Site icon আলাপী মন

হিডেন ট্রান্সমিটার

হিডেন ট্রান্সমিটার
-বিশ্বদীপ মুখার্জী

 

 

আকাশে যেমন এক রাশ মেঘ বেঁধেছিলো নিজের বাসা, ঠিক তেমনই স্বস্তিকের হৃদয়েতেও নিজের বাসা বেঁধেছিল মেঘেরা। যে কাজ আজ তাকে করতে হবে তাতে বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না তার। নিজের শরীরে কোনো প্রকারের কাটা-ছেঁড়া স্বস্তিকের পছন্দ নয়। অথচ প্রজ্ঞা বলেছে- ‘ভয়ের কিছু নেই, স্বস্তিক। তুমি বুঝতেও পারবে না। কিছুক্ষণের ব্যাপার মাত্র।’
প্রজ্ঞা উৎসাহিত। তাকে দুঃখ দিতে চায় না স্বস্তিক। তাই ছুটির দিনে সকালে উঠবার ইচ্ছে না থাকলেও, উঠেছে সে। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখল, সকাল সাতটা। নিজের আশিতলা ফ্ল্যাটের বেডরুমের কাঁচের জানালার বাইরে তাকালো। আকাশে জমে আছে কালো মেঘ। প্রদূষণ মুক্ত বাতাসের জন্য তাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটা বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো স্বস্তিক। এতো উচ্চতাতে স্বচ্ছ বাতাসের সম্ভাবনাই বেশি। তার 3 ডি মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলে রিমাইন্ডার সেট করা ছিল আজকের দিনের। বিরক্ত হয় সে দিকে তাকালো স্বস্তিক।

স্নান সেরে তৈরি হওয়ার সময় ফোন এলো প্রজ্ঞার। ভিডিও কল হওয়ার সময় স্বস্তিক প্রজ্ঞাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘আচ্ছা প্রজ্ঞা, তোমাদের ওই যন্ত্রটা শরীরের কোন অঙ্গে লাগাবে?’

খিলখিলিয়ে হাসলো প্রজ্ঞা। হাসলে তার সুন্দরতা শতগুণ বৃদ্ধি পায়।

‘তোমার কোমরের কাছে। আর ওই যন্ত্রটার একটা নাম আছে, স্বস্তিক। সেটা হয়তো তুমি জানো।’
‘জানি। হিডেন ট্রান্সমিটার।’

দেশের জনসংখ্যা প্রায় চারশত কোটির কাছে। প্রত্যেকের শরীরে ট্রান্সমিটার লাগানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু লাগানো অনিবার্য। বিগত দু’বছর ধরে এ কাজ চলছে। আরও কত দিন লাগবে বলা যায় না। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির দায়িত্বে এ কাজ পড়েছে। তারা বেশ সুন্দর ভাবে গুছিয়ে এ কাজ নির্বহন করছে। কোনদিন কার শরীরে হিডেন ট্রান্সমিটার লাগানো হবে, সেটা ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা ঠিক করে। এক সপ্তাহ আগে সেই লোকটিকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে অমুক দিনে তার শরীরে সেই যন্ত্রটা লাগানো হবে। প্রত্যেক শহরের সরকারী হাসপাতালে কাজ শেষ করা হয়। এখানে বিশ্বাসের কথা সব থেকে আগে ওঠে। তাহলে কি সরকার দেশের নাগরিকদের ওপর বিশ্বাস করে না? এক মন্ত্রীর বক্তব্য- ‘প্রশ্ন বিশ্বাস কিম্বা অবিশ্বাসের নয়। প্রশ্ন হলো সুরক্ষার। দেশের কিম্বা আপনাদের সুরক্ষার।’

নিজের ব্যাটারী চালিত গাড়িতে বসলো স্বস্তিক। আজকাল সব গাড়ি চলে ব্যাটারীতে। গাড়িগুলো আকারে খুব বড়ো নয়। ড্রাইভার সহ চার জন বসতে পারে এক সাথে। সকালে তাড়াহুড়ো করে বেরোবার ফলে কিছু খেতে পারেনি স্বস্তিক। কিছু দূরেই আছে এক ভালো রেস্তোরাঁ। সেখানেই প্রাতঃরাশ সেরে নেবে সে। এখনও এখানে সস্তায় ভালো খাবার পাওয়া যায়।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই, কাঁচের দরজার সামনে পা রাখতেই দরজা আপনি খুলে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিক্যুরিটি। স্বস্তিকের ওপর নজর পড়তেই তাকে বাঁ দিকে তাকাবার ইশারা করলো। বাঁ দিকের দেয়ালে ছোট্টো একটা ক্যামেরা। ক্যামেরাটা স্বস্তিকের শুধু ছবিই তুললো না, সাথে তার সম্পূর্ণ শরীর স্ক্যানও করে নিলো। কিছু সেকেন্ডের কাজ। অতঃপর এগিয়ে গেল স্বস্তিক। রিক্ত টেবিল খুঁজতে একটু বেগ পেতে হলো তাকে। আজ ছুটির দিন। প্রায় প্রত্যেকেই বসে থাকে আজকের দিনের অপেক্ষায়। একটা সময় ছিল যখন সরকারী বা বেসরকারী কর্মচারীরা সপ্তাহে একদিন অন্ততঃ ছুটি পেতো। বেশিরভাগ সেটা রবিবার হতো। পরিস্থিতি গেছে পাল্টে। এখন দু‘মাস, তিন মাস টানা কাজের পর সকারের তরফ থেকে কোনো একদিন ছুটির ঘোষণা হয়। সে দিন লোকেরা পুরো সময় নিজের পরিবারকে দেয়। অনেকেই নিজের পরিবার সহ রেস্তোরাঁতে খেতে এসেছে।

‘সকাল দশটায় কি সবাই নিজের লাঞ্চ সেরে নেবে?’ মনে-মনে ভাবলো স্বস্তিক।

একটা টেবিল দেখতে পেল। গোল টেবিল। চারটে চেয়ার দিয়ে ঘেরা। এক জন একটা চেয়ারে বসে আছে, তার দিকে পিঠ করে।
‘এখানে বসা যেতে পারে। দেরি করে লাভ নেই।’ একথা ভেবে স্বস্তিক দ্রুত কদমে এগিয়ে গেল সে দিকে।

প্রত্যেক টেবিলে একটা করে মেনু কার্ড লাগানো আছে। নানাবিধ ব্যঞ্জনের নাম লেখা তাতে। খাবার ঠিক করে, টেবিল নাম্বার দিয়ে ‘সাবমিট’ লেখা স্থানে স্পর্শ করতে হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে নিজের পছন্দের খাবার।
‘আমি কি এখানে বসতে পারি?’ চেয়ারে বসে থাকা লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বস্তিক।
সে লোকটা খাওয়া থামিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে স্বস্তিকের দিকে দেখল। চমকে উঠল দু’জনেই।
‘আরে নির্ভয় তুই?’ সেই লোকটার পিঠে একটা চাপড় মেরে স্বস্তিক বলল।
নির্ভয়ের সাথে স্বস্তিকের পরিচয় প্রায় ছ’বছরের। কলেজের বন্ধু তারা। স্বস্তিক সামনের টেবিলে বসলো।
‘তুই তো ছুটির দিনে বেলা বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠিস না। আজ হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি সেজেগুজে চললি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলো নির্ভয়।
স্বস্তিক ইলেকট্রনিক মেনু কার্ডে খাবারের অর্ডার দিলো।
‘শান্তি নেই ভাই। জীবনে শান্তির খুব অভাব।‘ ঈষৎ হতাশার স্বরে স্বস্তিক বললো।

‘প্রজ্ঞার সাথে কোথাও ঘুরতে চললি নাকি?’
‘তার ছুটি কোথায়? ডক্টরদের আবার ছুটি। তার হাসপাতাল থেকেই ডাক এসেছে।’
‘ডাক এসেছে মানে?’ নির্ভয় জিজ্ঞেস করলো।
‘হিডেন ট্রান্সমিটার লাগাবে।’ স্বস্তিক উত্তর দিলো।

পর্ব – 2
…………………….

‘ওঃ! ঠিক। যা, লাগিয়ে নে।’ নির্ভয় বলল।
‘তুই তো বোধহয় লাগিয়ে নিয়েছিস না?’ জিজ্ঞেস করলো স্বস্তিক

কফিতে একটা চুমুক দিয়ে নির্ভয় বলল- ‘প্রায় এক মাস হয়ে গেল। তারপর থেকে জীবনটা পাল্টে গেছে একরকম।’
এক বেয়ারা এসে খাবার দিয়ে গেল। এক কাপ কফি আর একটা বার্গার।
‘জীবন পাল্টে গেছে মানে কী বলতে চাস তুই?’ বার্গারে এক কামড় দিয়ে স্বস্তিক জিজ্ঞেস করলো।
নির্ভয়ের খাওয়া প্রায় শেষের পথে। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে, টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল- ‘যখন তোর শরীরে যন্ত্রটা ঢুকবে, তখন তুইও বুঝতে পারবি। আমরা আজ থেকে প্রায় দু’শত বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই যে স্বাধীনতা কোথায়? চব্বিশ ঘন্টা কিছু অদৃশ্য চোখ তাকিয়ে আছে তোর দিকে। এটা কে স্বাধীনতা বলে? ডেলি রুটিনের ব্যতিক্রম যদি হয়, তোর কাছে কল চলে আসবে।” আপনি অমুক জায়গায় এতক্ষণ ধরে আছেন কেন? কতক্ষণ থাকবেন?” প্রতি পদে কৈফিয়ৎ দাও। বিরক্ত হয় গেছি আমি। কিন্তু কোনো উপায় নেই। নিষ্কৃতির কোনো পথ নেই, ভাই।’

নির্ভয়ের শেষ কথা গুলো বিষাদে ভরা। কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল স্বস্তিক।
‘তোর প্রাইভেসি বলে কিছু থাকবে না আর।’ নির্ভয় স্বস্তিকের চোখে চোখ রেখে বলল- ‘তুই যদি নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে সেক্সও করিস, সেটার কৈফিয়ৎও দিতে হবে ইন্টার্নাল সিক্যুরিটিকে । ‘
কথা শেষ করে কটাক্ষের হাসি হাসলো নির্ভয়। নির্ভয়ের কথাগুলো তোলপাড় শুরু করে দিয়েছিল স্বস্তিকের হৃদয়ে। এতো গভীরে গিয়ে চিন্তা করেনি স্বস্তিক। প্রাইভেসি শব্দের মূল্য তার জীবনে অনেক বেশি।
নির্ভয় যা কিছু বলল, তার প্রমাণ স্বস্তিক সেখানে বসেই পেয়ে গেল। কথা বলতে বলতে বেজে উঠল নির্ভয়ের মোবাইল। নিজের 3 ডি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো নির্ভয়। শুরু হলো ভিডিও কল

ওপার থেকে আওয়াজ এলো- ‘আমরা দেখতে পারছি, আপনি বিগত দেড় ঘন্টা ধরে লেক টাউনের এক রেস্তোরাঁতে আছেন। কেন জানতে পারি কী?’
‘আমি ব্রেকফাস্ট করছি।’ নির্ভয়ের কন্ঠে বিরক্তির ভাব।
‘ ক্ষমা করবেন স্যার, কিন্তু ব্রেকফাস্ট করতে এতো সময় তো লাগে না।’
ওপার থেকে যে মৃদু কন্ঠ মোবাইলে ভেসে আসছিলো, সেটা যার কন্ঠ তাকে দেখতে পাচ্ছিল না স্বস্তিক, নির্ভয়ের সামনে বসে থাকা দরুন।
বিচিত্র এক মুখভঙ্গী করলো নির্ভয়। বললো- ‘আসলে আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয় গেল। তাই একটু গল্প করছিলাম আর কি।’
‘ওকে স্যার। ধন্যবাদ।’
ফোন কেটে গেল।
‘দেখলি স্বস্তিক। এটাই হলো আমাদের স্বাধীনতা।’ পুনরায় কটাক্ষের হাসি হাসলো নির্ভয়।
নির্ভয়ের চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইল স্বস্তিক। অর্ডার দেওয়া খাবার খেতে পারলো না সে। গভীর চিন্তায় ডুবে থাকলো। তার প্রাইভেসি নষ্ট হবে, সে কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না স্বস্তিক। তার জীবনে আছে কিছু প্রাইভেসি, সেটা কারুর সাথে শেয়ার করতে পারবে না সে। এমন কি প্রজ্ঞাকেও সে প্রাইভেসির কথা বলেনি স্বস্তিক। হিডেন ট্রান্সমিটার শরীরে প্রবেশ করলে সে প্রাইভেসি আর প্রাইভেসি থাকবে না। দেশের সুরক্ষার অজুহাত দিয়ে সরকার নিত্যনতুন নিয়ম বার করেছে। সে সবের প্রতি কোনো দিনই মাথা ঘামায়নি স্বস্তিক। হাসি মুখে সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু এবার সরকারের নিয়ম মানতে দ্বিধা বোধ করছে স্বস্তিক। কিন্তু কোনো উপায় সে দেখতে পারছে না। সরকারের নিয়ম যদি না মানা হয়, তাহলে ইন্টারনাল সিক্যুরিটির হাতে পরতে হবে তাকে। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির হাতে পরা মানে, প্রায় জীবন শেষ। দু’বার পুরো রিং হয় কেটে গেল স্বস্তিকের ফোন। প্রজ্ঞা কল করেছে। না, কোনো উপায় নেই। স্বস্তিককে যেতেই হবে হাসপাতাল, লাগাতেই হবে হিডেন ট্রান্সমিটার।

হাসপাতাল পৌঁছবার সময় অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়ছিল। হাসপাতালের মুখ্য ফটক বেশ বড়ো। ফটকের সামনে যে সিক্যুরিটি গার্ড ছিল সে স্বস্তিকের থেকে চাইলো তার আই.ডি. কার্ড। নিজের ছোট্টো কেবিনে গিয়ে কি করলো, তার পর বেরিয়ে এলো সে। হাতে একটা গোল লোহার মেডেল। মেডেলটা স্বস্তিকের গলায় পরিয়ে, আই কার্ড ফেরত দিলো তাকে। স্বস্তিক দেখলো মেডেলে লেখা আছে – 146।
‘তার মানে আমার আগে 145 জন আছে।’ মনে মনে ভাবলো স্বস্তিক।
প্রজ্ঞা অপেক্ষা করছিল স্বস্তিকের। ভেতরে ঢুকতে দেখেই এগিয়ে গেল সে। স্বস্তিকের গলায় ঝোলানো মেডেল দেখে বলল- ‘145, তার মানে দেরি আছে। এখন বিরাশি নাম্বার চলছে।’
‘তোমার কাজ নেই?’ জিজ্ঞেস করলো স্বস্তিক।
‘এতক্ষণ তো কাজই করছিলাম। এখন একটু বিরতি পেলাম। চলো, কোথাও গিয়ে একটু বসি।’
স্বস্তিকের হাত ধরে তাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেল একটা রুমে প্রজ্ঞা। রুমটা বেশ বড়ো। অনেক ডেস্ক আর চেয়ার পাতা। দেয়ালে একটা ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে পেল স্বস্তিক। বুঝতে দেরি হলো না যে এটা ক্লাস রুম। বেশ কিছু লোক এদিক ওদিক বসে আছে। তারাও এসেছে সরকারের হুকুম পালন করতে। দুটো রিক্ত চেয়ারে গিয়ে বসলো প্রজ্ঞা আর স্বস্তিক। স্বস্তিকের ঈষৎ ফ্যাকাসে মুখ দেখে প্রজ্ঞা তাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘তোমার শরীর খারাপ নাকি? মুখটা শুকনো লাগছে তোমার।’

কথা শেষ করে স্বস্তিকের কপালে নিজের হাত রাখলো প্রজ্ঞা। এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দিলো স্বস্তিক।
‘মুখ শুকনো হলেই কি শরীর খারাপ হতে হয়? তোমারা ডক্টররা শরীর খারাপ ছাড়া কিছু বোঝো না?’
স্বস্তিকের এহেন ব্যবহারে অবাক হলো প্রজ্ঞা। স্বস্তিক এমন ব্যবহার তো কোনো দিন করেনি তার সাথে। আজ হঠাৎ তার হলো কী? আজকের দিনে প্রেম শব্দটা লুপ্তপ্রায়। লোকেদের ধারণা যে পুরুষ ও নারীর মধ্যে একটাই সম্পর্ক হওয়া উচিত, সেটা হলো শারীরিক সম্পর্ক। বিবাহ নামের যে সামাজিক রীতিটা বহু কাল ধরে চলে এসেছে, সেটা এখনও বর্তমান, শুধু মাত্র বংশ বৃদ্ধির কারণে। অল্প লোকেরাই আছে, যারা আজও প্রেম নামের শব্দকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অনুভূতিহীন মানুষ যান্ত্রিক রবোর্ট তুল্য। নিজেরদের রবোর্ট- এ বদলাতে চায় না স্বস্তিক আর প্রজ্ঞা। স্বস্তিকের কথায় প্রজ্ঞার খারাপ লেগেছে, তাই খারাপ লেগেছে স্বস্তিকেরও। পলকে প্রজ্ঞার হাসিমুখী চেহারাটা শুকিয়ে গেল। নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো স্বস্তিক।
প্রজ্ঞার হাতে নিজের হাত রেখে বলল- ‘আই এ্যাম সরি, প্রজ্ঞা।’
‘কী হয়েছে তোমার, স্বস্তিক?’
খানিক চুপ থেকে স্বস্তিক প্রশ্ন করলো- ‘একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে প্রজ্ঞা? হিডেন ট্রান্সমিটার মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে সরকার কী প্রমাণ করতে চায়?’
অদ্ভুত প্রশ্ন। এমন প্রশ্ন স্বস্তিক আগে কোনোদিন করেনি। আজ হঠাৎ এ ধরণের প্রশ্ন এলো কী করে তার মনে?
‘তুমি তো জানো স্বস্তিক সরকার কেন করছে এটা। এতে শুধু দেশের সুরক্ষা নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের নিজের সুরক্ষা আছে। যদি কখনও কেউ কোনো অসুবিধেতে পড়ে, তৎক্ষনাৎ ইন্টারনাল সিক্যুরিটি তাকে উদ্ধার করতে পারবে।’ প্রজ্ঞা বললো।

‘আজকের লোকেরা নিজেই উন্নত। তারা নিজের সাহায্য নিজেরাই করতে পারে। আর যদি গুরুতর কিছু ঘটে, তাহলে ইন্টারনাল সিক্যুরিটি সেখানে পৌঁছাবার আগেই ঘটনা ঘটে যাবে। এখনও বিজ্ঞান এতোটা উন্নতি করেনি যে তারা টেলিপোর্ট হয় পৌঁছে যাবে। এই যুক্তি জনতাকে ঠকাবার জন্য। আমাকে এই যুক্তি দিও না।’
প্রজ্ঞার আশ্চর্যের সীমা নিজের আকার বৃদ্ধি করছিলো।
‘তুমি বলতে কী চাও?’ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো প্রজ্ঞা।
‘কিছু সাধারণ কথা। সেগুলো হয়তো তুমিও জানো, কিম্বা না জানার অভিনয় করছো।’

স্বস্তিকের রহস্যময় কথার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে প্রজ্ঞা, কিন্তু পারছে না।
‘প্রজ্ঞা!’ স্বস্তিক পুনরায় বলতে শুরু করলো- ‘আসলে কি জানো? আসল কথা হলো বিশ্বাসের, যেটা সরকার আমাদের ওপর করে না। যে দেশের সরকার জনতার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, সে দেশের কী দশা হয় সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না। তোমার কি মনে হয় প্রজ্ঞা, আমি কি কোনো অসৎ কাজের সাথে লিপ্ত?’
‘সে তো আমিও নয় স্বস্তিক। তবু্ও তো আমি এ কাজ করেছি।’
প্রজ্ঞার কথায় মৃদু হাসলো স্বস্তিক।
‘সত্যটা শুনতে চাও। খারাপ লাগবে। কিন্তু শোনা দরকার। তুমি নিজের স্বাধীনতাকে সরকারের হাতে বিক্রি করে দিয়েছ। আজ তুমি যাই করো, সব খবর তাদের কাছে থাকবে। তোমার প্রাইভেসি বলে আর কিছু থাকলো না।’
প্রজ্ঞার মুখ পুনরায় পাণ্ডুবর্ণ হয় গেল। নিজেকে সামলে সে বলল- ‘আমার এমন কোনও প্রাইভেসি নেই যার কারণে আমি সরকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো।’
‘তোমার না থাক, অন্যের তো থাকতে পারে। দেশের সুরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে জনতার প্রাইভেসির মধ্যে হস্তক্ষেপ করার সরকারের কোনো অধিকার নেই। সরকার যদি দেশের সুরক্ষার অন্য কোনো উপায় না বার করতে পারে, তাহলে সেটা সরকারের অক্ষমতা। এটা হিডেন ট্রান্সমিটার নয় প্রজ্ঞা, এটা কুকুরের গলার চেন।’
স্বস্তিক উত্তেজিত হলো।
‘শান্ত হও স্বস্তিক। এখানে হল্লা করো না।’
স্বস্তিক শান্ত হলো। প্রজ্ঞা আর কথা বাড়াতে চায় না, তাই শান্ত কন্ঠে স্বস্তিককে বলল- ‘যাই হোক। এটা ভুল কি ঠিক সেটা ভাববার আমাদের দরকার নেই। সব জিনিসেরই দু’টো দিক থাকে। এখন আর কিছু করার নেই। কাজটা শেষ তো করতে হবে।’
দৃঢ় কন্ঠে স্বস্তিক বলল- ‘না, আমি পারবো না।’

পর্ব – 3
…………………….

স্বস্তিকের মুখে ‘না’ শুনে চমকে উঠল প্রজ্ঞা।
‘না মানে? তুমি প্রতিবাদ করতে চাও নাকি?’
প্রজ্ঞার কন্ঠস্বরে আতঙ্কের আভাস পরিস্কার বোঝা গেল।
‘প্রতিবাদ তো এক না একজনকে করতেই হবে, প্রজ্ঞা। আমি করলে ক্ষতি কী?’
‘তুমি পাগল হয় গেছো? তুমি জানো এই ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা কত ভয়ংকর? তোমায় কি ছেড়ে দেবে তারা?’ এবার উত্তেজিত হলো প্রজ্ঞা- ‘নিয়ম ভাঙ্গার শাস্তি কী জানো তো?’
‘জানি, তাও আমি প্রতিবাদ করবো। আমি নিজের জীবনের কিছু প্রাইভেসি কারুর সাথে শেয়ার করতে পারবো না।’
‘এমন কী প্রাইভেসি আছে তোমার জীবনে, যেটা আমি জানি না? আর আমি যতটুকু জানি, তাতে এমন কিছু নেই যেটা তুমি শেয়ার করতে পারবে না।’
স্বস্তিক চুপ রইল।
‘স্বস্তিক, জবাব দাও। তুমি কে, তোমার বাবা মা কে ছিলেন এটা শুধু আমি না সবাই জানে। তুমি কী করো, কোথায় থাকো, সেটাও সবাই ….।’
‘প্রজ্ঞা!’ প্রজ্ঞার কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিলো স্বস্তিক- ‘এমন কিছু নিশ্চয়ই আছে যেটা আমি শেয়ার করতে চাই না।’
প্রজ্ঞা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো স্বস্তিকের দিকে।
‘কী সেটা?’
স্বস্তিক আবার চুপ।
‘বলো স্বস্তিক। আমি জানতে চাই তুমি আমার থেকে কি লুকিয়েছো? তোমার কী এমন রহস্য আছে, যেটা আমি জানি না।’
‘সেটা যদি বলেই দি, তাহলে আর প্রাইভেসি কী রইলো?’
‘হেঁয়ালি করো না। আমার মাথা গরম হয় যাচ্ছে। যেটা জিজ্ঞেস করছি, সেটার জবাব দাও।’ ধৈর্য্য হারাচ্ছিল প্রজ্ঞা।
‘আমাকে ক্ষমা করো, প্রজ্ঞা। আমি বলতে পারবো না।’
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো স্বস্তিক।
‘এটা কী হচ্ছে, স্বস্তিক? তামাশা করছো কেন?’ ক্রোধে প্রজ্ঞার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। সেও উঠে দাঁড়ালো। বলল- ‘তুমি জানো তোমার এই নাটকের জন্য আমার চাকরি যেতে পারে। অসংখ্য ক্যামেরা আমাদের ওপর নজর রেখেছে। নিজের ড্রামা বন্ধ করো।’
‘আমি ড্রামা করছি না, প্রজ্ঞা। আমি নিজের প্রাইভেসি বিক্রি করতে পারবো না।’
‘তোমার প্রাইভেসি আমার থেকে বেশি ইম্পোর্টেন্ট?’
খানিক চুপ থেকে স্বস্তিক বলল- ‘বলতে পারো।’
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল স্বস্তিক।
‘তুমি পারবে না বেরোতে, স্বস্তিক। অকারণ ঝামেলা করো না।’ প্রায় চিৎকার করে কথাগুলো বললো প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার কথাগুলো হয়তো স্বস্তিকের কর্ণ স্পর্শ করলো না।
প্রজ্ঞা নিজের ডান হাতের ঘড়ির একটা বোতাম টিপলো। চারিদিকে শোনা গেল সাইরেনের আওয়াজ। স্বস্তিক দ্রুত গতিতে লিফ্টের দিকে এগোলো। কিন্তু লাভ হলো না। লিফ্ট বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেল সে। কিন্তু বিলম্ব হয় গেল। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা হাতে অত্যাধুনিক বন্দুক নিয়ে ঘিরে ফেললো তাকে। ক্রোধের কারণে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো স্বস্তিক। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির একটা গার্ড লঘু কদমে এগিয়ে এলো তার দিকে।
‘দু’ হাত ওপরে করুন।’ স্বস্তিককে বলল সে।
স্বস্তিক হাত তো ওপরে করলোই না, উল্টে তার পেটে সজোরে পদাঘাত করলো। গার্ডটা আঘাত পেয়ে সেখানেই বসে পড়লো। চকিতে স্বস্তিকের মাথার পেছনে হলো বিকট যন্ত্রণা। চোখের সামনে ধীরে ধীরে ছেয়ে গেল অন্ধকার। শরীর দুর্বল মনে হলো। দু’পায়ে যেন জোর নেই। অচেতন অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো স্বস্তিকা।
ঘটনাস্থলে প্রজ্ঞার সাথে ইন্টারনাল সিক্যুরিটির এক বড়ো অফিসার এলো। স্বস্তিকের মূর্ছিত দেহের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞাকে বললো- ‘ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদারের ছেলে এমন করলো কেন, বলতে পারেন?’
প্রজ্ঞা জবাব দিলো না। অপলক তাকিয়ে রইল স্বস্তিকের দিকে। তার দু’চোখে জল।

পর্ব – 4
…………………….

কঠিন সত্যটা স্বস্তিক জেনেছিল নিজের পিতার কাছে। ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদার স্বস্তিকের পিতা। এক সময় দেশের নাম করা ডাক্তার ছিলেন। বেশ কিছু কঠিন রোগের ওষুধের আবিষ্কার করে বেশ সুনাম কামিয়েছিলেন। রুগী দেখা হয়ে গেলে বাকি সময়টা ওষুধ আবিষ্কারের কাজে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। স্বস্তিক তাঁর এক মাত্র সন্তান। বহু বছর আগে তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ স্বস্তিকের মা স্বর্গ লাভ করেছেন।
যে দিন স্বস্তিক সেই সত্যটা জানতে পায়, তার পিতা মৃত্যুশয্যায়। একদিন স্বস্তিককে ডেকে তিনি বললেন- ‘স্বস্তিক, যাওয়ার আগে একটা দায়িত্ব তোমায় দিয়ে যেতে চাই।’
‘কী বাবা?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন- ‘তুমি হয়তো জানো না বেহালাতে আমার একটা বাড়ি আছে। বেশ পুরনো বাড়ি। আমার ঠাকুরদা সেই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। সেই বাড়ির বিষয় আজকের দিনে তুমি কেন, কেউ জানে না। বলতে পারো ওটা আমার গোপন ঠিকানা। আমার মৃত্যুর পর তুমি সেই বাড়িতে যাবে।’
সেই বাড়িতে কেন যেতে হবে, স্বস্তিক বুঝতে পারলো না।  জিজ্ঞাসু নেত্রে চেয়ে রইলো নিজের পিতার দিকে। খানিক বিরতির পর সৃঞ্জয় মজুমদার আবার বলতে শুরু করলেন- ‘সেই বাড়িতে একজন আছে। তোমাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে।

‘কে আছে সেখানে?’
‘তোমার বোন।’

চমকে উঠল স্বস্তিক। তার বোন হঠাৎ কোত্থেকে এলো? সে তো জানতো নিজের পিতার সে একটি মাত্র সন্তান। স্বস্তিক নিজের পিতার দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো।

‘এটাকে আমার ভুল বলতে পারো না। একজনের বিষণ্ণ মুখ আমার সহ্য হয়নি। কোনো স্ত্রীর স্বামীর মধ্যে যদি বাপ হওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সেই স্ত্রীর শোক দেখা যায় না। আমিও দেখতে পারিনি তোমার মাসির শোক। বিষাদে ভরা সেই মুখ আমার সহ্য হয়নি। আমি তার শূন্য কোল ভরিয়ে দিয়েছিলাম।’
ক্রোধে, ঘৃণায় স্বস্তিকের সম্পূর্ণ শরীর জ্বলছিল। স্বস্তিক জানতো তার মেসো আত্মহত্যা করেছিল। তাহলে তার পেছনে এটাই কারণ! একটা লোক, যার সম্পূর্ণ দেশে, সম্পূর্ণ বিশ্বে নাম, ডাক আছে, তার এই কুকীর্তি?
যে সময় সৃঞ্জয় নিজের মৃত স্ত্রীর ভগিনীর ওপর স্নেহের হাত রেখেছিলেন, সে সময় তাঁর মানসিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। সারা দিন নানাবিধ ওষুধের গবেষনায় তিনি ব্যস্ত থাকতেন, যার ফলে অল্প হলেও নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে সুস্থ হলেও সেটার প্রভাব পড়েছিল তাঁর শিশু কন্যাটির ওপর। ছ’বছর বয়স অবধি যখন তার মানসিক বিকাশ হলো না, চিন্তায় পড়লেন সৃঞ্জয়। নিজেরই কিছুদিন পূর্বে আবিষ্কৃত এক ওষুধ প্রয়োগ করলেন নিজের কন্যার ওপর। হিতে বিপরীত হলো। তাঁর কন্যা হয়ে উঠল ভয়ানক রাগী, ভয়ানক মারমুখী।
‘কোনো মানুষ এতো হিংস্র হতে পারে, জানা ছিল না আগে। আমি বুঝতে পারলাম আমার এক্সপেরিমেন্ট বিফল হয়ছে। তখন আর কিছু করার ছিল না। তবে থেকে সে আমার বেহালার বাড়িতে বন্দী।’
‘তার বড়ো জায়গায় চিকিৎসা করাতে পারতে তো।’ বলল স্বস্তিক।
‘পারতাম। কিন্তু করাইনি। তার পরিচয় আমি লুকিয়ে রেখেছি। নিজের বদনমীর ভয় ছিল আমার।’
নিজের বদনমীর ভয়ে স্বস্তিকের পিতা এক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিলেন। যে লোক অন্যের জীবন রক্ষার জন্য সারা জীবন অফুরন্ত পরিশ্রম করে গেল, সেই নাকি নিজের মেয়ের জীবন বরবাদ করলো!
কিছু দিন পরেই সৃঞ্জয় ইহলোক ত্যাগ করলেন। মুখাগ্নির সাথে সব কাজই স্বস্তিক করলো, কিন্তু শুধু নিয়ম রক্ষার খাতিরে। ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদার মৃত্যুর পূর্বেই নিজের পুত্রের কাছে নিজের সম্মান হারিয়েছিলেন।

পর্ব – 5
…………………

বাড়িটা খুব ছোটো। একতলা । সামনে অল্প জায়গা ছাড়া আছে। কোনোকালে হয়তো সেখানে বাগান ছিল, এখন ঝোপ ঝাড় ভিন্ন আর কিছুই নেই। বাড়িটা যে বেশ পুরনো, সেটা এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। চাবি দিয়ে সদর দ্বার খুলে ভেতরে ঢুকলো স্বস্তিক। বাইরে দিনের আলো, তবুও ভেতরটা অন্ধকার প্রায়। যেটুকু আলো ভেতরে প্রবেশ করছিল, তাতেই সুইচ বোর্ড খুঁজে পেল স্বস্তিক। চারিপাশে জমে আছে এক রাশ ধুলোর স্তুপ। বাড়িটা যে দীর্ঘ দিন ধরে অযত্নে আছে, সেটা দেখেই বোঝা যায়। ডাইনিং হলের মাঝে বড় এক অর্ধভগ্ন টেবিল পাতা। তার চারিপাশে চারটে চেয়ার পাতা। লাইট জ্বালাতে অল্প আলো হলো। বাড়ির অবস্থা দেখেই গা গুলিয়ে উঠল স্বস্তিকের। কোন দিকে যাবে, কী করবে কিছুই ঠাহর করতে পারছিল না সে। হঠাৎ তার নজর গেল মাটির দিকে। ধুলোর স্তুপের মধ্যে দেখতে পেল নগ্ন পায়ের ছাপ। ছাপটা কার, বুঝতে পারলো স্বস্তিক। একটা বন্ধ ঘর থেকে পায়ের ছাপটা বেরিয়ে চলে গেছে যত্র তত্র। স্বস্তিক এগোলো সেই বন্ধ ঘরের দিকে। দরজায় আওয়াজ করলো, কোনো সাড়া পেল না। পুনরায় শব্দ করলো, একই অবস্থা। একবার আরও দরজায় টোকা মারতে যাবে, দরজা খুলল। নিজের সামনে এক জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল স্বস্তিক। বুঝতে সময় নিলো না, তার সামনে যে দাঁড়িয়ে সে তার সৎ বোন। চুলগুলো ছেলেদের মত করে কাটা, চোখ দুটো বেশ বড় কিন্তু ঈষৎ রাঙ্গা। পরনে দেহের আকার থেকে বেশ বড় এক ফুল হাতা জামা ও ফুল প্যান্ট। খানিক বিস্ময়ে চেয়ে রইল স্বস্তিকের দিকে। সৃঞ্জয়কে চিনতো, স্বস্তিককে দেখলো প্রথম।
‘কে?’ কন্ঠে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
‘আমি স্বস্তিক। ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদারের ছেলে। তোমার নাম কি আভা?’ স্বস্তিকের গলা সহজ।
দরজা অর্ধেক খোলা ছিল, পুরো খুলে দিলো আভা। তার আচরণ স্বাভাবিক। সৃঞ্জয় হয়তো আভাকে স্বস্তিকের বিষয় বলেছেন। দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো আভা। স্বস্তিকের ঘরে প্রবেশ করার সংকেত। ঘরে আসবাব পত্র বলতে কিছুই নেই। একটা খাট, আলমারি, আলনা এবং একটা রেফ্রিজারেটর। স্বস্তিকের হাতে বেশ বড় একটা প্যাকেট, খাবারের। কোথায় রাখবে ভাবছে।
আভা তার হাত থেকে সেটা নিয়ে নিলো। জিজ্ঞেস করলো- ‘বাবা কোথায়?’
মাথা হেঁট করলো স্বস্তিক। কি করে সে পিতৃ বিয়োগের সংবাদ দেবে, ভেবে পাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে বলল- ‘এবার থেকে অমিই আসবো।’
দীর্ঘ কাল একা থাকার এবং অসুস্থতার দারুণ বেশিরভাগ মানুষই খিটখিটে হয় যায়। স্বস্তিক জানতো না যে আভার ভেতরে এমন আচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা। আভার ক্রোধের বিষয় তার জানা আছে। এই কথাটা বলবার পর ভয়ে ভয়ে তাকালো আভার দিকে। আভার দু’চোখ বিস্ফোরিত। হাতের প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো মাটিতে।
‘না। বাবা ছাড়া আমি কারুর হাতে খাবার নেবো না। তুই কে আমায় খাবার দিতে আসার? বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এখান থেকে। চিৎকার করে বললো আভা।
থতমত খেয়ে গেল স্বস্তিক। কিন্তু পলকে নিজেকে সামলে নিলো। উত্তেজনাতে আভার শরীর থরথর কাঁপছে। দ্রুত বেগে চলছে তার নিঃশ্বাস। ক্রোধ হলো স্বস্তিকেরও। নিজের ওপর, নিজের পিতার ওপর। সৃঞ্জয় নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কেন নিজের পুত্রের ঘাড়ে ফেলে গেলেন? কেনই বা স্বস্তিক নিতে গেল সেই দায়িত্ব? এতো বছর পর্যন্ত যাকে চিনতো না, জানতো না, হঠাৎ করে তার দায়িত্ব তার কাঁধে চলে এলো। চকিতে তার চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন ঘটলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অসহায় মেয়ে। সে নিশ্চয়ই নিজের ইচ্ছেতে এই পৃথিবীতে আসেনি । স্বস্তিকের ধমনীতে বইছে যার রক্ত, এই মেয়েটার ধমনীতেও বইছে তারই রক্ত। সৎ হলেও, আভা তার বোন। এই সত্যটা মানতে সে বাধ্য।
আরেক কথা মনে পড়লো স্বস্তিকের। সে নিজের পিতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তার পিতা নিজের জীবনে ভুল করে থাকুক না কেন, সে কোনো দিন ভুল করেনি, আর করবেও না।
‘রাগ করো না, আভা। যেটা সত্যি , সেটাকে মানতেই হবে‌। আর এটাই সত্য যে তোমার …. মানে আমাদের বাবা আর এখানে আসবে না। সে দেহ ত্যাগ করেছে।’
শেষের কথা গুলো চাপা গলায় বলল স্বস্তিক। অল্প ভারী হয় গিয়েছিল তার কন্ঠস্বর।
খানিক অপলক চেয়ে রইল স্বস্তিকের দিকে আভা। অতঃপর দেয়ালে পিঠ সাঁটিয়ে মাটিতে বসে পড়লো।

পর্ব – 6
…………………….

অনেক কষ্টে নিজের চোখ মেললো স্বস্তিক। সংবিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগলো। মাথার পেছনে অল্প যন্ত্রণা। কারণটা মনে পড়লো তার। আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো চারিদিকে। ছোট্টো একটা ঘরের মাঝে পাতা এক ট্রলিতে শুয়ে আছে সে। কতগুলো ছোটো ছোটো লাইট ঘরটাকে নিবিড় অন্ধকার থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। স্বস্তিক লক্ষ্য করলো তার গায়ে এক সবুজ রঙের চাদর । হঠাৎ তার বাঁ দিক দিয়ে শব্দ হলো একটা। দরজা খোলার শব্দ। সে দিকে দেখার চেষ্টা করলো স্বস্তিক। প্রজ্ঞা এগিয়ে আসছে তার দিকে। পাশে এসে দাঁড়ালো প্রজ্ঞা। মুখ গম্ভীর।
‘শরীর কেমন লাগছে এখন?’ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো প্রজ্ঞা।
উঠে বসবার চেষ্টা করলো স্বস্তিক, প্রজ্ঞা বাধা দিলো।
‘উঠতে হবে না। রেস্ট নাও।’
কোমরের কাছে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো স্বস্তিক। অজান্তেই তার হাত চলে গেল সেখানে। জামাটা একটু উঠিয়ে দেখল, বাঁ দিকের কমরে বাঁধা আছে ব্যান্ডেজ। ব্যাপারটা বুঝতে সময় নিলো না সে। তার অচেতন অবস্থাতেই এরা নিজের কাজ সেরে নিয়েছে। বিরক্তি এবং হতাশা মেশানো দৃষ্টিতে তাকালো প্রজ্ঞার দিকে।’
পারলে তোমরা এটা করতে? ছল করে কাজ সেরে নেওয়া তোমাদের মত প্রতিষ্ঠিত লোকেদের শোভা দেয় না।’
‘কোনো উপায় ছিল না, স্বস্তিক। তুমি যা শুরু করেছিলে, তাতে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’ শান্ত কন্ঠে বলল প্রজ্ঞা।
এবার উঠে বসলো স্বস্তিক। প্রজ্ঞা পুনরায় বাধা দিতে চাইলো, শুনলো না স্বস্তিক।
‘শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার জন্য এতো চিন্তা কিসের? প্রত্যেকেই তো এই যন্ত্র লাগিয়ে উল্টো পায়ে ফিরে যাচ্ছে। আমি তো স্পেশাল নয়।’ ঈষৎ উত্তেজনা স্বস্তিকের কন্ঠে।
নিজের বাঁ হাত স্বস্তিকের ডান কাঁধে রাখলো প্রজ্ঞা, তাকে শান্ত করার চেষ্টা।
‘ আমি তো তোমায় বলেছিলাম ……। ‘
‘থাক প্রজ্ঞা। কথা বাড়াতে হবে না। শুধু একটা কথা বলতে চাই। তাহলেই বুঝে নাও, স্বাধীনতা কোথায়? এখন আমরা তাদের হাতের পুতুল, যাদের ভোট দিয়ে আমরাই আসনে বসিয়েছি।’
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো স্বস্তিক। এগোলো দরজার দিকে।
‘শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও, স্বস্তিক।’ প্রজ্ঞা ট্রলির কাছে দাঁড়িয়ে স্বস্তিককে বলল ।
‘কী জানতে চাও?’ রুক্ষ কন্ঠে বলল স্বস্তিক।
‘তোমার জীবনে এমন কী রহস্য আছে, যেটা আমি জানি না?’
চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললো স্বস্তিক। বলল- ‘আমি তো আগেই বলেছি, আমি বলতে পারবো না।’
স্বস্তিক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কেন বলতে পারবে না প্রজ্ঞাকে সে আভার বিষয়? সে তো ভুল কিছু করেনি। বরং একটা ভাল কাজ করেছে সে। এক অসহায় মেয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে। এতে তো স্বস্তিকের সম্মান বৃদ্ধি হওয়া উচিত।’ সম্মান শব্দটা খোঁচা মারলো স্বস্তিককে। নিজের সম্মান প্রত্যেকের কাছে প্রিয়। প্রিয় ছিল সৃঞ্জয়ের কাছেও। তাই তো আভার পরিচয় তিনি গোপন রেখেছিলেন চিরকাল। স্বস্তিকের পরিচয় কী? ছোটো খাটো একটা ব্যবসায়ী মাত্র। যে ফ্ল্যাটে থাকে, সেটাও তার নিজের নয়। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে দানে পাওয়া। এখনও লোকেরা স্বস্তিককে ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদারের ছেলে বলেই চেনে। নিজের পিতার সামনে সে তো নগন্য। পিতার চরিত্রে সার্বজনিক ভাবে হীনতার আরোপ লাগানোর তার কোনো অধিকার নেই। না, সে নিজের পিতার সম্মান নষ্ট হতে দেবে না। কিছু একটা করতেই হবে তাকে। বেহালা যেতে পারবে না সে এবার। গোপন ঠিকানার রহস্য ভেদ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। রহস্য রহস্যই থাক, এটাই সবার পক্ষে ভালো। অন্ততঃ সৃঞ্জয় মজুমদারের পক্ষে তো বটেই। কিন্তু কী করবে মাথায় আসছে না স্বস্তিকের। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেছে স্বস্তিক। বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। এখন দুপুর দু’টো, কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। নিজের পিতার সম্মান রক্ষার উপায় সে কিছুতেই বার করতে পারছে না। বাড়ি ফিরেও সে স্থির বসতে পারছে না। মনের ছটফটানি তার সর্বাঙ্গে দেখা দিয়েছে। কখনও চেয়ারে বসছে, কখনও সোফাতে, কখনও সারা ফ্ল্যাট হাঁটছে। ইতিমধ্যেই প্রজ্ঞার বেশ কয়েক বার ফোন চলে এসেছে। কথা বললো না স্বস্তিক। ফোন বন্ধ করে রেখে দিলো। চিন্তার মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে হঠাৎ এক বুদ্ধি খেললো তার মস্তিষ্কে। চকিতে ছ্যাঁৎ করে উঠল তার হৃদয়। যেটা সে ভাবলো, সেটা করতে পারবে তো? অন্য কোনো পথ তো সে আর দেখতে পারছে না। স্বস্তিক মনস্থির করলো। যেটা ভেবেছে, সেটাই করবে।

পর্ব – 7
…………………….

‘বাবা, আমি যা কিছু করছি তোমার খাতিরে। যদি ভুল করি, ক্ষমা করে দিও।’ মনে মনে বলল স্বস্তিক।
মোবাইল অন করে আভাকে ফোন করলো। আভাকে একটা মোবাইল সে দিয়েছিল। মোবাইল আভার হাতে দিয়ে সে বলেছিল- ‘এটা রাখো। ইচ্ছে তো আছে রোজ আসবার, কিন্তু সম্ভব হবে না। ফোন থাকলে রোজ কথা তো হতে পারবে।’
প্রথম আলাপের পর আভার সাথে সম্পর্কটা বেশ মধুর হয় উঠেছিল স্বস্তিকের। পিতৃ বিয়োগের সংবাদ পেয়ে বিষাদের গভীর সাগরে ডুবে গিয়েছিল আভা। দেয়ালে পিঠ সাঁটিয়ে মাটিতে বসে পড়েছিল। দু’পায়ের মাঝে গুঁজে দিয়েছিল নিজের মুখ। তার পাশে গিয়ে বসেছিল স্বস্তিক। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল- ‘আমাদের এটা মেনে নিতেই হবে আভা। এটাই সত্য। এবার থেকে তোমার বাবার বদলে তোমার বড়ো ভাই আসবে তোমার কাছে। তোমার কোনো আপত্তি আছে?’
মুখ তুলে অশ্রু ভেজা চোখে আভা তাকিয়েছিল স্বস্তিকের দিকে। অশ্রু মুছে দিয়েছিল স্বস্তিক। আভা আগের থেকে অনেক সুস্থ। একদিন সে স্বস্তিককে বলেছিল- ‘তোমার কী মনে হয়? আমার মাথা খারাপ? হ্যাঁ, হঠাৎ করে মাঝে মাঝে মাথা গরম হয় যায় ঠিকই। কিন্তু এটা কি এতোই গভীর সমস্যা যে আমাকে এই বাড়ি থেকে বেরোতে দিতে নেই? বাবার চিকিৎসাতে এখন আমি তো অনেকটাই সুস্থ। তাও বাবা আমাকে কেন বেরোতে দিতো না, দাদা?’
জবাব দিতে পারেনি স্বস্তিক। শুধু বলেছিল- ‘তুমি বাইরে যেতে চাও? ঠিক আছে, আমি নিয়ে যাবো।’
নিয়ে গিয়েছিল স্বস্তিক । আভা যেন এক নতুন জীবন পেয়েছিল। স্বস্তিকের হৃদয়ে গভীর জায়গা দখল করে নিয়েছিল সে। ‘বোন’, এই একটা শব্দ স্বস্তিকের যেন সম্পূর্ণ জীবন পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল।

আভাকে ফোনে স্বস্তিক বলল- ‘তুমি বেরিয়ে চৌমাথায় এসো। আমি এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছবো।’
চমকে উঠল আভা।
‘এখন! খুব বৃষ্টি পড়ছে তো।’
‘হ্যাঁ, এখন। হাতে সময় নেই। আমি যে কোনোদিন আর সেই বাড়িতে যেতে পারবো না।’
‘কেন?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো আভা।
‘দেখা করে বলবো। তুমি চৌমাথার বাস স্টপে দাঁড়াও। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।’
ফোন কেটে দিলো স্বস্তিক। জানালার বাইরে তাকালো। ঠিকই, বৃষ্টি বেশ প্রবল বেগে পড়ছে। পথে ঘাটে জলের প্রাচুর্য বেড়েছে নিশ্চয়ই। প্রকৃতি যেন বাধা উৎপন্ন করার চেষ্টা করছে স্বস্তিকের পথে। কিন্তু স্বস্তিকের সিদ্ধান্ত দৃঢ়। এই হিডেন ট্রান্সমিটার তার জীবনের গোপনীয়তা প্রকাশ্যে এনে দেবে। লোকেরা জানতে পেরে যাবে বেহালার গোপন ঠিকানার বিষয়। প্রশ্ন উঠবে আভার পরিচয় নিয়ে। না, আর সহ্য করতে পারছে না স্বস্তিক। মাথা কেমন দপদপ করে উঠছে তার। দ্রুত কদমে রান্না ঘরের দিকে এগোলো সে। একটা ধারালো ছুরি হাতে নিলো। সন্তর্পণে কোমরের ক্ষতস্থান থেকে ব্যান্ডেজ সরিয়ে ছুরি স্পর্শ করলো। বিকট যন্ত্রণার সাথে প্রবল রক্তপাত। দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করলো। খানিক পরেই তার হাতে চলে এলো ছোট্টো, চ্যাপ্টা, গোলাকৃতির এক ট্রান্সমিটার। সেটা কে পায়ের তলায় পিষে, ক্ষতস্থানে কোনোক্রমে একটা মোটা কাপড় বেঁধে দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল সে। স্বস্তিক জানে তার হাতে এবার সময় অল্প। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা হিংস্র কুকুরের মতো খুঁজে বেড়াবে তাকে এবার। যে সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল, সেটার প্রথম পদক্ষেপ সে পেরিয়ে গেছে। এবার পেছনে হটবার আর কোনো উপায় নেই। কিছু হিংস্র মানুষের হাত থেকে বেঁচে যত শীঘ্র সম্ভব আভার কাছে পৌঁছতে হবে। নিজের গাড়ি বার করলো স্বস্তিক। বৃষ্টির বেগ এতো প্রবল যে শহরের কিছু রাস্তা নদীতে পরিণত হয়েছে। এই নদী পেরিয়ে আভার কাছে পৌঁছতে সময় লাগবে। খুব মন্থর গতিতে এগোচ্ছে স্বস্তিকের গাড়ি। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইন্টারনাল সিক্যুরিটি যে কোনো সময় হামলা করতে পারে তার ফ্ল্যাটে। সেখানে পাবে না স্বস্তিককে। চকিতে শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে খবর। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে এদের ঠিকানা। স্বস্তিকের বেহাল পৌঁছনোতে লেগে যেতে পারে প্রশ্ন চিহ্ন। বুক টিপটিপ করছে স্বস্তিকের। দু’চারটে ইন্টারনাল সিক্যুরিটির গাড়ি তার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। বুকটা ধড়াস করে উঠল তার। ভয়ে যেন তার হাত,পা অবশ হয়ে গেল। কোনোরকমে সে এগিয়ে চলল।

পর্ব – 8
……………………..

এক সময় স্বস্তিক পৌঁছল বেহালার চৌমাথায় এসে। বেশ ভালোই সময় লাগলো তার। সে দেখল কাঁচ দিয়ে ঘেরা বাস স্টপের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে আভা। রাস্তায় প্রায় হাঁটু পর্যন্ত জল। বাস স্টপের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো স্বস্তিক। গাড়িটা চিনতো আভা। এই গাড়িতে চড়ে স্বস্তিকের সাথে সে বহু বার বেরিয়েছে। এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। দরজা খুলে স্বস্তিকের পাশে বসলো। 

‘ব্যাপার কী দাদা?’ উত্তেজিত কন্ঠে আভা জিজ্ঞেস করলো।
‘বলছি।’ গাড়ি নিয়ে স্বস্তিক এগিয়ে গেল।

কোন দিকে যাবে জানে না সে। এই মুহূর্তে তার কোন দিকে যাওয়া উচিত, বুঝতে পারছে না। যেটা সে মনস্থির করেছে, সে কাজটা করতে হঠাৎ কিছু অজ্ঞাত কারণে দ্বিধা বোধ করছে সে। কিন্তু আর তো কোনো উপায় নেই। একবার আভার সাথে এ বিষয় আলোচনা করে নেওয়া ভালো। আভা তাকে আবার জিজ্ঞেস করলো- ‘দাদা, ব্যাপারটা কি? আমার যাচ্ছি কোথায়?’
‘কোথায় যাচ্ছি সেটা বলার আগে একটা কথা তোমাকে বলে দিতে চাই, আভা।’ কথা শেষ করে আভার দিকে তাকালো স্বস্তিক।
‘কী কথা?’ উৎকন্ঠা মেশানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আভা।
ধীর কন্ঠে বলতে আরম্ভ করলো স্বস্তিক। বললো নিজের পিতার কর্ম, বলল হিডেন ট্রান্সমিটারের বৃত্তান্ত, বলল পিতার সম্মান রক্ষার কথা। অবশেষে বললো পিতার সম্মান রক্ষার এক মাত্র উপায়। দু’চোখ বন্ধ করে কথাগুলো শুনছিল আভা। স্বস্তিকের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বলল- ‘আর যখন কোনো উপায় নেই, তখন এটাই ঠিক। তুমি যা করেছো, ঠিক করেছো, দাদা। বাবার সম্মান রক্ষার খাতিরে তুমি যাই করো, আমি তোমার সাথে থাকবো।’
স্বস্তিক নিজের বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরলো আভার ডান হাত।
তাদের গাড়ি এগিয়ে চললো ডায়মন্ড হার্বার রোড ধরে। অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা ছ’টা বাজে, কিন্তু মনে হয় যেন রাত নেমে এসেছে। বৃষ্টির বেগ যেন বেড়েই চলেছে। হঠাৎ তারা দেখল এক সাথে অনেক গাড়ি, বাস ও ট্রাক পংক্তিবদ্ধ হয় দাঁড়িয়ে আছে। কী ব্যাপার? বুকটা পুনরায় টিপটিপ করে উঠল স্বস্তিকের। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলো- ‘এতো জ্যাম কেন?’

জবাব পেল- ‘ইন্টারনাল সিক্যুরিটির তামাশা, মশায়। চেকিং চলছে। কিসের চেকিং সেটা ভগবানই জানেন।’
বুকটা স্বস্তিকের ধড়াস করে উঠল। ভয় মেশানো দৃষ্টিতে তাকালো আভার দিকে।
‘কী হবে এবার?’ আভার কন্ঠেও আশঙ্কার ছাপ স্পষ্ট।
গাড়ির ভেতর থেকেই চারিপাশে ভালো করে দেখে নিল স্বস্তিক। কিছু একটা চোখে পড়লো তার। রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে চলে গেছে একটা লম্বা ব্রিজ। আসলে সেটা যে মেট্রো রেলের লাইন, সেটা বুঝতে পেলো স্বস্তিক। চকিতে মাথায় আরেক উপায় এলো তার। চোখের ইশারাতে আভাকে গাড়ি থেকে নামতে বলল। গাড়ি থেকে নেমে সন্তর্পণে তার মেট্রো স্টেশানের দিকে এগোতে লাগলো। অবশেষে একসময় মেট্রো স্টেশনে এসে পৌঁছলো তারা। পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে প্রায় আধ ঘন্টা সময় লাগলো তাদের। মেট্রো স্টেশন ছিলো পেছন দিকে। তাই সিক্যুরিটির নজরে আসার সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল। সর্বাঙ্গ ভেজা তাদের। কিন্তু সে দিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। দু’টো টিকিট কেটে’ সুরক্ষা গন্ডী পেরিয়ে তারা প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলো। রক্ষে যে এখানে কোথাও ইন্টারনাল সিক্যুরিটি নেই। প্ল্যাটফর্ম চারিদিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা। লাইনের ধারে কাঁচের বেশ কিছু দরজা আছে। মেট্রো এসে দাঁড়ালে, মেট্রোর দরজা এবং সেই কাঁচের দরজা একসাথে খোলে। অত্যাধিক বর্ষার দারুণ যাত্রীর সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না। খানিক পরেই মাইকে ঘোষণা হলো, ধর্মতলা থেকে কাকদ্বীপ যাওয়ার মেট্রো এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে আসতে চলেছে। নিজের উদ্দেশ্যের দিকে আরও এক পা এগিয়ে যাওয়ার সময় চলে এলো স্বস্তিক ও আভার। দু’জনেই একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো। আভার মন দুর্বল, তাও সে নিজের পিতার সম্মান রক্ষার খাতিরে নিজের দাদার মতে একমত হয়েছে। আভার গালে নিজের হাত রাখলো স্বস্তিক। চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল আভার।
মেট্রোতে চড়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে দু’জনে দেখতে পেলো রাস্তায় গাড়ির সে লম্বা লাইন। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা একে একে করছে সব গাড়ির তল্লাশি।

কাকদ্বীপের সেই বৃহৎ জলাশয় আজ নিয়েছে ভয়ংকর রূপ। চারিদিকে অন্ধকার। অঝোরে পড়ছে বৃষ্টি। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বস্তিক ও আভা। হঠাৎ যেন তারা সমুদ্রের ওপারে দেখতে পেলো নিজের পিতার প্রতিচ্ছায়া। শেষ বারের মতো আলিঙ্গনবদ্ধ হলো দুজনে। সমুদ্র এগিয়ে আসছে তাদের দিকে, তারা এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শেষ বারের মতো চোখ মেলে নিজের বোনের শূন্যে ভাসা দু’টো হাত দেখল স্বস্তিক।

ক্রমাগত স্বস্তিকের মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছে প্রজ্ঞা। একই কথা সে বার বার শুনতে পাচ্ছে- ‘The number you have dial is switch off right now. Please try after some time’

সমাপ্ত ।

Exit mobile version