আদর্শ
-পারমিতা চ্যাটার্জী
গল্পের প্লটটা অনেকদিন আগের একটি মেয়ের কথা- সে সময় মেয়েরা জন্মালে বাড়িতে বেজে উঠতো না মঙ্গল শঙ্খ।
দীপালীকা ছিল ওর নাম কালিপুজোর দিন চতুর্দিক যখন প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত ঠিক তখনই আঁতুড় ঘর থেকে একটি সদ্যোজাত শিশুর কান্না ভেসে আসে, দাই বেরিয়ে এসে খবর দিল উদগ্রীব পিতাকে, মেয়ে হয়েছে গো।
পিতা সুধাময়ের মুখে হাসি উঠল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন- মেয়ের মা ভালো আছে তো?
দাই অবাক হয়ে জবাব দিল,-হ্যাঁ। মেয়ে হয়েছে শুনে কোন বাপের মুখ যে এমন হাসিতে ভরে যেতে পারে এরকমটা সে দেখে অভ্যস্ত নয়।
সুধাময়ের মা ঘর থেকে বের হলেন গম্ভীরমুখে- মাকে দেখে সুধাময় হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল- মা সুখবর আছে তো। মিষ্টি নিয়ে আসি?
– সুখবর? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে খোকা?
– কেন?
– হয়েছে তো একটা মেয়ে তারজন্য আবার মিষ্টি?
– তার মানে? আজ দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজোর দিন তোমার ঘর আলো করে মা লক্ষ্মী স্বয়ং এলেন তার তুমি তাকে তাচ্ছিল্য করছো?
– হ্যাঁ, তুমি ওই নিয়ে খুশি থাকো শান্তিতে থাকো, আমাকে এর মধ্যে জড়িয়ে না–
– হ্যাঁ মা এতেই আমার শান্তি আমার মুক্তি। ওর নাম রাখলাম দীপালীকা।
– তা নাম তো তুমি যাই রাখো ওর পাঁচ ছ’বছর বয়েস হলেই ওকে বিয়ে দিয়ে দেব।
– না মা তা হবেনা। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় মেয়েদের অন্ধকার থেকে আলোয় আসার পথ দেখিয়েছেন। আমি সেই আলো থেকে আমার মেয়েকে বঞ্চিত করবনা। ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল বেথুনে পড়াশোনা করবে।
– কি বলছিস তুই?( দুু’কান চাপা দিয়ে বললেন) এ কথা শোনাও পাপ..
– তাহলে আমি সেই পাপ কাজটাই করব।
– এতে তোর পূর্বপুরুষরা তোকে ক্ষমা করবেন না। কেন তুই একটা মেয়ের জন্য অভিশাপ কুড়োবি?
– এতে যদি আমার অভিশাপ লাগে তো সেই অভিশাপ মাথায় করে নেব। ও একটা মেয়ে নয়,ও আমার মেয়ে। আমি ওকে আমার আদর্শে গড়ে তুলবো।
মায়ের আদেশ অমান্য করে? এতে তুই শান্তি পাবি?
– হ্যাঁ মা এতেই আমি শান্তি পাবো। এক্ষেত্রে যদি নিজের আদর্শকে অস্বীকার করে আমার মেয়েকে তোমাদের অন্ধ কুসংস্কারের অন্ধকার গলিতে ঠেলে দিই তাহলে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি সারাজীবন অশান্তিতে জ্বলে পুড়ে মরবো। কিন্তু আমার অর্জিত আদর্শে যদি আমার মেয়েকে আমি গড়ে তুলতে পারি, তাতেই আমার পরম শান্তি মা পরম শান্তি। এরপরও যদি তুমি আমাকে এ নিয়ে আর একটা কথাও বলো তাহলে এই দীপান্বিতার সন্ধ্যাবেলায় দাঁড়িয়ে বলছি, তুমি তোমার ছেলের মরামুখ দেখবে। এ দেশের শত শত মেয়ের কান্না তোমার চোখে পড়েনা? ছোট্ট মেয়েগুলোকে বৈধব্যের কঠোর নিয়মে ফেলে তোমরা কি আনন্দ পাও? না.. তুমি যদি বলো আমি মাতৃ আদেশ লঙ্ঘন করছি। তবে হ্যাঁ আমি তাই করছি। সবক্ষেত্রে অন্যায় মাতৃ আদেশ মেনে নেওয়া যায়না। তোমার আদেশ রক্ষা করতে গেলে, আমি নিজের আত্মজার প্রতি চরম অপরাধ করবো। তাতে আমি শান্তি পাবো না মা। তারচেয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়াই ভাালো। আর যদি বিদ্যাসাগরের আদর্শে আমার আত্মজাকে গড়ে তুলতে পারি। তাতেই পাবো আমি পরম শান্তি, পরম মুক্তি।