পরকীয়া
-প্রলয় কুমার নাথ
(১)
সালটা ছিল ১৯৫০। তিন বছর আগে ইংরেজরা এই বঙ্গদেশ থেকে চিরতরে বিদায় নিলেও, করে গিয়েছে সর্বশেষ ষড়যন্ত্র। লুপ্ত হয়েছে এত বছর ধরে চলে আসা জমিদারি প্রথা। দেশভাগের দাবানলের রেশ যেন এখনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে দুই বাংলার মানুষজনকে। কত রাজা জমিদারের দল তাদের বংশ গৌরব এবং সম্পত্তির মোহ ত্যাগ করে, সর্বহারা হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছে কাঁটাতারের এই পারে। তবে এপার বাংলার জমিদার বংশগুলোর ভাগ্যের বৃহস্পতি এখনো কিছুটা হলেও অক্ষুন্ন রয়েছে, তাই জমিদারি উঠে গেলেও পূর্বপুরুষের জমানো ধনসম্পদের জোরে এখনো তারা বজাই রাখতে পেরেছে সেই হৃত আভিজাত্য বোধ। এই শ্রেণীর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল মুর্শিদাবাদের মহেশপুর গ্রামের চৌধুরীরা।
অন্যান্য গ্রামের মতই শতাব্দী প্রাচীন জমিদার বাড়িটা জনবসতি থেকে একটু দূরে অবস্থিত। ক্ষমতার প্রতীক সিংহের স্তম্ভ দেওয়া প্রবেশ দ্বার আর উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এই সাত মহলা বাড়িটার দুই দিকে বেশ বড় আম বাগান। এক দিকে আছে এই বংশের দ্বারাই খনন করানো পরিবারের নিজস্ব দীঘি। এবং ওপর দিকে আছে শাল সেগুনের গভীর জঙ্গল। এই জঙ্গলের ওপর প্রান্তে অবস্থিত মহেশপুর শ্মশান। সেদিন ছিল শ্রাবণ মাসের এক অন্ধকার রাত্রি, আমাবশ্যা না হলেও মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বুকে দৃশ্যমান নয় চাঁদ এবং তারারা। সাহসে বুক বেঁধে, রাতের জঙ্গলের ভয়াবহতার মাঝে, দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছিল এক যুবতী। এই এবড়ো খেবড়ো বন্য জমির কিছুটা দূরত্ব পার করতে পারলেই নিকটে আসবে তার গন্তব্যস্থল……..মহেশপুর শ্মশান!
শাড়ির আঁচলে বাধা বস্তুটিকে হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে, জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এসেই তার নাকে প্রবেশ করলো শবদাহের তীব্র গন্ধ। কিছুক্ষন আগেই বোধহয় মড়া পুড়িয়ে গেছে কোন শবযাত্রীর দল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই, একটি বন্য ঝোঁপের আড়ালে দৃশ্যমান হল উজ্জ্বল অগ্নি শিখা। হ্যাঁ, তার মানে ঠিক স্থানেই এসেছে সে, ওই তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা রয়েছে মড়ার খুলি এবং হাড়গোর! ওই তো সেই অগ্নিকাণ্ডের কম্পমান অলোক রশ্মিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সেই অঘোরী তান্ত্রিকের ধ্যানে মগ্ন উলঙ্গ শরীরের অবয়বটিকে! তার কাছে সেই যুবতী অগ্রসর হতেই, তার পদশব্দের ক্ষীণ আয়োজে ধ্যান ভেঙে গেল সেই অঘোরীর, তার রক্তাভ চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো মেয়েটির মুখের ওপর।
সেই মুহূর্তে গুরুগম্ভীর শব্দ করে আকাশে গর্জে উঠলো এক ফালি বিদ্যুতের ঝলক। তার আলোতে, এই রাতের অন্ধকারেও সেই তান্ত্রিকের ভয়ঙ্কর রূদ্র মূর্তি দেখে একটু হলেও ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল সেই যুবতী। কিন্তু পরমুহূর্তেই বুকে সাহস সঞ্চার করে সে শুনতে পেল সেই তান্ত্রিকের অস্ফুট কণ্ঠস্বর,
– তোকে যা বলেছিলাম, তা নিয়ে এসেছিস তো তুই?
মেয়েটি তার আঁচলে লুকিয়ে বেঁধে রাখা কয়েক গাছি চুল বার করে, তা এগিয়ে ধরলো তার দিকে। দুই আঙুলের ভেতর চুলগুলিকে নিয়ে, বলে উঠলো তান্ত্রিক,
– বাহ…..এবার বল কি চাস তুই? এই দেহাংশ যার, তাকে কি পিশাচ দ্বারা হত্যা করতে হবে আমাকে?
মেয়েটির মুখে খেলে গেল একটি শয়তানি হাসি, তান্ত্রিকের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে সে বলে উঠলো,
– না, একেবারেই নয়…….তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আপনাকে…….কিন্তু জীবিতাবস্থাতেই তাকে যেন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যাতে সে প্রতিনিয়ত নিজেই খুঁজতে বাধ্য হয় মৃত্যুর রাস্তা…..হা হা হা হা!
সেই যুবতীর পৈশাচিক অট্টহাসি শুনে যেন চমকে উঠলো সেই জঙ্গলের গাছের ডালের বাসায় ঘুমন্ত পাখিরা!
(২)
মহেশপুরের চৌধুরী পরিবারের একমাত্র বংশধর আমি, স্বর্গীয় জমিদার রাজবাহাদুর রামাদিত্য চৌধুরীর একমাত্র সুপুত্র, শ্রীযুক্ত শিলাদিত্য চৌধুরী। এত বড় বাড়ি এবং বিষয় সম্পত্তির মালিক আমি একা, তাই নেহাৎ বাপের ইচ্ছা রাখতেই কলকাতার কলেজ থেকে একাধিক প্রচেষ্টায় বি.এ পাশ করে গ্রামে ফিরে আসার পর আর অর্থ উপার্জন করার কথা ভেবে দেখিনি। বিবাহ করার কোন ইচ্ছা নেই, তবে তার মানে এই নয় যে নারী শরীরের প্রতি আমার অরুচি! মদ্যপান, বন্ধু-বান্ধব, বাঈজি সঙ্গ এবং দুই হাতে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমেই কাটছিলো আমার দিনক্ষণ।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই রূপের সাগরে যৌবনের লহরী তুলে, সারেঙ্গির তালে তালে কোমর দুলিয়ে নেচে চলছিলো রত্না বাঈ। অত্যাধিক মদ্যপান করার জন্যই বোধহয় আমার চোখের সামনে রত্নার একটি আবছা অবয়বই ফুটে উঠেছিল, অথচ ঝাড়বাতির আলোয় এই জলসাঘরের কোনো কোণেই অন্ধকারের লেশমাত্র ছিলো না। মুজরায় আমন্ত্রিত আমার সকল বন্ধু বান্ধবেরা একে একে রত্নার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে টলতে টলতে বিদায় নিলে, আমি চিতাবাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম রত্নার শরীরের ওপরে। অবশ্য রত্নার তাতে কোনরূপ আপত্তি ছিলো না, কারণ একে তো আমি হলাম সুপুরুষ জমিদারপুত্র, আর তাছাড়া সে ভালো করেই জানে যে তার সাথে কাটানো প্রতিটা রাতেরই দ্বিগুন মূল্য দিতে সক্ষম আমি!……..শয়নকক্ষে রত্নার নগ্ন শরীরটা থেকে সমস্ত মধু শুষে নিয়ে, পরম স্বর্গসুখ উপলব্ধি করতে করতে কখন যে কেটে গেল রাত, তা আমার খেয়ালই নেই!
সকালে ঘুম ভাঙলো হঠাৎ এই ঘরের দরজায় কারোর কড়াঘাতের আওয়াজ শুনে। তার সাথেই ভেসে আসছে এই জমিদারির বয়স্ক নায়েব মশাই, শঙ্কর বাবুর গলার আওয়াজ। বিছানায় উঠে বসে দেখলাম, যে ততক্ষনে রত্নাও ঠিক করে নিয়েছে নিজের পরণের পোশাক। শশব্যস্ত হয়ে শান্তিপুরী ধুতির ওপর কোনরকমে গেঞ্জিটা চড়িয়ে, তাড়াতাড়ি গিয়ে ঘরের দ্বার দিলাম খুলে। হন্তদন্ত হয়ে সে ঘরে প্রবেশ করলেন শঙ্কর বাবু, তারপর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে তিনি বললেন,
– ছোট বাবু…….ছোট বাবু, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, ছোট বাবু……আপনি তাড়াতাড়ি চলুন আমার সাথে!
রত্না কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে। আমিও আশ্চর্য হয়ে আর কথা না বাড়িয়ে, শঙ্কর বাবুর সাথে বেরিয়ে এলাম আমার শয়ন কক্ষ থেকে……
আমরা ছুটে গেলাম এই বাড়ির বাইরের মহলের উদ্দেশ্যে। সেই মহলের ঘরগুলো মূলতঃ এই বাড়িতে আগত অতিথিদের নিবাসের জন্য তৈরি করা হয়েছে। আমারই অনুমতিতে, তেমনই একটি ঘরে কয়েক মাস ধরে বসবাস করছে, দেশ ভাগের পর সর্বশান্ত হয়ে প্রাণ হাতে করে ওপার থেকে এপার বাংলায় ছুটে আসা আমারই এক বাল্যবন্ধু, শশধর এবং তার স্ত্রী, নন্দিনী। সেই ঘরে ঢোকা মাত্র, সেখানকার দৃশ্য দেখে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল! ঘরের এক কোনে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে নন্দিনী, আমার মত একজন পরপুরুষের হঠাৎ আবির্ভাবেও যার কোন হুঁশ নেই!……আর……আর আমার সামনেই……আমার সামনেই ঘরের করিকাঠ থেকে ঝুলছে শশধরের গলায় দড়ি দেওয়া দোদুল্যমান মৃতদেহ!
(৩)
স্থানীয় থানা থেকে দারোগা বাবু তার দলবল নিয়ে এসে কিছুক্ষন আগেই নিয়ে গিয়েছেন শশধরের মৃতদেহ। এটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়, আপাতদৃষ্টিতে সেই কথাই মনে হয়েছে সকলের। আজ সকাল থেকেই চারিদিকে অন্ধকার করে শুরু হয়েছে বৃষ্টির তান্ডব। কিছু দরকারি সই সবুত করতে গিয়েছিলাম কাছারি বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়িতে পা রাখতেই চোখ চলে গেল বাইরের মহলের সেই ঘরটির দিকে। এই সন্ধ্যার অন্ধকারেও যেন একটা ক্ষীণ আলোর আভাস আসছে তার ভেতর থেকে। নন্দিনী বৌঠান এখন কেমন অবস্থায় আছেন, মনে বড় কৌতূহল হচ্ছিলো সেই কথা জানার জন্য। তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেই ঘরের দিকে, কিন্তু একটু গিয়েই কানে এলো নন্দিনী বৌঠান বাদেও অপর এক নারীর পরিচিত কণ্ঠস্বর। এই গলার আওয়াজ এই বাড়ির এক রাঁধুনি, সরমার। কোন এক কথায় পরিপেক্ষিতে, সরমা যেন উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
– তন্তর মন্তর……কালা জাদু……এই সবে বিশ্বাস করিস লা? বল রে হতভাগী, জবাব দে আমার কথার?
আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সেই ঘরের দরজায় বাইরে এক কোনে। তারপর আড়ি পেতে শুনতে লাগলাম এই দুজনের কথা বার্তা। নন্দিনী সরমার দিকে বিস্ফারির চোখে শুধু চেয়ে আছে, তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ধারা! সরমা এবার নন্দিনীকে ধরে ঝাঁকিয়ে আবার চিৎকার করে উঠলো,
– আমি নিশ্চিত রে, হতভাগী……আমি নিশ্চিত……তোর সোয়ামীর ওপর কোন অপদেবতার ছায়া পড়েছিলো…….নাহলে একজন সুস্থ সবল ভালো মানুষ কখনো অমন হয়ে যায়!
নন্দিনী এবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,
– এ….এ….এই সব কি বলছো তুমি, সরমাদি!…..না, না, আমি এই সবে বিশ্বাস করি না……বিশ্বাস করি না আমি!
সরমার গলার স্বরটা কেমন যেন পাল্টে গেল এবার, সে সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠলো,
– সত্যি কথা বল তো আমায়……জমিদার বাবুর রূপ, অর্থ…..এই সব দেখেও কি কোনদিন তোর মনে শখ হয়নি তার ইস্তিরী হবার!…..আর সেই জন্যই বোধহয় নিজের সোয়ামীর থেকে পিছু ছাড়াতে, তুই নিজেই…….
সরমার কথা পুরোটা না শুনেই যেন আশ্চর্য হয়ে কি একটা বলতে চলছিলো নন্দিনী, ঠিক এমন সময় আর সহ্য করতে না পেরে আমি সশরীরে প্রবেশ করলাম এই দুই নারীর সামনে।
আমার আগমনে সাথেই যেন দপ করে কেঁপে উঠলো অদূরে রাখা সন্ধ্যা প্রদীপের অগ্নি শিখাটি। আমাকে দেখেই যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলো ওরা দুজন, বিশেষত আমি সব কিছু শুনতে পেয়েছি, এই আশঙ্কায় যেন পাংশু বর্ণ হয়ে উঠলো সরামার মুখ। আমি দৃঢ় কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কি বলছিলে তুমি সরমা? কি হয়েছিলো শশধরের? কেমন হয়ে গিয়েছিলো সে?
সরমা ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠলো,
– আ….আ….আমি কি….কি…কিছু জানিনে, কর্তা বাবু…..আমি মুক্ষু সুক্ষু মানুষ……আমি কেমনে জানবো তেনার কি হয়েছিল!…..আমি হেঁসেলে যাই, কর্তা বাবু…..অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে সেখেনে……
এই বলে সে পড়ি কি মরি করে ছুটে বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে!
সেই মুহূর্তেই একটি দমকা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিলো সেই ঘরের প্রদীপখানি। আকাশের বুকে ঝিলিক দিয়ে ওঠা একটি অকস্মাৎ বজ্রপাতের তীব্র গর্জনের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে নন্দিনী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আমার দেহটাকে! এই সুন্দরী নারীর দুই সুডৌল স্তনের পরশে যেন আরো দ্রুত গতিতে বেজে উঠলো আমার হৃদস্পন্দনের ধ্বনি!……. কিন্তু পরমুহূর্তেই অপমান আর লজ্জা বোধ হওয়ায়, নিজেকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে, শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। শুনতে পেলাম তার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আওয়াজ! আমি আবার একই প্রশ্ন করে উঠলাম তাকে,
– শশধরের কি হয়েছিলো বৌঠান? বলুন আমায়…..দয়া করে বলুন…..
নন্দিনীর মাথা থেকে সরে গেল শাড়ির আঁচলের ঘোমটা। অন্ধকারের মধ্যে, আমার চোখে চোখ রেখে, অস্বাভাবিক বিদ্বেষ মেশানো কণ্ঠস্বরে সে বলে উঠলো,
– তার শরীরে খুঁত জন্মেছিলো, ঠাকুরপো……নপুংসক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি…….কোন মেয়ে মানুষের শরীরে সুখ দেওয়ার ক্ষমতা লোপ পেয়েছিলো তার……শুনলেন তো আমার কথা…..পেলেন তো আপনার প্রশ্নের উত্তর!
আবার যেন একটি বজ্রপাত ঘটলো আমার মাথায়, তবে তা নিঃশব্দে! নন্দিনী কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে উঠলো,
– কয়েক মাস ধরে রোজ রাতে একই ভাবে বিফল হতে হতে, মানসিক অবসাদে ভেঙে পড়েছিলেন মানুষটা……আমি কিন্তু তাকে এই নিয়ে কিছু বলিনি…..কখনো কোন কটু কথা শোনায়নি……বুঝতেই পারিনি যে কাল রাতেও একই ঘটনা ঘটার পর, তিনি এতটাই ভেঙে পড়বেন, যে আমি ঘুমিয়ে পড়লে পরে তিনি…..তিনি……
আর বলতে পারলোনা নন্দিনী। দলা পাকানো কান্নায় আটকে গেলো তার কণ্ঠস্বর। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম আমি!
(৪)
সেদিন সন্ধ্যায় আর ইচ্ছা করলো না রত্না বাঈ-এর মেহেফিলে যেতে। নিজের শয়ন কক্ষের আরাম কেদারায় বসে নিজেকে বুদ করে রেখেছিলাম বিদেশী হুইস্কির রঙিন স্রোত আর অম্বুরী তামাকের সুগন্ধের মাঝে। অন্যদিন এই সময় কোনো নারী দেহ ছাড়া আমার চোখে কিছুই মজে না, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আজ যে শুধুই একজন পুরুষের চিন্তা বিদ্ধস্ত করে চলেছে আমার মস্তিস্ককে! সে আর কেউ নয়……শশধর! কলেজে একসাথে পড়ার সময় ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ। শুনেছিলাম, যে তার বাড়ি ছিল পূর্ব বাংলার রাজশাহীতে। সেখানকার বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে ছিলো সে। পরপর তিনবার পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাস করি আমি, কিন্তু আমার মেধাবী বন্ধুটি এক বারেই পার করে দেয় তরী।
ভাগ্যের কি পরিহাস, দেশ ভাগের পর, একদিন সেই ছেলেই তার নব বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় এসে পৌঁছলো আমাদের জমিদারিতে! ভাগ্যিস আমি ছিলাম, নাহলে যে কোথায় ভেসে যেত তারা, তা কে জানে! সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম আমি নন্দিনীকে……অমন ক্লান্ত বিদ্ধস্ত অবস্থায়ও এমন রূপের অধিকারিণী সে, যা উন্মাদ করে দিতে পারে যে কোন পুরুষকে! নাহ, সত্যিই স্বার্থক মনে হয়েছিলো ওদের দুজনের জুটি! শশধরকে দেখে মনে হচ্ছিল, যে আমার যেন সব থেকেও কিছু নেই। সত্যিই, নারী দেহ ভোগ করা…..সে তো যে কোন পুরুষই পারে, কিন্তু সারা জীবনের জন্য যে নারীর ভেতর নিজের আশ্রয় খোঁজে একজন পুরুষ, তেমন নারীকে নিজের সহধর্মিণী রূপে পাওয়াটা ভাগ্যবানের কথা!
আর সেই ছেলেরই আজ এই নিদারুণ পরিণতি! একটা অজানা শিহরণ খেলে গেল আমার সমগ্র শরীরে……তার মানে কি সত্যিই কোন অতি-প্রাকৃত শক্তির দ্বারা নিজের পুরুষত্ব হাড়িয়েছিলো শশধর? কেমন করে এ সম্ভব? আর কেই বা চাইতে যাবে তার এমন দুর্গতি? এবং কেন? এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে এসেছিলো আমার, তা নিজেই বুঝতে পারিনি। হঠাৎ তন্দ্রা বোধটা ভেঙে গেল একটি যুবা কণ্ঠের আকস্মিক তীব্র আর্তচিৎকারে! মদের নেশাটা তখনও পুরোপুরি কাটেনি আমার……তাও আরাম কেদারা থেকে উঠে, টলমল পায়ে একবার ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আমি……কই, এখন তো আর কিছু শোনা যাচ্ছে না! এই সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না থাকায়, তার বুকে পূর্ন রূপে বিকশিত হয়েছে চাঁদ। বেশ কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করে, আর তেমন কোন অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর না শুনতে পেয়ে ঘরে ফিরে এলাম আমি। মনে, হল হয়তো ঘুমের ঘোরে দেখা কোনো দুঃস্বপের বশে আমি শুনতে পেয়েছি সেই আর্তনাদ!
কিন্তু সেই আর্তনাদ যে আমার মনের কল্পনা দ্বারা উৎপন্ন নয়, এই কথা ভয়ঙ্কর ভাবে প্রমাণিত হল পরের দিন সকালে! আরো একবার গোটা জমিদার বাড়ি ঘিরে হুলস্থুল বেঁধে গেল! আতঙ্ক জমাট বেঁধেছে এই বাড়ির পেছনের দিকে লাগোয়া ছোট ছোট মোসাহেবখানার একটি ঘরে। সেই ঘরে বাস করতো এক বিশ পঁচিশ বছর বয়সের যুবক, নাম কালাচাঁদ। গায়ের রঙের সাথে যথার্থই সমার্থক ছিল তার নাম। এই বাড়ির পনেরো কুড়ি জন চাকরের মধ্যে সে একজন। আজ সকালেই তার ঘরের মেঝেতে আবিষ্কৃত হয়েছে তার মৃতদেহ! তার হা করা মুখ এবং ঘরের করিকাঠের দিকে এখনো চেয়ে থাকা বিস্ফারিত দুই চোখের দৃষ্টি দেখেই মনে হচ্ছিল, যে গতকাল রাত্রেই কোন অজানা দৃশ্য দেখে প্রবল আতঙ্কের চোটে বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার হৃদ যন্ত্র!
(৫)
আরশির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গা থেকে একে একে গয়নাগাটি খুলে রাখছিলো রত্না। সম্পূর্ণ রূপে বিবস্ত্র হয়ে একবার আরশির বুকে ফুটে ওঠা নিজের নগ্ন দেহটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলো সে। এই দেহের জন্যই আজ তার এত নাম ডাক, পয়সা কড়ি!……নাহলে ওই সব নাচ গান তো কত মেয়েই করতে পারে, কিন্তু সকলে কি আর ডাক পায় জমিদার বাড়িতে মুজরা করতে আসার! খাস ছোট বাবু তাকে কলকাতা থেকে এই গ্রামে বায়না করে আনিয়েছেন, এই বাড়ির অন্দরমহলের একটি সুবিশাল ঘরে তার থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন! কলকাতার কত নাম জাদা বাইজি বেশ্যারা চাতকের মত হা করে আছে তার জন্য!……এই সব ভাবতে ভাবতেই নিজের শরীরটা একটি হালকা শাড়িতে আবৃত করে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার খোলা হাওয়ায় দাঁড়ালো।
চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারের কালি মেখে সাক্ষাৎ দৈত্যপুরীর মত দাঁড়িয়ে আছে গোটা জমিদার বাড়িটা। বাড়ির চাকর বাকরেরাও ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়……নিভে গেছে সকল ঘরের বাতি। শোনা যাচ্ছে না কারোর কন্ঠ ধ্বনি। শুধু বাড়ির পেছনের ওই জঙ্গল থেকে আসছে শেয়ালের ক্রন্দন রব। কেমন যেন গা ছমছম করে উঠলো রত্নার। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। বন্ধ করে দিলো নিজের দুই চোখ……আবার কত অন্যান্য চিন্তা ভিড় করে এলো তার মস্তিষ্কে……এই যে ছোট বাবু, যাকে সে এতো ভালোবাসে, তিনিও তো শুধু তার শরীরটাকেই চিনলেন! তার সাথে কাটানো প্রতিটা রাতের দাম তিনি কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নেন! একবার যদি তিনি বুঝতেন তার মনের কথা…..একবার যদি এক চিলতে সিঁদুর তিনি তুলে দিতেন তার কপালে!…..নাহ, আর ভাবতে পারলো না রত্না……তার বন্ধ চোখের পাতায় ভেতর থেকেই গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা অশ্রু ধারা!
এমন সময় হঠাৎ নিজের কপালে যেন কিসের একটা স্পর্শ অনুভব করলো রত্না। চমকে উঠে, সে দু চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো, যে সেটা হল……এই রাতের অন্ধকারে……ঠিক তার ওপরে, সেই ঘরের করিকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত এক ছায়া মূর্তির পায়ের গোড়ালি!……বিস্ফারিত চোখে তেমন ভাবেই ওপরের দিকে তাকিয়ে রইল রত্না……আর পড়লো না তার চোখের পাতা…….নিঃশ্বাস নেবার জন্য আর ওঠা নামা করলো না তার বুক!
(৬)
পরদিন সকালে বিমর্ষ চিত্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাড়ির উঠোনের এক কোনে। ততক্ষনে থানা থেকে লোকজন এসে তুলে নিয়ে গিয়েছে রত্নার মৃতদেহ। একটি আত্মহত্যা, এবং পরপর দুটি মৃত্যু…….যা কিভাবে ঘটলো এখনো তা কেউ জানে না! চোখের সামনে সব কিছু যেন ঝাপসা মনে হচ্ছিলো আমার। মনে হচ্ছিলো, যে আমার বিবেকে থাকা বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝের গন্ডিটাকে কেউ হাতুড়ি মেরে গুড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত! তার মানে এই বাড়ির ওপর সত্যিই চেয়ে গেছে কোন অশরীরীর কালো ছায়া?…….চিন্তার ঘোর কাটলো, যখন দেখলাম, যে কাছারি বাড়ির সামনের উঠোনে কয়েকজন লেঠেলের মধ্যে যেন একটি জটলা বেঁধেছে। তারা যেন উত্তেজিত হয়ে কি সব বলে চলেছে, এদিকে নায়েব মশাই যেন তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন!
আমি কৌতূহলী হয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই, তারা চুপ করে গেল, কিন্তু ততক্ষণে মুখ খুললেন শঙ্কর বাবু,
– ছোট বাবু…….এরা সকলে আপনাকে একটা কথা বলতে চায়, ছোট বাবু…..
আমি বললাম,
– বেশ বলো…..কি বলতে চাও!
লেঠেলদের সর্দার, কাল্লুর এদের মধ্যে সবচেয়ে তাগড়াই চেহারা। সে সমীহের সুরে করজোড়ে আমাকে বলে উঠলো,
– হুজুর, অপরাধ নেবেন না, হুজুর……..কিন্তু আমাদের সকলের একটাই কথা মনে হচ্ছে……এই বাড়িতে যা কিছু অঘটন ঘটে চলেছে, তার পেছনে……তার পেছনে একজনেরই হাত থাকতে পারে……..
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
– কে সে? কার কথা বলছো তুমি কাল্লু?
কাল্লুর দীর্ঘকৃতি শক্ত পোক্ত শরীরটাও যেন কেঁপে উঠলো আতঙ্কের চোটে, সে অস্ফুট কণ্ঠে বলল,
– এই গ্রামের শ্মশানে একজন অঘোরী তান্ত্রিকের বাস, হুজুর…….সে পিশাচ-সিদ্ধ……তন্ত্র মন্ত্র, কালা জাদু……এই সব…..এই সব জানে সে!
কাল্লুর কথা শেষ না হতেই বাকি লেঠেলরাও তারস্বরে তাকে সমর্থন করে উঠলো। কাল্লু বলেই চলল,
– আমাদের সকলের মনে হয়, এখনই একবার শ্মশানে গিয়ে ওই শয়তানটাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া উচিত……ওকে লাঠির বাড়ি মেরে ওর হাড় গোর ভেঙে ওকে গ্রাম ছাড়া করা উচিত……
আবার বাকি জন গর্জে উঠলো কাল্লুকে সমর্থন করার সুরে। অগত্যা, আর কোন উপায় না দেখে আমি বললাম,
– ঠিক আছে……তোমরা সেখানে যেতে চাইছো, তো যাও……কিন্তু তার গায়ে হাত তুলবে না কেউ, তোমাদের কাজ হবে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসা……আমি নিজে ওকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবো, তারপর ঠিক হবে ওর শাস্তির মাপকাঠি!
ওরা সকলে আমায় প্রণাম করে চলে গেল শ্মশানের রাস্তায়। আমি উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলাম তাদের সেই অঘোরীকে নিয়ে ফিরে আসার। কিন্তু প্রতীক্ষার অবসান যে এতো বিভীষিকাময় হতে পারে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল! দুই ঘন্টার মধ্যেই ওরা ফিরে এলো সেই অঘোরীর প্রাণ হীন নগ্ন দেহটাকে নিয়ে!…….সেই একই রকম ওপরের দিকে চেয়ে থাকা তার বিস্ফারিত চোখ!……মৃত্যুর ক্ষণিক আগে উপলব্ধি করা তীব্র আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ছড়িয়ে আছে তার দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা মুখমণ্ডলে!…….মনে হল, যেন পায়ের নিচ থেকে মাটিটা সরে গেল আমার! নিস্তেজ হয়ে গিয়ে ধপ করে উঠোনে বসে পড়লাম আমি!…..ওরা সকলে লাশটিকে ফেলে শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো আমার কাছে………
(৭)
এরপর অতিবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। ক্রমাগত মৃত্যুগুলির আতঙ্কের রেশ অনেকটাই কেটে গিয়েছে আমার মন থেকে। এরই মধ্যে নন্দিনীর এই বাসস্থানের খোঁজ পেয়ে, তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তার এক দূরসম্পর্কের কাকা। সদ্য বিধবা সুন্দরী যুবতী, নন্দিনীর অসহায়ত্বের কথা ভেবেই বোধহয় তিনি সাহস করে একটি প্রস্তাব তোলেন আমার কাছে……হ্যাঁ, নন্দিনীকে নিজের স্ত্রী রূপে গ্রহণ করার প্রস্তাব! বলাই বাহুল্য, সেই মুহূর্তে নন্দিনীর অশ্রু ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে, আমিও “না” করতে পারিনি সেই প্রস্তাবে!
আজ গোটা জমিদার বাড়িতে সাজ সাজ রব। রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে সারা বাড়িময় জ্বলে উঠেছে আলোর নকশা। নহবৎখানা থেকে ভেসে আসছে সানাই-এর মধুর ধ্বনি। আজ আমার আর নন্দিনীর ফুলশয্যার রাত্রি! রত্নার সাথে সেদিনকার সহবাসের পর, আবার নারী সঙ্গ পেতে চলেছি আমি! সন্ধ্যে থেকেই আমার ঘরে লেগেই আছে ইয়ার দোস্তদের হৈ হুল্লোড় এবং তার সাথে মদ্যপান। সঠিক সময়ে তারাই আমার নেশাগ্রস্ত শরীরটাকে ধরে ধরে পৌঁছে দিল ফুলশয্যার ঘরের দরজার বাইরে। সেই দরজা খুলে ধীর পায়ে অগ্রসর হতে লাগলাম ফুলে ফুলে সাজানো পালঙ্ক-টার দিকে, যার মাঝে বেনারসী আর গহনায় সুসজ্জিতা হয়ে, ঘোমটার ভেতর নন্দিনীও বোধহয় অধীর চিত্তে প্রতীক্ষা করছে আমারই জন্য!
বিছানায় এসে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম নন্দিনীর ওপর। নেশাগ্রস্ত কাঁপা কাঁপা হাতেই খুলতে লাগলাম তার একের পর এক পোশাক। নন্দিনীর মুখেও যেন ফুটে উঠলো পরম তৃপ্তির আভাস, যখন তার সম্পূর্ন নগ্ন শরীরটার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ সঞ্চারিত হতে লাগলো। আর একটুও সময় নষ্ট না করে, সেই ঘরের বাতি নিভিয়ে, প্রবল উত্তেজনায় খামচে ধরলাম নন্দিনীর শরীরটাকে। যেন ভেঙে গুড়িয়ে গেল তার নরম দুই হাতের তালু আমার শক্ত পুরুষালি হাতের মুঠোর ভেতর। তার শরীরের সমস্ত অংশ ভরিয়ে দিলাম আমি চুম্বনের মাদকতায়। মুখ রাখালাম আমি তার উন্মুক্ত দুই স্তনের মাঝে…….কিন্তু!……কিন্তু!……
কিন্তু একি……আমারই চোখের সামনে, অন্ধকারের মধ্যে একটু একটু করে যেন বদলে যাচ্ছে নন্দিনীর শরীর…….যেন ক্রমশ লোমশ আর পুরুষালি হয়ে উঠছে তার সর্বদেহ! তার স্তন যুগলের জায়গায় যেন রয়েছে কোন পুরুষের পেশীবহুল বুকের অংশ! …….এ কি করে সম্ভব! কি করে!….এক নিমেষে আমার রক্তের সমস্ত কামোত্তেজনা যেন গলে জল হয়ে গেল!……মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো!……আমি এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিলাম এই “পুরুষের” দেহ থেকে…….তারপর খাট থেকে দূরে গিয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দেওয়ালের গায়ে!
এতক্ষনে খাটের উপর উঠে বসেছে সেই “পুরুষের” মূর্তি। তার তীব্র পুরুষালি কণ্ঠের অট্টহাসিতে যেন কেঁপে উঠলো আমার সর্ব শরীর! এই কণ্ঠস্বর আমার খুব চেনা…….এ যে আমার বাল্যবন্ধু শশধরের গলার আওয়াজ!……আমি কম্পিত গলায় চিৎকার করে বলে উঠলাম তাকে,
– ক্ষ….ক্ষ…..ক্ষমা…….ক্ষমা করে দে ভাই আমার….…মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে আমার……নন্দিনীর রূপ দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি আমি…….
হাড় হীম করা সুরে বলে উঠলো শশধরের কন্ঠ,
– ক্ষমা চাইছিস এখন? ক্ষমা? মনে পড়ছে তোর অপরাধের কথাগুলো?…….তোর দ্বারা রত্নাকে অর্থের প্রলোভন দেখানো……তারপর সে হাত করলো বাড়ির চাকর কালাচাঁদকে……..সে আমাদের ঘর পরিষ্কার করতে আসার সময় লুকিয়ে সংগ্রহ করলো আমার চিরুনিতে লেগে থাকা কয়েক গাছি চুল…….সেই চুলের গাছি নিয়ে রত্না গেল শ্মশানের সেই অঘোরী তান্ত্রিকের কাছে, আমার দেহাংশ-এর সাহায্যে তন্ত্র মতে ধীরে ধীরে আমাকে নপুংসক করে তোলার জন্য……কি রে মনে পড়ছে তো সেই সব কথা?
আমি আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। শশধরের প্রেতাত্মা বলেই চলল,
– কালাচাঁদ, রত্না এবং সেই অঘোরী……এদের সকলের অপরাধের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুই যথেষ্ট মনে হয়েছে আমার কাছে!…..কিন্তু তুই তো আমার বাল্যবন্ধু…..তুই কি করে পারলি আমার এমন সর্বনাশ করতে? শুধু মাত্র নন্দিনীকে পাওয়ার জন্য এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করলি আমার সাথে?……নাহ, মৃত্যুর মত তাৎক্ষণিক শাস্তি তোর জন্য যথেষ্ট নয়, শিলাদিত্য!……আমি তোকে মরতে দেব না রে, আর না তো তোর শরীরেও প্রবেশ করাবো নপুংসকতার মত খুঁত!…….তবে তোর দেহে পুরুষত্ব অটুট থাকলেও, তুই কখনই পাবি না নারী সঙ্গের সুখ! আজ থেকে যখনই তুই কোন নারীর সাথে সহবাস করতে উদ্যত হবি, তখনই তার মধ্যে দেখতে পাবি আমাকে……..মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ বিচূর্ণ হবে তো কামোত্তেজনা!……সারা যৌবন কাল ধরে তুই ছটফট করবি নারী সঙ্গ পাওয়ার জন্য, কিন্তু কিছুতেই তুষ্ট করতে পারবি না নিজেকে! তোর একমাত্র সঙ্গী হবে হস্তমৈথুন……হা হা হা হা!
আমি ভয়ার্ত চিত্তে, কোনোমতে সেই ঘরের দরজা খুলে এক ছুটে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে…….তার পর জোর কদমে ছুটে চললাম যে দিকে দুই চোখ চায়……..কিছুক্ষনের মধ্যেই মনে হল, যে চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে গেল সব……নিজেও বুঝতে পারলাম না, যে কখন আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম নিচে!
(৮)
এই ঘটনার পর বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছে। নন্দিনী অন্যত্র বিবাহ করে সুখে সংসার করছে। কলকাতার সব নাম জাদা মানসিক রোগের ডাক্তারগুলোও সুস্থ করে তুলতে পারেনি আমাকে! কেউ কেউ কি যেন একটা গাল ভরা ইংরাজি নাম দিয়েছে আমার এই রোগটার……হ্যাঁ মনে পড়েছে…….Fregoli delusion……. এই মানসিক রোগে নাকি রোগী সকল মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মানুষকেই খুঁজে পায়, সে মনে করে যে ভিন্ন ভিন্ন মানুষজন হল আসলে একটি নির্দিষ্ট মানুষেরই ছদ্মবেশে ধারণ করা রূপ!……..কিন্তু আমি এই সব মানি না। আমি নিশ্চিত, যে শশধরের প্রেতাত্মাই আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য এই কাজ করে চলেছে, এবং আমার সারা জীবন ভর সে একই ভাবে আমাকে এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে চলবে!
আপনাদের কি মনে হয়?
সমাপ্ত