মুক্তি
-প্রলয় কুমার নাথ
(১)
মোবাইলে এস.এম.এস-এর ইনবক্সে আসা ঠিকানাটাকে আরেকবার পড়ে নিয়ে, রাস্তার সামনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি। হ্যাঁ, এই বাড়িটার ঠিকানাটাই তো সেই ভদ্রলোক আমাকে মেসেজ করে পাঠিয়েছেন। আর কিছু না ভেবে আমি গিয়ে কড়া নাড়লাম সেই বাড়ির সদর দরজায়। কিছুক্ষণ পর, দরজা খুলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে, এসে দাঁড়ালেন একজন রোগা চেহারার বয়স্ক ভদ্রলোক। উনি কিছু বলার আগেই, আমি বলে উঠলাম,
– নমস্কার…..আমি সুবিনয় সেনগুপ্ত…..খবরের কাগজে আপনার দেওয়া বিজ্ঞাপনটা দেখে, আমি আজ সকালেই আপনাকে ফোন করেছিলাম, তখন আপনি এই ঠিকানাতে এসে দেখা করতে বলেন……আপনি নিশ্চয় রামচন্দ্রবাবু?
এবার হাসি ফুটে উঠলো ভদ্রলোকের মুখে, তিনি প্রতিনমস্কার জানিয়ে, সম্মতিসূচক ইঙ্গিত করে আমাকে বাড়িতে ভেতরে আসতে বললেন।
বাড়ির ড্রইং রুমে বসে ভদ্রোলকের সাথে কথা হচ্ছিল আমার। কিছুক্ষণ আগেই ধূমায়িত কফি আর বিস্কুটের ট্রে আমাদের সামনে রেখে গিয়েছে বাড়ির চাকর। কফির মাগে সশব্দে চুমুক দিয়ে, বেশ আয়েশ করে, রামচন্দ্রবাবু আমাকে বলে উঠলেন,
– তা মশাই-এর হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে বিষ্ণুপুরে যাওয়ায় মনোবাসনা হল কেন?
আমি উত্তর দিলাম,
– আসলে, আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পি.এইচ.ডি করছি, আমার গবেষণার বিষয়ের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে বাঁকুড়ার বিভিন্ন প্রাচীন রাজবংশ তথা তাদের শিল্প-সংস্কৃতির কথা……তাই…….
উনি বলে উঠলেন,
– বাহ, বেশ, বেশ……ঠিক আছে, আমার বাড়িটা তো ওখানে ফাঁকাই পড়ে আছে বেশ কিছু বছর ধরে, যবে থেকে ছেলে বৌমার সাথে আমি এই কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছি…..তা, আপনি কত দিনের জন্য ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতে চাইছেন?
আমি কফিতে একবার চুমুক দিয়ে বলে উঠলাম,
– এই ধরুন পাঁচ-ছয় মাস…..তার মধ্যেই গবেষণার জন্য সমস্ত দরকারি তথ্য জোগাড় করা হয়ে যাবে, আশা করি……
উনি প্রসন্নতার হাসি হেসে বললেন,
-ভালো কথা…..বাড়ি ভাড়া আর সিকুরিটি ডিপোজিট , কতো তো আপনাকে ফোনেই বলেছি, আর তা নিয়ে আপনার কোন সমস্যা নেই, সেকথাও জানিয়েছেন……তবে মশাই, ভাড়ার টাকাটা কিন্তু প্রতি মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে দিতে হবে, মনে থাকে যেন….…আপনি কাল থেকেই ওখানে শিফট করে যেতে পারেন, তবে তার আগে আপনার যে কোন একটা পরিচয় পত্রের ফটোকপি…..
আমি হেসে বলে উঠলাম,
-অবশ্যই….আমি ভুলিনি সেই কথা….আজকেই নিয়ে এসেছি সিকুরিটি ডিপোজিট আর পরিচয় পত্রের কপি…..তো, আর কিছু বলার আছে আপনার আমাকে?
এবার রামচন্দ্রবাবু বেশ গম্ভীর মুখে আমাকে বললেন,
-তবে….তবে, ওই বাড়ির পাশের বাড়িতে একজন ভদ্রলোক থাকেন, নাম মহিতোষ নন্দী, রামানন্দ কলেজের অধ্যাপক …….ওনাকে একটু সমঝে চলবেন, মশাই……
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
-কেন বলুন তো?
রামচন্দ্র বাবু বেশ চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-আসলে, কয়েক বছর আগে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওনার স্ত্রী মারা যান…..তারপর থেকেই কেমন যেন খেপাটে স্বভাবের হয়ে গেছেন উনি…..কলেজের সময়টুকু বাদ দিয়ে সর্বক্ষণ বাড়ির ভেতরেই থাকেন, পাড়ার কারোর সাথে তেমন কথাবার্তাও বলেন না, তাছাড়া……তাছাড়া…..
আমি কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলাম,
-তাছাড়া…..তাছাড়া কি?
রামচন্দ্র বাবু অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন,
-তাছাড়া তার স্বভাব চরিত্রও তেমন ভালো নয়……পাড়ার অনেকেই, বেশ কিছু বার, অচেনা মেয়েদের ওনার ঘরে যেতে দেখেছে!
আমি সহাস্য কণ্ঠে তাকে বলে উঠলাম,
-না না, রামচন্দ্র বাবু…..পাশের বাড়িতে কে কি করছে, তাতে আমার কি? ওসব নিয়ে আমার কোন অসুবিধাই হবে না….আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন!
(২)
বিষ্ণুপুরে অত্যন্ত মনোরম স্থানে অবস্থিত রামচন্দ্রবাবুর দোতলা হলুদ রঙের ছোট্ট বাড়িটা। তবে জায়গাটা বেশ নির্জন, আশে পাশে আর সেরকম কোন বাড়ি ঘর চোখে পড়ে না, শুধু ওই এক মহিতোষ নন্দীর বাড়ি ছাড়া। এই বাড়ির সামনে একটা বেশ বড় পুকুর, অন্য দিকে একটি দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, আর পেছনে এবং আরেক দিকে মহিতোষবাবুর বাড়িটা ছাড়িয়ে শুরু হয়েছে সুসুনিয়া পাহাড়ের পাথুরে জমি। দোকানপাট বা জনবসতি খুব একটা ধারে কাছে নেই, তার জন্য অনেকটা সময় ধরে হাঁটা পথ দিয়ে চলতে হয়……তাই বাজার হাট করাটা বেশ মুস্কিলের ব্যাপার এখানে। এই বাড়ির ডান দিকে, বাগানের কিছুটা অংশ পেরিয়ে গেলেই, শুরু হয়েছে মহিতোষ বাবুর বাড়ির জমির পাঁচিল। তার বাড়িটাও দোতলা, তবে বেশ বড় জায়গা জুড়ে অবস্থিত, পুরোনো আমলের বনেদি ধাঁচে গড়া। তবে, এখন তা খুব একটা দৃষ্টিনন্দন না হলেও, বেশ কিছু জায়গায় আধুনিক যুগের মেরামতির ছাপ লক্ষ্যনীয়।
বিকালের দিকে, যখন আমি বাগানের ভেতর একটু পায়চারি করছি, সেই সময়ই প্রথম দেখা হল মহিতোষ বাবুর সঙ্গে। ভদ্রোলকের বয়স পঞ্চাশের কাছে হলেও, তার চেহারা অত্যন্ত ঈর্ষণীয়…..লম্বা সুঠাম মেদহীন ফর্সা শরীরে বনেদি আভিজাত্যের ছটা স্পষ্ট, চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা, এবং ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি যেন তার পুরুষালি গাম্ভীর্যে আরো মাধুর্য এনেছে। তিনি বোধহয় কলেজ থেকে ফিরলেন, বাড়ির সামনে নতুন তৈরি গ্যারেজে গাড়িটা ঢুকিয়ে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেই আমার সাথে চোখাচোখি হল ভদ্রোলকের। আমি মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করলেও, উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, তারপর কোন কথা না বলে, ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতর। আমিও মুখ ফিরিয়ে বাড়ির ভেতর ফিরে আসতে যাবো, এমন সময় হঠাৎ আমার চোখ চলে গেল মহিতোষবাবুর বাড়ির দোতলার একটি ঘরের পেছনের খোলা জানলার দিকে……..দূর থেকে দেখে, এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, যে সেই জানলার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পোশাক পরিহিতা এক নারীমূর্তি! আমি চমকে উঠে আরেকবার ভালো করে চাইলাম সেই দিকে…..কিন্তু নাহ্…..এখন আর কাউকেই জানলার আড়ালে দেখতে পেলাম না! ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো আমার, মনে হলো হয়তো চোখের ভুল……তবে, রামচন্দ্রবাবুর কথা অনুযায়ী, বিপত্নীক মহিতোষ বাবুর বাড়িতে কোন মহিলার দেখা পাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়…..কিন্তু আমি যে নিজে চোখে দেখলাম, যে মহিতোষবাবু বাড়ির সদর দরজার তালা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন, আর সেই মুহূর্তে তার সাথে অন্য কেউ ছিলোও না…….তাহলে…..তাহলে কি উনি কোন মহিলাকে ওই বাড়ির ভেতরে রেখে, বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে বেরিয়েছিলেন! কিন্তু কেন?
সেদিন এই নতুন জায়গায় পৌঁছে, সবকিছু গোছগাছ করতে করতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় একটি হোটেল থেকে রাতের খাবারটা কিনে এনেছিলাম। সমস্ত দিনের ট্রেন জার্নির ধকলে বেশ ক্লান্ত হয়ে, তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু জানিনা কেন, ঘুম আসছিলো না দুই চোখে……রাত একটু বেশি হতেই শুরু হয়ে গেল প্রবল বজ্র- বিদ্যুৎ সহ ভারী বর্ষণ। আমার ঘরের বাইরে রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে ক্রমাগত বৃষ্টির শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ফাঁকা বাড়িতে একা আমি, আর তাছাড়া আজ সারা দিন ধরে লোড-শেডিং……এমন আবহাওয়ার মধ্যে কেমন যেন গা ছমছম করছিল আমার। মহিতোষবাবুর বাড়ির জানলায় দেখা সেই মেয়েটির দৃশ্যটাও যেন বার বার ঘোরাঘুরি করছিল চোখের সামনে! আচমকাই বৃষ্টির তেজটা যেন একটু বেড়ে গেল বোধহয়……আমার পাশের জানলা দিয়ে আসা বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যেতে লাগল বিছানার চাদর। আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলাম জনলার দুই পাল্লা।
ঘুমটা কতক্ষণ এসেছিল বলতে পারবো না, এমন সময় কিসের যেন একটা ঠক ঠক আওয়াজ শুনে খুলে গেল দুই চোখের পাতা। আরেকবার…..আরেকবার শুনতে পেলাম শব্দটাকে……বুঝতে বাড়ি রইলো না, যে শব্দটা আসছে ওই জানলার কাঁচের সার্সির বাইরে থেকে! কেউ যেন বাইরে থেকে ক্রমাগত আলতো হাতে ঠোকা মেরে চলেছে জানলার পাল্লার গায়ে! আতঙ্কে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল……আমি ধরফর করে বিছানা থেকে উঠে বসলাম…..তারপর ছুটে গিয়ে ব্যাগ হাতড়ে বার করলাম একটি মোমবাতি আর দেশলাই-এর বাক্স…..শব্দটা তখনও হয়ে চলেছে……আমি কম্পিত হাতে বেশ কয়েকটা দেশলাই-এর কাঠি নষ্ট করে, মোমবাতিটা জ্বালিয়ে ধরে একবার চেয়ে দেখলাম জনলাটার দিকে!……মোমবাতির কম্পমান আলো গিয়ে পড়ল বন্ধ জনলাটার গায়ে আর তাতে আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম……জানলার কাঁচের সার্সির বাইরে একটি হাতের ছায়া…..এই অন্ধকার ঘরের মোমবাতির ক্ষীণ আলোতেও দেখা যাচ্ছে তার সরু সরু পাঁচটা আঙুলের আকৃতি!……ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলে, আমি মোমবাতিটা হাতে করে, আরোষ্ঠ হয়ে দেওয়ালের গায়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম!
এবার এই হাতের তর্জনীটা ছাড়া অন্য আঙুলগুলো ভাঁজ হয়ে মুঠোর মধ্যে চলে এল…..ধীরে ধীরে তর্জনীটা স্পর্শ করল জানলার কাঁচের বাইরের পৃষ্ঠতলে…..তারপর যেন মনে হল, সেই বৃষ্টির জলে ভেজা কাঁচের বাইরে থেকে আঙ্গুল বুলিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছে সেই হাত!……আমি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইলাম সেই দিকে…..প্রথমে লেখা হল “ম”……তারপর “উ-কার”……তারপর “ক-এ ত-এ”…..এবং অবশেষে “ই-কার”……আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল সেই অশরীরি হাতের লেখা শব্দটি……”মুক্তি”!
(৩)
আমি কতক্ষন দেওয়ালের গায়ে এই ভাবে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, সম্বিত ফিরে এল, যখন হঠাৎ করে ঘরের আলোগুলো জ্বলে উঠল। তার মানে এতক্ষন পরে লোড-শেডিং-এর সমস্যা দূর হয়েছে। আমি সাহসে বুক বেঁধে, ছুটে গিয়ে তখনই খুলে দিলাম সেই জানলার দুই পাল্লা। বলাই বাহুল্য, জানলার বাইরে কাউকেই দেখতে পেলাম না। তবুও আমি হাল না ছেড়ে, তাড়াতাড়ি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম, পেছনের বাগানে, ঠিক ওই জনলাটার বাইরে। চারিদিকে নিশুতি রাতের গাঢ় অন্ধকার, বৃষ্টির দাপট অনেকটাই কমে গিয়েছে……এই বাড়ির পাশেই কষ্টি পাথরের তৈরি দৈত্যপুরীর মত দাঁড়িয়ে আছে মহিতোষ বাবুর বাড়িটা! কিন্তু, নাহ…..আঁধারের মধ্যে যতদূর দুই চোখ যায়, কাউকেই তো দেখতে পেলাম না। আমি চারদিকে তাকাতে তাকাতে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম বাগানের মধ্যে দিয়ে, মহিতোষ বাবুর জমির পাঁচিলের খুব কাছে। হঠাৎ সেই রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে, কানে যেন একটা অস্ফুট পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল, “আহহ আহহ…..”
আমার মনের কৌতূহল মাথায় একটি দুর্বুদ্ধি খেলিয়ে দিলো, আমি সন্তপর্নে পাঁচিল টপকে চলে এলাম মহিতোষ বাবুর বাড়ির খুব কাছে। তারপর সেই শব্দেকে অনুসরণ করে, তার বাড়ির একতলার একটি ঘরের পেছনের জানলার বাইরে দাঁড়াতেই সেই শব্দের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে এলো…..বন্ধ জানলার ট্রান্সলুসেন্ট কাঁচের সার্সির ভেতর থেকে, সেই ঘরের বিছানার ওপর শোয়ানো একটি নগ্ন নারীদেহের অস্পষ্ট আবছায়া দেখা যাচ্ছে, আর তার ওপর উপর হয়ে নিজের উলঙ্গ শরীরটাকে ক্রমাগত সামনে পেছনে দুলিয়ে চলেছে একজন দীর্ঘদেহী পুরুষ…….বুঝতে বাকি রইল না, যে তিনি হলেন মহিতোষ বাবু, আর তার কন্ঠ থেকেই আসছে ওই শব্দ। আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে তারাতারি নিজের ঘরে ফিরে এলাম। কিছুক্ষন আগেই সেই অশরীরির উপস্থিতির ভীতি যেন আমার মস্তিষ্কে আর নেই…..তার জায়গায় আমার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুতে যেন জমে উঠেছে কামোত্তেজনা! আমি কোন কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম….কিন্তু হঠাৎ একটা কথা মাথায় এল…..সঙ্গমের সময় কি শুধু পুরুষের গলা দিয়েই সুখের শব্দ উৎপন্ন হয়? কই, ওখানে তো কোন নারীর কন্ঠস্বর আমার কানে আসেনি!
(৪)
পরদিন সকালের দিকে, বিষ্ণুপুরের প্রাচীন কয়েকটা মন্দিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ঘর থেকে সবে বেড়িয়েছি, এমন সময় আবার চোখ চলে গেল মহিতোষ বাবুর বাড়ির দিকে। নাহ, এবার কোন নারীমূর্তি নয়…..এবার দেখতে পেলাম একজন বেঁটে কালো চেহারার পুরুষকে, সে যেন ফিসফিস করে কিসব কথাবার্তা বলছে মহিতোষ বাবুর সঙ্গে, সেই বাড়ির সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে! কিছুক্ষন পর, সে বেরিয়ে এলো সেই বাড়ি থেকে, আর মহিতোষ বাবুও বোধহয় কলেজের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে, অপর ব্যক্তিটি বাড়ির সামনের গলিটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই বাড়ির সামনে এসে, আমাকে দেখে কেমন যেন থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও কৌতূহলী হয়ে তার কাছে যেতেই, সে দাঁত বার করে একটি কুচ্ছিত হাসি হেসে আমাকে বলে উঠল,
– স্যারের কি এই বাড়িতে নতুন আসা হয়েছে নাকি?
আমি বললাম,
– হ্যাঁ, গতকাল থেকেই ভাড়া নিয়েছি একতলাটা……
সে আবার হেসে, দুই হাত কচলে আমাকে বলে উঠল,
– তা মশাই, বিয়ে-থা করেছেন, নাকি ব্যাচেলর?
আমি বিরক্তি ভরে বলে উঠলাম,
– না, বিয়ে করিনি…..কিন্তু প্রথমে বলুন আপনি কে? আর এই সব কেন জানতে চাইছেন?
সে অস্ফুট স্বরে, বেশ লোভনীয় কণ্ঠে বলে উঠল,
– স্যার, আমার নাম জগাই…..আ…আ….আমি, এই কাছেই, এখানকার এক রেড লাইট এলাকার দালাল……এই অঞ্চলের সবাই চেনে আমাকে……তাই, স্যার, বলছিলাম কি…..আমার হাতে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো ইয়ে আছে…..সবারই দুধে আলতা গায়ের রং…..আপনার লাগলে বলতে পারেন….
প্রথমে আমি চমকে উঠলাম এই কথা শুনে, তারপর বুদ্ধি করে, প্রসঙ্গ পাল্টে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– তা মহিতোষ বাবু তোমার সার্ভিসে স্যটিসফায়েড তো?
সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল,
– স্যটিসফায়েড বলে স্যটিসফায়েড……আরে মশাই, উনি তো আমার থেকেও আরো বড় দালাল……এই নিয়ে চারটে মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম ওনার ঘরে……উনি প্রচুর পয়সা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন তাদের…..তারপর তিনি বললেন, যে তিনি নাকি তাদের আরো বেশি দামে দুবাই-এর কোন এক ব্যবসায়ীর কাছে বেচে দিয়েছেন…..মেয়েগুলোর ভাগ্য সত্যিই ভালো স্যার, তারা তো ওখানে রাজরানী হয়ে আছে…..আর বোধহয় না এই দেশের মাটিতে কখনো পা ফেলবে তারা!
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
– তারপর সেই মেয়েগুলোর সাথে কি আর কোনোদিন কথা হয়েছিল তোমার?
সে হেসে বলল,
– ধুর স্যার, কি যে বলেন…..আমি মাল দিয়েছি, পয়সা পেয়েছি, খেলা শেষ…..আর আমার কি দরকার তাদের খোঁজ নেওয়ার!
আর কয়েকটা সামান্য কথাবার্তা বলে চলে গেল জগাই, যাওয়ার আগে আমাকে বার বার বলে গেল, যে “ইয়ের” দরকার হলে তাকে যেন অবশ্যই জানাই। আমি সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে রইলাম তার দিকে!
(৫)
সেদিন বিকালের দিকে ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, তখনও বুঝতে পারিনি, যে সেদিনই হবে এই নাটকের যবনিকা পতন…….আর যে ঘটনার সম্মুখীন আমাকে হতে হবে, তা সারা জীবন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে! সেদিন বাড়ির সদর দরজার তালা খুলতে যাবো, এমন সময় নাকে গেল, কেমন যেন একটা কেমিকেল আর আঁশটে গন্ধের মিশ্রণ! চারিদিকের হওয়া-বাতাসও যেন গুম মেরে গেছে, কেমন যেন একটা ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া চারিদিকে! কিন্তু বুকটা ধক করে উঠল তখন, যখন মহিতোষ বাবুর বাড়ির ছাদে দেখা মিলল, সেই গতকাল দেখা নারীমূর্তির! এবার কিন্তু সেই দৃশ্য পরমুহূর্তে অদৃশ্য হল না…..সেই মেয়েটি একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে উঠল!
দুরু দুরু বুকে, আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিক পানে……এবার সেই মেয়েটি আমাকে আঙ্গুলের ইশারায় সেই বাড়ির ছাদের নিজের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করল। সদিকে তাকাতেই, সেই বাড়ির দোতলার ঘরের একটি জানলা হঠাৎ খুলে গেল……আর সেখানে দৃশ্যমান হয়ে উঠল আর এক নারীমূর্তি। আমি অবাক চোখে চেয়ে দেখলাম, যে এই দ্বিতীয় মেয়েটি তার হাতের ইশারায় আমাকে আবার নিচের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করছে!……আর ঠিক সেই মুহূর্তে খুলে গেল, সেই বাড়ির এক তলার ঘরের আরেকটি জানলা। আমি আতঙ্ক সহ্য করবার পরীক্ষা দিতে দিতে দেখতে পেলাম, এই জানলার পেছনেও দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি মেয়ে! এই তৃতীয় মেয়েটি আমাকে আবার ইঙ্গিত করল তার ডান দিকে তাকাতে। আর সেই মুহূর্তে, আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, যে সেই বাড়ির সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি মেয়ে। এই চতুর্থ মেয়েটি মহিতোষ বাবুর বাড়ির তালাবন্ধ সদর দরজার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করল! আমি আর একটুও সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলাম সেদিকে…….. তারপর নিচ থেকে একটি পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে কয়েকবার তালাটার গায়ে আঘাত করতেই, সেটা সশব্দে খুলে পড়ে গেল দরজা থেকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই, পেছন ঘুরে আর দেখতে পেলাম না সেই মেয়েটিকে।
আমি রুদ্ধশ্বাসে ঢুকে পড়লাম মহিতোষ বাবুর বাড়ির ভেতরে……তারপর সেই অদ্ভুত আঁশটে গন্ধটাকে অনুসরণ করে, সিঁড়ি দিয়ে ছুটে উঠতে লাগলাম ওপরের দিকে…….এখানে সেই গন্ধটার তীব্রতা আরো বেশি, আমি রুমাল বার করে নাকে চাপা দিয়ে দোতলার একটি ঘরের ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে, সেই ঘরের দৃশ্য দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম!…….সেই ঘরের চারপাশে, চারটে বড় বড় তরল পদার্থে ভরা কাঁচের বাক্সের প্রতিটার মধ্যে রাখা রয়েছে একটি করে নগ্ন নারীর শরীর! দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যে বহুদিন আগেই মারা গিয়েছে মেয়েগুলি, তাদের পেট কেটে থেকে নাড়িভুড়ি বার করে নিয়ে, তারপর সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের দেহ…..এবং সেগুলিকে ফরমালিন বা ওই জাতীয় কোন এমবালমিং তরলের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে, যাতে মরদেহে কোন পচন না ধরে! কিছুক্ষন বিহ্বল হয়ে থেকে, নিজের মনেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম আমি,
– তার মানে…..তার মানে, মহিতোষ বাবু……একজন নে…নে….….
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার পেছন থেকে একটি গুরুগম্ভীর পুরুষকণ্ঠ ভেসে এলো,
– নেক্রফিলিয়াক……তাই তো? হ্যাঁ, এই শব্দটাই ব্যবহার করা হয় তাদের জন্য, যারা মৃতদেহের সাথে সহবাস করে মানসিক শান্তি পায়!
আমি পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, যে দুই হাত দিয়ে একটি রিভলবার ধরে, আমার দিকে সেটা তাক করে, মুখে ক্রুর হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মহিতোষ বাবু!
আমি কিছু বলার আগেই তিনি উন্মাদের মত বিকট হেসে বলে উঠলেন,
– আসলে কি জানেন তো মশাই, এইসব সুন্দরী মেয়েগুলোর রূপ যৌবন আর কতদিন থাকবে, বলুন? বয়স হলেই তো সব শেষ……তাই আমি ওদেরকে মেরে, ওদের শরীরগুলো এই ভাবে প্রিসার্ভ করে রাখি…..যাতে জীবন ভর ওদের শরীর একই রকম যুবতী অবস্থায় থাকে…..যাতে আমি সারা জীবন ওদের এই সুন্দর শরীরগুলো ভোগ করে যেতে পারি……এই কথা আর কেউ জানে না, শুধু এখন আপনি জেনে গেলেন……তাই, আপনাকেও আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না….কিছুতেই না……সো গেট রেডি টু ডাই…….হাহাহাহা…..
উনি হিংস্র মুখে রিভিলবারের ট্রিগারে চাপ দিতে গেলেন……সাক্ষাৎ মৃত্যুকে নিজের সম্মুখে দেখে সভয়ে এক পা পিছিয়ে এলাম আমি…..ঠিক এমন সময়…..হঠাৎ জ্বলা নেভা করতে শুরু করল সেই ঘরের লাইট…..আর সেই ক্ষণিক আলো ক্ষণিক অন্ধকারের ছন্দের মধ্যেই, আমি দেখতে পেলাম……যে মহিতোষ বাবুর চারপাশে এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই চার নারীমূর্তি! তারা রক্তহীন নিষ্পলক চোখে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে! ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে যেতে লাগলো তার কাছে…..আরো কাছে……আতঙ্কে একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলেন মহিতোষ বাবু, তার হাত থেকে নিচে পড়ে গেল রিভলভারটা…….কিন্তু তার চিৎকারকেও ছাপিয়ে গেল, সেই চার অশরীরি নারীর সমবেত কণ্ঠস্বর,
– মুক্তি……মুক্তি চাই, মুক্তি!……মৃত্যুর পরেও, নিজের শরীরের ওপর এই নরপিশাচটার দেওয়া নরক যন্ত্রনার জ্বালা থেকে মুক্তি চাই……মুক্তি!
আর দেরি করলাম না আমি, তখনই সামনে থেকে তুলে নিলাম, কোন শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি একটি ফুলদানি……তারপর ছুটে গিয়ে সেটাকে দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম সেই চারটে কাঁচের বাক্সের গায়ে….সঙ্গে সঙ্গে কাঁচ ভেঙে, ঘরের মেঝের ওপর ছড়িয়ে গেল বাক্সগুলির ভেতরে থাকা সেই তরল পদার্থ…..চারটে মেয়ের মৃতদেহও বেরিয়ে এলো বাক্সের ভেতর থেকে। আমি জানতাম, যে ফরমালিন থাকার দরুন, এই তরলটি খুব সহজেই আগুনে জ্বলে ওঠে! আমি ছুটে গিয়ে চলে গেলাম সেই ঘরের দরজার কাছে…..তারপর পকেট থেকে সিগারেট ধরাবার দেশলাই-এর বাক্সটা বার করে, একটি কাঠি ধরিয়েই, ছুঁড়ে দিলাম সেটা ঘরের মেঝে লক্ষ্য করে……সাথে সাথে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল গোটা ঘরটা…..মহিতোষ বাবু চেষ্টা করলেন ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু তাকে ঘিরে রাখা সেই চার প্রেতাত্মার বন্ধন তিনি ছিন্ন করতে পারলেন না! কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই চারটে লাশের গা থেকে, আগুন স্পর্শ করল তার জীবন্ত শরীরটাকে…..কিন্তু তখনও তাকে ঘিরে রেখেছে সেই চার প্রতিশোধকামী প্রেতাত্মা!……..আমি সেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেলাম, দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার আগে, মহিতোষ বাবুর কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা শেষ আর্তনাদ! মনে মনে বলে উঠলাম আমি,
– ওই চার নারীর প্রেতাত্মার সাথে সাথেই, আজ এই পৃথিবী থেকে মুক্তি পেল আরেকজন নররূপী দুরাত্মা!
(সমাপ্ত)