উপহার
– বিভূতি ভূষন বিশ্বাস
মায়ের হাত ধরে কাঁচা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। একেবারে অজপাড়াগাঁ ফাঁকা রাস্তা, লোকজন নেই বললেই চলে। দুটি ছোট্ট ছেলে কাঁধে হাত দিয়ে হেঁটে আসছে। আমার থেকে ছোটো হবে। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম। 1980 সালের ঘটনা যোগোযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। ছেলে দুটি কাছে আসতেই মা জিজ্ঞাসা করল —– রাম লক্ষণ তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো আমরা রাম লক্ষণ নই। আমার নাম বিধান ওর নাম বিকাশ আমরা যমজ দুই ভাই। আমরা এখন কলকাতায় যাচ্ছি।
মা বলল —- তোমাদের বাড়ি কোথায়?
ওরা বলল —কলকাতায়।
মা বলল —-এখানে কাদের বাড়িতে এসেছ?
ওরা বলল —মামা বাড়ি। ওখানে ভালো লাগছে না তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি।
মা বলল —–কোন গ্রামে তোমার মামার বাড়ি। মামার নাম কি?
ওরা বলল —- তা তো মনে নেই।
মার দিকে তাকিয়ে দেখি মার চোখ মোটা মোটা হয়ে গেছে। কারণ আমাদের গ্রাম থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে কলকাতা। ছেলে দুটিকে মা ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো। ওরা আমাদের গাছে পাকা আম দেখে কি আনন্দ। আমি গাছে উঠে আম পেড়ে দিলাম। আম হাতে নিয়ে আমার মতো করে গাছে উঠতে চাইলো। অনেক বার চেষ্টা করে হাঁপিয়ে গেলো তারপর কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে ঘুমিয়ে পড়ল। এখন দেখছি মা আমার থেকে ওদের বেশী খেয়াল রাখছে। দেখে আমার বড্ড হিংসা হচ্ছে। কিছু বলতে পারছি না। মা যে বলে রেখেছে আমি ওদের বড় দাদা ওদের যেন কোনরকম অসুবিধা না হয় তার খেয়াল রাখতে। দুই তিনদিন বেশ আনন্দে কেটে গেল ।
হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে পুলিশের গাড়ি এসে হাজির। থানার বড়বাবু বাবাকে ডেকে বললেন —- থানায় খবর দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছেন। বাচ্ছা দুটিকে দেখে শুনে রাখবেন। আমরা ওদের সম্পর্কে খবর পেলেই আবার আসবো। বাবা আর মা দুজনেই বড় বাবুর দেওয়া কাগজে সই করে দিলেন। মা লেখাপড়া বেশী জানেনা তাই বড় কষ্টে নিজের নাম “তিলোত্তমা” লিখলেন। প্রায় পনের কুড়ি দিন ভাইদের সঙ্গে আনন্দে কেটে গেল। তারপর এক দিন আবার পুলিসের গাড়ি এলো। এবার লোকজন অনেক বেশী ছিলো। গাড়ি থেকে একটি মোটা মত লোক দুই ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন। বাবার হাতে একটা কাগজ দিয়ে ভাইদের নিয়ে চলে গেল। কাগজটিতে লেখা ছিল “মাতৃহারা পুত্রদের ফিরে পেয়ে অমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে যদি কখনো কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে এই ঠিকানায় চিঠি লিখবেন। অমি হাজির হয়ে যাবো।”
অনেক বছর কেটে গেল মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে । গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শে কলকাতার মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দিলাম। ডাক্তাররা দেখে বললেন দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। কিডনি পালটালে মা ভালো হয়ে যাবে। খরচ পড়বে পাঁচ লাখ টাকা। শুনে যেন মাথায় বাজ পড়ল। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা কোথায় পাবে এত টাকা। আমার এই দুর্দশার কথা শুনে একজন বুদ্ধি দিলেন। কলকাতার প্রতিটি ইস্কুল, কলেজ, ক্লাবে গিয়ে সাহায্য চাইলে চিকিৎসার টাকা উঠে আসবে। কথা মতো কাগজ পত্র তৈরি করে বেরিয়ে পড়লাম ভিক্ষা করতে। ভিক্ষা করতে করতে একটি ইস্কুলের নাম দেখে অবাক হয়ে গেলাম। “তিলোত্তমা উচ্চ বিদ্যালয়” এ তো আমার মায়ের নামে ইস্কুল। হেড মাষ্টারের কাছে গিয়ে কাগজ পত্র দেখালাম। উনি কাগজ পত্র দেখে বললেন। তোমাকে আর ভিক্ষা করতে হবে না। পাশেই তিলোত্তমা নাসিং হোম আছে ওখানে মা’কে ভর্তি করে দাও। বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়ে যাবে।
আমি যেন আশার আলো খুজে পেলাম। ওনার কথা মতো তিলোত্তমা নার্সিং হোমে মা’কে ভর্তি করে দিলাম। দশ পনের দিনের মধ্যে মা সুস্থ হয়ে উঠল। এক নার্স বলল মার দুটো কিডনি পাল্টে দিয়েছে। খুব আনন্দ হচ্ছে আবার ভয়ও করছে। কত টাকা পয়সা দিতে হয় কে জানে। মা’কে আজ ছেড়ে দিল। কাউন্টার থেকে একটি বিল আমাকে দিল তাতে লেখা আছে মোট খরচ পাঁচ লক্ষ টাকা। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কে যেন আমার হাত ধরে টেনে তুলল। তাকিয়ে দেখি হেড মাষ্টর মহাশয় আর পাশে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বাবু। ওনারা বললেন নিচে পড়ে দেখো দাদা । দাদা বলতেই অমি চমকে উঠলাম। আমার তো কোনো ভাই নেই। রসিদের নিচে পড়ে দেখি পেইড লেখা পাশে নাম রাম লক্ষণ। পরে ভাইরা বলল আমরাই সেই মায়ের রাম লক্ষণ। বাবা মরার সময় তোমাদের কথা বলে গিয়েছিল। বাবার ইচ্ছাতেই ইস্কুল ও নার্সিং হোমের নাম রাখা হয়েছে। আর বাবা তার অঙ্গ সংরক্ষণ করেছিলেন। বাবার কিডনি দুটি মাকে লাগিয়ে দিলাম। দুই ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।