ময়না মতি
-রাণা চ্যাটার্জী
আমি ময়না মতি ,
বড় আদরে শৈশব থেকে ডালপালা মেলে
বড়ো হয়ে ওঠা এক যুবতী নারী।
ছোটো বেলায় দাদার মুখে শোনা, রামু চাচা
একটা ময়না পাখি এনে দিয়েছিলো!
সেটাই ছিলো দাদার ধ্যান জ্ঞান।
এক ঝড়ের রাতে, ভুল করে দরজা বন্ধ থাকায় মর্মান্তিক পরিণতিতে, আশ্চর্য্যজনক ভাবে খুবলে খেয়েছিলো কোনো দস্যি, হুলো বেড়াল !
তার কিছু দিন পরেই ক্লাস ফোরে পড়া
দাদা,পূর্বাভাস পায় “আমি আসছি “।
ভাই না বোন তা নিয়ে,খুব একটা মাথাব্যাথা ছিলনা দাদার, কেবল ছিলো এক রাশ আনন্দ,
যখন গভীর রাতে মা, প্রথম বাবাকে জড়িয়ে
আমার আগমনের বার্তা দিয়েছিলো।
আদরের ময়না হারিয়ে, দাদার সেই চোখে চোখে রাখা, আর মা বাবার পরম স্নেহে,
আমার ময়না মতি হয়ে ওঠার দিনযাপনের শুরু।
আড়ালে কখনো কখনো ঠাকুমার হাপিত্যেশ শুনতাম,
কলতলায় যখন গোবর কুড়ানী ও পাড়ার খুড়িমা দুদণ্ড জিরোতে আসতো দুপুরে আমাদের বাড়ির পেছন দাওয়ায়।
আর একটা পুত্র সন্তান নেবার চাপ, অবশেষে সুখের দিনে নজর লাগালো অচিরেই ।
এক হাড় কাঁপানো ঠান্ডার বৃষ্টি বাদলার ভোর রাতে,
গ্রামের উঁচু নিচু এবড়ো খেবরো জল-ডাঙ্গা রাস্তায় ভ্যানের ঝাঁকুনিতে তীব্র প্রসব বেদনায় বার বার জ্ঞান হারিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ!
খুব সামান্য চাহিদায়,বড়ো স্নেহে দুই ছেলে মেয়ে, আর স্বামীর একটু আদর, অবজ্ঞাতেই খুশির স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, সরলমনা আমার মা।
মায়ের মুখটা মনে করতে করতে ঘুম ভাঙ্গা সকালে হঠাৎ জল ভর্তি মগের আচমকা হাত থেকে পড়ে যাওয়া,
ছ্যাঁক করে বুকের মাঝে যেন কিছুর বার্তা দিলো !
সহজ পাঠ বইয়ের আঁকিবুঁকির মাঝেও শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা,”এই বুঝি বাবা এলো “!
দুপুরে বাবা এলেন,গ্রামের কিছু গ্রামের মাতব্বর সঙ্গে, সেই অপূর্ব সরলতা মাখা আমার মা হিমশীতল ডেডবডি হয়ে উঠোনে আমাদের সামনে!
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাক্স প্যাটরায় মায়ের শখের দু চার খান শাড়ি,সোনার জল ধরানো গয়না গায়ে উঠলো আমাদের সৎ মায়ের।
বাবা সোহাগে পায়ের মল গড়িয়ে দিলেন,সেই মিষ্টি ছম ছম নূপুর ধ্বনি বড়ো বেমানান সুরে বাজতো আমার কানে! আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ের সাথে দু দণ্ড গল্প করার নীরবতা বাধ সাধতো মুহূর্তে।
দাদার ঠাঁই হলো,দশ ক্রোশ দূরের আনন্দমার্গ স্কুলের হোস্টেলে।
ময়নামতির সেই অভাগীর দিন শুরু …!
নাম কা ওয়াস্তে,বইগুলো নিয়ে বসতাম আর, নতুন মায়ের ফাই ফরমাশ খেটে দিন গুজরান হতো।
মাঝ রাতে দাওয়ার কঞ্চি ঘেরা এক চিলতে চৌকিতে শুয়ে বালিশ ভেজানোর কতো রাত জাগা!
মা ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতেন স্বপ্নে, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে এলে আমায় নিয়ে যাবার বায়নায় বলে উঠতাম, “মা গো আমায় কি নিয়ে চলো না মা, তোমার কাছে !”
কখনো ঘোরে চিৎকার করে ‘ওরে দাদা ,আয়না রে ,আমায় নিয়ে চল।’
আমার প্রিয় ঘর, ছিঁটে বেড়া দেওয়াল, আর খাঁ খাঁ উঠোন আমায় গিলতে আসতো !
কয়েক বছরের মধ্যেই ফুলে ফেঁপে উঠলো আমার শরীর,
পাড়া প্রতিবেশী, গ্রামের ফচকে ছোঁড়া, বুড়ো কেউই আড় চোখে আমার ডাগর শরীরের বেড়ে ওঠা দেখতে ছাড়তো না।
মাতব্বরেরা বিধেন দিলেন হেঁকে, ‘ওরে ময়নার বাপ্, মেয়ে তো দিন কে দিন ডাল পালা মেলছে গতি কর জলদি’
মনে মনে হেসেছিলাম, দাদার আদরের ময়না মতীর একটা হিল্লের জন্য এই পুরুষ কুলের কতো চিন্তা !
জানলাম না, চিনলাম না, গ্রামের দুগ্গা তলায় সিঁদুর দান সম্পন্ন হলো এক ভিনদেশি পুরুষের সাথে!
নব বধূর সাজে আমি ময়নামতী, ফুলশয্যার রাতেই বুঝলাম, আমার বাপের বয়সী, এক পোড়া কাঠ কয়লা হয়েছে আমার জীবনের সোহাগ।
বিয়ের এক মাসের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেলো, মোটা অঙ্কের খেলায় নতুন মা, আমার সত্গতি করেছেন নপুংসক এই আধবুড়োর সঙ্গে।
প্রতি রাতে, ঘুমানোর ভান করে কান্নায় কেঁপে ওঠা আমার মন মায়ের কাছে, দাদার কাছে যখন আশ্রয় খুঁজতো, উপলব্ধি করতাম এক জান্তব লোমশ হাত আমার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাপ নেবার খেলায় মাতে!
মাত্র উনিশটা বসন্ত পার হওয়া আমি এখন ঠাঁই পেয়েছি হাসপাতালের ফিমেল বার্নিং ওয়ার্ডের বেডে,
একটা কাক সেই কখন থেকে কর্কশ ভাবে ডেকেই চলেছে কার্ণিশে!
সারা শরীর আমার অর্ধ দগ্ধ, জ্বলে গিয়েছে বুক, পেট তলপেট,নিম্নাঙ্গ!
এক উন্মত্ত ঝড়ো রাতে মদ্যপ স্বামীকে ঠেলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি।
ময়না পাখি হয়ে শেকল কেটে বাঁচতে চেয়েছিলাম!
ভেবেছিলাম এক ছুটে দাদাকে খুঁজে সব বলে হালকা হবো,বলবো “দাদারে তোর ময়না মতীকে বাঁচা “।
রাত জাগা সকালে উঠে সে সুখ আর হয়নি !
পৌরুষে আঘাত লাগা মদ্যপ যে ক্ষ্যাপা বাঘের চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তার নজির পেয়েছি আমি হাতে নাতে!
প্রকৃতির ডাকে ঘুম চোখে ভোরবেলায় বাইরে আসতেই, কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আমার সর্বাঙ্গ!
ঠোঁটে দেশলাই কাঠি চেপে, ‘আমার নাকি রূপের গরব ,’ আর সেটাকেই পুড়িয়ে দিতে পারার উল্লসিত দেঁতো পুরুষতন্ত্রের হাসির মুখরিত ধ্বনি আজও কানে ভাসছে।
হাসপাতালের বেডে পরম যত্নে আমার চোখের জল, মুছিয়ে দেবার আপ্রাণ চেস্টায় রত আমার নার্স আর দেখভাল করা মাসি ।
মন তখনো আকুতি নিয়ে বলছে, আয় না রে দাদা, একটি বার, এসে দেখে যা তোর ময়নামতি কেমন একটু একটু করে মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে!