সেরা উপহার

সেরা উপহার
-রেহানা দেবনাথ

 

 

-“একই পাড়াতে বিয়ে হওয়ার জন্য দুজনে একটা গাড়ি বুক করে বাপের বাড়ি যেতে কত সুবিধা হয় বলতো দিদি,তা ছাড়া নিশ্চিন্তে দুই বোনে গল্প করতে করতেও যাওয়া যায়।” দেবযানী তার দিদি দেবললীনাকে গদগদ গলায় বলে।

-দেবলীনা মুখটা একটু বিকৃত করে বলে “সুবিধা না ছাই! ছোট একটা ট্যাক্সিতে ছয়টা বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আটজনে এক ঘন্টা এক সাথে যাওয়া কত যন্ত্রণার।”

-“সে কষ্টের হোক তবুও তো আনন্দ আছে, তা ছাড়া বড়দা আর মেজদা মিলে গাড়ির খরচটা দেয়, এর থেকে আর বেশি কি আশা করবো। বাস,ট্রেনে লোকের ধাক্কা খাওয়ার থেকে এটা তো ভালো!” উৎফুল্ল হয়ে দেবযানী বলে।

দেবলীনা রাগতস্বরে বলে-“তুই তো বলবিই! দাদাদের আদরের ছোটো বোন, তাদের চামচা!”

-“দেখ দিদি ভাইফোঁটার দিনে আর ঝগড়া করিস না! যদিও তোর স্বভাব আছে, প্রতি বছর গিফট নিয়ে যা রাগারাগি করিস” কঠোরভাবে বলে দেবযানী।

দেবলীনা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বলে- “কেন ঝগড়া করবো না! বড়দা,মেজদা, সেজদা তবুও তো দামী দামী উপহার দেয়, আর ছোড়দা পঞ্চাশ কিংবা একশ টাকা হাতে ধরিয়ে দেয় প্রতিবছর। আগে ছেড়ে দিতাম, এখন ছাড়বো কেন! নিজের বউ শালা শালীদের নিশ্চয় দামী জিনিস দেয়। আমাদের বেলায় যত গরীবিপনা।”

-“দুই দাদার চেয়ে ছোটদা সত্যিই তো গরীব। তার উপর নতুন সংসার করেছে, ওর কথাও তো আমাদের ভাবতে হবে!’ কাতর সুরে বলে দেবযানী।

কিছুক্ষণ পর দেবলীনা বলে “বোনরে আমার কোমরের থেকে পা দুটো প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে।”

-এই ব্যথাটার কথা তো তুই আগের বছর থেকেই বলছিস! ডাক্তার দেখাস নি?” প্রশ্ন করে দেবযানী।

দেবলীনা দুই হাত দিয়ে কোমরটা চেপে ধরে বলে “না।ব্যথার ওষুধ খেয়ে কমে যায়। ভেবে ছিলাম পুজোর পর যাবো।”

দেবযানী দিদির পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে “আর একটু ধৈর্য্য ধর দিদি মিনিট দশেকের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবো তখন পাড়ার গোপী ডাক্তার বাবুকে একবার দেখিয়ে নিবি।” গাড়ি বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেবলীনার ব্যাথা প্রচণ্ড বেড়ে যায়!যন্ত্রণার চোটে সে বাবারে মারে বলে কাতরাতে থাকে।দাদারা বোনের ওই অবস্থা দেখে কাছাকাছি নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা চলে। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যায়।তার ভিত্তিতেই ডাক্তারবাবু দেবলীনার বড়দাকে জানায় যে দেবলীনার দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিডনির ব্যবস্থা করা নয়তো রোগীকে বাঁচানো যাবে না। দেবলীনা কিছুই জানতে পারলো না সে শুধু জানলো যে রাতে তার অপারেশন হবে। তাই সে তার মাকে বলল “মা আমি দাদাদের এখানেই ফোঁটা দিতে চাই! যদি আর কোনোদিন দেবার সুযোগ না পাই।” বলতে বলতে দেবলীনা ও তার মা দুজনেই কাঁদতে থাকে। বিকেলে নার্সিং হোমে দুই বোনে মিলে দাদাদের ফোঁটা দিল। দুই দাদা যথারীতি দামী দামী উপহার দিলো, ছোটো দাদা এবার কিছুই দিলো না!
দেবলিনাও কিছু বললো না শুধু বললো  “এটা হয়তো শেষ ফোঁটা হতে পারে! তাতেও ফাঁকি দিচ্ছিস।”

ওর ছোট দাদা বললো “ফাঁকি নয় এবার তোর জন্য দামি ও সেরা উপহার আমিই দেব! একটু অপেক্ষা কর”, বলে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।দেবলীনা আশ্চর্য হয়ে গেল। অপারেশন হওয়ার পর পরের দিন দুপুরে দেবলীনার জ্ঞান ফেরে। বিকেলে বাড়ির সবাই দেখতে এলে সে সবাইকে দেখতে পায় ছোটদাকে ছাড়া! দুদিন পর দেবলীনা দেবযানীকে বলে”হ্যারে বোন দু দিন ধরে ছোটদা আমায় দেখতে এলো না! কোথাও কি গেছে নাকি আমাকে ভাইফোঁটার দামী উপহার দিতে হবে বলে দেখা করছে না।”

দেবযানী অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বলে “আর কত দামী উপহার নিবি! পৃথিবীতে এমন কোনো দাদা আছে কিনা আমার জানা নেই যে ভাইফোঁটায় তার বোনকে এত দামী উপহার দিয়েছে বলে!”

দেবলীনা আশ্চর্য হয়ে বলে- “আমাকে! কখন দিয়েছে!!”

-“তোর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ছোটদা নিজের একটা কিডনি দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছে আর নিজে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে ভিতরের রক্তপাত বন্ধ না হওয়ার জন্য” কথাটা বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে দেবযানী। দেবলীনা কি বলবে কি করবে বুঝতে পারে না! সে শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলে “আমাকে একবার ছোটদার কাছে নিয়ে চল, তার সেরা উপহার পেয়ে আমি কেমন খুশিতে আছি তাকে একবার দেখিয়ে আসি!!

Loading

Leave A Comment