পলাশগড়ের পিশাচ
-প্রলয় কুমার নাথ
(১)
কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি পড়া থেমেছে। তবে ধুলো ওড়ানো ঠান্ডা হাওয়ার দাপট এখনো আছে। চারিদিকে নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে, পলাশগড়ের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িটা তার ভয়াবহ রূপ নিয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেন একটা দৈত্যপুরী, দাঁত বার করে গিলে খেতে আসছে। সাইকেল আরোহী যুবকটি একবার চেয়ে দেখলো সেদিক পানে। তার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠলো একটা বিষয় লক্ষ্য করে……এত বছর আগে পরিত্যক্ত বাড়িটার দোতলার একটি ঘরে আলো জ্বলছে! কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল, যে কিছুদিন আগেই তো কোন এক শহুরে বাবু কিনে নিয়েছেন এই বাড়িটাকে! যাক বাবা, তাহলে আর ভয়ের কোন কারণ নেই, তিনিই হয়তো জ্বালিয়েছেন ওই আলো। জমিদার বাড়ির পাঁচিলের সামনে একটি সরু গলি দিয়ে যেতে যেতে, সাইকেলের ব্যালান্স সামলে, একবার নিজের সস্তা হাতঘড়িটা থেকে বহু কষ্টে সময়টা দেখে নিলো সেই যুবক। রাত এগারোটা দশ……নাহ, আজ বড্ড দেরি হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে, মনে মনে ভাবলো সে।
জমিদার বাড়িটাকে পিছু ফেলে, সেই সরু গলি ছেড়ে এবার পাকা সড়কে ঢুকে পড়ল সাইকেল আরোহী যুবক। আবার একটা হালকা ভয়ের আমেজ যেন দানা বেঁধে উঠল তার বুকের ভেতর। এই রাস্তাটা সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য। অবশ্য এই শীতের রাত্রে এই অজ পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এই রাস্তাটার দুই পাশে কোন মানুষের বসতি নেই, এখানকার জমি বেশ জঙ্গলাকীর্ণ। তার ভেতর থেকেই বোধহয় কোন রাত জাগা পাখি কর্কশ সুরে ডেকে উঠলো। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাকও আসছে কানে। যুবকটি আরো দ্রুত গতিতে সাইকেলের পেডাল ঘোরাতে শুরু করলো। হঠাৎ যেন তার মনে হল, সামনের একটা বড় অশ্বত্থ গাছের পেছন থেকে কেমন যেন একটা খসখস শব্দ আসছে…….ঠিক যেন শুকনো পাতার ওপর কারোর সন্তপর্ণে চলার শব্দ!……একটু পরেই সে নিশ্চিত হয়ে উঠল, যে কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে ওই গাছের পেছনে!……এই অন্ধকার রাতেও যেন একটা ছায়ামূর্তির অবয়ব স্পষ্ট চোখে পড়ল তার…..কিন্তু…..কিন্তু একি কোন মানুষের দেহাকৃতি? নাকি কোনো বন্য পশুর? কে ওটা? কে!
তীব্র আতঙ্কের বশে, কম্পমান হাতে আর সাইকেলের ব্যালান্স রাখতে পারল না সেই যুবক। সাইকেল সমেত হোঁচট খেয়ে পড়ল সে রাস্তার ওপর। কোনো পশুর হিংস্র চাপা গর্জনের শব্দ এখন স্পষ্ট এলো তার কানে…..সে রুদ্ধশ্বাসে সাইকেলটাকে দূরে সরিয়ে ফেলে, রাস্তার ওপর কোন মতে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে লাগলো……নিজের সর্বশক্তি দিয়ে পা চালাতে লাগলো…..জোরে, জোরে…..আরো জোরে……যতক্ষণ না সে বুঝতে পারলো, যে সেই পৈশাচিক ছায়ামূর্তিটা একটা হিংস্র গর্জন করে, পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার কাঁধের ওপর………
(২)
এই ঘটনার একদিন আগে:
————–
সেদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, বিছানায় বসে নিজের কোলে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল অমলেন্দু। সে একটি নামী তেল এবং খনিজ পদার্থের কোম্পানিতে এসিস্ট্যান্ট জিওলজিস্ট পদে কর্মরত। সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের এই পলাশগড় গ্রামের একটি পার্বত্য অঞ্চলে মাটির নিচে তেলের খোঁজ পেয়েছে তার সংস্থা, এবং এখানেই তারা গড়ে তুলতে চায় তাদের আরেকটি শাখা। আর যেদিন থেকে অমলেন্দুর ওপর সেই দায়িত্ব চাপানো হয়েছে, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে কলকাতার এই শহুরে বাবুটির পলাশগড়ের মত এই গন্ডগ্রামে পড়ে থাকার নরক যন্ত্রনা। সে জানে, যে কর্মজীবনের বেশ কয়েকটা বছর তাকে এখানেই কাটাতে হবে, তাই তার উচিত একটা উপযুক্ত বাসস্থান খোঁজার। এমনই সময় যখন নাম মাত্র দামে সে পেয়ে গেল এই গ্রামের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী জমিদার বাড়িটিকে, তখন আর সে পিছপা হয়নি।
এখানে কোন দৈনিক খবরের কাগজের সংস্থান এখনো করে উঠতে পারেনি অমলেন্দু, তাই বাধ্য হয়েই প্রতিদিন সকালের সেই অভ্যাস মেটাতে সে চোখ রাখছে তার ল্যাপটপে বিভিন্ন খবরের সাইটগুলোতে। তবে ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, যে তার ডঙ্গলের নেটওয়ার্ক এখানে খুব খারাপ নয়! এই বাড়িতে সে বাদে আছে আর দুটি মাত্র প্রাণী: এক, বাড়ির বৃদ্ধ চাকর সুখেন এবং দ্বিতীয় জন হল অমলেন্দুর বোন মধুরিমা, যে কিছুদিন হল কলেজের পরীক্ষার পর, দাদার এই নতুন কেনা বাসস্থানে নিছক কৌতূহলী হয়েই বেড়াতে এসেছে। এছাড়াও প্রমীলা বলে একজন মাঝবয়সী বিধবা ভদ্রমহিলা এই বাড়িতে দু’বেলা এসে রান্নার কাজ করে দিয়ে যান।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সুখন প্রবেশ করলো সেই ঘরে, আর তার পেছনে পেছনে সেখানে উপস্থিত হল একটি পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সী সুন্দরী মেয়ে। জিন্স আর টপ পরিহিত চেহারায় বেশ আধুনিকতার ছাপ। সুখেন কিছু বলার আগেই, অমলেন্দু মেয়েটিকে দেখে বিন্দুমাত্র বিস্মিত না হয়ে বলে উঠল,
– আপনি নিশ্চয় শ্রাবন্তী, রাইট?
মেয়েটি ম্লান হেসে উত্তর দিলো,
– হ্যাঁ……আর আপনি নিশ্চয় অমলেন্দু সেন, তাই তো?
এরা দুজনে একে অপরকে আগে থেকেই চেনে, এই কথা বুঝে সুখেন আর বেশি কিছু না বলে সেই ঘর থেকে চলে গেল। অমলেন্দু মৃদু হেসে বলল,
– আমি যেন এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না…..আপনি সেদিন ফেসবুক মেসেঞ্জারে কেনই বা হঠাৎ আমার কাছ থেকে এই বাড়ির ঠিকানা নিলেন…..আর কেনই বা এখানে আসতে চাইলেন…….এনিওয়়ে, আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন….বসুন….বসুন…..
এমন সময় দাদার ঘর থেকে একজন অচেনা মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে, মেয়েলি কৌতূহল সংবরণ না করতে পেরে সেখানে ছুটে এলো মধুরিমা।
শ্রাবন্তীর সাথে মধুরিমার আলাপ পর্ব শেষ হলে, শ্রাবন্তী বলে উঠল,
– অমলেন্দু বাবু, আমার মত একজন অচেনা মানুষকে এই জায়গার ঠিকানা এবং এখানে আসার অনুমতি দেওয়ার জন্য সবার প্রথমে আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ!
এই বলে কিছুক্ষণ থামলো সে, মধুরিমা আর অমলেন্দু দু’জনেই তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইল। এবার বেশ উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠলো শ্রাবন্তী,
– এবার যে কথাগুলো আমি আপনাদের বলতে চলেছি, সেগুলো বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার..তবে আমি কিন্তু এক বর্ণও মিথ্যা কথা বলতে চাইনা আপনাদের!
এরপর সে মধুরিমার দিকে চেয়ে বলে উঠল,
– আমিও তোমার মতো একজন সাধারণ মেয়ে, মধুরিমা…..কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার সাথে প্রতিনিয়ত কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, যার অর্থ আমি এখনো খুঁজে পাচ্ছি না!
মধুরিমা কৌতূহলী হয়ে বলল,
– কি ঘটনা ঘটে আপনার সাথে?
শ্রাবন্তী অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল,
– একটা স্বপ্ন!…..একটা অদ্ভুত স্বপ্ন রোজ রাতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার……বিশ্বাস করো….এই বাড়িটা…..এই বাড়িটারই ছবি আমি দেখতে পাই সেই স্বপ্নে! আর তখনই একটা ভয়……একটা অদ্ভুত মৃত্যুভয় যেন জাঁকিয়ে ওঠে আমার বুকের ওপর…..যেন এই বাড়ির সামনে থেকেই অন্ধকারের মধ্যে কেউ একটা ছুটে আসছে আমার দিকে!……শোনা যাচ্ছে তার হিংস্র গর্জন!……সে যেন…..যে যেন এই মুহূর্তের ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় আমার শরীরের ওপর!
এবার অমলেন্দু বুদ্ধিদীপ্ত গলায় বলে উঠল,
– আর তাই, যখন আমি ফেসবুকে নেহাৎ কৌতুকের জন্যই, আমার এই নতুন বাসস্থানের কয়েকটা ছবি আপলোড করি……সেগুলো কোনোভাবে আপনার চোখে পড়ে, তাই তো?
শ্রাবন্তী বলে উঠল,
– হ্যাঁ, আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা, তবে আপনার প্রোফাইল অনুযায়ী, আপনি যে কলেজ থেকে ছ-বছর আগে পাস আউট, আমিও একবছর আগে সেখান থেকেই গ্রাজুয়েশন করেছি, তবে আমার বিষয় সাইকোলজি……তাই আপনার আর আমার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড থাকা অস্বাভাবিক নয়। তেমনই কেউ একজন আপনার ওই এলবামটাকে শেয়ার করেছিল……ছবিগুলো দেখেই চমকে উঠি আমি! সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারি, যে এই তো আমার স্বপ্নে দেখা সেই বাড়ি! তখনই আপনার সাথে যোগাযোগ করে জানাই আমার এখানে আসার ইচ্ছার কথা!
একটু থেমে বেশ অপ্রভিত স্বরে বলে উঠল শ্রাবন্তী,
– আপনাদের কাছ থেকে ব্যস কয়েকদিনের সময় চেয়ে নিচ্ছি আমি…..এই ক’দিনের মধ্যেই এই বাড়িতে থেকে আমায় খুঁজে পেতে হবে আমার সেই দুঃস্বপ্নগুলির উত্তর!
ওরা দুজনেই ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল শ্রাবন্তীর দিকে!
(৩)
বর্তমান সময়ে:
——–
সেদিন সকালে তখনো মধুরিমার ঘুম ভাঙেনি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে, বাড়ির সামনে খোলা মাঠের সবুজ সতেজতাকে অনুভব করার জন্য, সেখানেই দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিল অমলেন্দু আর শ্রাবন্তী। দূরের রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে আসছিল প্রমীলা। হঠাৎ গ্রামের একটি অল্পবয়সী ছেলে ছুটে এলো তার কাছে…তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে কি যেন বলতে শুরু করলো তাকে। সেই কথা শোনা মাত্র একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলো প্রমীলা!…..তারপর পেছন ফিরে উন্মাদের মত ছুটতে শুরু করলো সেই পথ ধরেই!……ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগায়, প্রমীলার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে, তার পেছন পেছন ছুটতে লাগলো অমলেন্দু আর শ্রাবন্তী!
ওরা বাড়ির সামনের সেই সরু গলিটা ছাড়িয়ে সেই পাকা সড়কে প্রবেশ করলো। সেখানে রাস্তার এক ধারে তখনো পড়ে রয়েছে একটি দুমড়ে যাওয়া সাইকেল! সেটাকে পাশ কাটিয়ে, সেই গ্রাম্য ছেলেটির নির্দেশ অনুসারে প্রমীলা ঢুকে পড়লো পাশের জঙ্গলের ভেতর। অমলেন্দু আর শ্রাবন্তীও তাদের অনুসরণ করলো। একটু ভেতরে যেতেই দেখা গেল বেশ কিছু গ্রামবাসীর একটা জটলা। সেই ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়েই, একবার চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো প্রমীলা! অমলেন্দু আর শ্রাবন্তীও ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল সামনে….. তারপর সেখানকার দৃশ্য দেখে একটা তীব্র চিৎকার করে শ্রাবন্তী অমলেন্দুকে জড়িয়ে ধরে, তার বুকে নিজের চোখ ঢাকলো! অমলেন্দুরও বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আতঙ্কে……..ওদের সামনেই পড়ে আছে এক যুবকের ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ! তার শরীরের বেশিরভাগ অংশই যেন কেউ প্রবল আক্রোশে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে! বেরিয়ে পড়েছে দেহের ভেতরে থাকা হাড় কঙ্কাল! জমাট বাধা রক্তে ভেসে যাচ্ছে সেখানকার মাটি!
এমন সময় পাশ থেকে একজন বয়স্ক গ্রামবাসী কপাল চাপড়ে বলে উঠল,
– হায় ঈশ্বর……হতভাগীর ছেলেটাই ছিলো তার একমাত্র সম্বল……আর তারও কিনা আজ এই অবস্থা হল!
অমলেন্দু কোন মতে বলে উঠল,
– এ…এ….এটা প্রমীলাদির ছেলে!
সেই বয়স্ক মানুষটি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল,
– হ্যাঁ বাবু…..হ্যাঁ……গতকাল ও পাশের গাঁয়ে গিয়েছিল, কোন এক বাড়িতে পুরোহিতের কাজ করতে…..ওরা বামুন কিনা……তারপর আর রাত্রে বাড়ি ফেরেনি বাবু…ওই হতভাগীর ঘরের পাশেই আমার ঘর……সারারাত ধরে ছেলের চিন্তায় ঘুমোতে পারেনি সে…….সকালে বলল, যে খুড়ো, আমি কাজে যাচ্ছি…..ছেলেটা হয়তো কোনো কাজে আটকা পড়েছে, তাই কালকে বাড়ি ফিরতে পারেনি…..আজকে ঠিক ফিরে আসবে…….
কথা শেষ করতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সেই লোকটি। পরক্ষণেই তার মুখে ফুটে উঠলো ঘোর আতঙ্কের চাপ। সে বিস্ফারিত চোখে বলল,
– সেই একশো বছর আগেকার নরখাদক আবার জেগে উঠেছে, বাবু……আবার জেগে উঠেছে সে!
এতক্ষনে শ্রাবন্তী নিজের সম্বিত ফিরে পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
– কে? কে সেই নরখাদক? কার কথা বলছেন আপনি?
কম্পিত গলায় সেই লোকটি বলে উঠল,
– প….প…..পিশাচ, দিদিমণি, পিশাচ!……প…প….পলাশগড়ের পিশাচ!
(৪)
কিছুক্ষণ আগেই স্থানীয় থানা থেকে লোকজন এসে ঘটনাস্থল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে প্রমিলার ছেলের দেহাবশেষ। এখনো অবধি এই হত্যার সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছে পুলিশ। তারাও বেশ ধন্দে পড়ে গেছে এই নৃশংস ঘটনার সম্মুখীন হয়ে, কারণ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, যে এটা কোন মানুষের কাজ নয়। ছেলেটিকে হত্যা করা হয়েছে নরমাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে! এদিকে এই অঞ্চলে তো বাঘ ভালুকের উপস্থিতিও কেউ উপলব্ধি করেনি কোনোদিন! তাহলে কে করলো এই কাজ? প্রমীলার জ্ঞান ফিরলেও, সে এখন চরম মানসিক শকের মধ্যে আছে। পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে সে, এক ফোঁটা জলও বেরোয়নি তার চোখ থেকে! স্বভাবতই, এক অজানা বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পলাশগড় গ্রামে!
অমলেন্দুর নতুন বাসস্থানে বসেই তাদের কথা হচ্ছিল এই গ্রামের বেশ কিছু মানুষজনের সাথে। তাদের মধ্যে আছেন সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবং গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান, রঘুপতি বাবু। এমন সময় সেই ঘরে প্রবেশ করলো এক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ শ্বেতাঙ্গ যুবক। বলিষ্ঠ চেহারার গঠন, কানের নীচ অবধি রাখা খয়েরি চুলের জুলফি এবং নীলাভ চোখের মণি বিশিষ্ট এই বিদেশী যুবক যে কোন নারীর মন জয় করে নিতে পারে এক নিমেষে। শ্রাবন্তী লক্ষ্য করলো, যে এই যুবককে দেখা মাত্র চাপা লজ্জা আর খুশিতে নিচু হয়ে গেল মধুরিমার নজর, আনন্দে রক্তাভ হয়ে উঠলো তার ফর্সা গাল! তবে যুবকটি যে প্রমীলার ছেলের এই নিদারুণ পরিণতির কথা শুনেছে, তা তার উদ্বিগ্ন মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে! তাকে দেখেই অমলেন্দু ইংরাজিতে বলে উঠলো,
– আরে স্যামুয়েল যে…..এসো ভাই এসো…….
এই বলে স্যামুয়েলকে বসতে দিয়ে, অমলেন্দু শ্রাবন্তীকে বলে উঠল,
– ও হল স্যামুয়েল উইলসন……আমরা হামেশায় শুনে থাকি যে কেউ উচ্চশিক্ষা বা চাকরিসূত্রে বিদেশে গেছে, কিন্তু বিপরীতটা খুব কমই দেখি, তাই না? স্যামুয়েল হল তেমন একজন, যে ব্রিটেন-এ জন্মেও ভারতের প্রতি আকৃষ্ট……ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেছে কয়েকদিন আগেই……এই বাড়ি সম্পর্কিত কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কয়েকদিন আগে এখানে আসে ও…..আর সেদিন থেকেই আমার আর বোনের সাথে ওর আলাপ….যদিও বা এই বাড়ি বা জমিদার বংশ সম্বন্ধিত কোন তথ্যই আমি ওকে দিতে পারিনি…..
শ্রাবন্তী কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল স্যামুয়েলের দিকে, কিন্তু পরমূর্তেই গত রাতে ঘটা সেই বিভীষিকাময় ঘটনার কথা ভেবে, সে সেই বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল,
– আপনি তখন বললেন, যে একশো বছর আগেকার নরখাদক জেগে উঠেছে! এই কথার মানে কি?
সেই ভদ্রলোকের হয়েই যেন বলে উঠলেন রঘুপতি বাবু,
– এই গ্রামে আমার সাত পুরুষের বাস, দিদিমণি…..তাই আমিই বলছি শুনুন! সেটা বোধহয় ১৯২০ সাল হবে……আমার ঠাকুরদার বয়স তখন পনেরো কি ষোলো বছর। তার মুখেই শুনেছি সেই কথা……সেই সময়ও ঠিক একই ভাবে এই গ্রামের বেশ কিছু গ্রামবাসী শিকার হয় এই অজানা নরখাদকের! এই গ্রামেরই বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া যেতে থাকে সেই সব অসহায় মানুষগুলির ক্ষতবিক্ষত আধ খাওয়া মৃতদেহগুলো!
এই কথা শুনে যেন একটা চাপা আতঙ্কের স্রোত বয়ে বয়ে গেল শ্রাবন্তীর শিরদাঁড়া দিয়ে! রঘুপতিবাবু বলেই চললেন,
– টানা দুই – তিন বছর ধরে চলেছিলো এই হত্যালীলা…. তবে একটা বিষয় সকলেই লক্ষ্য করছিল, যে প্রায় সব কটা মানুষকেই এই ভাবে খুন করা হয় গতকালের মতই শীত কালের রাত্রিগুলোতে! অন্যান্য সময়ে কিন্তু কখনই কোন মানুষের প্রতি হানা দেয়নি এই শয়তান!
অমলেন্দু বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
– এই শয়তান বলতে আপনি ঠিক কার কথা বলতে চাইছেন রঘুপতিবাবু?
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন রঘুপতিবাবু,
– পিশাচ, বাবু……পিশাচ! সেদিনের মত আজও আবার এই গ্রামের প্রতি পিশাচের নজর লেগেছে! গ্রামের একজন দু’জন নাকি অন্ধকারে দেখতে পেয়েছিলো তার ছায়া……সে না মানুষ, না কোন বন্য পশু!……তবে অন্ধকারের মধ্যেও জ্বলজ্বল করে ওঠে তার দুই চোখে জমে থাকা নরমাংশের প্রতি লোভ!
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর স্যামুয়েল ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলে উঠল,
– আপনি যে সময়টার কথা বলছেন, সেটা আপনাদের দেশের স্বাধীনতার বেশ আগেকার কথা। সেই সময় নিশ্চয় এই গ্রাম, এই বাড়িরই জমিদার বংশের শাসনের আওতায় ছিল……তারা কি কোন চেষ্টা করেছিলেন এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের হাত থেকে গ্রামবাসীদের বাঁচাতে?
রঘুপতি বাবু বলে উঠলেন,
– না, বাবু……আসলে যে সময় এই ঘটনাগুলি ঘটতে শুরু করে, সেই সময় থেকেই এই জমিদার পরিবারের ওপর নেমে আসে পতনের ঝড়……এই পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যেই ক্রমাগত দ্বন্দ্বে বিদ্ধস্ত হয়ে উঠেছিল সেই সময়, তাই আর গ্রামবাসীদের বাঁচানোর চেষ্টা করার কোনো ফুরসৎ পায়নি তারা!
শ্রাবন্তী বেশ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল,
– আমি জানতে চাই এই বংশের ইতিহাসের কথা….. আপনি যা জানেন, তা দয়া করে বলুন!
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলতে লাগলেন রঘুপতি বাবু,
– সেই সময় এই বংশের প্রধান পুরুষ ছিলেন জমিদার চন্দ্রমোহন রায়। তার ছিল দুই ছেলে: রাজেন্দ্র মোহন এবং মৃগাঙ্ক মোহন। ছোট ছেলের জন্মের পরই চন্দ্রমোহনের পত্নী বিয়োগ হয়। রাজেন্দ্র ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, তাকে আমেরিকার রুশো শহরে ডাক্তারি পড়তে পাঠান রাজেন্দ্র মোহন। ডাক্তারি পাশ করে তিনি এই দেশে ফিরে আসেন আমেরিকার এক মেমসাহেবকে বিয়ে করে। সেই বিদেশিনী মহিলার নাম ছিল এমিলি। নিতান্ত অখুশি হয়েও তাকে পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নেন চন্দ্রমোহন।
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি,
– কিন্তু সমস্যা শুরু হয় চন্দ্রমোহনের মৃত্যুর পর, মৃগাঙ্ককে নিয়ে……ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় তিনি ছিলেন তার দাদার বিপরীত, এবং এই দুই ভাইয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক কোনোদিনই ছিল না। সেই সময় রাজেন্দ্রই ছিলেন দন্ডমুন্ডের কর্তা……আর এমনই একদিন পাশের গ্রামের এক আদিবাসী মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসাবে এই বাড়িতে নিয়ে প্রবেশ করেন মৃগাঙ্ক! সেই মেয়েটির নাম ছিল রমাবতী। এই সময় রাজেন্দ্র যেন ভুলে যান নিজের প্রেম কাহিনীর কথা……তিনি সম্পূর্ণ রূপে রমাবতীকে এই বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন! দুই ভাইয়ের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠে বিবাদ……এবং তা ঘোরতর শত্রুতার রূপ নেয়, যখন এক বৃষ্টি মুখরিত দিনে, সকালবেলায় গ্রামের পুকুরে ভেসে ওঠে রমাবতীর লাশ! নিজের প্রেমিকাকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠে মৃগাঙ্ক, তার মনে স্থির বিশ্বাস জেগে ওঠে, যে রমাবতীর মৃত্যুর পেছনে রাজেন্দ্রই দায়ী!
শ্রাবন্তী অধৈর্য হয়ে বলল,
– তারপর? তারপর কি হল মৃগাঙ্কর?
আবার নিজের মস্তিষ্কে জোর খাটিয়ে বলে উঠলেন রঘুপতিবাবু,
– তারপর হঠাৎ একটি রাতের পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যান মৃগাঙ্ক! তার কি হয়েছিল তা কেউ জানে না……তবে লোকমুখে ফেরে, যে তাকে নাকি, গ্রামের জঙ্গলের শেষে নদীর ওপারে, কোন এক বৈষ্ণবদের আখড়ায় দেখা গিয়েছিল একবার! যদিও বা এই বিষয়ে পরে আর তেমন কোন খোঁজ খবর নেয়নি কেউ……এরপর বোঝা যায়, যে শরীরে জমিদারি রক্ত বইলেও, বাবা হতে অপারগ রাজেন্দ্র! সেই শোকে দুঃখেই বোধহয় এক রাত্রে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। এরপর এমিলিও এই সব কিছু ত্যাগ করে আমেরিকায় ফিরে যান। এখানেই শেষ হয়ে যায় এই বংশ। তাহলে বুঝতেই পারছেন, যে এই পরিবারের সাথে ওই অজানা নরখাদকের কোন সম্পর্কই নেই……..
এবার সেখানে উপস্থিত সকলকে অবাক করে চিৎকার করে বলে ওঠে শ্রাবন্তী,
– সম্পর্ক আছে…..সম্পর্ক আছে, রঘুপতিবাবু…… কারণ এই বাড়ির সামনে থেকে ছুটে আসা সেই নরপিশাচটারই আবছা প্রতিচ্ছবি আমি এতদিন ধরে রোজ রাত্রে ঘুমের ঘোরে দেখে এসেছি!……তাই যদি আমার স্বপ্নগুলোর কোন অর্থ থেকে থাকে, তাহলে এই বাড়ির সাথে নির্ঘাত কোন সম্বন্ধ আছে ওই বিভীষিকার…..আর এটাই আমাকে খুঁজে বার করতে হবে…..হবেই!
এই কথা শুনে যেন সকলের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে যায়!
(৫)
সেদিনও নিস্তব্ধ শীতের রাত্রের ঠান্ডা আমেজে ঘুমিয়ে ছিলো গোটা পলাশগড় গ্রাম। আজ আমাবস্যা…….যেন কোনো অশরীরি আতঙ্কের কালো ছায়া ছেয়ে রয়েছে গোটা গ্রামের ওপর। গত রাত্রে ঘটা সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে গ্রামের কোন মানুষ আর ভুলে করেও বাড়ির বাইরে নেই এই সময়। গ্রামের এক প্রান্তে বেশ কয়েক ঘর দরিদ্র কৃষকদের বাস। এখনো এই মানুষগুলো ঘরের সাথে শৌচাগার গড়ে তুলতে পারেনি। এমনই একটি কুঁড়ে ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে ছিল মা, বাবা এবং তাদের বারো বছরের ছোট্ট মেয়ে। হঠাৎ কানে বাপের গলার আওয়াজ আসতেই ঘুম ভেঙে গেল মেয়েটির! আবারও সে স্পষ্ট শুনতে পেল, যে বাবা যেন তাকে বাড়ির বাইরে থেকে ডেকে বলছে,
– মা…..মা রে……একবারটি বাইরে এসে আমারে দেখ, মা……আহ, বড্ড যন্ত্রনা হচ্ছে পায়ে……তোর বাপেরে লতায় কেটেছে, মা…..
ধক করে উঠল মেয়েটির বুক……সত্যিই তো, তার বাপ তো বিছানায় নেই! তার মানে কি সে রোজকার মত প্রকৃতির ডাকে ঘরের বাইরে বেড়িয়েছে আর সেখানেই কি তাকে সাপে কেটেছে! আর অপেক্ষা না করে, ঘুমন্ত মাকে না ডেকেই, ভেজানো দরজা ঠেলে বাবাকে খুঁজতে বাইরে বেরিয়ে যায় মেয়েটি………..কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ফিরে এসে, বিছানায় মেয়েকে না দেখে অবাক হয়ে যায় তার বাবা! সে সত্যিই ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়েছিল শৌচকর্ম করতে। কিন্তু এত রাত্রে তার মেয়ে গেল কোথায়! সেও কি একই কাজ করতে বাইরে গেছে?
হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে, বাইরে গিয়ে এক দুবার মেয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলো সে, তার স্ত্রীও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে এতক্ষনে। বাড়ির পাশেই যে জঙ্গলাকীর্ন স্থানে তারা শৌচকর্ম করে, সেখানে গিয়েও অনেক্ষন খুঁজলো তারা মেয়েটিকে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না তাকে……..ঠিক এমন সময় মেয়ের গলার একটি তীব্র আর্তচিৎকার যেন খান খান করে ভেঙে দিল সেই রাতের নিস্তব্ধতা! কম্পিত বক্ষে স্বামী স্ত্রী দুজনে ছুটে গেল তাদের মেয়ের কন্ঠস্বর অনুসরণ করে…….আরেকবার! আরেকবার শোনা গেল তার চিৎকার!……..আরো জোরে……আরো জোরে পা চালাতে লাগলো ওরা দুজন……কিছুক্ষনের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল গ্রামের পূবদিকের একটি আধবোজা পুকুরের কাছে!…..কিন্তু সেখানকার দৃশ্য দেখে তাদের চক্ষুস্থির হয়ে গেল!
তাদের মেয়ের রক্তাক্ত নিথর দেহের টুঁটি তখনো কামড়ে ধরে আছে একটা অদ্ভুত চেহারার জীব! রাতের অন্ধকারের মধ্যে তার অবয়বের অস্পষ্ট আবছায়া দেখে তাকে না তো কোন মানুষ মনে হচ্ছে, না কোনো পশু! শুধু আগুনের গোলার মত জ্বল জ্বল করছে তার হিংস্র চোখ দুটি! এই দৃশ্য দেখে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় লোকটির স্ত্রী!……..এবার সেই ছায়ামূর্তি যেন মেয়েটিকে ছেড়ে তাকিয়ে দেখল, অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা, আতঙ্কে আরষ্ঠ তার বাপের প্রতি!…….একটা চাপা হিংস্র গর্জন করে উঠল সে!…..কিন্তু লোকটির দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে একবার যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেই বিভীষিকা…….তার কারণ, লোকটির হাতে ধরে থাকা হ্যারিকেনের জ্বলন্ত অগ্নি শিখা! হঠাৎ পেছন ফিরে লাফ দিয়ে, দূরে বনঝোপের মধ্যে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল সে! শুধু পরে রইল একটি বাচ্চা মেয়ের আধ খাওয়া মৃতদেহ, তার অজ্ঞান মা, এবং বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়া তার বাপ!
(৬)
পরদিন সকালে, গ্রামের সকলের কাছেই ছড়িয়ে পড়ল সেই অজানা আততায়ীর হাতে তার দ্বিতীয় শিকারের এই মর্মান্তিক পরিণতির কথা! মেয়েটির বাবার দেখা সেই অদ্ভুত প্রাণীটির বর্ণনা শুনে, নানা লোক তাকে নানা ধরণের বন্য পশুর তকমা লাগাতে শুরু করেছে। আগেরবারের মত, এই দ্বিতীয় ঘটনাটার ক্ষেত্রেও অক্ষমতার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। আতঙ্কের বশে, এই গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র বসবাস করার কথাও ভাবছে অনেক গ্রামবাসী। সেদিনকার মত, আজকেও বেশ উদ্বিগ্ন চিত্তে এই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে স্যামুয়েল। এমন সময়, হঠাৎ কোথা থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো এই বাড়ির চাকর সুখেন। সে অমলেন্দু, শ্রাবন্তীকে, স্যামুয়েল আর মধুরিমাকে বলে উঠল,
– দাদাবাবুরা!…..দিদিমণিরা!……এই দু’টো মানুষের এমন অবস্থায় জন্য যে দায়ী, তাকে ধরে ফেলেছে গ্রামের লোক……তাকে দেখতে হলে চলুন আমার সাথে!
ওরা বেশ অবাক হয়ে, আর কোন কথা না বাড়িয়ে, ছুটে গেল সুখেনের নির্দেশানুসারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সেই গ্রামের শেষে শ্মশানে এসে হাজির হল। কিছুটা ভেতরে ঢুকতেই, ওরা অবাক হয়ে দেখলো, যে একজন জটা-জুটোধারী লাল পোশাক পড়া তান্ত্রিক গোছের বৃদ্ধ লোককে খুব নির্মম ভাবে প্রহার করার পর, একটি বটগাছের গুড়ির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে! কোনো মতে অর্ধ-চেতন এবং রক্তাক্ত অবস্থায় বাঁধন থেকে ঝুঁকে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে! তার চারিধারে গ্রামের লোকের ভিড়…….তার মধ্যে রয়েছেন রঘুপতিবাবুও। অমলেন্দুদের দেখে তিনি উৎসাহের সাথে বলে উঠলেন,
– আসুন আপনারা…..আসুন…..দেখুন একবার এইসব কার কারসাজি…….দেখুন একবার!
শ্রাবন্তী অবাক হয়ে বলে উঠলো,
– অপনারা কি করে বুঝলেন, যে এই হত্যাগুলির পেছনে আছে এই তান্ত্রিক?
রঘুপতি বাবু জোরের সাথে বলে উঠলেন,
– এই শয়তানটা তন্ত্র সাধনা করে…..পিশাচ নামায় সে প্রতিদিন রাত্রে! ও যবে থেকে এই গ্রামে এসেছে, তবে থেকেই শুরু হয়েছে ওই অদ্ভুত জীবটির আনাগোনা!… নিঃসন্দেহে এই সবের পেছনে ওরই হাত আছে!…..তাই আমরা সব গ্রামের মানুষরা ঠিক করেছি, যে ওকে এই গ্রাম ছাড়া করবো…..পুলিশের হাতে তুলে দেবো ওকে…
এই কথা শোনার সাথে সাথে, গ্রামের বেশ কয়েকজন মাতব্বর গোছের যুবক আবার চড় থাপ্পড় লাগাতে শুরু করলো সেই গাছে বাঁধা লোকটির গায়ে। সেই মুহূর্তে শ্রাবন্তী ছুটে গেল তার কাছে, আর সেই লোকটির গায়ে আর কারোর হাত তুলতে বাধা দিয়ে, সে চিৎকার করে বলে উঠলো,
– পাগল হয়ে গেছেন আপনারা!…..একটা বয়স্ক মানুষের ওপর ভিত্তিহীন সন্দেহ করে এই ভাবে অন্যায় অত্যাচার করছেন!…..কি প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে, যে এইসব ওর কারসাজি? এখনো অবধি এটাই বোঝা গেল না যে ওটা কি ধরণের প্রাণী…..আর এরই মধ্যে আপনারা খুঁজে পেয়ে গেলেন তার সৃষ্টিকর্তাকে! ব্যাপারটা কি এতোই সহজ? আপনাদের কি মনে হয়, পুলিশ এসে আপনাদের কথা বিশ্বাস করবে? কখনই না…..তারা আপনাদেরই একটি অসহায় মানুষকে অত্যাচার করার জন্য গ্রেফতার করবে!…..তাই, ভালো চান তো এখনই ওকে ছেড়ে দিন…..ছেড়ে দিন ওকে!
সকল গ্রামবাসীই অবাক হয়ে গেল শ্রাবন্তীর এই আচরণে! তবে তারা শহরের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মান্য করেই চলে, তাই খুব বেশি বিবাদে না গিয়ে, লোকটির বাঁধন খুলে তাকে ছেড়ে দিলো সবাই। গাছের গা ঘেষে অসহায় ভাবে মাটিতে বসে পড়লো লোকটি। তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে অস্ফুট কণ্ঠে সে বলে উঠল,
– এই কথা ঠিক…..এই কথা ঠিক, যে আমি পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক……তবে আমি এই শক্তিকে কাজে লাগাই জনগণের মঙ্গল কামনায়……কিন্তু…..কিন্তু রোজ রাতে যে নরমাংস লোভী জীবটা দেখা দিচ্ছে…..সে কোন সাধারণ জীব নয়……তার শক্তি আমার থেকে আরো বেশি……সে আমার ক্ষমতার বাইরে…….তার সম্বন্ধে আমি সব কথা জানি……সব জানি আমি!…..সে তোমাদের মধ্যেই থাকে……তোমাদের আশে পাশেই ঘুরে বেড়ায় সব সময়, কিন্তু তোমরা তাকে চিনতে পারো না!…..তার ক্ষিদে কখনো শেষ হবে না…..এই গ্রামকে ধ্বংস করে দেবে সে…..ধ্বংস করে দেবে!
এই কথা শুনে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে উঠলো সকলে। রঘুপতিবাবু বিস্ফারিত চোখে বলে উঠলেন,
– কে সেই জীব? বলো আমাদের…..কার কথা বলতে চাইছো তুমি!
প্রহারের বেদনায় জর্জরিত কণ্ঠে লোকটি বলে উঠলো,
– বলবো না…..কিছুতেই বলবো না…..মরে গেলেও না! তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করেছো…..আমাকে মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছো…..তার শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাদের! তোমাদের একে একে সকলকে মরতে হবে ওই জীবের হাতে…..সকলকে……হাহাহাহা!
(৭)
না, কোনো ভাবেই আর কোন কথা বার করা যায়নি ওই তান্ত্রিকের মুখ থেকে। ওরা সকলেই যে যার বাড়ির ফিরতি পথ ধরেছিল। লোকটি শ্মশানের সেই বটগাছের নিচেই চুপ করে বসে হাঁপাতে লাগলো। জমিদার বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগে অমলেন্দুদের কাছে হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এলো গ্রামের এক তরুণ যুবক। তাকে দেখে অমলেন্দু বলে উঠলো,
– শ্রাবন্তীর কথামত, তোমাকে যে নদীর ওপারে পাশের গ্রামে সেই বৈষ্ণবদের আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম, সেখানে গিয়েছিলে তো তুমি?
ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো,
– হ্যাঁ বাবু, হ্যাঁ……সেই কথা বলতেই তো এলাম…….প্রায় একশো বছর আগেকার ঘটনা, তাও যতটা পেরেছি খোঁজ খবর নিয়েই এসেছি!
অমলেন্দু নিজের ওয়ালেট থেকে একটি পাঁচশো টাকার নোট বার করে ছেলেটির হাতে দিয়ে, বলে উঠলো,
– বলো কি জানতে পারলে সেখান থেকে…….
ছেলেটি টাকাটা পেয়ে বেশ খুশির সুরে বলে উঠলো,
– দেখুন বাবু, ওই আশ্রমের সবচেয়ে বড় গোঁসাই-এর সাথেই কথা বলে এসেছি আমি! তার বক্তব্য, যে সেই সময়, একদিন সকালে নদীর পারে একজন সুদর্শন যুবকের অচৈতন্য দেহ দেখতে পায় আশ্রমের কিছু লোক। সম্ভবত ইনিই ছিলেন এই জমিদার বংশের মৃগাঙ্ক মোহন! তারা তাকে আশ্রমে নিয়ে এসে সুস্থ করে তোলে, কিন্তু তার মাথায় লাগা একটি আঘাতের জন্য পূর্বেকার সমস্ত স্মৃতি ভুলে যান তিনি!…. .কিন্তু….. কিন্তু
শ্রাবন্তী কৌতূহলী হয়ে বলে ওঠে,
– কিন্তু কি?
ছেলেটি বলেই চলে,
– কিন্তু এরপর মৃগাঙ্ক মোহনের সম্পর্ক তৈরি হয় সেখানকার এক সুন্দরী বৈষ্ণবীর সাথে! মেয়েটি গর্ভে তার সন্তান আসে!…..এর কিছুদিনের মধ্যেই কোন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মৃগাঙ্ক মোহন!…..এদিকে গর্ভবতী মেয়েটির সাময়িক অসহায়ত্বের কথা ভেবে, সেই আশ্রমে তাকে সন্তানের জন্ম দেওয়া অবধি থাকতে দেওয়া হয়। একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় সে। কিন্তু তারপরই অবৈধ সন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে তাকে আশ্রম থেকে বহিস্কার করা হয়! ছেলেকে নিয়ে চলে যায় সে সেখান থেকে…..তারপর সেই মা ছেলের যে কি হয়েছিল, তা আর জানা নেই কারোর!
অমলেন্দু লক্ষ্য করলো, যে এই কথা শুনে শক্ত হয়ে এলো শ্রাবন্তীর চোয়াল, তার কপালের চামড়ায় দেখা দিলো চিন্তার রেখা!
(৮)
আবার আরেকটি শীতের রাত তার বিভীষিকাময় কালো চাদর বিস্তার করেছে গোটা গ্রামের ওপর। আবার সকলকে গুনতে হচ্ছে আতঙ্কের প্রহর। না জানি, এবার গ্রামের কার পালা! কার শরীরের রক্ত মাংস মেটাবে এই নরপিশাচটার জঠরের জ্বালা! নিস্তব্ধ গোটা গ্রামে শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে শেয়াল কুকুরের ভীত আর্তনাদ! সেই রাত্রে মধুরিমার ঘুম আসছিলো না। তার শুধু মনে পড়ছিল স্যামুয়েলের কথা! কিছুক্ষণ আগে যদিও বা ফোনে অনেক কথাই হয়েছে তার সাথে, তবুও যেন তাকে নিজের আরো কাছে পাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল মধুরিমার! বিছানাটা যেন বড্ড খালি খালি লাগছে তার স্যামুয়েলকে ছাড়া……আজ যদি সে এই বিছানায় তার পাশেই থাকতো! ভাবতেই কামোত্তোজনায় হৃদ-স্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পেল তার!……ঠিক এমন সময় হঠাৎ বাড়ির সদর দরজা খোলার একটা হালকা আওয়াজ কানে আসতেই, যেন চিন্তার ঘোর কেটে গেল মধুরিমার! সে কৌতূহলী হয়ে সন্তপর্ণে দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে এসে, চোখ রাখল বাড়ির বাইরের রাস্তার দিকে……সেখান দিয়ে চুপি চুপি হেঁটে যাচ্ছে এক ছায়ামূর্তি! সেই সরু গলিটা পার করে, যে রাস্তাটা ধরলো সে……মধুরিমা খুব ভালো করেই জানে, যে সেটা হল শ্মশানে যাওয়ার পথ!
গাঁজার নেশাটা যেন একটু বেশিই করে ফেলেছে, এই কথাই মনে হচ্ছিল শ্মশানের সেই বট গাছের নিচে বসে থাকা তান্ত্রিকের। মাথাটা বেশ জোরেই ঘুরছে এখনো……এমনিতেই শীতের রাত্রের ঘুটঘুটে অন্ধকার সারা শ্মশানময়, তার ওপর আবার চোখের দৃষ্টিশক্তিটাও ঠিক মত কাজ করছে না নেশার ঘোরে!……কিন্তু সেই আবছা দৃষ্টি দিয়েও সে যেন দেখতে পেল, যে দুটো জ্বলন্ত আলোর বিন্দু যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে সামনের ঝোঁপের আড়াল থেকে!…….চমকে উঠে দুই চোখ কচলে নিলো সে…..নাহ, এখন আরো স্পষ্ট আর বড় লাগছে ওই অলোক বিন্দু দুটিকে! এমন সময় সেই সুপরিচিত চাপা গর্জনের আওয়াজ এলো তার কানে……বুঝতে বাকি রইল না, যে ওই দুই আলোক বিন্দু হল তার সামনেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকা সেই নরপিশাচটার দুই চোখ!
পরের দিন সকাল বেলায়, যখন সুখেনের মারফত অমলেন্দু, শ্রাবন্তী আর মধুরিমা জানতে পারলো, যে সেই অতি প্রকৃত জীবের তৃতীয় শিকার হয়েছে, তাদের গতকাল শ্মশানে দেখা সেই তান্ত্রিক……..তখন বিস্ফারিত চোখে, আতঙ্ক আর ক্রোধ মেশানো স্বরে শ্রাবন্তীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠলো মধুরিমা,
– গতকাল রাত্রে তুমি চুপি চুপি শ্মশানে যাওয়ার রাস্তা দিয়ে কোথায় গিয়েছিলে, শ্রাবন্তী? আমি নিজে চোখে তোমাকে দেখেছি সদর দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে!……বলো, আমার কথার জবাব দাও……..
শ্রাবন্তী চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল মধুরিমার দিকে!
শ্রাবন্তীকে নিরুত্তর দেখে, অমলেন্দুর উদ্দেশ্যে আরো জোরে চিৎকার করে উঠলো মধুরিমা,
– আমি জানি ওর কাছে কোন উত্তর নেই রে দাদা… .. কারণ ওই…..ওই হল সেই নরখাদক পিশাচিনী…..ওই সব স্বপ্ন-টপ্ন সব মিথ্যা কথা ওর…..মনে করে দেখ, দাদা ও যবে থেকে এই বাড়িতে এসেছে, তবে থেকেই এই গ্রামের হত্যালীলা শুরু হয়েছে……ওকে পুলিশের হাতে তুলে দে, দাদা…..আমাদের সকলকে মেরে ফেলার আগে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দে!
ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায়, চিৎকার করে মুখ খুলল শ্রাবন্তী,
– হ্যাঁ মানছি…..মানছি আমি কাল রাতে শ্মশানে গিয়েছিলাম, আর ওই তান্ত্রিকের সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলাম……কারণ আমার মনে হয়েছিলো, যে সকালে রাগের বশে সকলের সামনে সে মুখ না খুললেও, রাতে হয়তো আমার কাছে একান্তে ওই নরখাদক জীবটার সম্বন্ধে সব কথা খুলে বলবে…..কিন্তু আমি সেই জায়গায় পৌঁছনোর আগে…..পৌঁছনোর আগেই সে ওই জীবটার শিকার হয়……হ্যাঁ, অমলেন্দু বাবু, আজ সকালে এই গ্রামের লোকেরা ওই ব্যক্তির যে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখেছে, তা আমি কাল রাতেই সেখানে গিয়ে দেখতে পাই! কিন্তু সেই সময়….সেই সময় তার দেহাবশেষের ধারে কাছে কাউকেই দেখতে পাইনি আমি….কাউকেই না!
এই বলে আর কোন কথা না বাড়িয়ে, সেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল শ্রাবন্তী। মধুরিমা নিজের বিস্ফারিত চোখের সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে! বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অমলেন্দু!
(৯)
মধুরিমার সন্দেহের জালে জড়িয়ে গিয়ে এই বাড়ির পরিবেশটাকে কেমন যেন গুমোট লাগতে শুরু করেছে শ্রাবন্তীর। তবে যে যাই বলুক না কেন, এই রহস্যের সমাধান না করে সে কিছুতেই এখান থেকে ফিরে যাবে না, তাতে যদি ওই পিশাচটার হাতে প্রাণ দিতে হয়…….তাতেও রাজি আছে সে! এই বদ্ধ ঘরের আবহাওয়া থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার জন্য, সেদিন বিকালে একবার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ছিল শ্রাবন্তী। বিকাল বেলায় সেই নরখাদকের আক্রমণের কোন ভয় নেই, এই কথা সে জানে। বাড়ি ফিরে এসে, হঠাৎ তার চোখ চলে গেল পেছনের বাগানে! সেখানে ঝোঁপের আড়ালে, একটি আমগাছের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মধুরিমা আর স্যামুয়েল! মনে একটি অজানা কৌতূহল হওয়ায়, শ্রাবন্তী পা টিপে টিপে চলে গেল সেই স্থানের খুব কাছে……তারপর নিকটবর্তী আরেকটি গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে লাগলো এই দুজনের কথাবার্তা!
মধুরিমা স্যামুয়েলকে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল, স্যামুয়েল ইংরাজি বাংলা মিশিয়ে বলে উঠলো,
– কি করছো কি, মধুরিমা……ছাড়ো আমায়……এখুনি তোমার দাদা অফিস থেকে চলে আসবে! সে যদি আমাদের এই অবস্থায় দেখতে পায়! মনে হয় না সে কখনো আমার মত একজন বিদেশীর হাতে তোমাকে তুলে দিতে চাইবে……….
মধুরিমার আলিঙ্গন বিন্দুমাত্র শিথিল হল না, সে সেই অবস্থাতেই বলে উঠলো,
– দাদা যদি মত না দেয়, তাহলে তার অমতেই তোমার সাথে চলে যাবো আমি! স্যামুয়েল……যেদিন থেকে আমি তোমাকে দেখেছি, সেদিন থেকেই শুধু তোমার হয়ে গিয়েছি! তুমি কি কিছুই বোঝো না! কেন এলে বলো তো তুমি! সুদূর ব্রিটেন ছেড়ে কেন এলে এখানে! কেন এলে আমার চোখের সামনে!
স্যামুয়েল এবার মধুরিমার দুই কাঁধ আলতো করে ধরে বলে উঠলো,
– জানো তো মধুরিমা, শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার জন্যই আসিনি আমি এখানে…….আসলে এই গ্রামটা আমাকে খুব টানে! কারণ এটাই ছিল আমার পূর্বপুরুষের ভূমি!
অবাক হয়ে মধুরিমা বলে উঠলো,
– তোমার পূর্বপুরুষেরা এখানে থাকতেন! মানে?
স্যামুয়েল ম্লান হেসে বলে উঠলো,
– হ্যাঁ, ঠিক তাই! রাজেন্দ্র মোহনের হৃদ রোগে মৃত্যুর পর, তার স্ত্রী এমিলির সম্পর্ক গড়ে ওঠে তখনকার এক ব্রিটিশ অফিসারের সাথে…..তার নাম ছিল হেনরি উইলসন। এই গ্রামের জমিদারির দায়-দায়িক্ত তার কাঁধেই ছিল সেই সময়। কলঙ্ক রটে যাওয়ার ভয়ে, তিনি এমিলিকে নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটেনে চলে যান। সেখানে তাদের একটি পুত্রসন্তানও হয়। তিনিই হলেন আমার ঠাকুরদা……তবে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান ইমিলি! এই কথা এই গ্রামের লোকেরা না জানলেও, জানে আমার পরিবার! তাই এই গ্রামের প্রতি আমার এত টান!
মধুরিমার মুখে খেলে উঠলো একটি বাঁকা হাসি, সে স্যামুয়েলকে আরো শক্ত বন্ধনে আবৃত করে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
– আজ রাতে……আজ রাতে বারোটা নাগাদ, বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, আমি কিন্তু গ্রামের পুবদিকে নদী পারে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, স্যামুয়েল…..আমায় কথা দাও তুমি আসবে!
স্যামুয়েল ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
– কিন্তু সেই নরখাদক……সেই পিশাচ…….
মধুরিমা কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলে উঠল,
– একটা গোটা রাতে তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য, আমি ওই পিশাচের হাতে বলি হতেও রাজি, স্যামুয়েল…..প্লিজ, বলো…..বলো তুমি আসবে……
একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলে স্যামুয়েল বলল,
– ঠিক আছে……আসবো!
এইটুকু শুনেই সেখান থেকে লুকিয়ে কেটে পড়লো শ্রাবন্তী……মনে মনে সমস্ত ঘটনাগুলিকে একই সুতোয় গেঁথে চলেছিল সে এতদিন ধরে, বাকি ছিল শুধু একটা সূত্র পাওয়া! আজ সেটাও পেয়ে গেল সে! আর দেরি নেই এই পিশাচের রহস্যের জট খুলতে!
(১০)
সেই নরখাদকের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে, এই গ্রামে বিভীষিকার কালো ছায়া নিয়ে হাজির হয়েছে চতুর্থ রাত্রি! চারিদিকে অন্ধকারের কালি মেখে অপার নিস্তব্ধতায় ঘুমিয়ে আছে গোটা পলাশপুর গ্রাম। পরদিনই, আবার না জানি পাওয়া যাবে কার মৃত্যুসংবাদ! বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, মধুরিমা চুপি চুপি সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে! তারপর দ্রুর পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেল গ্রামের পূর্ব দিকে অবস্থিত নদীর পারে! সেখানে এসেই খুশিতে ভরে উঠলো তাই বুক, কারণ সেখানে স্যামুয়েল তার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো! মধুরিমা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল স্যামুয়েলকে, কিন্ত সেই মুহূর্তেই তাকে অবাক করে এক ঝটকায় অনতিদূরে সরিয়ে দিলো স্যামুয়েল! তারপর হিংস্র স্বরে বলে উঠলো সে,
– বড্ড ভুল করেছো আমাকে ভালোবেসে, মধুরিমা……বড্ড বোকামির কাজ করে ফেলেছো তুমি……নিজের মৃত্যুকে নিজেই ডেকে এনেছো আজ রাতে!
মধুরিমা অবাক হয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
– মানে? এসব কি বলছো তুমি!
মধুরিমার দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো স্যামুয়েল,
– মানে?…….মানে, এই গ্রামের সেই নরখাদক আর কেউ নয়, মধুরিমা…..আমি……আমিই হলাম এই “পলাশগড়ের পিশাচ”! হাহাহাহা……
আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মধুরিমা সেই রাতের অন্ধকারে দেখলো, যে একটা চাপা গর্জন করে উঠলো স্যামুয়েল!……তার সমস্ত শরীরের আকৃতি যেন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করলো!…..ভাঁটার মত জ্বলে উঠলো তার দুই কোটরে ঢোকা চোখ!…..তার সুন্দর মুখশ্রী বদলে গিয়ে ধারণ করল এক হিংস্র শেয়াল এবং কুকুরের মুখাকৃতির সংমিশ্রনের রূপ!.…. ঠোঁটের সামনে বেরিয়ে এলো দুটো তীক্ষ্ণ কুকুরদন্ত!……ধীরে ধীরে আয়তনে বৃদ্ধি পেতে লাগলো তার শরীরের!……ছিঁড়ে যাওয়া জিন্স আর টি-শার্ট-এর ভেতর থেকে উন্মোচিত হল একটি সুবৃহৎ দানবিক চেহারা, যার শরীরে মাংসপেশির নাম মাত্র নেই, আছে শুধু হাড়-পাঁজরের ওপর শুষ্ক চামড়ার আস্তরণ! যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার পেটের ভেতরে থাকা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো!
একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে দু-পা পিছিয়ে এলো মধুরিমা। আবার একটা হিংস্র গর্জন করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েও হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল এই দানব! কারণ মধুরিমার পেছনেই এখন জ্বলন্ত মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে অমলেন্দু!…… আরেকবার ভয়ঙ্কর গর্জন করে, পিছু ফিরে লাফিয়ে উঠে পালাতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়ল এই নরপিশাচ…..কারণ তার বিপরীত দিকেও একটি উজ্জ্বল রূপোর বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবন্তী!…..আর দেরি না করে, নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে, সেই তীক্ষ্ণ বল্লমের ফলাটিকে এক ঝটকায় সে বিঁধিয়ে দিল হতভম্ব পিশাচটির বুকে, সোজা তার হৃদপিণ্ডের ভেতর! ঠিক যেন মা দুর্গা ত্রিশূল হাতে বধ করলেন মহিষাসুরকে! …….রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে মৃত্যুযন্ত্রনায় চেঁচিয়ে উঠলো এই “পলাশগড়ের পিশাচ”! ফিনকি দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে লাগলো তার বুক থেকে! মাটিতে পড়ে গিয়ে, কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে গেল তার দেহ!
আতঙ্কে মধুরিমা দুহাত দিয়ে তার দাদাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো! ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে শ্রাবন্তী দেখলো, যে আবার ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হল এই মৃত পিশাচটির দেহ….কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের সামনে পড়ে রইল উলঙ্গ স্যামুয়েলের রক্তাক্ত মৃতদেহ! ওরা অবাক হয়ে দেখলো, যে আশে পাশের বনঝোপের ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে সারি সারি জ্বলন্ত চোখ জোড়া!…..শ্রাবন্তী বলে উঠল,
– স্যামুয়েলের রক্তের গন্ধে এখানে ছুটে এসেছে গ্রামের শেয়ালগুলো, ওরা ওদের খিদে মেটাক!…..এই লাশটাকে এখানেই ছেড়ে যেতে হবে আমাদের। কাল সকালে গ্রামবাসীরা জানবে, যে স্যামুয়েলই হল এই পিশাচের চতুর্থ এবং শেষ শিকার! নাহলে পুলিশ আমাদের সমস্ত কথা অবিশ্বাস করে, স্যামুয়েলের খুনের দায়ে হাতে হাতকড়া লাগাবে আমাদের!
এই বলে স্যামুয়েলের বুকে বিঁধে থাকা রূপোর বল্লমটা এক টানে বার করে নিল শ্রাবন্তী, তারপর ঠিক ফোল্ডিং ছাতার মত সেটাকে ছোট করে ভরে নিলো অদূরে পড়ে থাকা নিজের হ্যান্ড-ব্যাগে!
(১১)
সেদিন রাত্রে ঘুম এলো না কারোর চোখে। বাড়ি ফিরে হতবাক অমলেন্দু আর মধুরিমাকে বলতে শুরু করলো শ্রাবন্তী,
– আমি যা বলতে চলেছি, তার মধ্যে কিছুটা আছে আমার আন্দাজ, এবং বাকিটা ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং অলৌকিকতা!…… যখনই আমি শুনি, যে রাজেন্দ্র মোহন আমেরিকার রুশো শহর থেকে এমিলিকে বিবাহ করে এনেছিলেন, সন্দেহটা আমার তখনই হয়। এখনও আপনারা ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন, যে সেই সময় (অর্থাৎ ১৯২০ সালের কাছাকাছি), রুশো শহরের বেশ কিছু মানুষও এই একই ভাবে কোন নরপিশাচের হাতে মারা পড়ে। তাদের ধারনা, যে প্রবল নিচু তাপমাত্রায়, যখন সেখানকার জনগণের কাছে খাবার ফুরিয়ে যেত, তখন বাধ্য হয়েই কেউ কেউ হয়ে উঠতো নরমাংশভোগী! আর ঠিক এই সময়ই তাদের শরীরে প্রবেশ করতো এক ভয়ানক অপদেবতা, যার নাম হল “ওয়েন্ডিগো” (wendigo)!
এর ফলে তারা প্রতি শীতের রাত্রে এই ভয়ানক পৈশাচিক রূপ ধারন করে মানুষ শিকার করতে বেরতো, এতে সাহায্য করতো তাদের অন্যের স্বর নকল করার অদ্ভুত ক্ষমতা!…..একবার শরীরে এই অপদেবতা বাসা বাঁধলে, হাতের সামনে অন্যান্য খাবার থাকলেও, নরমাংশের খিদে যেন তাদের কখনো মিটতো না! এরা ভয় পায় আগুনকে। এছাড়াও, কোন ওয়েন্ডিগো বা এই জাতিয় পিশাচকে মারতে গেলে লাগে রূপোর অস্ত্র, যা দিয়ে ছেদ করতে হয় তাদের হৃদপিণ্ডকে! সেটা আমি আগে থেকেই আঁচ করে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম ওই রূপোর ফোল্ডিং বল্লমটাকে……..সেই সময়, ওই শহরের মানুষদের বাঁচাতে, ওয়েন্ডিগোদের চিহ্নিতকরণ করে এমন ভাবেই হত্যা করছিলেন ওয়েন্ডিগো-হান্টাররা!
– যাইহোক, আমার বিশ্বাস এমিলিও ছিলেন এমন এক ওয়েন্ডিগো! তাকে হয়তো চিনে ফেলেছিলেন ওয়েন্ডিগো-হান্টাররা…… তাই, তিনি রাজেন্দ্র মোহনকে প্রেমের জালে জরিয়ে, তার সাথে চলে এলেন ভারতের এই পলাশগড়ে। এখানে এসেও বেশ কিছু বছর ধরে শীতের রাত্রিগুলিতে চালাতে লাগলেন এই হত্যালীলা। অপুত্রক রাজেন্দ্র মোহনের হৃদ রোগে মৃত্যুর পর, যতদিন না এমিলি হেনরির সাথে ব্রিটেনে পাড়ি দিলেন, ততদিন ধরে চলতে থাকলো তার এই পৈশাচিকতা!……এদিকে আদিবাসী হওয়ার ফলে রমাবতী হয়তো জানতেন কোন গুপ্ত তন্ত্র-বিদ্যা, তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন এমিলির আসল রূপ! তাই একদিন তাকে হত্যা করে পুকুরে ভাসিয়ে দিলেন এমিলি। সময়টা বর্ষাকাল হওয়ায়, তাকে শুধু হত্যাই করলেন তিনি, কিন্তু তার মাংশ ভক্ষন করলেন না!
– মৃগাঙ্ক মোহন ভাবলেন, যে এটা তার দাদার কাজ। তিনি প্রেমিকার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, রাজেদ্র মোহনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু এমিলি বোধহয় ততদিনে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলেন রাজেদ্র মোহনকে…… তাই, যে রাতে মৃগাঙ্ক মোহন তার দাদাকে মারতে যাবেন, সেদিনই এমিলি তার পৈশাচিক রূপ ধারণ করে আক্রমন করলেন তাকে! মৃগাঙ্ক প্রান ভয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো জমিদার বাড়ি থেকে……তার পেছন পেছন মূর্তিমান বিভীষিকার মত ছুটে আসতে লাগলেন এমিলি! কিন্তু দৈবক্রমে গ্রামের নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রানে বেঁচে গেলেন মৃগাঙ্ক, কিন্তু মাথায় চোট পেয়ে তিনি হারিয়ে ফেললেন স্মৃতিশক্তি! তারপরে সেই বৈষ্ণব আশ্রমে ঘটা ঘটনার কথা আপনারা জানেন……শুধু জানেন না এটাই, যে মৃগাঙ্ক মোহনের সেই পুত্রসন্তানই হলেন আমার ঠাকুরদা!……হ্যাঁ, এই কথা আমাদের পরিবারের সকলেই জানে, যে আমার ঠাকুরদার বাবা ছিলেন খুব ধনী কিন্তু নিঃসন্তান। একদিন এক অসহায় বৈষ্ণবী তাকে একটি পুত্র সন্তান দত্তক দিয়ে যান, তারপর আর তার কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি!
– তবে আমার ঠাকুরদা যে সেই সন্তানই ছিলেন, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম তখনই, যখন মৃগাঙ্ক মোহনের এমিলি দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সেই রাতের কয়েকটা দৃশ্য ভেসে আসতে থাকে আমার স্বপ্নের মধ্যে! পূর্বপুরুষের কিছু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা, পরবর্তী প্রজন্মগুলির কারোর মনে জীনগত ভাবে জেগে ওঠার এই ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় “epigenetic transmission of transgenerational trauma”! ঠিক একই রকম ভাবে, স্যামুয়েলও যেহেতু এমিলির বংশধর, তার মধ্যেও জেগে উঠতে শুরু করলো এই “ওয়েন্ডিগো-র” নরমাংশলোভী মনোভাব! সেও আবার এখানে এসে জাগিয়ে তুলল একশো বছর আগে এমিলির দ্বারা শুরু করা হত্যালীলা! কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে, আমার বা স্যামুয়েলের আগের দুটি প্রজন্ম ছিল শুধুমাত্র এই ঘটনাগুলির জেনেটিক বাহক, তাদের মধ্যে কিন্তু এক্সপ্রেসড হয়নি এই ক্যারেক্টার-গুলি!
– রমাবতীর মতই, তন্ত্র-বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ায়, সেদিন ওই তান্ত্রিকও চিনে ফেলেছিলো স্যামুয়েলের আসল রূপ। কিন্তু গ্রামবাসীদের প্রতি রাগের কারনে, তিনি চাইলেন যে স্যামুয়েল আরও গ্রামের মানুষদের হত্যা করুক! হয়তো ভেবেছিলো সে, যে স্যামুয়েলের কথা সবার কাছে ফাঁস না করে দেওয়ার জন্য তাকে অন্তত মারবে না স্যামুয়েল। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমান করে, স্যামুয়েল তাকেই বানালো তার তৃতীয় শিকার! এতে তার খিদে যেমন মিটলো, তেমনই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিল তার আসল রূপের এক চিহ্নিতকারী! আর বাকি দুটো মানুষকে মারার পেছনে ছিল শুধুমাত্র তার নরমাংশের খিদে মেটানোর উদ্দেশ্য! আর অমলেন্দু বাবু, আমার কথামত মশাল হাতে ওই নদীর পারে গিয়ে, আপনি আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছেন এই পিশাচকে মেরে আপনার বোনকে বাঁচাতে।
এতটা কথা একসাথে বলার পর চুপ করে হাঁপাতে লাগলো শ্রাবন্তী। অমলেন্দু আর মধুরিমা এখনও বিহ্বল চোখে তার দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এমন সময় পুব আকাশের ঈশান কোনে দেখা গেল উদিয়মান সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি।
(সমাপ্ত – “ওয়েন্ডিগো-র” সম্বন্ধে বিশদে জানতে দেখতে পারেন নিচে দেওয়া লিংক: https://www.ranker.com/list/wendigo-facts/lyra-radford)
Thank you Alapi Mon for selecting my story.
আপনার রচনায় সমৃদ্ধ আলাপী মন।