শাস্তি
-রেহানা দেবনাথ
রায়ান সানার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সিটি হাসপাতালে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে আই.সি.ইউ. তে সানার চিকিৎসা চলছে। রায়ান এর দুচোখে জল চলে আসে সত্যিই তো সে চায়নি, সানাকে শাস্তি দিতে বা সে মারা যাক! সে শুধু সানার বাবাকে শাস্তি দেবার জন্য ঘটনাটি ঘটিয়ে ছিল। সে তো ভেবেই ছিল কয়েকদিন পর সব সত্য জানিয়ে দেবে কারণ সে সানাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে। হঠাৎ জামার কলারে টান পড়তেই রায়ান সম্বিৎ ফিরে পায়! দেখে সানার বাবা ওর জামার কলার ধরে টানতে টানতে হাসপাতালের বাইরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে “হারামজাদা তোর এত বড় সাহস আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলে আবার তাকে দেখতে এসেছিস! আজ তোকেও শেষ করে দেব।” রায়ান এক ঝটকায় কলার ছাড়িয়ে নেয় আর তার ঝটকার চোটে টাল সামলাতে না পেরে সানার বাবা মাটিতে পড়ে যায়।চেঁচামেচির আওয়াজে অন্য রোগীদের বাড়ির লোকজনদের সাথে সাথে হসপিটালের লোকজনও এসে পড়ে। ততক্ষণে রায়ান হসপিটালের বাইরের দিকে চলে এসেছে। পিছনে লোকজনের জোরে চিৎকারে যেই সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে অমনি একটা রড তার মাথায় পড়লো আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়লো। রায়ান প্রচন্ড যন্ত্রনায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো, কিছু বোঝার আগেই! রায়ান এর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা অনুভব করলো আর দেখলো তাকে ঘিরে দুজন ডাক্তার ও একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে।তারপর ক্ষণেই দু’জন পুলিশ দরজা ঠেলে ঢুকেই ডাক্তারদের উদ্যেশ্যে বললো”ওনার জবানবন্দি নেব।” একজন ডাক্তার বললো “পেশেন্টকে জোর জবরদস্তি করবেন না।এখন বিপদ কাটেনি।মাথার এম.আর.আই. এর রিপোর্ট এলে সব বোঝা যাবে।” না! না! আপনি চিন্তা করবেন না কিছু কথা বলেই ছেড়ে দেব।” পুলিশ অফিসার রায়ানের নাম, বাপের নাম, বাড়ির ঠিকানা সমস্ত লিখে নিয়ে সানার বাবার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক আর কেনই বা তাকে মারার চেষ্টা করেছে সেই বিষয়ে জানতে চাইলো আর সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলো যে উনি এখন লকাপে আছে। রায়ানের মাথার যন্ত্রণাটা আরো বেড়ে গেল পুরানো ঘটনাগুলোর কথা মনে করাতে। সে “আহ!আর পারছি না” বলে চিৎকার করে ওঠে। ওর চিৎকার শুনে ডাক্তারবাবু ইন্সপেক্টরকে বলে “আজ এই পর্যন্ত থাক, রোগীর অবস্থা খুব ভালো ঠেকছে না আপনার ওর বাড়ির লোকদের আনার ব্যবস্থা করুন।” ইন্সপেক্টর আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। নার্স ঘুমের ইনজেকশন দিতে রায়ান ঘুমিয়ে পড়ে। রায়ানের ঘুম যখন ভাঙলো তখন দেখলো কাঁচের দরজার বাইরে বাবা মা দাঁড়িয়ে তার দিকে করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। নার্স বাইরে গিয়ে বাবা মাকে ডেকে দিলো। ওর মা কাঁদতে কাঁদতে রায়ানের কাছে এসে বলল “এইসব কি করে হলো? আর ওই লোকটাই বা তোকে কেন খুন করতে চাইলো? সব কথা আমাদের বল বাবা। তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি নিয়ে বেঁচে থাকতাম!সোহমকে হারিয়ে তোকে আঁকড়ে ধরে আমরা বেঁচে আছি বাবা!” রায়ান একটা হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয়া।” ওই লোকটাকে আমি জেলে পচিয়ে মারবো।” রাগতস্বরে রায়ানের বাবা কথাটা বলে। রায়ান বাবার দিকে তাকিয়ে বলে “ওনাকে যে শাস্তি দেবার তা আমি দিয়ে দিয়েছি! দাদাকে কষ্ট পেতে দেখে আর ওর হারিয়ে যাওয়ায় আমরা যে কষ্ট পাচ্ছি,সেই কষ্ট এখন উনি ভোগ করছেন!”
” তার মানে কি!” ওর বাবা বিস্ময়ের সুরে বলে। রায়ান উত্তেজিতভাবে বলে “তোমাদের হয়তো মনে আছে! পাঁচ বছর আগে দাদা যখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে তখন পাখি আর দাদার বন্ধুত্ব হয় ও পরে প্রেমে পরিণতি পায়। আমাকে যেবার দাদা কলকাতায় নিয়ে এসেছিল সেবার পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ওদের বাড়িও দেখায়। বিশাল জায়গা নিয়ে দোতলা বাড়ি। তখনই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে এত বড়লোকের মেয়েকে দাদার মতো গ্রামের সামান্য স্কুল শিক্ষকের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে তো! আমার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল! এম.এ. কমপ্লিট করার পর পাখির বাবা পাখির বিয়ের ব্যবস্থা করে। পাখি সব কিছু জানালে প্রথমে উনি পাখি আর দাদার সম্পর্কটা মেনে নেন নি পরে দাদাকে ডেকে শর্ত দেয় মা বাবাকে ছেড়ে ঘর জামাই থাকতে হবে! দাদা ওনার প্রস্তাবে রাজি হয় নি ঠিকই কিন্তু পাখিকেও ভুলতে পারছিল না। দাদা আমাকে সমস্ত বিষয় জানিয়েছিল। এই টেনশনেই হয়তো দাদা অন্যমনস্ক হয়েছিল আর তাতেই রেল লাইন পার হবার সময় ট্রেনে দুর্ঘটনাটা ঘটে যায়। দাদার মৃত্যুর খবর দেবার জন্য পাখিদের বাড়ী গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের কাছে জানতে পারি যে ওরা দিল্লী গেছে সেখানে পাখির বিয়ে। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এর প্রতিশোধ আমি নেব। এরপর আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করে ইচ্ছে করেই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই কারণ, খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম পাখির বোন সানা সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ে। তারপর থেকে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী ওকে আমার প্রেমের জালে ফাঁসাই! তারপর ওর বাবার সঙ্গে দেখা করে আমি মেদিনীপুরের একজন বড়লোকের একমাত্র ছেলে তা বিশ্বাস করাতে পারি আমার এক বন্ধুর নাম আর আমার নাম এক হওয়ার জন্য। এরপর উনি সমস্ত আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আমাকে হবু জামাই বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এর ঠিক পরেই আমি মোক্ষম চাল চালি! বাড়ী থেকে গিয়ে সানাকে বলি যে আমার বাবা তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে পরের মাসে, আমার আর তার সম্পর্ক মেনে নেয় নি, আমি ওকে বিয়ে করার জন্য সব ছেড়ে দিয়েছি। ওর বাবা বলে যে একবার বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে তাই উনি নিজেই বিয়ের ব্যবস্থা করেন!শহরের নামী দামী লোকেদের নেমন্তন্ন করেন। বিয়ের দিন যখন সব আয়োজন শেষ লোকজনের সমাগম হয়েছে ঠিক সেই সময় আমি সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ি চলে আসি! অভিনয় করতে করতে সানাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলি তাই দু’দিন পরে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে,জানতে পারি সেদিনকার ঘটনায় সানা খুব আঘাত পায় ও মাথা ঘুরে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। সেই কারণে হসপিটালে ভর্তি আছে। তখন আর না থাকতে পেরে দেখতে চলে আসি আর তখনই ওর বাবা আমায় দেখে ফেলে চিৎকার করতে থাকে আমি বেরিয়ে আসি। তারপর কি ঘটলো কিছুই বুঝতে পারলাম না! ওর বাবা মা হাঁ করে ওর কথাগুলো শুনছিলো!” তুই এত কিছু করে ফেললি আর আমরা কিছুই জানতে পারলাম না! তুই একটা লোককে শাস্তি দিতে গিয়ে একটা নিষ্পাপ মেয়েকেও শাস্তি দিলি!আক্ষেপের সুরে ওর মা বলে ওঠে।”
“প্রতিশোধের আগুন সবকিছু জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়,এটা কি তুই কেন বুঝলি না বাবা” ওর বাবা বলতে থাকে এমন সময় ডাক্তার রুমে ঢুকে বললেন “আপনারা কাউন্টারে গিয়ে ফর্মালিটি পেপারগুলো সাইন করে দিন আধঘন্টা পর ওনার মাথার অপারেশন হবে।” রায়ান প্রশ্ন করে “ম্যাডাম অপারেশন সাকসেসফুল হবার চান্স কত পার্সেন্ট?” ডাক্তার বলে আমরা তো আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো, এরপর সব ঈশ্বরের ইচ্ছা!” রায়ান মায়ের হাতটা চেপে ধরে বলে “মা সানা এই হসপিটালেই ভর্তি আছে। ওর সাথে একবার দেখা করে বলে দিও আমি ওকে ঠকাতে চাইনি।ভেবেছিলাম পরে ওকে সব সত্যি জানিয়ে দেব! জানিনা আর ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া হবে কিনা!” ওর মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রায়ান অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে দেখে বাবা মা এর সাথে সানা দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান সানার দিকে তাকিয়ে বলে “আমাকে ক্ষমা করে দিও!” সানা কাঁদতে কাঁদতে রায়ানের হাতটা ধরে বলে “আমি তোমার মায়ের কাছ থেকে সব ঘটনা জানতে পেরেছি।আমার বাবা তার ভুলের শাস্তি অনেক আগে থেকেই পাচ্ছে পাখি বিয়ের পর থেকে আর কোনোদিন আমাদের বাড়ি আসেনি এমন কি যোগাযোগ রাখেনি!এমকনকি বাবাকে বলে দিয়েছে যেদিন বাবা ওর বাড়িতে পা দেবে সেইদিন ই ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে! বাবা খবর নিয়ে জানতে পেরেছে ওর স্বামী খুব অত্যাচার করে তবুও ও ওখানেই পড়ে আছে শুধুমাত্র বাবাকে কষ্ট দেবার জন্য!” এবার ছাড়ুন পেশেন্টকে ভিতরে ঢোকাতে হবে”বলে নার্স ট্রলিতে ঠেলা দেয়।হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে সানা বলে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, তোমায় ফিরে আসতে হবে। এবার ছেড়ে চলে গেলে আর কোনোদিনও ক্ষমা করবো না।” অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে রায়ানের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় যে সে ফিরে আসবে।