সমাজের সাহিত্য ও সাহিত্যের সমাজ

সমাজের সাহিত্য ও সাহিত্যের সমাজ
-রুদ্র প্রসাদ

 

 

যুগ যুগান্তরের অক্লান্ত সাধনার ফলে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই সমাজ, রচিত হয়েছে তার পরিকাঠামো। প্রতিনিয়ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হতে সৃষ্টি হয়েছে নানান রূপরেখার তরঙ্গ। ভেতরের-বাইরের সেই সমস্ত তরঙ্গায়িত রূপরেখার ভাবস্পন্দন অপরূপে ফুটে উঠে বিকশিত হয়েছে সাহিত্য। তাই তো সৃষ্টির জগতে ‘জীবন’ মহান শিল্পী এবং সাহিত্য তারই অনুপম ‘স্বরূপ’।

একদিকে প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ, আর অন্যদিকে সামাজিক উচ্ছ্বসিত জীবন তরঙ্গ – উভয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়েই দৃষ্টিগোচর হয় চারপাশের বিদ্যমান জগত, যার নিত্য-প্রবহমাণ জীবন-ধারা, সামাজিক প্রেক্ষাপটে শত-সহস্রের কর্ম-কোলাহল ও সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে, সময়ের সাথে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মুখরিত স্বরূপ যখন ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ আত্মপ্রকাশ করে, তখন তা রূপ নেয় সাহিত্যের। সাহিত্য তাই সমাজের দর্পণ, তাতে দেখা যায় বিশেষ দেশ-কাললব্ধ সমাজের মুখ।

সাহিত্যের প্রত্যক্ষ উপকরণ সমসাময়িক সমাজ ও সামাজিক জীবন, কিন্তু তা কোনও নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে নিঃশেষিত হয় না। তা স্রষ্টার শৈলীর অপরূপ শিল্প-সৌকর্যে সমকালীনত্ব অতিক্রম করে, স্রষ্টার শিল্প-প্রতিভার অনুপম রূপ চিরন্তনতার জয়টিকা ললাটে নিয়ে হয়ে ওঠে সর্বকালীন, সার্বজনীন। ক্ষণিকের ভাবনা হয়ে যায় চিরকালের, পরিবর্তনশীল সমাজ ও নীরব সময়, স্রষ্টার মুদ্রিত সৃষ্টির গুণে হয়ে ওঠে মুখর, বাঙ্ময়।

বহিরঙ্গের বিশ্ব-প্রকৃতি বা সামাজিক পরিপ্রেক্ষণী থেকে উপকরণ সংগৃহীত হলেও স্রষ্টা হলেন সৃষ্টি-সাম্রাজ্যের অধিকর্তা। ‘সৃষ্টিকর্তা’ তাঁর একান্তই আপন অনুভব দিয়ে বিশ্বকর্মার মতোই ‘আপনা’কে রচনা করেন, কিন্তু সেই স্রষ্টার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে আর এক মহাশিল্পী সেই সৃষ্টিতে সহযোগী হয়। সমাজই সেই ‘মহাশিল্পী’, সে স্রষ্টার অবচেতন মানস দর্পণে ফেলে আপন প্রতিচ্ছবি, সাহিত্যরূপে রচনা করে যায় জীবনবেদ। কোনও শিল্পীই তাঁর সমকালীন সমাজকে অস্বীকার করতে পারেন না, তাই তাঁদের রচনা-সম্ভারে মূর্ত হয়ে ওঠে তৎকালীন সমাজের নির্ভুল প্রতিবিম্ব।

যাঁর মধ্যে সাহিত্যের নব-নব রূপ আত্মপ্রকাশের জন্য উন্মুখ, যিনি অতিন্দ্রিয় অনুভব ক্ষমতা ও উপলব্ধি শক্তির অধিকারী, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের নানা ঘটনা তরঙ্গ, সমাজের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রবল আবর্তে সৃষ্ট এক অনির্বচনীয় ভাবরস সিঞ্চিত করে যাঁর চেতনালোক, যাঁর অনুভূতির রঙে পান্না হয় সবুজ, গোলাপ হয় সুন্দর – তিনিই স্রষ্টা, তিনিই সাহিত্য সৃষ্টির কারিগর। আসলে এই সমাজই যেন হাসি-কান্নার এক আশ্চর্য ফল্গুধারা, স্রষ্টা তাতে অবগাহন করেন, অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ঘটে সংগৃহীত জলে ফলিয়ে তোলেন সৃষ্টির অভিনব শস্য। বহির্বিশ্বের বৈচিত্র্য তাঁর অন্তরের অন্তঃস্তলে সঞ্চিত হয়ে যখন প্রকাশবেদনায় ব্যাকুল হয় রূপলাভের জন্য, স্রষ্টা তখন তাকে ‘বাণীরূপ’ প্রদান করে স্থাপন করেন সাহিত্যের হিরণ্ময় পাত্রে । সমাজ থেকে সংগৃহীত অভিজ্ঞতা এভাবেই সাহিত্যায়নের মাধ্যমে হয়ে ওঠে শাশ্বত, নান্দনিক।

সমাজ সৃষ্টি করে স্রষ্টাকে, স্রষ্টা সৃষ্টি করেন শিল্প। কোনও স্রষ্টা কখনওই সমাজের অনতিক্রম্য অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন না। কারণ, ‘সমাজ’ মানে তো কেবলমাত্র স্থান বা কাল এবং মানুষ নয়, ‘সমাজ’ মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আচার-আচরণ, বিচার-অবিচার, সংস্কার-ব্যবহার, মহত্ত্ব-নীচতা, অমৃত-গরল — সমস্ত কিছুরই সমাহৃত যোগফল। সেখানে যেমন রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত আছে, তেমনই আছে অর্থনৈতিক নানান ঘটনাপুঞ্জ; সেখানে যেমন দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার আছে, তেমনই আছে অকুণ্ঠ মানবিক উদারতা। চারপাশের ওঠাপড়া থেকেই স্রষ্টা আহরণ করেন তাঁর সৃষ্টির উপকরণ। সমাজের বিস্তীর্ণ প্রান্তর থেকে খড়-কুটো সংগ্রহ করে রচিত হয় তাঁর সৃষ্টির খেলাঘর। কারণ তিনি একাধারে দ্রষ্টা এবং স্রষ্টা। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাবলী, বস্তু-সম্ভার ও বহু-বিচিত্র মানব-জীবনকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন, অননুকরণীয় উপলব্ধি শক্তিবলে তার ভাবসত্য অনুভব করেন এবং তাকে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন্ত ভাষা-শৈলীর মাধ্যমে রূপদান করেন। তাই স্রষ্টারা সাধারণের মধ্যে থেকেও অনন্যসাধারণ, স্বতন্ত্র।

কবি, সাহিত্যিকেরা হলেন সমাজের মুখর চারণ। তাঁদের লেখনীতে ভাস্বর হয়ে ওঠে সমাজের সত্য, স্বরূপ। সাহিত্যের মুকুরে তাই দেখা যায় সমাজের সমসাময়িক প্রতিরূপ। তা সে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘শকুন্তলা’, ‘কাদম্বরী’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘কিং লিয়র’, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘অলিভার ট্যুইস্ট’, ‘ওয়ার এণ্ড পীস’, ‘মাদার’ বা ‘গোরা’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘নীলদর্পণ’ থেকে ‘কেয়া পাতার নৌকা’, ‘প্রথম আলো’, ‘দ্বিখণ্ডিত’, ‘কাঙাল মালসাট’, ‘হলদে গোলাপ’ – যাই হ’ক না কেন, সর্বত্র মুখরিত হয়েছে সমাজের আবেগ-মথিত মর্মবাণী। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে তৎকালীন বাংলার সামাজিক বিন্যাস ও অর্থনৈতিক রূপরেখা অকিঞ্চিতকরভাবেই প্রতিভাসিত। তার সাহিত্যচিত্রের মুক্ত বাতায়ন পথে সমগ্র সমাজ হয়ে ওঠে জীবন্ত, দৃশ্যমান। ‘চর্যাপদ’, ‘শ্রীকৃষ্ণকাব্য’, ‘মঙ্গলকাব্য’, জীবনী-সাহিত্য — সর্বত্র সমাজের ভাবমূর্তি অত্যন্ত সাবলীলভাবেই উদ্ভাসিত। কাজেই, ‘সাহিত্য’ সমাজের এক বিশ্বস্ত দলিল।

কবি, সাহিত্যিকেরা হলেন দক্ষ মধুকর এবং সৃষ্ট সাহিত্য এক অনিন্দ্য মধুচক্র। সমাজ উপবনের বহু-বিচিত্র পুষ্পরাজি থেকে তিল তিল করে মধু সঞ্চয় করে, তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনানুযায়ী নবতর সৃষ্টির আনন্দে যা নির্মাণ করেন, তা তিলোত্তম সৌন্দর্যের শিল্পময় প্রকাশ, চিরন্তন হৃদমধুর অফুরন্ত ভাণ্ডার। কাজেই, সাহিত্যের যে চিরায়ত মধুধারা, তা শিল্পীকে সরবরাহ করে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ সমাহৃত সমকালীন সমাজ। সাহিত্যের অক্ষয় ধাত্রে সমকালের সমাজ চিরকালের মধুময় সম্পদরূপে সংরক্ষিত হয় এক শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত অনবদ্য কৌশলে।

এই ভাবেই ‘স্রষ্টা’ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে নানাবিধ সামাজিক সামগ্রী নিয়ে মেতে ওঠেন নিত্য-নতুনের সৃষ্টিখেলায়, ফলে যা সামান্য, তা সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে অনন্য; যা ব্যক্তিবিশেষের, তা হয়ে ওঠে সার্বজনীন; যা অবলীলায় পেরিয়ে যায় দেশ-কালের গণ্ডী। কিন্তু সবার অগোচরে সমাজই তার বৈচিত্র্যময় সম্ভার নিয়ে মেতে ওঠে সৃষ্টির অনির্বচনীয় খেলায়। তাই ‘সাহিত্য’, ‘সমাজ’-এরই বিশ্বস্ত দর্পণ, ‘সমাজ’-এর ‘সাহিত্য’, তারই নির্ভুল প্রতিচ্ছবি ।।

Loading

2 thoughts on “সমাজের সাহিত্য ও সাহিত্যের সমাজ

Leave A Comment