জুড়াইতে চাই
-সঞ্জিত মণ্ডল
কত যে অভিজ্ঞতা হয় জীবনে, বয়স যত বাড়তে থাকে অভিজ্ঞতার সীমানাও বাড়তে থাকে নানান ঘাত প্রতিঘাতে। জীবনের ব্যাপ্তি বুঝে অভিজ্ঞতারা হানা দেয় কখনো সাধুর ছদ্ম বেশে, কখনো মোহিনী বেশে, কখনো বা ঝেড়ে কেশে, কখনো বা বেশ হেসে হেসে। কেউবা প্রথমে আসে বন্ধুর বেশে শত্রুতা করে পরে, কেউ বা শত্রু হয়ে এসে বন্ধুত্ব মেনে নেয় শেষে। পোড় খাওয়া মানুষ পুড়ে পুড়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বেশ হিসেব করে। আর বেহিসেবী লোক ভেসে যায় অনভিজ্ঞতার বন্যায়, খরায়, কিংবা খারাপ হাওয়ায়।
অমল, বিমল, কমলরা সব এক লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে, ইন্দ্রজিৎ কেবল একা হয়, মেঘের আড়ালে থেকেও সে যুদ্ধ চালায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়, নবকুমারের মতো অন্যের জন্যে কাঠ কাটতে গিয়ে নদীর চরে জঙ্গলে হারিয়ে যায়। এদিকে নেপোরা সব লুটে পুটে খায়, খোলা হাওয়ায়। বলবার কেউ নেই, প্রতিবাদীর মাথা উড়ে যায় নয়তো চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যায়।
ভালো কাজের বিপদ অনেক, ঘরে বাইরে শত্রু তৈরি হয়, ঈর্ষান্বিত হয় বন্ধুরাও, আত্মীয়েরাও ছেড়ে কথা বলেনা, অথচ ক্রুর অসামাজিক দৈত্য হলে রা কাড়েনা কেউ, সবাই ভয়ে সরে যায়, পাছে ঝাড় খেতে হয়। লোটালুটি চলতে থাকে কত অনায়াসে! মানুষ জানে খারাপ কাজের শাস্তি আছে, আজ নয় কাল তাকে শাস্তি পেতেই হবে, ধরা সে পড়বেই, তবুও সে সাময়িক লাভের আশায় গর্হিত অসামাজিক কাজ করে বসে। যখন সে শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড়ায়, তাতেও কি সে সম্বিত ফিরে পায়! অপরাধীরা দেখেও শেখেনা ঠেকেও শেখে না, জানিনা এর শেষ কোথায়। পাপের পথ এমনি করেই মসৃণ হয়, কেউ বাধা মানে না ।
নৃশংসতা দেখলে লোকে শিউরে ওঠে, ভীরু লোকে ভিরমি খায়, সাহসী চটপট সরে যায়, দায় এড়ায়, সমাজ সংসার এগিয়ে চলে সৃষ্টির বদান্যতায়। ভাবি এক আর হয় আর এক। শান্তি চাই, কোথায় পাই, জুড়াতে চাই, কোথায় জুড়াই, পৃথিবী তো একটাই! একটাই চাঁদ একটাই সূর্য। কেউ হাতে চাঁদ নিয়ে জন্মায়, কেউ হাতে চাঁদ ধরতে চায়। কার কপালে যে কি আছে হায়!
সকাল বেলায় অন্ন চিন্তা, দুপুরে আহারের চিন্তা, রাতে শুতে যাবার চিন্তা, জীবন কাটে, জীবন বৃথা, জীবন ধন্য কার যে কোথা!
তাই আজ মনে হয়,”পথের শ্রান্তি ভুলে, স্নেহভরা কোলে তব, মা গো বল কবে শীতল হব। কতদূর, আর কত দূর বল মা-“—
তাই আরো মনে হয়,
“যেদিন হবে তোমার প্রকাশ আমার মনের মাঝে,
দেখবো তখন কেমন তোমার দূরে থাকা সাজে।
তাই তোমার গানে মনে প্রাণে চিত্তে জাগাই সাড়া,
এমনি করে বিশ্বলোকে দাও গো তুমি নাড়া।
তোমার নামে ঋদ্ধ হব মানুষ হব আমি,
দাও আমারে বিশ্বলোকের অমর সুর ও বাণী।”
কবিগুরুর যে গান গেয়ে জুড়াইতে চাই সেই গানের সুর ও বাণী :–
“সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর–
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।
কত বর্ণে কত গন্ধে কত গানে কত ছন্দে
অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর।
আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।
তোমায় আমায় মিলন হলে সকলই যায় যে খুলে,
বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠবে তখন দুলে।
তোমার আলোয় নাই তো ছায়া,
আমার মাঝে পায় সে কায়া,
হয় সে আমার অশ্রু জলে সুন্দরবিধুর।
আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।”
যেদিন সত্যিই মানুষের মধ্যে পরম ঈশ্বরের শোভা বিমূর্ত হবে, সেদিন চিত্তে জাগবে সাড়া, সেদিন বোধহয় মানুষকে অন্য কোথাও “জুড়াইতে” যাবার জন্যে চিন্তা করতে হবে না,আমাদের এই পৃথিবীই হবে সকলের বাসযোগ্য পিতৃভূমি তথা মাতৃভূমি, তথা জন্মভূমি স্বদেশ আমার, তোমারে করি নমস্কার।।