ডুবন্ত বিকেল
-অমল দাস
তখন হেলে পড়া সূর্য্য আর উত্তুরে মৃদু বাতাসের শরৎ-এর এক মনোরম বিকেল। নিলেশ আর দিশানী জোড়া শালিকের মত ডানা মেলে সাইকেল চড়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগলো। কানে কানে মৃদুমন্দ ফিসফিস, আর দিশানীর গাল ভরা লাজুক হাসি মফঃস্বল থেকে কিছুটা দূরে বড় রাস্তার পাশে এক বিশাল ঝিলপারের প্রাকৃতিক দৃশ্যে প্রেম পরিপূরণে এসে থামলো। নিত্য বিকেলে বার্ধক্যের এই ঝিলে যৌবন ফিরে আসে যুবক যুবতীদের সমাগমে। বড় রাস্তার চারচাকা বাহী যাত্রীরাও এখানে দাঁড়িয়ে পড়ে ঝিলপারের প্রকৃতির গোধূলি রূপ চাক্ষুষ করতে । বহু মটরসাইকেলেরও লাইন লেগে থাকে এখানে সেখানে ঝিলের পারে। আর আশেপাশে-ঝোপেঝাড়ে তো কত কি!
সাইকেল বসে বসে দিশানীর কোমর প্রায় ধরে গিয়েছিল। সে নেমেই একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিল তার কোমর। এমন সময় দিশানীর এক বান্ধবী সহেলী তার লৌহ পুরুষের বাইকে চড়ে একটু সামনে গিয়ে থামলো। দুই বান্ধবীর নয়ন মিলন হলো, কথা হলো না। ঠোঁট একটু নড়লো তবে হাসি ফুটলো না। চাউনিতে কিছু একটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল হয়তো বান্ধবী সহেলীর নয়নে, তাই মুখ ঘুরিয়ে নিলেশকে বললো- নিলেশ তুমি একটা বাইক কেন নিচ্ছোনা?
-বাইক! কেন? এই তো এইটুকু রাস্তা! সাইকেল নিয়েই তো…
কথাটা শেষ হলো না নিলেশের, দিশানী মুখ গোমরা করে বললো- দেখোনা! এখানে সবাই বাইকে আসছে, আমরাই শুধু …….. সবাই কেমন করে দেখছে আমাদের দিকে যেন অপরাধী আমরা।
-আরে বাবা! কে তাকালো তাতে কি এসে যায়? তুমি আমার জন্য, আমি তোমার জন্য এখানে এসেছি, অন্যকে তো এখানে দেখানোর কিছু নেই? আর অন্যের দেখারও কিছু নেই!
-সহেলীকে দেখোনি? কীভাবে শুধু মাত্র অহংকার দেখানোর জন্যই আমাদের সামনেই থামলো!
-ঠিক আছে, কি হয়েছে তাতে! ওদের প্রেম কি মহৎ হয়ে গেলো? না আমাদের প্রেম ছন্নছাড়া হয়ে গেলো? ওসব ভেবোনা!
সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে নিলেশ দু’ পা এগিয়ে গেলো। পাশেই একটি গাছের গুড়ি পড়ে আছে, সেটা দেখিয়ে বললো- চলো ওখানে গিয়ে বসি।
দিশানী অভিমানী সুরে সটান উত্তর দিলো- না আগে বলো তুমি কেন নিচ্ছো না? সবাই তো নিচ্ছে! তোমার ইচ্ছা করে না, আমরাও একটু এদিক সেদিক ঘুরি বাইকে করে?
-আরে পাগলি! বাইক নিলে তুমি পিছে চলে যাবে। সাইকেলে আসি বলে তুমি আমার সামনে থাকো। আমিও সেটাই চাই যে, তুমি আমার আগে থাকো আমি তোমার পিছে।
– না হবে না! উত্তর দাও! সব সময় তুমি কথা এড়িয়ে যাও! আজ যদি কথা না দাও তবে আর আমি তোমার সাথে এখানে আর আসবো না।
হঠাৎ পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে এক ঝাঁক পাখি কিচমিচ করতে করতে উড়ে গেলো। সূর্য্যেরও এবার ডুবু ডুবু ভাব। হালকা হাওয়ায় ওঠা ঝিলের ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে এপারেই যেখানে দিশানীরা দাঁড়িয়ে।
নিলেশ একটু অভিমানী হয়েই বললো- আর আসবে না মানে? তোমার আমার সম্পর্ক কি বাইকের পেট্রোলের গন্ধে জুড়ে ছিলো- না মনের টানে? হঠাৎ করে সম্পর্কের মাঝে বাইক কোথা থেকে এলো! এর প্রয়োজনই বা কি?
-তুমি অনেক Back day তে পড়ে আছো নিলেশ! সমাজে চলতে গেলে এখন এগুলোর প্রয়োজন আছে।
– না প্রয়োজন নয়, অযাচিত ব্যয়ে অতিরঞ্জিত করা।
-ভুল নিলেশ! মানুষ তো দু’পা হাঁটতেই পারে, তবু অটো চড়ে। রান্না জানে, তবু রেস্টুরেন্ট যায়, একটা পোশাক তো একমাসে নষ্ট হয় না তবু মাসে মাসে পোশাক কেনে। এটা খারাপ নয়! বর্তমান ট্র্যাডিশন! এভাবেই চলছে।
-হ্যাঁ তা চলছে! হয়তো এই ট্র্যাডিশন আমার মধ্যে নেই ।আর তোমার এই দাবী যদি মেনেই চলা হয়, তবে আজ বাইক দেখে বাইক, কাল চারচাকা দেখে যে সেটাই দাবী হবে না- তা তো ধূলোর মতো উড়য়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
-নিলেশ তুমি এই কথার আড়ালে নিজের যোগ্যতার দুর্বলতা ঢাকতে চাইছো কিনা জানি না! তবে এই যুগে এতো পুরনো ট্র্যাডিশন আগলে না রাখাই ভালো বুঝলে!
-বুঝলাম! পক্ষান্তরে যোগ্যতার মাপকাঠি যে বুঝিয়ে দিলে সেটা বুঝলাম।
-তুমি ভুল ভাবছো আমাকে। আমি তোমাকে সেভাবে….
দিশানী কথা শেষ করতে পারলো না! তার আগেই নিলেশ থামিয়ে দিয়ে বললো- না ভুল কিছু না! তোমার মনে হয় আমার মত অযোগ্যের হাত না ধরে যোগ্যের সাথেই সম্পর্ক করা উচিৎ ছিলো।
-নিলেশ আমি কিন্তু তেমন Mean করিনি ! তুমি অযথা জটিল ভাবছো। তবে ভাবছোই যখন, তখন পিছে না দেখে সামনে এগিয়ে চলার পথ সচল করো ! এই আর কি ?
নিলেশ কোন সাড়া করলো না! সাইকেলটা ঘুরিয়ে তাতে চেপে পড়লো।
দিশানী প্রশ্নবোধক মুখমণ্ডল নিয়ে জানতে চাইলো – সাইকেলে চড়লে যে ?
-বাড়ির দিকে যাই, দেখি একটা বাইক আনতে পারি কিনা! আমার আসতে দেরি হলে তুমি সহেলীদের সাথে চলে এসো। এই বলে সে সাইকেলের প্যাডেল শুরু করে দিলো।
দিশানী হতবাক হয়ে জানতে চাইলো- কি হলো? তুমি আমায় রেখে যাচ্ছ এই ভাবে এইখানে!
নিলেশের উত্তর এলো না কোন ! শুধু দিশানী যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে দূরত্বটা বেড়ে গেলো….. অ-নে-ক-টা।
অসাধারণ, অনবদ্য পরিবেশন।
ধন্যবাদ বন্ধু
অবুঝ দাবী, ইগো মিলেমিশে ‘ডুবন্ত বিকেল’। ভালোবাসা মানিয়ে নিতে শেখায়… কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকাল মানিয়ে নেওয়ার বড়ো অভাব বাস্তবে।রূঢ় বাস্তব
একদম সত্য কথা, ধন্যবাদ বন্ধু