ছেলেবেলার বন্ধু লকা

ছেলেবেলার বন্ধু লকা
-সৌরভ ঘোষ

 

অবাধ্য,দুরন্ত, ভীষণ -এইসব উপমাই খাটে
পাড়ার লোক অতিষ্ঠ,কারও কথা শোনে না যে
আমার বাড়ির পাশে
একচালার ঘরে মায়ের সাথে থাকে,
আমার প্রিয় বন্ধু স্কুলছুট লকা।
উত্তরের জানালা তখন বন্ধ থাকত
পরীক্ষা নিঃস্বাস ফেলত ঘাড়ে।
ফিসফিস শব্দগুলো জুড়ে
কব্জার ফাঁক দিয়ে কানের পর্দায় ধাক্কা দিত।
লকার আদরের ডাক- “যাবি? চলনা, আজ অনেক হাওয়া, সব ধান কাটা, মাঠ এক্কেবারে ফাঁকা,
খুব ঘুড়ি ওড়াবো, যাবি?
জানলাটা খোল,
চারটে ঘুড়ি দুটো লাটাই,সুতোয় কড়কড়ে লাল মাঞ্জা
আজ কেউ কাটতে পারবেনা, যাবি? চলনা”
জানালা খুলতেই লকার এক গাল নিষ্পাপ হাসি
হাতে পেটকাটি, চাঁদিয়াল, দুটো মুখপোড়া।
ইতিহাসের আলেকজান্ডারকে যুদ্ধে নামিয়ে মন তখন ঘুড়ির দেশে,
কিন্তু মা? দৃষ্টি এড়ানো বড়ই কঠিন, বাইরে বেরোতে মানা।
লকা সাহসী, কাউকে মানে না,
আবার ডাকে “যাবি? চলনা”

প্রতিদিন যে যাওয়াও যায়না,
তোর তো পরীক্ষা নেই
ভয়ও পাসনা মা’র লাঠির ঘা।
এদিকে গুরুমস্তিষ্কে তখন আলেকডান্ডারের সাহসী বিচরণ…
মন বলে “পুরুর দেশের মানুষ হয়ে ভয়? কক্ষনো নয়।”
দখিন বারান্দা, মা তখন সঞ্চয়িতা, মা’এর তখন ঝিমুনি
সন্তর্পনে পাহারা এড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি
মুক্ত আলো, মুক্ত শ্বাস, আহ…
মাঠ জুড়ে সে এক অগ্নিপরীক্ষা,
ঘুড়ির লড়াই, চেঁচানি – ‘ভো কাট্টা…’
লকা সুতো টেনে ধরে, আমার হাতে আস্ত মুখপোড়া
“ঢিলে দে ঢিলে দে ও মোমবাতি ছেড়েছে”
এত ছেলে!
কিকরে আসে, কি করে ধুলো দেয় মা’র চোখে?
লকার মাঞ্জা সেরা,
আমাদের মুখপোড়া আলেকজান্ডারের বিজয় পতাকা।
সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি,
মা’র রণমূর্তি,হাতে পুরির লাঠি
আমি তখন ঝিলাম,আমি তখন পুরু,
চোখে একফোঁটাও জল আসতনা,
না হত বুক দুরুদুরু।

আমার মা-আর মারে না,আর ডাকেও না জোরে
রাজা পুরুর বশ্যতা স্বীকার,
চাকরি নিয়েছি দূরে।
নিউটাউনে দুটো পার্ক পেড়িয়ে
সাজানো ফ্ল্যাট পুরো আটশো স্কোয়ার ফিটের।
এখানেও বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ে,অনেক
তবে ছাদ থেকে
আমার একমাত্র ছেলে মায়ের একান্ত অনুগত…

লকা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে,
শীতের দুপুর, ঘুড়ি দেখলেই মনে পড়ে।
এখনো ঘুড়ি ওড়ায় লকা?
তার ছেলেপুলে নিশ্চই…
মেঘগুলো ওদিক থেকেই আসে,
কই একটাও মুখপোড়া উড়ে আসেনা তো।
একদিন যাবো লকা তোদের গ্রামে,
আমার ছেড়ে আসা গ্রামে।
তুই কল খাটিয়ে দিবি
আমি নিজে ঘুড়ি ওড়াবো, মন দিয়ে…

বছর দুয়েক আগে বেচুদা বলেছিল লকার লিভার ক্যান্সার,
বেচুদার সাথেও অনেক দিন দেখা হয়নি,
তুই নিশ্চয়ই বেঁচে আছিস, এত প্রাণ আছে যার সে…
তুই’যে আলেকজান্ডার
আমি যাব লকা, আসছে শীতেই যাব,
আবার তুই জানালায় এসে দাঁড়াবি,
আবার ডাকবি আগের মত।
আর ভয় পাই না, এবার তোর কাঁধ ধরেই যাব
সারাদিন ঘুড়ি ওড়াবো,
দেখবি সব একই আছে, আমিও…
আর একবার ছেলেবেলা ফিরিয়ে দে লকা,
ছেলেবেলার সকাল, ঘাসের ডগায় শিশির
আকাশের দিকে চেয়ে তারা গোনা
করমচার ডাল থেকে নদীতে অগুন্তি ঝাঁপ
তোর গায়ের সোঁদা সোঁদা গন্ধ, দুপুরগুলো…
মাটির মুখোমুখি হতে চাই আর একবার
তুইই পারিস, তুই যে আলেকজান্ডার।
পারবি লকা
তুই নিশ্চই পারবি…ছেলেবেলা…

Loading

Leave A Comment