আমরা বাঙালী

আমরা বাঙালী 
-পারমিতা চ্যাটার্জী

 

 

আজ মহাষ্টমী, অয়ন্তিকা অঞ্জলি দিয়ে আসার সাথে সাথে তার শাশুড়ি মা তাকে বললেন চা করো তো তাড়াতাড়ি ! রূপুটা একদম উপোস করে থাকতে পারেনা। লুচিগুলোও ভাজতে আরম্ভ করতে হবে! অয়ন্তিকারও খুব খিদে পেয়েছিল  কিন্তু কি করবে এটা শ্বশুরবাড়ি। মা বলে দিয়েছিলেন, সব মানিয়ে নিতে হয়। সে চায়ের জল একদিকে বসিয়ে, অন্যদিকে লুচির কড়াই বসিয়ে দিল।  কমলা মাসী বলল, আমি লুচি বেলে দিচ্ছি।

ভাগ্যিস অভ্র এখন বাড়ি নেই! সে থাকলে ঠিক প্রতিবাদ করতো মায়ের এই ব্যাবহারের। অভ্রের ভালোবাসার জন্যেই হয়তো সে সব মানিয়ে নেয়। পুজোর দিনে অশান্তি হতো একটা, শান্তিপ্রিয় অয়ন্তিকা তা চায়না।
সবাইকে চা আর লুচি ভেজে দিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিল খাবার টেবিলে। ওর শ্বশুরমশাই বললেন- তুমি এবার নাও মা! তোমারটা না আনলে আমি খেতে পাচ্ছিনা।
শাশুড়ি মা বললেন- এ আবার কি আদিখ্যেতা?
– আদিখ্যেতা নয় এটা মানবিকতা। তোমার মেয়ে যেমন না খেয়ে থাকতে পারেনা, তেমন এই মেয়েটাও কিন্তু না খেয়েই কাজ করে যাচ্ছে।
অয়ন্তিকা তাড়াতাড়ি বলল- বাবা আমি ঠিক আছি আপনি খান। আমি বসছি এখুনি!
ওদের খাওয়া শেষ হতে না হতেই অয়ন্তিকার স্কুলের জীবনের বন্ধু নাজমা এলো, বিয়ের সময় আসতে পারেনি তাই। হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে।
অয়ন্তিকা পরিচয় করিয়ে দিতেই নাজমা প্রণাম করতে গেল।শাশুড়ি দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন- থাক থাক!

আগে মিষ্টির বাক্সটা হাতে নিয়েছিলেন পরে সেটা অচ্ছুতের মতো ফেলে দিলেন টেবিলের ওপর।
নাজমাকে ঘরে এনে বসানোর পর নাজমা বলল- আমি আজ যাইরে, বুঝতে পারছি তোর অবস্থা!  পরে একদিন বাইরে কোথাও দেখা করবো।

অয়ন্তিকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল- আজকের দিনে কিছু না মুখে দিয়েই চলে যাবি?
– না রে আর এখানে কিছু খাবোনা! যখন বাপেরবড়ি যাবি আমায় খবর দিস, মাসীমার হাতে নারকোল নাড়ু খেয়ে আসবো। জলভরা চোখে সে প্রাণের বন্ধুকে বিদায় জানালো।
সেদিনই বেড়াতে বেরিয়ে রূপু পরে গিয়ে মাথায় খুব আঘাত পায়। অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে।  হাসপাতাল থেকে বলল- এখুনি ব্লাডের দরকার! কিন্তু ‘ও’ পজিটিভ ব্লাড এখানে নেই। পুজোর সময় কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।
অভ্র হতাশ হয়ে পড়ল- কি করা যাবে এবার?
অয়ন্তিকার হঠাৎ নাজমার কথা মনে পড়ল! নাজমা কয়েকটা এনজিও সংস্থার সাথে যুক্ত।
অয়ন্তিকার ফোন পেয়ে নাজমা ছুটতে ছুটতে এলো,ডঃ কে গিয়ে বলল- আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ ডাক্তার  আপনি ইমিডিয়েট রক্ত দিতে শুরু করুন।
নাজমার দেওয়া রক্তে অবশেষে রূপুর প্রাণ রক্ষা পায়।
রক্ত দিয়ে নাজমা যখন বেরিয়ে আসছে, তখন অভ্র তাড়াতাড়ি এসে বলে – আপনি চলুন আগে কিছু খাইয়ে আনি! আপনি তো টলছেন!

নাজমা বলল- এখানে অবশ্য খাওয়ালে ছোঁয়া ঠেকার ব্যাপারটা থাকেনা।
অভ্র হাতজোড় করে বলে- দেখুন আমার মায়ের হয়ে আমি আপনার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি! আমি বাড়িতে থাকলে আপনাকে এত অপমানিত হতে হতো না।
— আচ্ছা আচ্ছা চলুন খাওয়াবেন বললেন যে?
– হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন – এই অয়ি এসো–
অয়ন্তিকা ইতস্তত করে বলল- বাবা মা!
– আরে তোমাকে আসতে বললাম এসো না! সবসময় সবার কথা ভাবলে হয়না, কখনও কখনও নিজের কথাও ভাবতে হয়। ওঁরা খেয়ে নেবেন। কিন্তু ইনি সবে রক্ত দিয়ে এসেছেন! এঁর খাওয়াটা অনেক বেশি জরুরি।
খাওয়ার পর বেরিয়ে আসার সময় অভ্র বাবা মায়ের জন্যে কিছু কিনে নিল।
ওদের আসতে দেখে অয়ন্তিকার শাশুড়ি এগিয়ে এসে নাজমার হাতদুটো ধরে বলল- তোমার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবনা!
– কিছু শোধ পাওয়ার জন্য আমি কিছু করিনি মাসীমা! একজন মানুষকে বাঁচানো আমার কর্তব্য বলে মনে করি তাই করেছি।
অয়ন্তিকার শ্বশুর মশাই এগিয়ে এসে বললেন – আজ কিন্তু ওর রক্ত আর রূপুর রক্ত মিলেমিশে গেল! আসলে কি বল তো? মানুষের রক্তের রঙ একটাই হয়, আর সে রঙটা লাল!
মা জানো আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলামের জন্মদিন পালন করি, তাঁদের গান গাই, কবিতা বলি। সবই আসলে একটা হুজুকে দাঁড়িয়ে গেছে। সবার বলতে ভালো লাগে আমার পঁচিশে বৈশাখ অমুক জায়গায় প্রোগ্রাম আছে, ওখানে আমায় গানে গাইবার জন্য ডেকেছে! কিন্তু তাঁদের আসল যে মূল্যবোধ, তাঁদের জীবনের যে দর্শন আমাদের দিয়ে গেছেন  যা হল মানবিকতা বোধ। মানুষের একটাই ধর্ম, যা হল মানবিকতার ধর্ম। তা আমরা ক’জন জানি বা মানি তা হাতে গোনা যায়, এই হল ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই বলে গেছেন,”বাঙালীর প্রাণ, বাঙালীর মন, বাঙালীর ঘরে যত ভাই বোন-
“এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান”।।

Loading

Leave A Comment