হায় রে মানবিকতা!
-তন্ময় সিংহ রায়
সমুদ্রতটে মর্নিং ওয়াকে আর পাঁচটা দিনের মতই জগদীশবাবু সেদিনও তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন রাখছেন। এই ৬৯-এও তার গতিবেগে ২৯-এর আভাস পায় অনেকেই। ধপধপে সাদা হাফ্-প্যান্ট, ব্র্যান্ডেড শু আর টি-শার্টে তার শৌখিনতার ছাপ স্পষ্ট। স্বভাবমতই মর্নিং ওয়াকের পর্ব শেষ করেই আওয়াজ দিলেন…’গোপাল, স্ট্র লাগিয়ে আমার ডাবটা দে, আর তিনটে বড়ো দেখে আমার গাড়িতে রেখে দিয়ে আয়, জানালা খোলা।
‘…. ‘এই যে বাবু, আপনার ডাব।’
হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন হেসে বলে উঠলো, ‘ও দাদা কিছু মনে করবেন না, ডাব খাবেন আবার পাইপ লাগে?’
…..’এক্সকিউস-মি! হু আর ইউ..এন্ড হাউ ডেয়ার ইউ?’
পায়ে চটি, সাধারণ ফুল প্যান্ট, ইস্ত্রিবিহীন জামা ও সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ির এই লোকটার এত স্পর্ধা! মনে মনে ভাবতেই… লোকটা বলে উঠলো… ‘মানে বলছিলাম যে, আপনি কি রাগ করলেন?’
প্রত্যুত্তরটা বিদ্যুৎ গতিবেগে জগদীশবাবু ফিরিয়ে দিতে উদ্যত হবেন এমন সময়ে গোপাল এসে বললো, ‘বাবু ডাব তিনটে রেখে এসিছি।’ তখনও জগদীশ বাবুর পারদ শীর্ষে… সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করেই আবার সেই লোকটাকে প্রশ্ন, ‘আপনি জানেন আমি কে? হাউ ডেয়ার ইউ ইডিয়ট ওল্ড ম্যান?
….. ‘ আপনি ইংরিজিতে কি বলছেন, দয়া করে বাংলায় বলুন, আপনার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি এখনও অনেক রেগে আছেন।’….লোকটা বলে উঠলো।
‘রাগবো না?… আমি এই অঞ্চলের সব থেকে ধনী ব্যক্তি (শিল্পপতি), অনেক বড়ো বড়ো লোকও আমার সাথে ১০ মিনিট কথা বলতে গেলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয় আর দিস ইস অ্যাবসোলিউটলি মাই পারসোনাল ম্যাটার যে আমি ডাবের জলটা কিভাবে পান করবো… উইদ স্ট্র না উইদাউট স্ট্র! ‘
…. ‘মানে বলছিলাম যে সে তো অবশ্যই, আপনি অনেক বড়ো মানুষ। যদি ভূল হয়ে যায় ক্ষমা করবেন।
‘…… ‘ক্ষমা, হোয়াট ক্ষমা? রাবিশ!’
…. ‘মানে বলছিলাম যে, আমি চললাম। ‘
হঠাৎ-ই জগদীশবাবু কেমন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেলেন, কপালের গোলাপী চামড়ায় জেগে উঠলো তিন-চারটে ভাঁজ।
…. ‘ও ভাই শুনুন, আপনার বাড়িটা কোথায় বলুন তো, আপনার নাম কি?
কিছু একটা হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করে গোপালও বেশ কিছুটা আশ্চর্য হোলো বটে।….. ‘বাড়ি আমার সাহেবপুর গ্রামে, নাম পবিত্র দত্ত।’
কৌতূহলের সীমা অতিক্রম করে জগদীশ বাবুর এবারের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা আপনি কোন স্কুলে পড়তেন মনে আছে?’ বলতে পারেন?’
….. ‘হ্যাঁ আমার ভালোই মনে আছে, সাহেবপুর অবৈতনিক বিদ্যালয়।
…. ‘আরে… দত্ত! চিনতে পারিসনি আমায়? আমি সেই জগো রে! আর সত্যিই তো কিভাবে চিনবি বল সেই ৫৩ বছর আগে মাধ্যমিকেই ছাড়াছাড়ি তারপর বাবার কোলকাতার চাকরীর সূত্রে শহরে চিরস্থায়ীভাবে চলে আসা। তোর, মানে বলছিলাম যে’টা আজও স্বভাব বিরুদ্ধ হয়নি দেখছি রে!
… অত্যাধিক বুড়োটে হয়ে গেছিস তুই! হ্যাঁ রে, তোকে আর ‘মানে বলছিলাম যে’-বলে নিশ্চই কেউ রাগায় না?
কে আর রাগাবে বল… সেই বকুল সেই দিনেশ সেই রোগা প্যাংটা গনেশটা… হ্যাঁ রে ত্রিদিপের সাথে আজ আর তোর নিশ্চয়ই কোনো যোগাযোগ নেই বল? আজ সব কে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! তা তুই এখানে কি ব্যাপারে? ‘
……দীর্ঘ দিনের ছোটো বেলার হারানো বন্ধু পুনরুদ্ধারে পবিত্রবাবুও যে মনে মনে খুশি হননি তা তো নয়ই বরং হয়ে পড়লেন বেশ কিছুটা আবেগপ্রবণ… ‘জানিস জগো, খবর পেলাম এখানে আগামীকাল একটা হাট বসে, তাতে বেশ সস্তায় ভালো চাদর ও শাড়ি বিক্রি হয়। খান ৫০ কিনবো বলে এসেছি রে, কিনেই রওনা দেবো গ্রামে।
…. ‘এতো চাদর কি করবি?’… কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হয়েই জগদীশ বাবুর প্রশ্ন ছিলো এমন।
……. ‘সে থাক বল তোর কথা, তোর তো এখন অনেক নাম, বিশাল ধনী শিল্পপতি, খবরের কাগজ ও টিভিতেও তোকে মাঝে মধ্যে দেখেছি, ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি সামনে থেকে।’
…. ‘হ্যাঁ রে দত্ত, আমার একটাই মেয়ে, বিয়ে দিয়ে দিয়েছি এক নামকরা এফ. আর. সি. এস হার্ট স্পেশালিষ্ট ডাক্তার-এর সাথে। এখন ওরা লন্ডনেই সিফট করেছে। বাড়িতে আমি, আমার মিসেস আর ৮-৯ জন দেখাশোনা, কাজকর্মের লোকজন। আমার জীবনে এখন সব দায়িত্বই শেষ আর ভীষণ শান্তিতেই আছি। এবারে বল তোর খবর কি?
….. ‘আমার দায়িত্ব তো আজও আমি পূর্ণ করতে অক্ষম রে! অনেক কাজ আজও বাকি পড়ে আর শান্তি? জানিনা কেন সে আমায় ভালোবাসেনা, তাকে বুকে জায়গা দেবো বলে আমি কি না করেছি তার জন্যে, কিন্তু পেলাম না রে ওর ভালোবাসা!
…. ‘কি বলছিস রে!’
…. ‘হ্যাঁ রে জগো, এই চাদর আর শাড়িগুলো এ বছরে আমাদের পাশের পলাশপুর গ্রামের কিছু হত দরিদ্রদের দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করবো, দারুণ শীতে এই একটা গরম করা বস্ত্রের অভাবে ওরা যে কি পরিমাণ ছটফট করে সে দৃশ্যকে আপন করতে গিয়ে আমি হারিয়েছি শান্তিকে, স্বামীহারা অসহায়া নিঃসন্তান বৃদ্ধা ছেঁড়া নোংরা একটাই শাড়িতে দিনের পর দিন কিভাবে বেঁচে আছে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি হারিয়েছি শান্তিকে!… বিগত ১৭ বছর ধরে প্রায় ৩৫-৩৬ টা বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন অসহায়, উপেক্ষিত জনেদের জন্যে আমি ও আমার স্ত্রী এই কাজ করে আসছি। গ্রামের অর্থবানেদের কাছ থেকে টাকা ভিক্ষে করে ও নিজের প্রয়োজনাতিরিক্ত জমানো টাকার সাহায্যে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আরো কত দায়িত্ব! মানুষ হয়ে রাস্তার নোংরায় অবহেলায় পড়ে থাকা একটা মানুষের দেহ দেখতে পারিনি, একটা অসহায় বাচ্ছা একটু ভাতের জন্যে যন্ত্রণায় ছটফট করছে, সহ্য করতে পারিনি! পারিনি ওই বাপ মা মরা শিশুটাকে ফেলে দিতে তাই তোর মতন শান্তি-র ভালোবাসা থেকে আমি আজও বঞ্চিত রে বন্ধু!
….তোর মনে পড়ে আমাদের স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন-এ আমাদের সুধীর স্যারের(হেডস্যার) গাওয়া শ্যামল মিত্রের সেই জনপ্রিয় সেই গানটার লাইনদুটো…… সেই মানুষ-ই আসল মানুষ যার জীবন পরের তরে, রাজার মুকুট ছেড়ে হাসি মুখে সে তো কাঁটার মুকুট পরে।’