স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি
-প্রলয় কুমার নাথ

 

 

(১)

দু’পাশে বামনপোখারীর জঙ্গলে ঘেরা মেঠো পথ দিয়ে যেতে যেতে, হঠাৎ সচকিত হয়ে বাইকের ব্রেক কষে ধরল অনিকেত। তীব্র ঝাঁকুনির চোটে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো বাইকের পেছনে বসে থাকা, তার স্ত্রী রায়া। তাদের সামনে দিয়ে অতি সন্তর্পণে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে রাস্তা পারাপার করে চলে গেল এক জীর্ণ পোশাক পড়া বয়স্ক ভদ্রলোক। অনিকেত বুঝতেও পারেনি, যে এই জনমানবশূন্য স্থানেও, তার বাইকের সামনে হঠাৎ করে উদয় হবে এই ব্যক্তি……আর একটু হলেই তার শরীরের ওপর দিয়েই চলে যেত অনিকেতের বাইক! কিন্তু কাঠের বোঝা মাথায় ক্লান্ত লোকটির যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই! নতুন স্থানে এসে, বিকালে স্ত্রীকে বাইকে বসিয়ে একটু আশে পাশে ঘোরানোরও কি জ্বালা!

কিছুক্ষণ পর আবার বাইকে স্টার্ট দিলো অনিকেত। পেছনে বসা রায়া আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কয়েক মাস আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাটার কথা আবারও মনে পড়ে গেল রায়ার! আজ ওই বয়স্ক লোকটি যে জায়গায় ছিল, সেদিন সে নিজেও ছিল একই স্থানে…..শুধু ঘটনাস্থলটা ছিল কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিট। সেদিন রায়া গিয়েছিল অনিকেতের অফিসে, সেখান থেকে সরাসরি সাউথ সিটি মলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দুজনের….. তবে সেদিন কিন্তু তীব্র গতিতে আসা অচেনা এক বাইক আরোহী রায়াকে দেখে সঠিক সময়ে বাইকের ব্রেক কষার সুযোগ পায়নি, তাই শপিং-এর পরিকল্পনা বদলে গিয়ে, তাদের গন্তব্যস্থল হয় একটি নিকটবর্তী নার্সিং হোম! বাইকের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়ে গিয়ে, মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ সেখানে ভর্তি ছিল রায়া!

এমন সময়ই একটি অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিকতার সম্মুখীন হতে হয় রায়াকে। মস্তিষ্কের বেশ কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে, ডাক্তারেরা ধরেই নিয়েছিলেন, যে আর বাঁচানো যাবেনা তাকে! চোখের জল চেপে রেখে, শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিল না অনিকেতের কাছে!……..এদিকে আই.সি.ইউ-র বেডে শায়িত অচৈতন্য রায়ার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠেছিল এক অদ্ভুত দৃশ্য!……যেন একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে সে…..আতঙ্কিত হয়ে সে ভাবছিলো, যে এই পথ শেষ হচ্ছেনা কেন? এই আঁধার ঘেরা পথ ধরে সে কি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ইহজগতের বাইরে?…….কিন্তু, কিছুক্ষণ পরেই তার চোখ ধাঁধিয়ে উঠেছিল দূর থেকে বিচ্ছুরিত তীব্র আলোর রশ্মিতে! তার সামনে দিয়ে, এক শুভ্র পোশাক পরিহিতা নারীমূর্তি যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে!

সেই সুন্দরী নারীর হাসিমুখ এক ঝলক দেখেই তাকে চিনতে পেরেছিল রায়া……এ তো তার ঠাকুমা, মৃন্ময়ী দেবী! যিনি রায়ার জন্মের অনেক আগেই ত্যাগ করেছিলেন ইহলোকের মায়া! যার সুন্দর রূপের কদর রায়া তার পরিবারের অনেকের মুখেই শুনেছে! বাড়ির এ‌্যালবামের পুরোনো দিনের ছবিগুলোতে তাকে দেখতে দেখতে, মনে মনে সে ভেবেছে, ইস, তাকে স্বচক্ষে একবার দেখার সৌভাগ্য তার কেন হল না!……এখন যেন ছবিতে দেখা, সেই সুন্দরী যুবতী মেয়েটাই তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! তাকে হেসে বলছে,
– কি রে……তোর এতদিনের সাধ পূরণ করতে পারলাম তো আজ!
ব্যাস, তারপর আর বেশি কিছু মনে নেই রায়ার। তবে খুব আশ্চর্যজনক ভাবেই তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো এর পর থেকে। ঈশ্বর যেন সত্যিই শুনলেন অনিকেতের প্রার্থনা, তিনি আবার রায়াকে সশরীরে ফিরিয়ে দিলেন তার কাছে।

(২)

এই ঘটনার কয়েকমাস পরে, একটি প্রাইভেট ব্যাংকে রুরাল মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত অনিকেতের বদলি হয় উত্তর বঙ্গের জঙ্গলে ঘেরা এই বামনপোখারী গ্রামে। এখানকার স্থানীয় এক ব্যবসায়ী, কৃষ্ণেন্দু বাবুর সুবিশাল বাড়ির নিচের তলাটা ভাড়া নিয়েছে সে। কৃষ্ণেন্দু বাবু তাদের মতই এখনো নিঃসন্তান এবং তার স্ত্রী অর্পিতার বয়স রায়ার মতই। তবে সাময়িক কিছু বাক্যালাপ ছাড়া, খুব বেশি একাত্ম বোধ নেই এই দুই পরিবারের মধ্যে।

কিছুদিন পরের ঘটনা। সেদিন রাতে ঘুম আসছিলো না রায়ার। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে, ভালোবাসার আবেগে সে একবার জড়িয়ে ধরলো পাশে শুয়ে থাকা অনিকেতকে……পরমুহূর্তেই একটা খটকা লাগলো রায়ার! যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান পুরুষ অনিকেতের শরীরটা আজ এত শীর্ণ লাগছে কেন! তারপরেই তার মনে পড়লো, আরে, অনিকেত তো গত তিন দিন ধরে অফিসিয়াল টুরে গিয়েছে দিল্লিতে…….আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠল রায়ার!…..তাহলে……তাহলে তার পাশে এখন যে শুয়ে আছে, সে কে!……এক ঝটকায় নিজেকে সেই দেহ থেকে সরিয়ে নিয়ে চোখ খুলল রায়া……তার চোখের সামনে এখন খাঁ খাঁ করছে ফাঁকা বিছানা…….ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো তার, এর মানে কি সেই অনুভূতি তার মনের ভুল? কিন্তু সে তো এখন জেগেই আছে…..জেগে থেকে তো আর মানুষ স্বপ্ন দেখবে না!

বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে ছুটলো রায়া। তারপর বেসিনের জলের কলটা খুলে, মুখে একবার জলের ঝাপটা দিতে গিয়ে…….নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে, ভয়ে একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলো সে!…..তার সারা হাতে লেগে রয়েছে জমাট বাঁধা কালচে রক্তের ছাপ!….কম্পিত শরীরে সে ভাবতে লাগলো, যে কোথা থেকে এলো এই রক্ত? তাহলে কি…..তাহলে কি, কিছুক্ষণ আগে যে পুরুষ শরীরের স্পর্শ সে ওই হাতে পেয়েছে, তার গায়ে লাগা ছিল এই রক্ত?……এমন সময় হঠাৎ জ্বলা নেভা করতে করতে বন্ধ হয়ে গেল বাথরুমের লাইট! আধো আলো আধো অন্ধকারে, বেসিনের সামনে রাখা আয়নায় চোখ যেতেই, সে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলো……যে তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে এক রোগাটে চেহারার তরুণের মূর্তি! তার কপাল থেকে চুঁইয়ে পড়ছে তাজা রক্তের ধারা! মণিহীন নিষ্পলক চোখে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রায়ার দিকে! তার রক্তমাখা শীর্ণকায় হাতটিকে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিচ্ছে সামনে……যেন এখনই স্পর্শ করতে চায় রায়ার কাঁধ!…….আরেকবার তীব্র আর্তচিৎকার করে, জ্ঞান হারিয়ে বাথরুমের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল রায়া……..

(৩)

পরদিন যখন হুঁশ ফিরে এলো রায়ার, তখন সকাল দশটা হবে। বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে আসছে পাখির কলরবের আওয়াজ। বাথরুমের ওপরে থাকা ঘুলঘুলি দিয়ে আসছে বাইরের সোনালী রোদের অলোক ছটা। সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে, তারপর একতলার ব্যালকনিতে গিয়ে খোলা হাওয়ায় দাঁড়ালো। অনিকেতের আজকেই ফেরার কথা। সে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে, যে অনিকেত ফিরলেই তাকে অন্যত্র বাসস্থান খোঁজার কথা বলবে…….সে নিশ্চিত, যে এই বাড়িতে কোন অশরীরির ছায়া আছে……কারণ গত রাত্রের ওই ঘটনাগুলো কখনো তার চোখের ভুল হতে পারে না!

শরীরে বেশ অস্বস্তি নিয়েই রায়া বেরিয়ে পড়ল বাড়ির বাইরে, বাজারের উদ্দেশ্যে। কারণ আজ বিকালের ফ্লাইটেই দিল্লি থেকে ফিরতে চলেছে অনিকেত, আর এদিকে রান্নাঘরে বেশ কিছু রন্ধন সামগ্রী প্রায় শেষের দিকে। এই গ্রামের একমাত্র বাজারটিতে হাঁটা পথে যেতে বেশ সময় লাগে। আমিষ নিরামিষ সবকিছুই পাওয়া যায় একই স্থানে। মুদিখানার দোকানের দোকানকার ব্যক্তিটি রায়ার নির্দেশানুসারে কয়েকটি মশলাপাতি ওজন করে প্যাক করতে করতে তাকে বলে উঠলো,
-দিদিভাইকে তো আগে এই গ্রামে দেখিনি…..এখানে নতুন এসেছেন বুঝি?
হ্যাঁ, আসলে চাকরিসূত্রে আমার স্বামী বদলি হয়ে এখানে এসেছেন……

-আচ্ছা, আচ্ছা…..তা এখানে উঠেছেন কোথায়?
-কৃষ্ণেন্দু বাবুকে চেনেন নিশ্চয়…..ওনার বাড়ির একতলাটা ভাড়া নিয়েছি আমরা……

এই কথা শুনে একটু যেন বিস্মিত হল সেই ব্যক্তি, তারপর বলল,
-ও, তো এই জন্যই বোধহয় প্রতীককে কয়েক মাস ধরে আর আসতে দেখিনা এই বাজারে……
বেশ কৌতূহলী হয়ে রায়া বলে উঠলো,
-প্রতীক কে?
-কৃষ্ণেন্দু বাবুর কোন এক দূরসম্পর্কের ভাই হল প্রতীক…..বেশ ভালো ছেলে, রোগাটে চেহারা, ফর্সা রং…… ওর বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ায়, কৃষ্ণেন্দু বাবু ওকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন, এখানকার একটি কলেজে তাকে ভর্তিও করিয়েছিলেন। ওনার বাড়ির এক তলায়, মানে এখন যেখানে আপনারা আছেন, সেখানেই থাকতো সে…….মাঝে মাঝে বাড়ির বাজার হাট করতে আসতো আমার দোকানে, তখনই ওর সাথে যা দু’চার কথা হত আমার……..তবে কয়েক মাস ধরে ওকে আর এদিকে আসতে দেখিনা। হয়তো পড়াশোনা শেষে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছে। তাই এখন কৃষ্ণেন্দুবাবু বাড়ির একতলাটা আপনাদের ভাড়া দিয়েছেন, বোধহয়……

এই বিষয়ে আর কোন কথা না বাড়িয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাজার থেকে ফিরতি পথে হাঁটা লাগায় রায়া। তার আতঙ্কে ভরা বুকে যেন একটা কথাই বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলছিলো, “না, না…..প্রতীক নিজের বাড়ি ফিরে যায়নি!……নিজের বাড়ি ফিরে যায়নি সে!……তাকে কেউ খুন করেছে!….কেউ নৃশংশ ভাবে তাকে সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে!……আর এই কথাই যেন জানান দিতে চাইছে গত রাত্রে দেখা তারই প্রেতাত্মা!”

(৪)

বাড়ি ফিরেই রায়া ছুটে গেল ওপর তলায়। কৃষ্ণেন্দুবাবু তখন নিজের অফিসে গিয়েছেন, বাড়িতে শুধুমাত্র আছে তার স্ত্রী অর্পিতা। রায়া তার কাছে গিয়ে তাকে সটান চিৎকার করে বলে উঠলো,
-তুমি কি কখনো এই বাড়িতে কোনো অশরীরির উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরেছো, অর্পিতা?…..বলো, বলো, আমার কথার জবাব দাও……
এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে অর্পিতা বলে উঠলো,
-মানে? এই সব কি বলছো কি তুমি? অশরীরি!….আমাদের বাড়িতে!
এই বলে খিল খিল করে হেসে উঠলো অর্পিতা। তারপর বলল,
-তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, রায়া…..কাল রাতে নিশ্চয় কোন হরর ফিল্ম দেখেছো…….
কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই চিৎকার করে উঠলো রায়া,
-না, অর্পিতা……আমার মাথা খারাপ হয়নি……খারাপ যদি কিছু হয়ে থাকে, তাহলে তা হয়েছে প্রতীকের সাথে……কারণ কাল রাতে তার প্রেতাত্মাই দেখা দিয়েছে আমায়!

এই বার যেন চমকে উঠলো অর্পিতা। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে সে কম্পিত গলায় বলে উঠলো,
-ত…ত….তুমি প্রতীকের কথা কোথা থেকে জানলে?
-তার থেকেও বেশি জানার দরকার হল, যে কি হয়েছিল প্রতীকের সাথে….আর সেই কথা তোমাকে আমায় বলতেই হবে আজ…..
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অর্পিতা। ঠিক সেই ঘরে প্রবেশ করলেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। তিনি রায়াকে বললেন,
-একটা দরকারি ফাইল নিতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, বৌদি…..আপনাদের সব কথাই আমি দরজার বাইরে থেকে শুনেছি। আপনি প্রতীকের ব্যাপারে জানতে চান, তাই তো? ঠিক আছে, বলছি আমি, শুনুন তাহলে…….

কৃষ্ণেন্দু বাবু বলে চললেন,
-আমার দূরসম্পর্কের ভাই হলেও, ওকে মায়ের পেটের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবসেছিলাম আমি……ওকে এখানে নিয়ে এসে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিলাম……কিন্তু কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি, যে ও তার এই প্রতিদান দেবে! যে অর্পিতা ওকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতো, ও তার ইজ্জতের ওপরই হামলা করতে যাবে!
এবার কাঁদতে কাঁদতে অর্পিতা বলে উঠলো,
– হ্যাঁ রায়া…..কৃষ্ণেন্দু ঠিক কথা বলছে……একদিন রাতে যখন আমি ওর ঘরে রাতের খাবারটা রাখতে যাই, তখনই ও সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে…..আমার চিৎকার শুনে কৃষ্ণেন্দু ছুটে আসে নিচে, তারপর এক ধাক্কায় ঘরের দরজা খুলে, ভেতরে ঢুকে আমাকে ওর হাত থেকে বাঁচায়……..সেই সময় রাগের মাথায় ওদের দুজনের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়……তেমনই এক মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু ওকে ঠেলে দেয় দেওয়ালের দিকে…..প্রচন্ড জোরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে গিয়ে সেদিনই মৃত্যু হয় ওর!
কৃষ্ণেন্দু বাবু বলে উঠলেন,
-এরপর আমরা ওর লাশটা বাথরুমে নিয়ে গিয়ে রেখে আসি……পরদিন সকলকে বলি যে গত রাত্রে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রতীকের…….এখন আপনিই বলুন…..আপনিই বলুন বৌদি, এমন একজন মানুষ যে নিজের বৌদিকে ধর্ষণ করতে যায়……তাকে মেরে, তার থেকে নিজের স্ত্রীর ইজ্জত বাঁচিয়ে, আমি কি খুব ভুল কাজ করে ফেলেছি?
রায়া পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এই প্রশ্ন শুনে!

(৫)

সেদিন অনিকেত ফিরলে তাকে সব কথা খুলে বলল রায়া। প্রথমে তার কথা বিশ্বাস করতে চাইছিলো না অনিকেত, কিন্তু পরে কৃষ্ণেন্দু আর অর্পিতার স্বীকারোক্তির কথা শোনার পর সেও রাজি হয়ে গেল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি ত্যাগ করে অন্য বাসস্থান খুঁজতে।

নাহ, সেদিন রাতে আর প্রতীকের প্রেতাত্মার দর্শন পায়নি রায়া। কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে, তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি অদ্ভুত স্বপ্ন!……এই ঘরটারই একটি দৃশ্য যেন ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে……সময়টা হয়তো কোন এক সকাল বেলা হবে। এই ঘরের মধ্যেই, পড়ার টেবিলে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি বইয়ের মধ্যে যেন ডুবে রয়েছে এক যুবক……সে আর কেউ নয়, গত রাত্রেই যার প্রেতাত্মাকে দেখতে পেয়েছে রায়া……প্রতীক!…….এমন সময় চায়ের ট্রে হাতে সেই ঘরে প্রবেশ করলো অর্পিতা! প্রতীক যেন বেশ বিরক্তি ভরে তাকালো তার দিকে। তার সামনে চায়ের কাপ প্লেট রেখে, তার সাথে কয়েকটা সাধারণ কথাবার্তা বলতে শুরু করলো অর্পিতা, তবে প্রতীকের ব্যবহার দেখে বোঝা যাচ্ছিল, যে সে যেন অর্পিতার সান্নিধ্যে থাকতেই চায়না একেবারে।

এরপর হঠাৎ নিজের ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা চিরকুট বার করলো অর্পিতা, তারপর মুচকি হেসে সেটা প্রতীকের হাতে ধরিয়ে দিয়েই, সলজ্জ ভঙ্গিতে সেখান থেকে কেটে পড়তে চাইলো। কিন্তু সে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই চিৎকার করে উঠলো প্রতীক,
-দাঁড়ান বৌদি, দাঁড়ান….ছি, ছি……লজ্জা করে না আপনার…..লজ্জা করে না? আপনার দেওয়া এমন প্রতিটা চিঠিতে যে কথাগুলো লেখা থাকে, সেগুলো যদি আমি একবার দাদাকে দেখিয়ে দিই…..তাহলে আপনার কি হবে তা ভেবে দেখেছেন কখনো?
এবার অর্পিতা ঘুরে দাঁড়ালো প্রতীকের দিকে, তারপর মুচকি হেসে বলে উঠলো,
-ওই চিঠিগুলিতে কিন্তু আমি কোন মিথ্যা কথা লিখিনা, প্রতীক…..আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি প্রতীক…..একবার তাকিয়ে দেখো আমার দিকে…..বলো, আমি কি সুন্দরী নই?……আমাকে দেখে কি একবারও জেগে ওঠে না তোমার পৌরুষ বোধ? আমি যে তোমার দাদাকে নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নই, প্রতীক!……এদিকে তোমার দাদা প্রায়ই আমার মোবাইল ঘাটে, তাই বাধ্য হয়েই তোমাকে চিঠি লিখে মনের কথা জানাতে হয়!
এই বলে শাড়ির আঁচলটা নিজের বুকের ওপর থেকে নিচে সরিয়ে ফেলল অর্পিতা!

সেই মুহূর্তেই লজ্জায় সেই দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, তীব্র ঘৃণার সাথে বলে উঠলো প্রতীক,
-আমি আজীবন দাদাকে শ্রদ্ধা করে এসেছি, আপনাকেও দেখে এসেছি নিজের দিদি হিসাবে……আর আপনি কিনা! ছি……এই মুহূর্তে…..এই মুহূর্তে এই ঘর থেকে চলে যান আপনি…..আর কখনো আমার সামনে এই ভাবে দাঁড়াবেন না……
কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই, সেই অবস্থায় অর্পিতা ছুটে গিয়ে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো প্রতীককে……নিজের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতীক নিজেকে তার এই যৌনলিপ্সা ভরা আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে, তার গালে সপাটে কষিয়ে দিলো একটি চড়! কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে প্রতীকের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে, নিজের শাড়ির আঁচলটা সঠিক জায়গায় এনে, সেই মুহূর্তে সেই ঘর থেকে বিদায় নিলো অর্পিতা……যাওয়ার আগে তাকে বলে গেল,
-আমি একজন মেয়েমানুষ হয়ে তোমাকে বিছানায় পেতে চাইছি…..আর তুমি কিনা আমাকেই উপেক্ষা করছো! এত দেমাক তোমার! আমার গায়ে হাত তুললে তুমি!…..এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে…..ভুগতে হবেই!

এরপরের দৃশ্য, যা রায়ার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, তার সময় বোধহয় আগের ঘটনার দিনই, রাত্রিবেলা। রাতের খাবার নিয়ে প্রতীকের ঘরে প্রবেশ করলো অর্পিতা। সকালের ঘটনার বশে প্রতীকের যেন তার দিকে চেয়ে দেখারও ইচ্ছা নেই এখন। কিন্তু খাবারের থালাটা টেবিলে রেখেই অর্পিতা করে বসলো একটি অভূতপূর্ব কাণ্ড! সে ছুটে গিয়ে সপাটে বন্ধ করে দিলো সেই ঘরের দরজা!…..তারপর নিজের গা থেকে একটানে যতটা সম্ভব পরনের শাড়িটা খুলে ফেলল!……নিজের দুই কাঁধের কাছে ব্লাউসের অংশগুলিকে খামচে ধরে এক টানে দিলো ছিঁড়ে……তারপর তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিলো,
-কৃষ্ণেন্দু…….কৃষ্ণেন্দু, বাঁচাও আমাকে……বাঁচাও……
অর্পিতার এই আকস্মিক আচরণে বাকরুদ্ধ হয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো প্রতীকের শীর্ণ দেহটি। এরপর অর্পিতা আবার চিৎকার করতে করতে প্রতীককে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানায়…….প্রতীক যেন শত চেষ্টা করেও ক্ষান্ত করতে পারলো না, নিজের যৌনলিপ্সায় সাড়া না দেওয়ার প্রতিশোধকামী এই উন্মাদিনীকে!

এমন সময়, অর্পিতার চিৎকার শুনে, দরজা ভেঙ্গে সেই ঘরে প্রবেশ করলো কৃষ্ণেন্দু। এই পরিস্থিতিতে আসল ঘটনার আন্দাজ করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়! সে যেন আর কিছু বলার সুযোগই দিলো না প্রতীককে! রাগের মাথায়, তার উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে, তাকে মারতে মারতে, তার শীর্ণ শরীরটাকে ধাক্কা মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেওয়ালের গায়ে……বিদ্যুৎবেগে প্রতীকের মাথাটা সপাটে আছড়ে পড়ল দেওয়ালের গায়ে…….তার কপাল ফেটে গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্তধারা……একটা শেষ আর্তচিৎকার করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল প্রতীকের নিথর দেহ!…….ব্যাস, এতটা দেখেই ঘুম ভেঙ্গে গেল রায়ার!

(৬)

পর দিন সকালেই কৃষ্ণেন্দু আর অর্পিতাকে ডেকে, গত রাতে নিজের দেখা স্বপ্নের কথা সবিস্তারে জানালো রায়া। পুরোটা শোনার আগেই আপত্তির সুরে চিৎকার করে উঠলো অর্পিতা,
-বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলাটা বেশ ভালোই শিখেছো, রায়া…….যদি ক্ষমতা থাকে তো প্রমাণ করে দেখাও…….প্রমাণ করে দেখাও যে তোমার স্বপ্নে দেখা ঘটনা সত্যি!
এবার হঠাৎ মুচকি হেসে উঠলো রায়া, তারপর ছুটে দিয়ে বিছানায় বালিশের নিচ থেকে বার করলো কয়েকটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো। তারপর সে খুশির সুরে বলল,
– প্রমাণ হল এই চিঠিগুলি…….যেগুলোতে তুমি প্রতীককে নিজের শারীরিক চাহিদার কথা লিখতে…….এগুলো কিন্তু আমি এই ঘর থেকেই খুঁজে পেয়েছি, অর্পিতা!
বিস্ফারিত চোখে উন্মাদের ভঙ্গিতে বলে উঠলো অর্পিতা,
-সে কি! এ কি ভাবে সম্ভব! এ কি ভাবে……
তার কথা শেষ না হতেই জোর দিয়ে বলে উঠলো রায়া,
-হ্যাঁ, অর্পিতা….এগুলোই সেই চিঠি……স্বয়ং প্রতীকের প্রেতাত্মা আমাকে এগুলো দিয়েছে…….এগুলোই আমার স্বপ্নে দেখা ঘটনার সত্যি হওয়ার প্রমাণ!

ধৈর্যের পরিসীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায়, চিৎকার করে বলে উঠলো অর্পিতা,
-এ সম্ভব নয়……কোনোদিনও সম্ভব নয়……কারণ প্রতীকের মৃত্যুর পর, ওগুলোকে এই ঘর থেকে খুঁজে বার করে আমি নিজে হাতে পুড়িয়েছি…..মিথ্যা কথা বলছো তুমি রায়া, মিথ্যা কথা বলছো!
কিন্তু এতটা বলার পরই যেন তার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হল! সে নিজেই বুঝতে পারলো, যে নিজের বিরুদ্ধেই কি ভয়ঙ্কর সত্য আজ সে নিজের মুখেই স্বীকার করে ফেলেছে! এমনই সময়, একটি বাঁকা হাসি খেলে গেল রায়ার ঠোঁটে, সে এক ঝটকায় সারা ঘরময় ছড়িয়ে ফেলে দিলো সেই কাগজগুলো……যেগুলো শুধুমাত্র সাদা কাগজ ছাড়া আর কিছু নয়! লজ্জায় দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লো অর্পিতা…….অবিশ্বাস, ঘৃণা আর বিদ্বেষ ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চুপ করে চেয়ে রইল কৃষ্ণেন্দু!

এমন সময় রায়ার চোখ চলে গেল সেই ঘরের এক কোনে……সেখানে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং প্রতীক! এখন তার মুখে নেই কোন বিভীষিকা, নেই কোন রক্তের ছাপ! এতদিন ধরে সে এটাই চাইতো, যে তার দাদা যেন জানতে পারে তার স্ত্রীর আসল পরিচয়! সে যেন বুঝতে পারে, যে তার হতভাগ্য ছোট ভাইটি ছিল সত্যিই নিরপরাধ! আর এটা প্রমাণ করাবার জন্যই সে সবাইকে ছেড়ে বেছে নিয়েছিল রায়াকে।

এখন রায়াও জানে এর কারণ…….সেদিনের সেই বাইকের দ্বারা এক্সিডেন্টের পর, তার যে “Near Death Experience” হয়েছে……..তার ফলেই হয়তো অতীতের কথা জানতে পারার একটি অতি-প্রাকৃত ক্ষমতা চলে এসেছে তার মধ্যে, যাকে “Parapsychology”-র ভাষায় বলা হয় “Retrocognition”. এর ফলেই সে সর্বপ্রথম দেখতে পেয়েছিল তার মৃত ঠাকুমার সেই যুবতী রূপ! হয়তো তার আশীর্বাদেই রায়ার প্রাপ্ত এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা! আর, আজ তার এই ক্ষমতার জন্যই, নিজের ইচ্ছাপূরণ করে মুক্তি পেতে চলেছে প্রতীকের অতৃপ্ত আত্মা!

(সমাপ্ত)

Loading

4 thoughts on “স্বীকারোক্তি

Leave A Comment