতা উদ্ভাসিত রঙীন আলোকে,
অন্যদিকের দুর্গাকে আড়ালে রাখে দ্যুলোকে;
কোথাও অবলোকনে সজ্জিত সম্মোহনী কায়া,
কোথাও মলিনে করাল এক গম্ভীর আবছায়া ।
লোক দেখানো শ্রীহীন শ্রদ্ধাতেই নতমুখী সবাই,
বেমালুম বিস্মৃতি! মানবিকতা বলে কিছুই নাই;
আনন্দেই দেখে সব সুবেশে আলোকিত মৃন্ময়ী,
আঁধারে আর্তনাদ চেপেই বাঁচে কত মৃতবৎ চিন্ময়ী!!!

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page