Site icon আলাপী মন

ক্ষত (পর্ব-২)

ক্ষত 
-বিশ্বদীপ মুখার্জী

 

 

পর্ব- ২

বাড়িটা ছোট, আশেপাশে বলতে গেলে জংগল। কোনো সময় হয়তো বাগান ছিলো, কিন্তু এখন সেটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। সদর দরজায় তালার দরুণ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ সম্ভব নয়। বাইরে থেকেই মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলো যে বাড়িতে খুব বেশি হলে দুটো ঘর। একটা ঘর বাড়ির পেছন দিকে। বেরোবার জন্য একটা দরজাও আছে। সন্তর্পণে বাড়িটার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে মৃত্যুঞ্জয়। বাড়িটা বেশ পুরনো, তায় আবার যত্নহীন। বেশ কিছু কাঠের জানালা অল্প অল্প ভাঙ্গা। জানালাগুলো বেশ উঁচুতে, তাই ছিদ্র দিয়ে কিছু দেখা সম্ভব হলো না মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য। এবার মাটির দিকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। কিছুক্ষণ আগেই হয়ে গেছে সূর্যাস্ত। পাঁচিল টপকে প্রবেশ করার প্রায় চল্লিশ মিনিটের বেশি হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ের। দিনের আলো থাকতেই নিজের কাজ শেষ করতে হবে তাকে। মাটির দিকে তাকাতেই খানিক পর কিছু রক্ত মাখা ব্যান্ডেজ ও তুলো পেলো সে।  স্টিচের কিছু সুতো তার হাতে এলো। প্রায় অর্ধেকটা পুড়ে যাওয়া বইয়ের একটা পৃষ্টা দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। তৎক্ষনাৎ সেটা তুলে নিলো। আধ পোড়া কাগজটা ভালো করে দেখলো। সাথে সাথে মাটিতে ছড়ানো প্রায় একই প্রকারের বেশ কিছু কাগজের টুকরো তার চোখে পড়লো। কোনোটা প্রায় নব্বই শতাংশ পুড়ে যাওয়া তো কোনোটা পঞ্চাশ শতাংশ। একে একে সবগুলোকে উঠিয়ে নিরীক্ষণ করলো মৃত্যুঞ্জয়। সবগুলো পৃষ্ঠাই মেডিকেল বইয়ের। সবগুলোকে এক সাথে দলাপাকিয়ে নিজের প্যান্টের পকেটে পুড়লো সে। আরও কিছু পাওয়ার আশায় ঘাড় হেঁট করে মাটির দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় এগোতে থাকে। মাটিতে ওটা কী পরে আছে? উবু হয়ে বসে সে জিনিসটা তুললো মৃত্যুঞ্জয়। একটা ছবিকে যেন দু’টুকরো করা হয়েছে, তারই একটা অংশ এখন মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। এক পুরুষের ছবি। ব্যাক ব্রাশ করা চুল, চোখে চশমা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, পরনে সুট-টাই। ছবিটা সাদা-কালো, বলাই বাহুল্য যে বেশ পুরনো ছবি। সেই ছবিটাও নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করলো মৃত্যুঞ্জয়। চারিপাশে বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। হাতঘড়িতে সময় দেখলো সে, সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। আর বেশি সময় নেই হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতীক নেলসন চলে আসবে। ঘাসের ওপর আরও কি কি আছে অন্ধকারের দরুণ দেখা সম্ভব নয়। পাঁচিল টপকে বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নেবে ঠিক সে সময় লোহার ফটক খোলার শব্দ পেলো সে। তৎক্ষনাৎ বাড়ির পেছন দিকের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো মৃত্যুঞ্জয়। আলোআঁধরির মধ্যে দেখতে পেলো কেউ ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মাঝারি উচ্চতা, বাঁ হাতের চেটোতে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা, পিঠে একটা ব্যাগ। সদর দরজা খোলার আওয়াজ কানে এলো মৃত্যুঞ্জয়ের। খানিক পরেই বাড়ির পেছন দিকের ঘরের বাতি জ্বলে গেলো। মৃত্যুঞ্জয়ের বুঝতে দেরি হলো না যে, এই ছেলেটাই প্রতীক নেলসন। না, আর এখানে থাকা ঠিক না। অতি সন্তর্পণে পাঁচিল টপকে বেরিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়।

পানের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট ধারালো সে। আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকলে কেমন হয়ে? খুব সম্ভব দ্বিতীয় ছেলেটাও খানিক পরেই চলে আসবে। দোকানি বারবার মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকাচ্ছিল। দোকানে গ্রাহকের প্রাচুর্যের কারণে কিছু বলতে পারছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল যে মৃত্যুঞ্জয় দ্বিতীয় ছেলেটার অপেক্ষাই করছে। অল্প একটু সুযোগ পেয়েই দোকানি মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘আমি আপনাকে জানিয়ে দিতাম বাবু। আপনার সময় নষ্ট করার দরকার ছিলো না।’

মৃত্যুঞ্জয় একটা আরও সিগারেট ধরিয়ে বলল- ‘এতক্ষণ যখন থেকেই গেলাম, তখন কাজটা শেষ করে যাওয়াই ভালো।’

দোকানির মুখটা শুকিয়ে গেলো। সে হয়তো ভাবলো মৃত্যুঞ্জয় নিজেই কাজটা সম্পন্ন করে তার থেকে সেই একশো টাকাটা ফেরত চেয়ে নেবে।
সিগারেটে দু’টো টান দিতেই পেছন থেকে এক বাইকের আওয়াজ পেলো মৃত্যুঞ্জয়। বাইকটা দাঁড়ালো দোকানের সামনে এসে। দোকানের পাশের দিকে আড়াল করে মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়েছিল। বাইকে যে বসে ছিলো সে যখন নিজের হেলমেটটা খুলল, তখন তাকে পরিস্কার দেখতে পেলো সে। দোকানি ঠিকই বর্ণনা করেছিলো। এতক্ষণে বাইকের নম্বরটা মৃত্যুঞ্জয় নিজের মোবাইলে নোট করে নিয়েছে । এক প্যাকেট সিগারেট কিনে যখন বাইকে বসে থাকা ছেলেটা পার্স বার করে টাকা দিতে যাবে, ঠিক তখনই মৃত্যুঞ্জয় দেখতে পেলো পার্সে এক জনের ভিজিটিং কার্ড। কার্ডে লেখা ছিলো- ‘পঙ্কজ চৌধরী, এডুকেশন ফর অল ইনস্টিটিউট, ১৬/বি, বোরিং রোড, পাটনা – ৮০০০০১।’
বলাই বাহুল্য মৃত্যুঞ্জয় পুরো ঠিকানাটা নিজের মোবাইলে টুকে নিলো।
সে ছেলেটা সিগারেটের মূল্য দিয়ে বাইক স্টার্ট করে চলে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে। তার চলে যাওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় দোকানিকে আবার একশো টাকা দিয়ে বলল- ‘আমি যে তার বাইকের নম্বর নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সে খবর যেন ঘুণাক্ষরেও তার কানে না যায়।’
দাঁত বার করে দোকানি টাকা নিয়ে বলল- ‘কিসি কো নাহি বোলেংগে বাবু। কিসি কো নাহি।’
মৃত্যুঞ্জয় বাড়ি ফিরলো তখন রাত সাড়ে আটটা। ঘরে ঢুকেই ফোন করলো সুপ্রতীক অধিকারীকে। বলল- ‘তোর পৈতৃক বাড়ি এটা। তুই বহু বছর থেকেছিস এখানে। তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ সুপ্রতীক জবাব দিলো।
‘পাটনাতে কোনো পুলিশ অফিসারের সাথে তোর পরিচয় আছে?’
‘হঠাৎ তোর পাটনাতে পুলিশের কি দরকার পড়লো?’
‘দরকার আছে বস, দরকার আছে। আর.টি.ও. থেকে একটা বাইক নম্বরের ডিটেলস নিতে হবে। বাইকটা কার এবং তার বাড়ির ঠিকানা। পারবি?’
‘কোনো গন্ডোগোল বেঁধেছে কি?’
‘না। চিন্তা করিস না। গন্ডোগোল বাঁধলেও মৃত্যুঞ্জয় আছে এখানে।’
‘জানি তুই গন্ডোগোল বাঁধতে দিবি না। দে, নম্বরটা দে। কালকের মধ্যে ডিটেলস পেয়ে যাবি।’
‘গুড।’
মৃত্যুঞ্জয়ের নম্বর দিয়ে ফোন রাখতেই ঘরে ঢুকলো অন্বেষা।
‘কোথায় ছিলে তুমি মৃত্যুঞ্জয়দা? প্রায় দু’ঘন্টা ধরে তোমার অপেক্ষা করছি।’ কথাটা বলে একটা চেয়ারে বসলো অন্বেষা।
‘কাজে গিয়েছিলাম। অত্যন্ত দরকারী কাজে।’ একটা সিগারেট ধরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল। চলে গেলো খোলা জানালার কাছে।
‘গতকাল রাতে প্রতীকের হাতে চোট লেগেছে।’ অন্বেষা বলল।
‘জানি। হাতের পাতায়। মোটা করে ব্যান্ডেজ বেঁধে আছে সেখানে।’ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
অবাক কন্ঠে অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো- ‘তুমি কী করে বুঝলে? দেখেছো নাকি তাকে?’
‘হুম। তার বাড়ির কাছেই ছিলাম। তোমাকে যা খোঁজ নিতে বলেছিলাম নিয়েছ?’
‘নিয়েছি।’ অন্বেষা বলল- ‘প্রতীক নেলসনের বাড়ি সমস্তিপুরে সেটা তোমাকে আগেই বলেছি। বাড়িতে থাকেন তার বাবা জোসেফ নেলসন। মা নেই, হয়তো মারা গেছেন। এক সরকারী স্কুলের টিচার ছিলেন তার বাবা। রিটায়ার করে এখন বাড়িতেই থাকেন। এই নাও বাড়ির ঠিকানা।’ একটা কাগজ অন্বেষা এগিয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
কাগজটা হাতে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘জোসেফ নেলসন কোন স্কুলে কাজ করতেন সেটা নিশ্চই জানতে পারোনি?’
মাথা নেড়ে না বলল অন্বেষা।
এক সাথে সিগারেটের তিন চারটে লম্বা টান দিয়ে সেটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। এগিয়ে এলো অন্বেষার পাশে রাখা কাঠের টেবিলের দিকে। প্যান্টের পকেট থেকে কাগজের টুকরোগুলো এবং আধ ছেঁড়া ছবিটা বার করে টেবিলে রেখে বলল- ‘এগুলো পেলাম প্রতীকের বাসস্থানের জঙ্গল থেকে।’
ঘাড় হেঁট করে সেগুলোর দিকে তাকালো অন্বেষা। আধ পোড়া কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল- ‘এগুলো তো মেডিকেলের বই মনে হয়ে।’
পরক্ষণেই তার নজর গেলো ছেঁড়া ছবিটার দিকে।
‘এই ছবিটা কি প্রতীকের বাবার?’ মৃত্যুঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘জানি না। নো আইডিয়া। হয়তো প্রতীকের বাবার, হয়তো তার সাথে যে থাকে তার বাবার। ছবিটা দেখে মনে হয়ে ভদ্রলোকের বিয়ের সময়ের ছবি। ছবির নিচেটা ভালো করে দেখো অন্বেষা। তারিখ লেখা ছিলো। ছবিটা ছেঁড়ার ফলে তারিখ বাদ পড়ে গেছে। কিন্তু সাল এখনও স্পষ্ট, ১৯৮৬।’
‘ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি দেখে তো খ্রিস্টান বলেই মনে হয়। কিন্তু প্রতীকের সাথে মুখের আদলের কোনো মিল দেখছি না।’ ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো অন্বেষা।

‘সব সময় এটা সম্ভব না যে ছেলের মুখের আদল বাবার সাথে মিলেই যাবে। প্রতীককে হয়তো নিজের মায়ের মতো দেখতে। কিম্বা কারুর মতো না।’ কথা শেষ করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়।

‘বেশ কিছু প্রশ্ন মনে খটকা দিচ্ছে অন্বেষা। প্রথমত, মেডিকলের বই সেখানে কী করছে? বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কেন? নিজের শরীরের চোটের চিকিৎসা কি প্রতীক নিজেই করে? তাহলে যখন তার মাথা ফাটে তখন স্টিচ করে কে? গত রাতেই বা পরিপাটি করে তার হাতে ব্যান্ডেজ কে বেঁধে দিলো? তোমাদের অফিসে ছেলেদের সংখ্যা নিশ্চই কম নয়। তাহলে রাধিকা প্রতীককেই কেন ভালোবাসলো? দ্বিতীয় ছেলেটাই বা কে? অবশ্য সেই ছেলেটার বিষয় আগামী কাল ইনফরমেশন পেয়ে যাবো।
অনেক প্রশ্ন অন্বেষা, অনেক প্রশ্ন।’
হঠাৎ অন্বেষার দিকে ফিরে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘তোমাদের অফিসের লাঞ্চ টাইম কখন হয়?’
‘দু’টো।’ জবাব দিলো অন্বেষা।
‘ঠিক আছে। কাল লাঞ্চ টাইমে তোমাদের অফিস যাবো। প্রতীকের সাথে কথা হলে ভালো, নাতো রাধিকার সাথে কথা বলবো। রাধিকাকে একবার ঝাঁকিয়ে দেখা যাক, যদি কিছু বেরিয়ে আসে।’
অন্বেষার অফিস এক্সিবিশন রোডে। এক বহুতল অট্টালিকার ছ’তলায় তাদের অফিস। দুপুর দুটোর আগেই মৃত্যুঞ্জয় সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ঠিক দুটোয় অন্বেষার ফোন এলো মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলে।
‘অফিসে চলে এসো মৃত্যুঞ্জয়দা। ক্যান্টিন আছে। এখানেই খেয়ে নেবো।’
ক্যান্টিনে অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়ের আলাপ করালো রাধিকার সাথে। অন্বেষার বয়সী রাধিকা। উচ্চতা অন্বেষার থেকে অল্প কম হলেও মুখশ্রী খুব সুন্দর। গায়ের রং বেশ ফরসা। খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় রাধিকাকে বলল- ‘দেখুন, আমি আপনাকে আগেই বলে দিতে চাই যে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞেস করবো। আমার যত দূর মনে হয়, যে ব্যাপারে তদন্ত করতে আপনি এবং অন্বেষা এগিয়েছেন সেটা খুবই গুরুতর এবং জটিল । একটা মানুষের শরীর চোটের কারণে যদি দিনে দিনে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়, তাহলে সেটার শেষ পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে। যদি সত্যি প্রতীক কোনো বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাহলে সেই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করা আমাদের কর্তব্য। আর সেই কারণেই আপনাকে যে প্রশ্নগুলো করবো তাতে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নও হতে পারে । আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না।’

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলো মৃত্যুঞ্জয়। রাধিকা যে একটু ঘাবড়ে গেলো সেটা বলাই বাহুল্য। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো অন্বেষার দিকে। অন্বেষা বলল- ‘নির্দ্বিধায় উত্তর দে রাধিকা। প্রতীককে তুইও বাঁচাতে চাস আর আমরাও।’
সামনে রাখা জলের গেলাস থেকে দু’ঢোঁক জল পান করে মৃত্যুঞ্জয়কে রাধিকা বলল- ‘বলুন।’
‘কত দিনের পরিচয় আপনার প্রতীকের সাথে?’
‘প্রায় চার মাস। ছ’মাস আগে সে অফিসে জয়েন করেছে। তখন বেশি কথা হতো না তার সাথে। তারপর আস্তে  আস্তে বন্ধুত্ব হয়।’ রাধিকা বলল।
‘যত দূর জানি প্রতীক মিশুকে নয়। আপনার সাথে তার ঘনিষ্টতার বিশেষ কারণ?’
‘আমাদের একে অপরের সঙ্গ ভালো লাগে।’
‘তাহলে তো অনেক কথাই সে আপনাকে বলেছে নিশ্চয়ই। যেমন নিজের শরীরে চোটের কারণের বিষয় আপনাকে বলে থাকতে পারে।’
মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় মাথা গরম হলো রাধিকার। বিরক্তির স্বরে বলল- ‘যদি কারণটা আমি জানতাম তাহলে রাতে এতো রিস্ক নিয়ে তার বাড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকতাম না।’
‘তাও ঠিক। আচ্ছা, এতো ছেলে আপনাদের অফিসে আছে, আপনার প্রতীককেই কেন পছন্দ হলো? মানে …. প্রতীক তো সাধারণ ছেলেদের মতো না।’
মৃত্যুঞ্জয় যে এ ধরনের কোনো প্রশ্ন করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি রাধিকা। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। বিস্ময়ের দারুণ কন্ঠরোধ হয়ে গিয়েছিল তার। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল- ‘ভালোবাসার পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না। যেখানে যুক্তি থাকে সেখানে ভালোবাসা থাকে না ।’
‘ভেরি গুড। আচ্ছা, আপনাদের দুর্বল মুহূর্তেও কিছু উল্লেখ করেনি প্রতীক?’
এবার আর থাকতে পারলো না রাধিকা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। প্রায় চিৎকার করে বলল- ‘কি ভেবেছেন আপনি নিজেকে? একটা মেয়ের অপমান করতে আপনার লজ্জা করে না? আমি আপনাকে চিনি না, জানি না, এ সব বাজে প্রশ্নের উত্তর দেবো কেন আপনাকে?’
‘রিল্যাক্স ম্যাডাম, রিল্যাক্স। প্লিজ বসুন। এটা আপনিও জানেন যে এ প্রশ্ন গুলো অত্যন্ত দরকারী। আপনি জানেন যে আমরা কেউ প্রতীকের খারাপ চাই না। তাই প্লিজ, মাথা গরম করবেন না।’ শান্ত কণ্ঠে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
অন্বেষা বোঝালো রাধিকাকে- ‘শান্ত হো রাধিকা। এ সব জানা খুব দরকার ছিলো মৃত্যুঞ্জয়দা’র জন্য। যখন সে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তখন তাকে কোঅপারেট করা কি আমাদের উচিত নয়?’
চেয়ারে বসলো রাধিকা। অর্ডার দেওয়া খাবার চলে এসেছে। তিনজনেই খেতে শুরু করলো। খাবার মাঝেই মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘প্রতীকের বাড়িতে যে ছেলেটা আসা যাওয়া করে তাকে কোনোদিন ভালো করে দেখেছেন?’

‘না।’ সংক্ষিপ্তে উত্তর দেয় রাধিকা।
‘আপনি কোনোদিন জিজ্ঞেস করেননি তার বিষয়?’
‘করেছিলাম। প্রতীক বলেছিলো যে তার পুরনো বন্ধু।’
‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
‘পাটলিপুত্র কলোনীতে।’
আর বিশেষ কিছু প্রশ্ন করলো না মৃত্যুঞ্জয়। লাঞ্চ শেষ হলো তাদের। হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয় দেখলো যে ক্যান্টিনের গেটে এসে হাজির হলো প্রতীক নেলসন। রাধিকার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘ভেবেছিলাম তোমার তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু দেখলাম পুরো লাঞ্চ আওয়ারটাই নিয়ে নিলে।’
গত সন্ধ্যের আলো আঁধারির মধ্যে প্রতীক নেলসনকে ভালো করে দেখতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। আজ ভালো করে দেখার সুয়োগ পেলো তাকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মাথার চুল, ক্লিন শেভ, কপালে ও দু’গালে অসংখ্য কাটা ও স্টিচের দাগ, বাঁ হাতের পাতায় এখনও পরিপাটি করে বাঁধা ব্যান্ডেজ। চেহারায় বিশেষত্ব বলতে এর থেকে বেশি উল্লেখ্যযোগ্য কিছু নেই।

‘নো ডিয়ার, আসলে অন্বেষার এক দাদা এসেছে। তাই দেরি হয়ে গেলো আর কি।’ রাধিকা এগিয়ে গেলো প্রতীকের দিকে। দুজনে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
লিফ্ট দিয়ে নীচে নামবার সময় মৃত্যুঞ্জয় অন্বেষাকে বলল- ‘তোমাকে এক দিনের ছুটি নিতে হবে অন্বেষা।’
‘কেন বলো তো?’
‘প্রতীকের অতীতের বিষয় জানা দরকার। সেটা জানতে পারবে যেখানে সে নিজের ছোট বেলা কাটিয়েছে সেখানে। মানে, সমস্তিপুরে। তোমাকে সমস্তিপুর যেতে হবে। প্রতীকের বাবার সাথে দেখা করতে হবে। তদন্ত যদি চালিয়ে যেতে চাও, তাহলে ছুটি নাও অফিস থেকে।’
ঈষৎ পান্ডুবর্ণ হয়ে গেলো অন্বেষার মুখ। নিচু গলায় বলল- ‘সে না হয়ে ছুটি নিলাম। কিন্তু …. কিন্তু আমাকে কি সমস্তিপুর একলা যেতে হবে?’
লিফ্ট থেকে বাইরে এলো তারা।
‘একজনকে সাথে লাগবে। তাই না?’ মৃদু হেসে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘শুধু তোমাকে। তুমি যখন এগিয়ে এসেছো, তখন থাকতে তো হবেই আমার সাথে।’ প্রতিউত্তর দিলো অন্বেষা।
‘হ্যাঁ ভালো কথা। সেই ছেলেটার নাম আর ঠিকানা জানা হয়ে গেছে।’
মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় চমকে উঠলো অন্বেষা।
‘তাই নাকি? দারুণ তো। কী নাম তার, কী করে সে?’
‘কী করে সেটা তো এখনও জানা যায়নি, তার নাম হলো বিকাশ পান্ডে। তুমি অফিসে যাও অন্বেষা। তোমার লাঞ্চ টাইম শেষ।’
বিকেল পাঁচটা বাজে যখন মৃত্যুঞ্জয় বোরিং রোডে ‘এডুকেশন ফর অল ইনস্টিটিউটে’ পৌঁছালো। চার তলা এক বাড়ির সম্পূর্ণ দু’তলাটা ইনস্টিটিউট। নীচে সারিসারি সাইকেল রাখা। বেশ কিছু অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা দু’তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো। নিজের নিজের সাইকেলের দিকে এগোলো প্রত্যেকে। একটা ছেলেকে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘পঙ্কজ চৌধুুুরীকে কোথায় পাবো?’
‘স্যার ক্লাসেই আছেন। জাস্ট একটা ব্যাচ শেষ হলো। এখনই শুরু হবে একটা।’ জবাব দিয়ে ছেলেটা নিজের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
দু’তলায় উঠল মৃত্যুঞ্জয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বাঁ দিকে একটা বড় হল ঘর, বেশ বড়। টেবিল চেয়ার পাতা ঘরময়। সামনের দেয়ালে ব্ল্যাক বোর্ড। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো ছাত্ররা নিজের নিজের স্থান গ্রহণ করছে। ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে পাতা চেয়ারে হাতে এক মোটা বই নিয়ে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। তিনি হয়তো পঙ্কজ চৌধুরী। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ ঊর্ধে, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, অর্ধেক থেকে বেশি সাদা। মাঝারি উচ্চতা, রোগা ছিপছিপে চেহারা এবং গায়ের রংটা একটু কালোর দিকে। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেলো তার দিকে। নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলো- ‘আপনি কি পঙ্কজ চৌধুরী?’
ভদ্রলোক খানিক হাঁ করে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
‘হ্যাঁ, আমি।’ চাপা কন্ঠে বললেন তিনি।
‘আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য ক্ষমা চাইছি, অত্যন্ত প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে একটু বাইরে আসবেন? দরকারী কথা আছে।’
ছাত্রদের অপেক্ষা করতে বলে পঙ্কজ চৌধুরী বেরিয়ে এলেন মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। সিঁড়ির মুখের কাছে দাঁড়িয়ে কথা হলো তাদের।
মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘জানি আপনার সময় অনেক মূল্যবান, তাই বেশি সময় নেবো না আমি। আমি শুধু এক জনের বিষয় জানতে আপনার কাছে এসেছি।’
‘কার বিষয়?’ পঙ্কজ জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনি বিকাশ পান্ডেকে চেনেন?’
‘বি….কা…শ পান্ডে!’ মনে করার চেষ্টা করলেন পঙ্কজ চৌধুরী।
‘হ্যাঁ, বিকাশ পান্ডে। বাড়ি দানাপুর, সগুনা মোড়। প্লিজ মনে করুন।’
‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আসলে বিকাশ পান্ডে নামের এক আরও ছাত্র ছিলো আমার । তাই গুলিয়ে ফেলছিলাম আর কি।’
‘কী জানেন তার বিষয়?’
‘বিকাশ ওয়াস এ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আপনি তো বুঝতেই পারছেন যে আমি সায়েন্স পড়াই। কেমেস্ট্রিতে খুব ভালো ছিলো সে। খুব ভালো বলতে এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্রিলিয়ান্ট। অনার্সে 80%এর ওপর নম্বর পেয়েছিল। তাতেও সে খুশি হয়নি। আমাকে বলেছিল সে নাকি আরও বেশি আশা করেছিল।’ উৎসাহিত হয়ে বললেন পঙ্কজ চৌধুরী।
‘সে এখন কী করছে?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘জানি না। দু’ হাজার বারোর ব্যাচ ছিলো। তার পর দুু’ এক বার দেখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে আর দেখা নেই।’
‘আচ্ছা, তাদের বাড়িতে কে কে আছে জানেন কী?’
‘না। তা জানি না।’
‘বাড়ির আর্থিক অবস্থার বিষয় কোনো ধারনা?’
খানিক ভেবে পঙ্কজ চৌধুরী বললেন- ‘আমার অনুমান আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। ইনস্টিটিউটের ফি জমা করতে প্রায় দেরি করতো। ভালো ছাত্র ছিলো, তাই আমি কনসিডার করতাম।’
‘তার বাবা কী করেন জানেন কী?’
‘না মশাই। বলতে পারবো না।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন। প্রতীক নেলসনের নাম শুনেছেন কী?’
ভদ্রলোক আবার চিন্তা করলেন।
‘না। শুনিনি।’
এক দীর্ঘস্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি আমার অনেক হেল্প করলেন।’
পঙ্কজ চৌধরী আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন- ‘বিকাশ কোনো প্রবলেমে নেই তো?’
‘এখন পর্যন্ত না। ধন্যবাদ, আসি।’ মৃত্যুঞ্জয় চলে গেলো সেখান থেকে।

 

চলবে……………

Exit mobile version