আধুনিকতা
-পারমিতা চ্যাটার্জী
ঘরে ঢুকেই খাটের ওপর ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে, রিমলি শয্যায় গা এলিয়ে দিল। ধরিত্রী দেবী ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করলেন, ‘এতো রাত অবধি তুমি কোথায় ছিলে?’
-‘আমি তোমাকে উত্তর দিতে বাধ্য নই মা আমার কাজ ছিল।’
-‘কি কাজ সেটাই জানতে চাইছি তুমি তো কোনো মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে কাজ করো না। সে যোগ্যতা তোমার নেই তাহলে কি এমন কাজ যে, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরতে হলো। তাও স্বাভাবিক অবস্থায় নয়!’
-‘মা, প্লিজ যুগটা অনেক এগিয়ে গেছে এই আধুনিক যুগের সাথে তুমি পরিচিত নও এই নিয়ে কথা না বলাই ভালো..’
-‘তা তোমার মতে আধুনিকতা মানে রাত বারোটা অবধি মদ খেয়ে বেলেল্লাপনা করা? এটাকে আধুনিকতা বলে না!’
‘আধুনিকতা মানে পুরাতন মানুষের সৃষ্টি কিছু সংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করা, আধুনিকতা মানে মানবিক হওয়া, অন্যের দুঃখকে নিজের মনে করে ভাগ করে নেওয়া। আধুনিকতা মানে স্বনির্ভর হওয়া, স্বামী বা বাবার কাছ থেকে ভিক্ষা করে টাকা ওড়ানো নয়। অত্যাচারী স্বামীর অপমান সহ্য করেও তার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো নয়। স্বামীর অপমানের ভাত না খেয়ে নিজের রোজগারের ওপর নির্ভর করা পরাধীনতা বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। যা আমি করেছি আমি, একজন স্বনির্ভর মহিলা একটা সরকারি কলেজে পড়া তোমার আধুনিক বাবা আর ঠাকুমার এই হুকুমটা মেনে নিইনি। আমার চাকরি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে আমার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তার প্রতিবাদ করা। আমি নিজের রোজগারের ভাত খেয়েও তোমার ঠাকুমার শেষ অবধি তাঁর সেবা করে গেছি। আমার মানবিকতার বোধ থেকে একে আধুনিকতা বলে।’
-‘মা, প্লিজ আমার বাবা আমায় যুগপোযোগী করে গড়ে তুলছেন। তুমি এই যুগের সাথে পরিচিত নও। তুমি তোমার পুরানো ধ্যান ধারণা নিয়ে থাকো আমায় জ্ঞান দিওনা।’
-‘তোমার যুগের আধুনিকতা কি বাবার কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা হাতখরচ ভিক্ষা করে নিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা করা? এরপর একদিন যদি খবরের কাগজের হেডিংয়ে তোমাদের নাম দেখা যায় অমুক শিল্পপতির মেয়ে মদ্যপ অবস্থায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরছিল। সে সময় — কিছু সমাজবিরোধী তার ইজ্জত লুটে নিয়ে তাকে মাঝপথে ফেলে দিয়ে গেছে তখন তোমার এই উচ্ছৃঙ্খল আধুনিকতার দাম দিতে পারবে তো?’
-‘,মা প্লিজ আমি খুব টায়ার্ড তুমি প্লিজ এখন যাও তোমার কলেজের স্টুডেন্টদের লেকচার দিও, আমাকে নয়।’
ধরিত্রী দেবী চলে আসেন তাঁর ঘরে। ভাবেন এ কোন পথে যাচ্ছে তাঁর একমাত্র আত্মজা? কি এর পরিণতি উচ্ছৃঙ্খল বাপের রক্তটাই বইছে ওর ধমনীতে! এর থেকে তাকে মুক্ত করা কি সম্ভব?
এর বেশ কয়েকমাস পরে একদিন খবরের কাগজ দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী এতো তাড়াতাড়ি ফলে যাবে ভাবতেই পারেন নি।
তাঁর দু’চোখে জলের ধারা তিনি যে মা! এ সত্যটা অস্বীকার করবেন কি করে? তিনিও তো ব্যার্থ হয়েছেন মেয়েকে এই উচ্ছৃঙ্খল আধুনিকতার শিকার থেকে মুক্ত করতে।এ দায় তিনি এড়াবেন কি করে?’
ছুটে যান নার্সিংহোমে। স্তব্ধ মেয়ের মাথায় হাত রেখে হাত রাখতেই, সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মা তার মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘কিছু হয়নি। এটা একটা দুর্ঘটনা, সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছো। এবার থেকে জীবনের চলার পথটা বদলে ফেল সত্যি আধুনিক হও মনে প্রাণে আধুনিক কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল হয়োনা।’
বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর স্বামী দাঁড়িয়ে আছে, তাঁকে দেখে হাতজোড় করে বললেন- আমায় ক্ষমা করো। এবার থেকে মেয়ের ভার তুমি নাও আমি হেরে গেলাম..’
-‘সে তো নেবো। মায়ের দায়িত্ব তো অস্বীকার করতে পারিনা। সেটা আমার আধুনিকতায় বলেনা। ওকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনাটাই আমার দায়িত্ব। তা আমি করবো। সে তুমি বললে বা না বললেও করবো।’
-‘আর আমায় ক্ষমা করতে পারবে?’
-‘না, পারবো না। ইচ্ছাকৃত অপমান আর অত্যাচারী স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হতে আমি অপারক নিজেকে অসম্মানিত হতে দিতে পারবোনা এটা আমার আধুনিকতা।’