বিজয়া স্মৃতি
-রাণা চ্যাটার্জী
দশমীর সকাল,ঘুম ভাঙতেই এক রাশ বিষণ্নতা গ্রাস করতো। তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল মন চাইতেই ফোন করার ধুম, দিন রাত কি করি, কি করি করে মোবাইলেকে কি পোষ্ট দিলো তার ছিল না উঁকি ঝুঁকি। তবু যেন বেশ ছিল সেই সব পূজা পার্বণের দিনগুলো। আন্তরিকতা, গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে সন্ধ্যায় বিসর্জনের পরে প্রণাম ও আশীর্বাদ আদান প্রদানের মধুরতা। তিলের নাড়ু, সিড়ির নাড়ু, নিমকি কত কি কাঁচের বয়ানে বানিয়ে রাখার তোড়জোড়। কোনো কোনো বাড়িতে ঘুগনি, কিনে আনা মতিচুর লাড্ডু পেলে তো আহা খুশিতে ডগমগ, মামার বাড়িতে আমার সেই শৈশব।
সব কিছু সেরে হ্যারিকেনের আলোতে এক গোছা পোস্টকার্ড নিয়ে দিদার সঙ্গে বসা, কাকে কাকে চিঠিতে বিজয়া আশীর্বাদ পাঠাবেন তার আলোচনা সেরে নিতাম উঠানে অন্ধকার আর ঝিঁ ঝিঁ শব্দ সঙ্গী করে।পুরানো ডাইরি ঘেঁটে ঠিকানা উদ্ধার করে তা দিদার নির্দেশ মতো লিখে ফেলার মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা,পোষ্টম্যানের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, চিঠির এক প্রান্তে দিদার কাঁপা কাঁপা হাতে আশীর্বাদ বার্তা, আর ঠিকানায় আমার অপরিপক্ক হাতের লেখনী সম্বলিত।
আজ বিজয়ার বিষাদ ভরা দিনে মনে পড়ছে পুরানো স্মৃতি। গ্রামে কাজের পাহাড় ভরা সংসারের এতো কাজ সামলে, ক্লান্ত ঘর্ম দেহে, একটু যে বিশ্রাম নেবে তা নয়, দুপুরে,রাত্রে একটু ফুরসৎ পেলেই গল্পের বই নিয়ে দিদার পড়তে বসা, আরো জানার আগ্রহ দেখতাম আর অবাক হতাম। আত্মীয় স্বজন, নাতি নাতনি, বেয়াই বেয়ান যে যেখানে আছে বিজয়া প্রণাম আসুক আর না আসুক দিদা কিন্তু আপন কর্তব্য সাবলীল ভাবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হাসিমুখে পালন করে গেছে।
আজ শিক্ষা সংস্কৃতিতে বহুগুণ পারদর্শী হয়ে আমরা বিজয়া প্রণাম করতে, জানাতে ইতস্তত বোধ করি। ভুলে যাই ঘরের গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নিতে, পাছে ওনারা যদি কিছু ভাবেন এই ভেবে। কেউ যদি কাঁচের বয়ান থেকে গুড়ের নাড়ু বের করে এনে দেয়, চোখ চাওয়া চাওয়ি করে মুখ টিপে হাসি, আদতে দিন কালের সাথে সাথে আমরা কেমন যেন একটু একটু করে কৃত্রিম হয়ে উঠছি বিজয়া দশমীর আধুনিকতা গন্ধ গায়ে মেখে।
আসলে কিছুই করার নেই। এই বিরামহীন যান্ত্রিকতার যুগে পেছিয়ে পড়াটাই বড় দায়, এগোতেই হবে, মাথা নিচু করে, সব ভুলে। সে দিন খুব দূরে নয়, যখন অতীতের ইতিহাস বলে কিছু থাকবে না।