Site icon আলাপী মন

কলঙ্ক বাহিনী

কলঙ্ক বাহিনী
-প্রলয় কুমার নাথ

 

 

(পর্ব-১)

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়ে, বেশ কয়েক বছর বেকার হয়ে বাড়িতে বসে থাকার পরও, যেদিন শিক্ষকতার চাকরির নিয়োগ পত্রটা হাতে পেলাম, সত্যি বলছি, খুব যে খুশি হয়ে উঠেছিলাম, তা কিন্তু নয়! যদিও বা এখনকার দিনে সরকারি চাকরির মহিমা অনেক, তবুও যেন একটা পিছুটান লেগেই ছিল মনে। এর একমাত্র কারণ হল আমার হবু কর্মস্থলের অবস্থান। আমি নিযুক্ত হয়েছিলাম সুদূর বীরভূমের সোনাঝুড়ি গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে, বলাই বাহুল্য, যে সেটা কলকাতা থেকে এতটাই দূর, যে সেখান থেকে নিয়মিত যাওয়া আসা করা সম্ভব নয়। একবার মনে হয়েছিল, যে এতদিন যেমন বাড়িতে ছাত্রদের টিউশন পড়িয়ে কাটাচ্ছিলাম, সেরকমই চলুক না, এই আয়-ও তো স্কুল শিক্ষকের মাইনার থেকে খুব একটা কম নয়, তার কারণ গৃহ শিক্ষক হিসাবে আমি পাড়ায় বেশ ভালোই পসার জমিয়ে ফেলেছিলাম।

কিন্তু, মা এই ব্যাপারে কোন নিজস্ব মতামত না দিলেও, বাধ সাধলেন আমার বাবা। তার সাফ কথা,
– পাগল হয়েছিস নাকি, এমন সুখের সরকারি চাকরি কেউ ছেড়ে দেয়!……এই টিউশন পড়ানোর কোন নিশ্চয়তা আছে?……আমরা আর ক’দিন আছি, ছেলে শুধু টিউশন পড়ায়, এই কথা শুনলে কেউ মেয়ে দেবে আমাদের ঘরে!…….এই হয়েছে এখনকার ছেলেদের দোষ…..আরে, আজকালকার মেয়েরাও কত হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছে, আর তুই সেই কুয়োর ব্যাঙ হয়েই রইলি!
বাপের এই অকাট্য যুক্তিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা বা সাহস, কোনোটাই আমার ছিল না, তাই অগত্যা একদিন লোটা-কম্বল গুটিয়ে বেরিয়েই পড়লাম নতুন কর্মস্থলে উদ্দেশ্যে। কিন্তু হ্যাঁ, সেদিন যদি বাবার কথা না মেনে, ওই “কুয়ো”-তেই পড়ে থাকতাম, তাহলে আমার আর্থিক অবস্থা এখনকার থেকে আলাদা হত কিনা বলা মুশকিল……তবে সেই অচেনা স্থানে গিয়ে যে অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার, তা হয়তো আজ আপনাদের বলা হত না!

বীরভূমের এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ভরপুর গ্রামটির কথা আপনারা অনেকেই নিশ্চয় শুনেছেন। এই গ্রামের থেকেও বিখ্যাত এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কোপাই নদী……ছোটবেলা থেকেই অনেক পড়েছি এই নদীর সম্বন্ধে……ময়ূরাক্ষীর এই ছোট উপনদীটি বর্ষাকালে বানভাসি হয়ে উঠলেও, গ্রীষ্মকালে একেবারেই শুকিয়ে যায়। এই নদীর অববাহিকায় মাটির রং লাল। এই মাটিতে ভূমিক্ষয়ের ফলে যে ছোটো ছোটো খাত সৃষ্টি হয়েছে, তা খোয়াই নামে পরিচিত। এছাড়াও, এই নদীর বাঁকগুলি অনেকটা হাঁসুলির আকৃতিবিশিষ্ট…….এই সব অনেক কথা মনে পড়ে যায় কোপাই-এর নাম শুনলেই!……তবে, সেখানে থাকার জায়গা খুঁজতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। পুরো গ্রাম জুড়েই খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট মাটির বাড়ি, লাল মেঠো পথ আর শাল সেগুনের জঙ্গল…..আর হোটেল রিসোর্ট যা আছে, তাতে থাকা যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ। যাই হোক, ভাগ্য কিঞ্চিৎ ভালো থাকায় একেবারে নদীর ধরেই একটি বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেলাম। বেশ নিরিবিলি নিঝঞ্ঝাট জায়গা……আসে পাশে খুব একটা বাড়ি ঘর নেই। একতলা ছোট পাকা বাড়ি, বাড়ির মালিক তার কলকাতায় চাকুরিরত ছেলের কাছেই থাকেন। রান্নার কাজের জন্য ঠিক করা হল এই গ্রামেরই একজন বয়স্ক লোককে, যার আসল নাম আমি জানিনা, তবে গ্রামের সকলে তাকে “হাবুদা” বলে ডাকে, হয়তো সে একটু হাবা বোবা সেই জন্যই!

সেই বাড়িতে প্রথম দিন সব কিছু গোছ গাছ করতে করতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার সময়, হঠাৎ, হাবা বোবা হাবু বেশ সবাক হয়েই, মুখটা কিঞ্চিৎ কাচু মাচু করে বলে উঠল,
– কিছু মনে যদি না করেন…..তবে একটা কতা বলি বাবু…..
আমি বেশ আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলাম,
– কি কথা বল…….
হাবুর মুখে বেশ একটা আতঙ্কের ছাপ আমি স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, সে কোনো মতে বলে উঠল,
– আজ্ঞে, রাত বিরেতে খুব একটা বাইরে বেরোবেননি যেন, বাবু……এই জায়গাটা খুব একটা ভালো নয় কো!
আমি আরো বিস্মিত হয়ে বলে উঠলাম,
– কেন গো…..এত সুন্দর শান্ত পরিবেশ…..সামনেই নদী…..তাহলে কেন ভালো নয় এই জায়গাটা?
হাবু যেন কিছু বলতে গিয়েও চেপে গেল, শুধু একবার ঢোক গিলে বলে উঠল,
– না মানে…..তেমন কিছুই নয়….ওই অনেকেই অনেক কতা কয় কিনা……
আমিও ছাড়বার পাত্র নই, সটান তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কে কি কথা বলে এই জায়গাটার সম্বন্ধে…..সব কিছু স্পষ্ট করে বল হাবু…..
কিন্তু হাবু যেন অস্থির হয়ে বলে উঠল,
– সে সব কতা আমি এই ভর সন্দে বেলায় বলতে পারবুনি, কত্তা…..চলি আমি….আপনি দরজাখানা ভালো করে বন্দ করি দেন…..
এই বলে সে চম্পট দিল। আমি দুই তিন বার তার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু সে পেছন ফিরে চাইল অবধি না…….ভারী আশ্চর্য তো! এই ভর সন্ধ্যা বেলায় সে কিসের ভয় দেখিয়ে গেল আমায়? মনে মনে ভাবলাম, কাল কাজে আসুক তো ও, তারপর হচ্ছে ওর!

সেদিন তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে, ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় চলে গেলেও ঘুম এল না। এখন বর্ষা কাল, সেই বিকাল থেকে কিছুক্ষণ আগে অবধি বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তাই কোপাই নদী এখন বেশ স্রোতস্বিনী। কানে ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক, আর নাকে ভিজে লাল মাটির সেই সোঁদা সোঁদা গন্ধটা যেন কিছুতেই ঘুমোতে দিচ্ছিল না আমাকে। এছাড়াও ঘরের মধ্যে রয়েছে একটা বেশ গুমোট ভাব। তাই মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা হচ্ছিল, একবার দরজা খুলে বাইরে নদীর ধার থেকে ঘুরে আসতে। কিন্তু হাবুর সেই সতর্ক বার্তাও মনে পড়ে গেল……আর সেই জন্যই বোধহয় এই রাত্রিকালীন নদীর শোভাটা দেখে আসার মনোবাসনাটা আরো তীব্র হয়ে উঠল! আর অন্য কোন কিছু না ভেবে, আমি বিছানা থেকে উঠে, দরজা খুলে বেরিয়ে বেরিয়ে গেলাম ঘরের বাইরে!……প্রকৃতির এই স্নিগ্ধ রুপোলি নৈশ্য রূপ যেন আমি আর আগে কোথাও দেখিনি……পূর্ণিমার চাঁদের আলোর রেশ নদীর শান্ত দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশিকে কি অবর্ণনীয় শোভায় আলোকিত করে রেখেছে! নিজেকে খুব বোকা মনে হল আমার….ওই ফাজিল হাবুর কথা শুনে নিজেকে এতোক্ষণ ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার জন্য! তবে একটা কথা ভেবে একটু খটকা লাগল, যে প্রকৃতির এই মায়াবী রূপ পরিদর্শন করার জন্য আমি বাদে আর বোধহয় কোন জনপ্রাণীই ধারে কাছে নেই!

সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, নদীর সামনের বাঁকেই বাধা রয়েছে একটি ছোট্ট কাঠের নৌকা, তবে তার ধারে কাছে তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। একটা দুর্নিবার ইচ্ছা যেন তখুনি মনে জেগে উঠল আমার…..এই চাঁদনী রাতে খোলা হওয়ায় যদি একবার এই নৌকায় চেপে নদীর বুক থেকে ঘুরে আসা যায়, তাহলে কেমন হবে!…….কিন্ত, হায় রে, নৌকা তো আছে…..মাঝি কই! …..আমি বেশ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম, নদীর ঢালু পার দিয়ে বনঝোপ মাড়িয়ে সাবধানে হেঁটে, সেই নৌকাটার কাছে! কই, এখানেও তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না!….কে এই নৌকার মালিক, কে জানে?…..ঠিক সেই মুহূর্তে, আমার মাথায় একটা বদ বুদ্ধি খেলে গেল, নেহাৎ মজা করার জন্যই, আমি এক লাফে চড়ে উঠলাম নৌকাটার ওপর। যদিও আমি নৌকা চালাতে জানি না, তবুও এই বেঁধে রাখা নৌকার ওপর উঠেও বেশ আনন্দ হচ্ছিল মনে। এমন সময়…….হঠাৎ……সেই নৌকাটার ছাউনির পেছন থেকে একটা বেশ ভারী পুরুষ কন্ঠ কানে এল,
– বাবুর বোধহয় এই অঞ্চলে নতুন আসা হয়েছে?
আমি চমকে উঠে ঘাড় ঘোরালাম পেছন দিকে!

(পর্ব-২)

 

এই জনমানবশূন্য নদীর পারে, এই মায়াবী রাতের অন্ধকারে, হঠাৎ এই কথা শুনে, কেন জানিনা, বুকটা বেশ শিউরে উঠল আমার। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখলাম, যে নৌকাটার ছাউনির পেছন দিক থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে একটি পুরুষের ছায়ামূর্তি! সে আমার একটু কাছে এলে, এই চাঁদের আলোয়, স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি তাকে…….সাধারণ লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত বেশ লম্বা মেদহীন সুঠাম চেহারার অধিকারী এই পুরুষটিকে। সে আবার হেসে আমায় বলে উঠল,
– কি বাবু, আমাকে ভূত ভেবে ভয় পেলেন নাকি?……তবে আমি কিন্তু ঠিকই ধরিচি, আপনি এই গাঁয়ে নতুন মানুষ…….
আমি নিজের বিস্মিত ভাবটাকে যথাসম্ভব লুকিয়ে, একটু কৃত্রিম ভাবে মৃদু হেসে বলে উঠলাম,
– হ্যাঁ…..ঠিকই ধরেছ তুমি…..আমি এই গ্রামে নতুন এসেছি…..গ্রামের স্কুলে শিক্ষকের চাকরি নিয়ে……তা তুমি কে ভাই?
সে হাত জোড় করে আমায় প্রণাম ঠুকে বলে উঠল,
– পেন্নাম হই কত্তা, পেন্নাম হই………..আমার নাম ছিদাম…..সবাই আমায় ছিদাম মাঝি বলেই চেনে…..
এবার আমার কাছে স্পষ্ট হল পুরো ব্যাপারটা, আমি নিশ্চিন্ত মনে তাকে প্রশ্ন করলাম,
– তা শ্রীদাম ভাই……আমার বাড়ির কাজের লোকটা বলছিল, যে এই জায়গাটা নাকি ভালো নয়……রাতের বেলা নাকি এই নদীর ধারে আসতে নেই…..এমন কেন গো?
শ্রীদাম মৃদু হেসে বলল,
– আসলে বুঝতেই পাচ্চেন কত্তা, এরা সবাই গ্রামের মুক্ষু সুক্ষু লোক…..রাতের বেলায় তো এই নদীর ধারে কেউ খুব একটা আসে না…..তাই নানা লোকে নানা কথা কইতে ভালোবাসে, তাছাড়া এই জায়গাটাতে রাতে সাপখোপের ভয়..…..আপনি এই সব নিয়ে ভাববেননি বাবু……

ঠিক এমন সময় দেখতে পেলাম, যে নদীর পার দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটি নারীমূর্তি……সে এই নৌকার কাছেই এসে দাঁড়ালো! শ্রীদাম তাকে হাত ধরে নৌকার ওপরে তুলতেই, আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে এলো তার চেহারা। সেই নারীর শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর, এই সাধারণ আধ ময়লা শাড়িতেও তাকে বেশ চিত্তাকর্ষক লাগছে। তার হাতে একটা ছোট্ট কাপড়ের পুটলি, তবে অন্য হাত দিয়ে সে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে! সে যেন হঠাৎ আমার মত আরেকজন পুরুষের এই নৌকায় উপস্থিতি, এই সময়ে প্রত্যাশা করেনি…..হাতের পুটলিটা নৌকার ওপর রেখে, সে কেমন যেন থমকে চেয়ে রইল আমার দিকে। এমন সময় একটা তীব্র শীতল হওয়ার ঝাপটা এসে অস্থির ভাবে উড়িয়ে দিয়ে গেল সেই মহিলার মুখে ঢেকে রাখা শাড়ির আঁচলটাকে। তার মুখের দিকে চেয়ে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম……এই চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে তার মুখের বেশির ভাগ অংশই বীভৎস ভাবে পোড়া!…..এছাড়া, এতোক্ষণে আমি এটাও লক্ষ্য করলাম, যে শুধু তার মুখ নয়, তার শরীরের বিভিন্ন উন্মুক্ত অংশই আগুনে দগ্ধ!….আমি তার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ, সে যেন এই কথা বুঝতে পেরে, আবার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে, অন্য হাতে পুটলিটা নিয়ে, নৌকার ওপর একটু দূরে গিয়ে বসল।

এমন সময় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শ্রীদাম বলে উঠল,
– হতভাগী আমার আমার ইস্তিরি, কত্তা…….ওর নাম ফুলন……আপনি ওকে দেখে ডরাবেননি……একদিন রান্না করতে গিয়ে, ইস্টোভ বাস্ট করে…….
আমি এই ভয়ঙ্কর প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য, ওর কথা শেষ না হতেই বললাম,
– ঠিক আছে, ঠিক আছে ভাই, বুঝলাম…….
ততক্ষনে ফুলন পুটলি খুলে রুটি, তরকারি, পেয়াঁজ, লঙ্কা বার করে ফেলেছে। আমি বুঝলাম, যে এখন ওদের নৈশ ভোজের সময়। শ্রীদাম নিজের অকপট সরলতায় আমাকেও ওদের সাথে খেতে বলল, কিন্তু আমি মিষ্টি হেসে ওকে জানালাম, যে আমার রাতের খাবার হয়ে গিয়েছে। অগত্যা ওরা খাওয়া শুরু করল…..আর আমি মুগ্ধ চোখে ওদের দেখতে লাগলাম…….এই রাতের অন্ধকারে, নির্জন খোলা নদী পারে, এই ছোট্ট নৌকায় বসেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটে যায় এই দুটি মানুষের। আমরা যেন বৃথাই বাড়ি গাড়ি আর আর্থিক প্রতিপত্তির জন্য কঁকিয়ে মরি, এদের মত মানুষদের এই প্রকৃতি যা নিজের হাত খুলে দিয়েছে, তাই কি কম?……এটা ভাবতেই বেশ অবাক লাগল আমার……কই ওদের তো এই খোলা নদীতে এত রাতে কোন ভয় লাগেনা? এতোক্ষণ আমি ওই মিথ্যাবাদী হাবুর কথায় ভয় পেয়েছি ভেবে নিজেই নিজের মনে হাসলাম!

ওদের খাওয়া হয়ে গেলে আমি ওদের বললাম,
– তোমার বাড়ি কোথায় শ্রীদাম? আশেপাশে তো কোন ঘর বাড়ি দেখছি না আমি?
সে হেসে বলল,
– এই নাও-ই আমার বাড়ি ঘর……আমার সব কিছু, কত্তা……দূরে গাঁয়ের শেষের দিকে একটা ছোট কুঁড়ে ঘর আছে বটে…..তবে সেখানে নেহাৎ দরকার না পড়লে আমি যাই নাকো…..আমি এখানেই থাকি সবসময়….ওই ঘরে ফুলন শুধু রাঁধা বারার কাজ করে……
এবার আমি নিজের মনের ইচ্ছার কথাটা দুম করে বলেই ফেললাম শ্রীদামকে,
– শ্রীদাম ভাই, একবারটি আমায় এই রাত্রি বেলায় নদীর বুক থেকে তোমার নৌকা করে ঘুরিয়ে আনবে…..আমার অনেক দিনের শখ, এমন রাতের বেলায় নৌকা ভ্রমণ করার……তবে, ভেবো না আমি বিনা পয়সায় যাব, তোমায় আমি একশো টাকা দেব এর জন্য!
শ্রীদাম বেশ খুশি হয়ে বলল,
– কেন ঘোরাবনি কত্তা…..নিশ্চয় ঘোরাব…..আপনি আমাদের গাঁয়ের নতুন লোক……আপনার আব্দার রাখবনি, তাই কখনো হয়? তবে হ্যাঁ….আপনাকে ঘোরাবার দাম হল পঞ্চাশ টাকা….তার এক পয়সাও বেশি নেবনি আপনার কাছ থেকে…….
কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকার বাঁধন খুলে দিল শ্রীদাম। নৌকার এক কোণে, ফুলনের কাছে বসে, সে দুই হাতে তুলে ধরল বৈঠা……সেই চাঁদের আলোয় রুপোলি নদীর জলের উপর দিয়ে ছলাক ছলাক আওয়াজ করে ধীর গতিতে নৌকা এগোতে লাগল নদী বক্ষে…..আর আমার মনে হল, যে পূব দিক থেকে আসা ঠান্ডা হওয়াটা যেন এখনই উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমায় এই নৌকার ওপর থেকে!…….সেই রাতের ওই স্বর্গীয় অনুভূতির কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

সেই দিগন্ত বিস্তীর্ণ জলরাশির দিকে চেয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ চোখ গেল অদূরে বসে থাকা ফুলনের দিকে……শাড়ির আঁচলের ফাঁক থেকে বেরিয়ে থাকা তার জ্বলন্ত দুই চোখের দিকে……মেয়েটা যেন এক দৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে, কি জানি, কিছু বলতে চাই কি সে আমাকে? অগত্যা, আমিই শ্রীদামকে বলে উঠলাম,
– তোমাদের কত বছর আগে বিয়ে হয়েছে শ্রীদাম?
সে যেন চমকে উঠল হঠাৎ এই কথা শুনে, তারপর ম্লান হেসে বলল,
– বিয়া!…..আমাদের আর কি বিয়া হবে, কত্তা……আমরা যে হলাম এই গাঁয়ের……এই গাঁয়ের কলঙ্ক, কত্তা……কলঙ্ক!……এই নদী যে হল তার সাক্ষী…….এই নদীর জলের স্রোতে, এই নৌকার প্রতিটা কাঠের গায়ে লেগে আছে আমাদের কলঙ্কের ছিটা!
আমি অবাক হয়ে বললাম,
– সে কি! তুমি যে একটু আগে বললে ফুলন তোমার স্ত্রী…..আবার এখন বলছ যে তোমাদের বিয়ে হয় নি……এই কথার মানে কি?
এতোক্ষণ পর মুখ খুলল ফুলন, সে বেশ বিদ্রুপের ভঙ্গিতেই আমাকে হেসে বলল,
– কাউকে ইস্তিরি মানতে গেলে সত্যিই কি কোন মরদকে তার সাথে মালা বদল করে বিয়া করতে হয় নাকি বাবু? তা না করে কি কেউ সোয়ামী ইস্তিরি হতে পারেনি?
আমি অবাক হয়ে গেলাম এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে। আমার এই অবস্থা দেখে শ্রীদাম নিজেই বলে উঠল,
– জানি, আপনি খুব অবাক হচ্ছেন বাবু…….আপনি এই কথার মানে বুঝতেন, যদি আমাদের জীবনের কথা শুনতেন……..সে কথা শোনার সময় কি আছে আপনার কাছে?
আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত ওদের বলে উঠলাম,
– হ্যাঁ…..বল…..আমি শুনব!

(পর্ব-৩)

 

দূরে নদীর পারে, কোনো গাছ থেকে হয়তো এক রাত জাগা পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। এছাড়াও, নদীর জল কেটে নৌকার এগিয়ে যাওয়ার শব্দও একটানা আসছিল কানে। চারিদিকে শুধু সেই রুপোলি জলের দিশাহারা উথাল পাথাল নৃত্য, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে নিকটবর্তী নদীর পার! সেই নৈশ্য অলৌকিক রাতের নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে, শুনতে পেলাম শ্রীদামের পুরুষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সে বলে যেতে লাগল তার আর ফুলনের কলঙ্কের কথা, যা এই রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মতই এই দুটি মানুষের জীবনকে জড়িয়ে রেখেছে কোন অমোঘ বাঁধনে!

“সে প্রায় সাত বছর আগেকার কথা। তখন এই নদীতে আরো অনেক মাঝিই তাদের নৌকা নিয়ে যাত্রীদের পারাপার করে দিনপাত করত। সেই শীতের রাতের কথা এখনো মনে আছে শ্রীদামের। সেই সময় তার নৌকা ছিল এই নদীর অপর পারে। বাকি সমস্ত মাঝি ভাইরা যে যার নৌকা নদীর তীরে বেঁধে রেখে, নিজের নিজের ঘরে চলে গেল, শ্রীদামও ভাবছিল, আজকের মত এটাই শেষ বার……আর তো কোন যাত্রীও নেই……ওই পারে পৌঁছেই নৌকা বেঁধে রেখে বাড়ি ফিরে যাবে সে। নৌকার বাঁধন খুলতে উদ্যত হলে, হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল দুজন নারীমূর্তি। তার মধ্যে একজন বেশ আকুল স্বরে বলে উঠল,
– মাঝি ভাই….লক্ষীটি আমার…..আজ এই পৌষকালীর মেলায় এসে বড্ড দেরি হয়ে গেল আমাদের…..সবাই নৌকা বেঁধে বাড়ি চলে গেল…..এখন তুমিই আমাদের একমাত্র ভরসা…..আমাদের ওপারে নিয়ে চল ভাই…..
শ্রীদাম একবার ভালো করে চেয়ে দেখল ওই দুই নারীকে, এদের মধ্যে একজন মাঝ বয়সী……কিন্তু অন্য জন…..অন্য জনকে এই শীতের রাতে চাদর মুড়ি দেওয়া অবস্থাতে দেখেও যেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শ্রীদাম……সে আর কেউ নয়……ফুলন! ফুলনও যেন বুঝতে পারল শ্রীদামের মনের অবস্থা, তাই সে মুখ টিপে হেসে, অপর মহিলাকে ইয়ার্কি করে বলে উঠল,
– ও বৌদিদি……তোমার মাঝি ভাই কি কালা নাকি…..শুধু হা করে চায়…..’হ্যাঁ’ বা ‘না’ যে কিছুই বলে না…….
এর পর ওরা দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলে, শ্রীদামের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে তখনই হাসি মুখে বলে উঠল,
– কেন নে যাব না….নিশ্চয় নে যাব……আসুন মা ঠাকরুন, আসুন…..
এই বলে প্রথমে সে ফুলনের বৌদিকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করে, আর তারপর ফুলনকে……. সারাক্ষণ শক্ত কাঠের বৈঠা ধরা হাত দিয়ে, সে যখন ফুলনের নরম হাতটা স্পর্শ করে তাকে নৌকায় টেনে তোলে, তখন যেন তার সারা শরীরে একটা তীব্র তড়িৎ-এর তরঙ্গ খেলে যায়…..সে ওই রাতের অন্ধকারেও মুগ্ধ নয়নে শুধু দেখতেই থাকে ফুলনকে……এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, যেন সে নৌকা চালানোই ভুলে গিয়েছে! ফুলনেরও বোধহয় শ্রীদামের স্পর্শ পেয়ে এমনই সুখানুভব হয়……কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নারী সুলভ লজ্জাবোধে ছুটে গিয়ে তার বৌদির পেছনে মুখ লুকোয়, ওদের দুজনের মুচকি হাসি যেন কোন কোকিলের কুহুতান শুনিয়ে যায় এই রাত্রির অন্ধকারেও!”

এতটা বলার পর একবার থামলো শ্রীদাম। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, আমি তাড়াতাড়ি নৌকার ছাউনির ভেতর ঢুকে বসলাম। তীব্র হওয়ার দাপটে, বৃষ্টির ঠান্ডা জলের ঝাপটা এসে পড়ছে আমাদের সকলের শরীরে। শ্রীদাম যেন বৃষ্টির জলে ভিজেই চলেছে, চোখ বন্ধ করে স্বাদ নিচ্ছে জলের প্রতিটা ফোঁটার। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের গায়ের ভিজে যাওয়া স্যান্ডো গেঞ্জিটা খুলে ফেলল শ্রীদাম……বৃষ্টির জলের ঝাপটা লেগে ওর চৌরা কাঁধের পেশিগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে! মনে মনে বেশ একটা হিংসা বোধ জাগল আমার, ওর এই সুঠাম সুন্দর শরীর দেখে…….সত্যিই এই চেহারা দেখে শুধু ফুলন কেন, যে কোন মেয়েরই মনে জেগে উঠবে কামের আগুন! ফুলন এখনো কি অপার্থিব মুগ্ধতায় চেয়ে আছে শ্রীদামের দিকে। আবার বলা শুরু করল শ্রীদাম।

“এরপর থেকে প্রায়ই নদী পারাপার করার অসীম চাহিদা জাগত ফুলনের মনে, বলা বাহুল্য, তা শুধু শ্রীদামের নৌকাতেই……আর শ্রীদামও যেন অপেক্ষা করে বসে থাকত, কখন নদীর পার থেকে ছুটে আসতে দেখবে ফুলনকে…..কখন পাবে সে ফুলনের রাঙা গোলাপের মত হাতের স্পর্শ…..কখন আলতো করে হাত বোলাবে তার কোমর ছোঁয়া ঘন কালো চুলের মধ্যে……কিংবা, কখন তাকে কাছে টেনে নিয়ে, তার ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট রাখতে গিয়ে, নিজের বুক দিয়ে অনুভব করবে ফুলনের সুডৌল স্তন যুগলকে……..তবে, কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিল শ্রীদাম, যে তাদের এই সম্পর্কের কোন পরিণতি নেই, কারণ ফুলনের বাবা মা তার মত একজন সাধারণ মাঝিকে কখনোই তাদের জামাই বলে মেনে নেবে না।……আর হলও তাই……..একদিন ফুলন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীদামের বুকে, তারপর অধৈর্য কণ্ঠে কেঁদে উঠে বলল,
– বাপ মা আমার বিয়া ঠিক করছে গ্রামের চৈতন্য ঘোষালের ছেলের সাথে…..ওরা খুব পয়সাওয়ালা লোক, ছিদাম…….ওর ছেলে বিনোদ শহর থেকে ডাক্তারি পড়ে এসেছে, তারও খুব পছন্দ হয়েছে আমাকে…….ওরা আমাকে তোমার কাছ থেকে সারা জীবনের জন্য কেড়ে নেবে, ছিদাম …..তাই বলছি, আজ…..আজ রাতেই চল…..আমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে চল ছিদাম…..পালিয়ে চল…….
এই কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগল শ্রীদাম, তারপর সে ফুলনকে গম্ভীর গলায় বলল,
– তুই চলে যা ফুলন….চলে যা এখান থেকে…..আর আসিসনি কখনো আমার নাও-এ…….আমার সাথে থেকে জীবনে অভাব অনটন ছাড়া আর কিছুই যে পাবিনি তুই……তোর বাপ মা যেথায় তোকে বিয়া দিতে চায়, তুই সেথায় বিয়া করে সুখী হো…..আর আসিসনি কখনো আমার কাছে…..
এই কথা শুনে প্রথমে খুব অবাক হয়ে এই কথার বিরোধিতা করেছিল ফুলন। কিন্তু যখন শ্রীদাম তার সিদ্ধান্ত থেকে একটুও নড়ল না, তখন সে কষিয়ে মেরেছিল শ্রীদামের গালে এক চড়……আর তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেই নদীর পার থেকে ছুটে চলে গিয়েছিল, আর কখনো না ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করে।”

আবার একবার বলা থামলো শ্রীদাম। আমাদের নৌকা এখন প্রায় মাঝ নদীতে চলে এসেছে। বৃষ্টিটা এখনো পড়ছে। এখন নদীর অপর পারের কালো গাছপালা আর বন ঝোপগুলোকে এই চাঁদের আলোতে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এবার আমাকে অবাক করে, শাড়ির আঁচলের ভেতর থেকে মুখ নেড়ে এই কাহিনীর পরবর্তী অংশ বলতে লাগল ফুলন!

“সেদিনের পর থেকে আর কখনো শ্রীদামের মুখদর্শন করেনি ফুলন……এর পর একদিন উলু শঙ্খের ধ্বনির মাঝে, ছাদনাতলায় এক অজানা মানুষের গলায় মালা পড়াতে বাধ্য হয়েছিল সে……বাধ্য হয়েছিল নিজেই অন্যের কাছে নিজের দাসখতে সই করে এক অচেনা মানুষের দেওয়া সিঁদুর নিজের সিঁথিতে ধারণ করতে……কিন্তু এই এতটা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে একবারও নিজের বরের দিকে চেয়ে দেখতে ইচ্ছা হয়নি ফুলনের, তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসা অশ্রুর প্রলেপের মাঝে শুধু ভেসে উঠেছিল শ্রীদামের সুন্দর মুখশ্রী…….এর পর এল ওদের ফুলশয্যার রাত! ফুলে ফুলে সাজানো বিছানায় ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে, আত্মীয় স্বজনের সমস্ত ইয়ার্কি ফাজলামি মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছিল সে এতোক্ষণ। তারা সকলে চলে যেতেই, হঠাৎ খুলে গেল ঘরের দরজা…..আর প্রথম নারীসঙ্গের অভিপ্রায়ে সেই ঘরে উত্তেজিত হয়ে প্রবেশ করল বিনোদ। এতোক্ষণ পর, ঘোমটার ভেতর থেকে নিজের স্বামীর দিকে যেন প্রথম চেয়ে দেখল ফুলন……..ঠিক যেন দামি ধুতি পাঞ্জাবী পরা, এক অসুস্থ চেহারার রোগা কাঠের পুতুল, কোন রকমে মদের নেশায় টলতে টলতে আসছে ফুলশয্যার খাটের পানে……..”

(পর্ব-৪)

 

“কোনোমতে ধুতির কোঁচাটা সামলে বিনোদ ঢলে পড়ল ফুলনের গায়ে। খাটের ধারে ঝুলন্ত রজনীগন্ধার মালাগুলো হুড়মুড় করে ছিঁড়ে পড়ল অনেকটা। টাল খেয়ে, জাপটে ধরল বিনোদ ফুলনের বুকটাকে, তারপর নিজের নেশাগ্রস্ত লাল চোখ দু’টিকে অনেক কষ্টে খুলে একবার চেয়ে দেখল ফুলনের মুখের দিকে। মদের গন্ধে ফুলনের গা গুলিয়ে উঠল, কিন্তু সে জানত, যে তাকে সহ্য করতে হবে…….যুগ যুগ ধরে তো সব মেয়েকেই সহ্য করে আসতে হয়েছে পুরুষের এই ফুর্তির দাপট! খুব আশ্চর্য লাগছিল তার…..এই লোকটা যে তার স্বামী আর সে যে তার স্ত্রী, এই কথা যেন মনেই হচ্ছে না ফুলনের……সে যেন শুধুমাত্র এই মানুষটার ভোগ্য সামগ্রী! এই কি তবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক…..সাত পাকে ঘুরে মালা বদল করে শাস্ত্র মতে বিয়ে করা বউ বলে যাকে সমাজ?…….বিনোদ ধাক্কা মেরে বিছানায় শুইয়ে দিল ফুলনকে, এক ঝটকায় সে তার বুকের ওপর থেকে সরিয়ে নিল বেনারসীর আঁচল……তারপর ওকে খামচে ধরে নিজের শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে ঝুঁকে পড়ল ওর দেহের ওপর…….মনে মনে শ্রীদামের মুখটা কল্পনা করে চোখ বন্ধ করল ফুলন…….কিন্তু একি! কিছুক্ষণের মধ্যেই টলমল করতে লাগল বিনোদের দুই হাত!……ফুলন বুঝলো, যে পৌরুষ জাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ক্রমাগত বিফল হচ্ছে মদ্যপ মানুষটা! কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলনের শরীরের ওপর থেকে সরে গিয়ে, তার পাশে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল বিনোদ!………”

এবার আসতে আসতে নৌকা ঘোরাতে শুরু করেছে শ্রীদাম। রাতও বেশ গভীর হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিটা কিছুক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গেলেও, ঠান্ডা হওয়ার দাপটে গা শিরশির করে উঠছে। ক্রমে আমরা আবার পরিচিত নদীর পারের দিকেই এগোচ্ছি………ফুলনের দগ্ধ মুখের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছিল ওর শাড়ির ফাঁক থেকে, তাতেই দেখতে পেলাম এক ফোঁটা জল ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর চোখের কোনায়……কিন্তু কোন লজ্জা শরম না করে প্রতিবাদী গলায় বলে উঠল সে,
– প্রথমে তো আমি ভেবেছিলুম, সেই রাতে নেশা করেছিল সে…….নেশায় শক্তি ক্ষয় করে দেয়, আমি জানি…….কিন্তু তারপর……তারপর প্রতিটা রাতেই এই একই ঘটনা ঘটত……..আমি খুব ভালো করেই বুঝে গেছিলুম, যে ওর শরীরে খুঁত আছে…..মেয়েমানুষের শখ মেটানোর খামতা ওর নেইকো…..কিন্তু বাবু, বিশ্বেস করেন, আমি তাও ওর বউ হয়েই ছিলুম, কখনো কিছুই চায়নিকো ওর কাছ থেকে…….যতদিন না……যতদিন না……

“এরপর বিয়ের দুই বছরে মধ্যেও যখন ওদের কোন সন্তান জন্মাল না, তখন বিনোদের পরিবারের সকলেই আঙ্গুল তুলতে লাগল ফুলনের ওপর,
– বাঁজা…..বাঁজা……বাঁজা মেয়েছেলের সাথে বিয়া দিয়া হল আমার অমন সোনার চাঁদ ছেলের……হায় ভগবান……বার করে দে, বার করে দে ওই মাগীকে ঘর থেকে………
শ্বশুর শাশুড়ী ননদ দেওরের এমন গঞ্জনা তো হয়ে উঠেছিল ফুলনের নিত্য দিনের সঙ্গী। কিন্তু সে কোনদিন তাদের বলেনি তার মা হতে না পারার আসল কারণ……সে জানে, যে এই পুরুষশাসিত অজ পাড়াগাঁয়ে কেউ মানবে না তার কথা……ওদের জব্দ করতে হবে অন্য ভাবে……যে রাস্তা ফুলন ভালোই জানে! আর তাই নিজের নারীত্বের প্রমাণ দিতে সে এত দিনের পর, আবার একদিন রাতে, সকলের অজান্তে, ছুটে এসেছিল শ্রীদামের নৌকায়। প্রথমে শ্রীদাম রাজি না হলেও, ফুলনের জোরাজুরিতে আর বেঁধে রাখতে পারেনি সে নিজের শরীর মনকে!……সেদিন এমনই এক বৃষ্টি মুখরিত রাতে, উত্তাল নদীর স্রোতকে সাক্ষী রেখে, এই নৌকার ছাউনির মধ্যেই এক হয়েছিল দুটো শরীর! অপার্থিব সুখে মুগ্ধ ফুলন সেদিন বুঝেছিল প্রকৃত পুরুষের স্পর্শ কাকে বলে! নিচে নদীর জলের ধারা আর ওপরের নিকষ কালো আকাশে ফুটে থাকা তারারা যেন বিস্ময় চোখে চেয়ে দেখল এই দুটি প্রাণের এক হয়ে যাওয়ার সঙ্গম দৃশ্যকে…….বলাই বাহুল্য, যা থেকে কিছু দিনের মধ্যেই ফুলনের দেহে সৃষ্টি হয়েছিল নতুন এক প্রাণের!…….একদিন তার শ্বশুর বাড়ির সকলের চোখে চোখ রেখে জানিয়েছিল সে, যে সে গর্ভবতী……আর এতেও যদি তাদের বিশ্বাস না হয়, তাহলে তারা অপেক্ষা করে দেখুক না আর কয়েকটা মাস! সেদিন সে দেখেছিল, তার স্বামীর অগ্নি দৃষ্টি……কোন ক্ষুধার্ত চিতা বাঘের গলায়, প্রথম গ্রাসেই যখন তার শিকারের কোন তীক্ষ্ণ হাড় আটকে যায়, যখন সে না পারে তাকে গিলতে আবার না পারে ওগলাতে……ঠিক সেই অবস্থায় মনে হচ্ছিল বিনোদকে দেখে! সে না তো বাড়ির সকলকে বলতে পারছিল নিজের অক্ষমতার কথা, না মনে মনে মেনে নিতে পারছিল ফুলনের গর্ভের সন্তানকে!…কিন্তু, এমন অবস্থায়, এই কথা জেনেও, যে বিনোদ যে কোন সময় তার ওপর প্রতিশোধের আঘাত হানতে পারে……ক্রমাগত একটা মস্ত বড় ভুল করতে থাকল ফুলন!”

আমাদের নৌকা এখন নদীর সেই পুরোনো পারের অনেকটাই কাছে এসে পড়েছে……আমি বুঝলাম, যে শেষ হতে চলেছে আমার পঞ্চাশ টাকার নৌকা ভ্রমণের মেয়াদ……তবে এই কথা সত্যি, যে টাকাটা কিন্তু বিফলে গেল না, আমার অনেক দিনের সাধ আজ পূর্ণ করল শ্রীদাম। তবে খুব কৌতূহল হচ্ছিল জানার, যে এরপর কি হল ফুলন আর শ্রীদামের জীবনে? ফুলনকে জিজ্ঞাসা করতেই, সে উন্মাদের মত খিল খিল করে হেসে উঠল। তারপর এই রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে সে বলে উঠল,
– তারপর, তারপর আর কি, বাবু…….একবার ছিদামের পরশ পেয়ে, আমি পাগলীর মত, যখনই সুযোগ পেতুম, তখনই ছুটে আসতুম ওর নৌকায়……সমস্ত লাজ লজ্জা, মান সম্মানকে পিছু থুয়ে…..এই নদীকে দেখছেন, এই নদীর জলের প্রতিটা স্রোত আমাদের কলঙ্ককে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিত এই নৌকা থেকে…….কিন্তু এই নদী আমাদের ক্ষমা করে দিলেও…..বিনোদ আমাদের ক্ষমা করলনি…..একদিন সমস্ত গ্রামবাসীদের এথায় নে এসে আমাদের হাতে নাতে ধরল সে…..সবার সামনে বলল সে, যে আমি কূলোটা…..আমি বেশ্যা…….সেদিনই গ্রামের সকলে ফয়সলা করল, যে পরপুরুষের সাথে শোয়ার জন্য, আমাকে আর কোন দিন ঘরে তুলবে না আমার সোয়ামী……আর ছিদামকেও একঘর করে দেওয়া হবে গাঁয়ে…….
ফুলন থামলে, এতোক্ষণ পর মুখ খুলল শ্রীদাম, হো হো করে হেসে উঠে বলল,
– সেই শাপে যেন আমাদের বর হল, বাবু…..সেই দিন থেকেই আমাদের এই ভাবে একসাথে পথ চলা……সারা গাঁয়ের মানুষের আমার দরকার নেই, কিন্তু ফুলনকে তো কাছে পেলুম……তাই তো আপনাকে বলেছিলাম বাবু……শুধু কি বিয়া করলেই সোয়ামী ইস্তিরি হওয়া যায়?
নৌকাটাকে নদীর তীরে বাঁধতে বাঁধতে আরো কত কিছু বলে গেল শ্রীদাম, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে গেলাম ওদের সব কথা, কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারলাম না ওদের প্রশ্নের!…….একটু পরে যখন শ্রীদাম আমার কাছে নৌকা ভ্রমণের দাম চাইতে এল, আমি দেখলাম, যে আমার ওয়ালেটে আছে চারটেই একশো টাকার নোট…..শ্রীদাম হাসিমুখে আমার কাছ থেকে একটা একশো টাকার নোট নিয়ে, ওর লুঙ্গির গিঁটে বাঁধা, একটা বৃষ্টির জলে ভেজা পঞ্চাশ টাকার নোট আমায় ফেরত দিল……..আমি বাড়ি ফেরার আগে ওদের বলে এলাম,
– তোমরা তো এই নদীতেই থাকো…..আমি কিন্তু মাঝে মধ্যেই ইচ্ছা হলে আসবো, তোমার নৌকায় চাপতে……
ওরা হাসি মুখে চেয়ে থাকল আমার দিকে!

(শেষ পর্ব)

 

পরদিন সকালে হাবু এলে, একটা হেস্তনেস্ত না করে আমার শান্তি হচ্ছিল না। ওকে দেখা মাত্র আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
– কাল তো বেশ মিথ্যা মিথ্যা ভয় দেখিয়ে গেলে আমায়……রাত্রের পর বাইরে বেরোবেন না, জায়গাটা ভালো নয়……আরো কত কথা…..আমি তো কাল সারাটা রাত ওই শ্রীদাম মাঝির নৌকা করে নদী থেকে ঘুরে এলাম…..কত কথা হল আমার ওর আর ওর বউ ফুলনের সাথে…..কই, ভয় পাওয়ার মত তো কিছুই দেখলাম না আমি?……আমাকে নতুন লোক দেখে, বোকা বানাতে ওই সব ভয় দেখানো কথা কাল বলে গেলে বুঝি?
এই কথা শুনে, হঠাৎ, আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল হাবুর শরীর! সে কোন রকমে আমায় বলে উঠল,
– ক…ক….কত্তা, আপনি…..আপনি ছি…ছি….ছিদাম আর ফু….ফু….ফুলনকে দেখতে পেয়েছেন!
আমি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলাম,
– মানে…..দেখতে না পাওয়ার কি আছে ওদেরকে? ওরা তো সারাক্ষণ ওই নদীর ওপর নৌকা নিয়েই থাকে…..এখনো আছে নিশ্চয়……
এই বলে আমি কাল রাতে শ্রীদাম আর ফুলনের কাছ থেকে যা যা শুনেছিলাম ওদের সম্বন্ধে, তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলাম হাবুর কাছে।

এই কথা শুনে, হাবু আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বার করে নিয়ে এল নদীর পারে। সকালের সোনালি রোদে ভরে উঠেছে নদীর জল, চারিদিকে সুন্দর সবুজ গাছপালার মধ্যে ডেকেই চলেছে কত নাম না জানা পাখির দল…….কিন্তু আশ্চর্য তো! শ্রীদামের নৌকাটা কোথায় গেল!……আমি ছুটে গেলাম নদীর আরো কাছে…..তবুও, চারিদিকে দিগন্ত বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে কোথাও চোখে এলো না ওদের নৌকাখানা! আমি একবার চিৎকার করে ডাকলাম ওদের নাম ধরে……কিন্তু, বলাই বাহুল্য, কেউ সাড়া দিলো না আমার ডাকে! হাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এল আমার কাছে, তারপর আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে বলতে লাগল,
– আ…আ….আপনার ভাগ্য ভালো কত্তা, যে আপনি কাল রাতে বেঁচে গেছেন…..এই জন্যই আমি আপনাকে কাল বলেছিলাম রাতে না বেরোতে, কারণ এই কথা সকলেই জানে, যে কোন অচেনা মানুষ দেখলে, ওরা তাকে দেখা দেয় কত্তা!…..নিজেদের মরার আগেকার গল্প শোনাতে থাকে!
আমার বুকটা ভয়ে হিম হয়ে গেল এই কথা শুনে, এ কি বলছে হাবু! ওকে কোন কিছু জিজ্ঞাস করার ক্ষমতাও যেন আমার আর নেই…..কিন্তু সে বলেই চলল,
– তবে, আপনার মত আর অন্য সকলকেই ওরা একটা মিছে কথা কয়……ফুলনের পেটে ছিদামের বাচ্চা আসার পর, ওর সোয়ামী ওকে ত্যাগ করেনি, কত্তা……ওকে…..ওকে….গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল…..ওই ওই ইস্টোভ বাস্ট করার কথাটাও মিথ্যা……আর সেই খবর পেয়ে ছিদামও এই নদীর জলে ডুবে আত্মহত্যা করে…..এই কতা গাঁয়ের সবাই জানে কত্তা…….সবাই জানে!
আমি আর সহ্য করতে না পেরে বসে পড়লাম নদীর পারে ঘাসের ওপর……তার মানে……তার মানে, আমি কালকের গোটা রাতটা দুজন প্রেতাত্মার সাথে গল্প করে কাটালাম!……আর ভাবতে পারলাম না আমি…..মনের মাঝে প্রবল ইচ্ছা হল একটা সিগারেট খাওয়ার, কিন্তু পকেটে যে সিগারেটের খালি প্যাকেট পড়ে রয়েছে। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে, হাবুকে বলে উঠলাম,
– হ….হ…হাবু, আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো তো…..তাড়াতাড়ি……
হাবু পয়সা চাইতেই আমি ওয়ালেট হাতড়ে দেখলাম তিনটে একশো টাকার নোটের মাঝে পড়ে আছে একটাই পঞ্চাশ টাকার নোট…..সেটা বার করে হাবুকে দিতেই সে ছুটে চলে গেল আমার জন্য সিগারেট আনতে……কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার মনে হল, যে নোটটা কেমন ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে না?…….আতঙ্কে আবার নদী পারে বসে পড়লাম আমি……আরে, এই “কলঙ্ক বাহিনী” নদীর বুকে ওর নৌকায় ভ্রমণ করার পারিশ্রমিক নেওয়ার পর, এই নোটটাই তো কাল আমাকে শ্রীদাম দিয়েছিল একশো টাকা ভাঙিয়ে!

(সমাপ্ত)

 

Exit mobile version