বোধন
-রেহানা দেবনাথ
পঞ্চমীর রাত চারদিকে আলোয় ঝলমল করছে। শুধু মহামায়ার ঘরে অন্ধকার একটি লণ্ঠনের আলো টিম টিম করে জ্বলছে, তারমধ্যেই চার ছেলে মেয়ে একনাগাড়ে ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছে, “ও মা আমাদের নতুন জামা কবে হবে? বাবা কবে আসবে?” মহামায়ার দু’চোখে জ্বলের ধারা সে কি করে এই বাছাগুলোকে বোঝাবে যে তার পক্ষে চার চারটে বাচ্ছার জন্য নতুন জামা কেনা অসম্ভব। মাস ছয়েক হলো স্বামী নিখোঁজ হয়ে গেছে! থানা পুলিশ, নেতাদের ধরেও তার খোঁজ পায়নি সে। সংসার চালানো দায় হয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিক বিলের টাকা জমা না দিতে পারায় তাও কেটে দিয়েছে।লোকের বাড়িতে রান্না করে আর ঘরে টুকিটাকি হাতের কাজ করে তবুও অভাবের সংসারে চারটে বাচ্ছার মুখে ঠিক মত পেটভরে খাবারটুকুও দিতে পারে না। স্বামী থাকতে কোনোরকমে চলে যেত। স্বামী তার আপন ভোলা মানুষ। কোনো কাজই বেশিদিন করতে তার ভালো লাগতো না তাই মাঝে মাঝেই কাজের জায়গার সঙ্গে সঙ্গে থাকার জায়গার পরিবর্তন করতে হতো। এই ধরনের পাগলামি মহামায়া প্রথম দিকে মেনে নিলেও দুটো বাচ্চা হবার পর থেকে অশান্তি শুরু হয়। মহামায়া মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে তবে অভাব ছিল না। ওর স্বামী শিবরাম ছিল উচ্চবিত্ত ঘরের একমাত্র সন্তান তাই মহামায়ার যখন তেরো বছর বয়স তখন শ্বশুর মশাই সম্বন্ধ নিয়ে এলে ওর দাদু রাজী হয়ে যায়। ওর বাবার অমত ছিল কারণ খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে ছেলের বাপের অনেক সম্পত্তি থাকলেও ছেলে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবে মন ও চরিত্রের দিক দিয়ে ভালো। সব কথা জানার পরও দাদু ঠাকুমা বলে মহামায়া আর শিবরাম নাম দুটোর মধ্যেই ওদের ঐশ্বরিক জোট আছে, তাই ওই ছেলের সঙ্গেই নাতনির বিয়ে দেবেন।একপ্রকার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে ওর বাবা বিয়েতে মত দেয়। বিয়েটা ভালোভাবে হয়েও যায়। বিয়ের একবছরের মধ্যে ওর শ্বশুর মশায় মারা যায় আর সব সম্পত্তি তার দুই খুড়তুতো স্বশুরেরা নিয়ে নেয়। শিবরাম সরল সিধে মানুষ তাই কোর্ট কাছারীর ঝামেলায় না গিয়ে বউকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে চলে যায় সব ছেড়ে দিয়ে। মহামায়ার বাবা সব জানতে পেরে মেয়ে জামাইকে নিজের কাছে নিয়ে আসে আর বন্ধুর ব্যবসায়ের এক দায়িত্বপূর্ণ কাজে লাগিয়ে দেয়। বছর না ঘুরতেই সেই কাজ সে ছেড়ে দিয়ে ভবঘুরের মত ঘুরতে থাকে। এই বাউন্ডুলেপনা দেখে মহামায়ার বাবা আর থাকতে না পেরে জামাইকে ছোট বড় কথা শুনিয়ে দেয় সবার সামনে যা মহামায়া ও শিবরাম দুজনেরই খারাপ লাগে। তারপর তারা সে ঘর ছেড়ে কলকাতা শহরে চলে আসে কাউকে কিছু না বলে। এইভাবে দশটা বছর পার হয়ে গেছে। মহামায়া আর বাপের বাড়ি যায় নি। শহরে এসে দিনমজুর খেটে কোনো রকমে সংসার চলে যায় ওদের। চার ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখেই ছিল হঠাৎ শিবরামের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় সব উল্টো পাল্টা হয়ে যায়। মহামায়া অথৈই জলে পড়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে বাচ্ছাগুলোর ঘ্যানঘ্যানে কান্না তার মনকে আরও বিষাদে ভরিয়ে দিচ্ছিল। দূর থেকে ভেসে আসা পুজো প্যান্ডেলের গানের আওয়াজ তার কানে তীরের মত বিধতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রনা তার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকে। এমন সময় দু’টি ছায়া মূর্তি তার দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। তাদের দেখে প্রথমে মহামায়া ভয় পেয়ে যায়। বাচ্ছাগুলোও তাকে এসে জড়িয়ে ধরে। ধীরে ধীরে লন্ঠনের আলোয় মূর্তিগুলো স্পষ্ট হলে মহামায়ার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। সমস্ত অভিমান ভুলে গিয়ে বাবা বলে বৃদ্ধ মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বাচ্ছাগুলো কান্না ভুলে গেল! তারা হাঁ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। তখন পাশের যুবকটি এগিয়ে এসে ছোট মেয়েদুটিকে কোলে নিয়ে বললো “আমি তোমাদের মামা” বলে বাচ্ছাগুলোকে আদর করতে লাগলো আর সঙ্গে আনা নতুন জামা কাপড়গুলো তাদের দিয়ে পড়তে বললো। এদিকে বাবা মেয়ের কান্না ও মান অভিমানের পালা সমাপ্ত হলে, মহামায়া বললো “বাবা মাস ছয়েক হবে তোমার জামাই নিখোঁজ হয়ে গেছে”। কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ওর বাবা বললো “আমি সব জানি।” বাবার মুখে কথাটা শুনে মহামায়া আশ্চর্য হয়ে যায়! ওর বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে সব জানতে পারবি। আগে তৈরী হয়ে নে, বাড়ী ফিরে চল রাস্তায় সব বলবো। শিবরাম আমাদের বাড়িতে আছে ভালো আছে। স্বামীর খোঁজ পাওয়া গেছে জেনে আর বাচ্ছাগুলো নতুন জামা পরে নাচছে দেখে মহামায়ার আনন্দে দুচোখ জলে ভরে গেল। ট্রেনে করে আসার সময় বাবার থেকে সে জানতে পারে শিবরাম যে বাসে করে কাজের জন্য কাকদ্বীপ যাচ্ছিল সেই বাসের এ্যকসিডেন্ট হয় নামখানার কাছে।সেখানকার সরকারি হাসপাতালে মাথায় চোট নিয়ে ভর্তি ছিল শিবরাম। একজন পরিচিত লোক ওকে চিনতে পেরে, মহামায়ার বাবাকে খবর দেয়। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে যে মাথায় খুব জোরে আঘাত লাগার জন্য শিবরামের মাথার অপারেশন হয় কথা বলার শক্তি চলে যায়। তার ফলে ওদের ঠিকানাও ওর বাবা জানতে পারেনি। এতদিনের চিকিৎসার ফলে শিবরাম কথা বলার শক্তি ধীরে ধীরে ফিরে পেয়েছে আর গত কাল রাতে তাদের খোঁজ খবর ঠিকানা দিয়ে পেরেছে। শিবরামকে বাড়িতে রেখে তাদের আনার জন্য ছুটে এসেছে। মহামায়ার কাছে সব স্বপ্নের মত লাগছে।তার হারিয়ে যাওয়া স্বামী, ফেলে আসা পরিবারকে এভাবে ফিরে পাবে সে ভাবতেই পারেনি। মনে মনে মা দুর্গার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো। মহামায়া তার চার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবা ও দাদার সঙ্গে যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো তখন দেখলো মা বরণের থালা নিয়ে ছুটে আসছে তার সঙ্গে চেনা অচেনা অনেক মানুষ ওদের দিকে হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে। সেই সময় চারিদিকে বোধনের বাজনা বেজে উঠলো!