গল্প

আত্মহত্যা

আত্মহত্যা
-রেহানা দেবনাথ

উমা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে তাই নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীরা নানা লোকে নানা কথা বলছে। ওর স্বামী ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। কানা ঘুষো চলছে বর প্রতিবন্ধী হয়ে বসে আছে প্রায় দু বছর হলো ও রান্নার কাজ করছে কলকাতায় গিয়ে। ওর প্রতিবেশী মহিমা বলে কত টাকা আর আয় হত যে দু’ ছেলেমেয়ের লেখা পড়ার খরচ, স্বামীর চিকিৎসা, সংসার খরচ হেসে খেলে চালাতো! আমাদের স্বামীরা কত বেশি টাকা আয় করে তাতেই সংসারে টানাটানি চলে! দেখ কোনো নাগর জুটিয়ে ছিল নাকি! রূপটা তো খারাপ ছিল না, ভ্রুকুটি কেটে রশিদা বলে। আহা বেচারা অসিত! ওর আর বাচ্ছা দুটোর কি হবে? সহানুভূতির সাথে শান্তি কাকিমা বলে। আমিনা ভাবি বলে কেন সবাই মিলে দেখে একটা বিয়ে দিয়ে দিলেই হলো, সংসারটা চলে যাবে। রিটা বলে এক পা কাটা আয় করতে পারে না, এমন ছেলেকে কে বিয়ে করবে? হেমা আগ বাড়িয়ে বলে কেন আমার বোনের শ্বশুর বাড়ির ওখানে একটি মেয়ে আছে দেখতে ভালো গায়ের রঙটা একটু শ্যামবর্ণা, খুব গরীব, আমি বললে রাজি হয়ে যাবে।
বিজয় বলে সবাই জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে!শশ্মান যাত্রা শুরু করতে এবার আসিতদাকে বাইরে আনার চেষ্টা করো। নিশিকান্ত বলে বউ মরে গেছে তাই বলে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘরে ঢুকে শোক পালন করলে হবে! পুরুষ মানুষ একটা বউ মারা গেছে আরেকটি হবে। ধর্মদাস বলে ঠিক বলেছেন দাদু সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা! গাজী বলে তাও যদি বউয়ের চরিত্র ভালো হত, তাও একটা কথা ছিল! শুনে এলাম গ্রামের সবাই তো আলোচনা করছে বউটা নাকি কোনো খারাপ কাজে না কুসঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে, না হলে কোনদিন আমাদের এলাকার বদনাম হয়ে যেত।
দড়াম দড়াম করে দরজার মেরে ও সবাই মিলে ডেকেও যখন আসিতের সাড়া পেলো না, তখন কয়েকজন মিলে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে বাঁ হাতের কাটা শিরা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ঘর ভেসে যাচ্ছে আর নিথর দেহটা বিছানায় পড়ে আছে ডান হাতে উমার ছবি। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল! কিছুক্ষণের মধ্যে সবার মুখে একটা কথা ঘুরতে থাকে অসিত বউকে এত ভালোবাসত যে ওর মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি তাই সেও আত্মহত্যা করেছে! ঘন্টা খানেক পর পুলিশ এসে আসিতের লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য তুলতে তার দেহের নীচ থেকে একটা চিঠি পায়। সেই চিঠির বয়ান ছিল যে উমা বাইরে কাজ করে সংসার চালাচ্ছিল তারা সুখেই ছিল। হঠাৎ মাস ছয়েক আগে অসিতের বন্ধু মহিম ওদের বাড়িতে আসে তারপর থেকে নানা অছিলায় যাতায়াত বেড়ে যায়। প্রায় প্রতি সপ্তাহে উমার ছুটির দিনে আসতে শুরু করে যা অসিতের কাছে অসহ্য লাগে কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারত না। এরপর মাস তিনেক পর থেকে উমা আর অসিতের মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। তার দিন পনের পর থেকে মহিমের আসাও কমে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে উমাও দেরী করে বাড়ি ফিরতে থাকে জিগ্যেস করলে বলেছিল এখন বেশি করে রান্না করতে হয় তাই দেরি হয়ে যায়।অসিতের মনে সন্দেহ জাগে কিন্তু কি করবে বুঝতে পারছিল কারণ নিজে আয় করতে পারে না ওর বউয়ের উপার্জনের টাকায় সংসার চলে। সপ্তাহ খানেক আগে মহিম এসে জানায় যে উমা কলকাতার একটি হোটেলে দেহ ব্যবসার কাজ করছে এছাড়া ওকেও কুপ্রস্তাব দিয়েছিল তাই ও বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।অসিত প্রথমে মানতে চায়নি। পরে মহিম প্রমাণ করার জন্য পরের দিন ওকে গাড়ি করে নিয়ে যায় আর একটা মেস বাড়িতে যেখানে পুরুষদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে মোহিনী ঢুকছে দেখায়। অসিতের মাথায় রক্ত ওঠে। সে বাড়ি ফিরে রাগে, ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে আর কি করবে ভাবতে থাকে। পরে রাত করে উমা আসার আগে বাচ্ছাদের খাইয়ে দেয়, তারপর নিজে খেয়ে নিয়ে বাকি খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয় বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে। উমা প্রতিদিনের মতো বাড়ি ফিরে সব কাজ সেরে রাত একটার সময় খাবার খেয়ে শুতে যাচ্ছে তখন তার সারা শরীরে জ্বালা শুরু হয়। ছটকাতে থাকে অসিত ঘুমিয়ে থাকার ভান করে!তারপর উমা যখন জোরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখন অসিতের হুশ হয় রাগের মাথায় সে কি কান্ড ঘটিয়েছে। তখন চেঁচামেচি করতে থাকে পাশের বাড়ির লোকজনেরা ছুটে আসে ওই রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় উমাকে। দুদিন পরে জ্ঞান ফিরলে অসিতের সঙ্গে নানা কথা বলার পর জানায় যে মহিম ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল ও দেহ ব্যবসার কাজে যুক্ত করতে চেয়েছিল রাজী হয়নি বলে ধমকি দিয়েছিল তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। উমা বলেছিল পারবে না কিন্তু আজ ভাগ্যের কি খেলা মৃত্যু আমাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কথাটা বলতে বলতে উমা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অসিত পাথরের মত বসে থাকে। কত সময় কেটে গেছে ওর হেলদোল নেই।আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী কয়েকজন মিলে হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে থাকে। এমন সময় তিনজন অল্প বয়সী ছেলে এসে উমার লাশ দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে অসিতকে জিগ্যেস করলো এটা কিভাবে হলো। গত তিন মাস ধরে দিদি আমাদের মেসে রান্না করছিল, সবাইকে খুব আদর যত্ন করতো, হাসি খুশি থাকত।আমরাও বড় দিদির মত মানতাম ও সন্মান করতাম।দুদিন মেসে না আসার কারণে দিদির ফোনে কল করে জানতে পারলাম যে উনি আত্মহত্যা করেছেন এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এখানে এসে আমরা তো অবাক হয়ে গেলাম বলতে বলতে চোখের জল মুছতে থাকে। অসিত হাঁ করে সব কথা শোনে তারপর বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকে নিজের বিবেকের সঙ্গে লড়াই চালায় শেষে তার দংশনে জর্জরিত হয়ে হার স্বীকার করে নেয়।
অসিতের চিঠির বয়ান শোনার পর আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীরা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো!

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page