মুক্ত বন্ধন

মুক্ত বন্ধন
-রাখী চক্রবর্তী

 

 

“এই তো সোনাই কাঁদে না।আর একটু চুপ করে থাকো,মামমাম চলে আসবে এক্ষুনি।”ছয় মাসের মাতৃহারা সন্তানকে আশ্বাস দিচ্ছে ওর একমাত্র মাসি।অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছে কথাটা বলা ভুল কারণ ওর মা আসবেই।
দু’ বোন আর মা, এই নিয়ে সংসারটা দিব্যি চলছিল।সোমী ও অমী এই দুই বোনের খুব মিল।ওরা দুু’ বছরের ছোট বড়। সোমী নিজেই দেখে শুনে অর্নবকে বিয়ে করে। অমীর সায় ছিল না এ বিয়েতে। যাই হোক বিয়ের পর থেকেই অমী বুঝতে পারছে সোমী কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। অথচ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই বলে ও সব কিছু না। বিয়ের প্রথম বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অমী মাসী হওয়ার খবরটা পেয়ে গেল। আনন্দের জোয়ার বইছে অমীদের বাড়িতে। কাকা, জেঠু, খুড়তুতো ভাই বোন সবাই একটা নতুন প্রাণের স্পন্দনের অপেক্ষাতে আছে । যথাসময়ে সোমী একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো। ছেলে জন্ম না দিতে পারায় সোমীর সাথে অর্নব ঝামেলাটা আরও বাড়িয়ে দিলো।ব্যাপারটা এবার বাড়ির সবার নজরে এল। সোমী একমাস হল অর্নবদের বাড়ি থেকে চলে এসেছে। ঠিক করেছে মার কাছে থেকেই সোনাইকে মানুষ করবে।
এদিকে অর্নব ও তার মা হঠাৎ একদিন এল সোমী ও তার বাচ্চাকে নিয়ে যেতে। সোমীর তো আনন্দ ধরে না।যাইহোক বেশ ভালো ভাবে কিছু দিন কাটলো সোমীর শ্বশুরবাড়িতে। সোনাই ও একটু একটু করে বড় হচ্ছে তার বাবার বাড়িতে।সোনাই যখন ছয় মাসে পড়লো অঘটনটা ঠিক তখনই ঘটলো।
দুপুর বেলায় সোমী খেতে বসেছে। পুরো খাবারটা শেষ ও হয়নি। এর মধ্যেই সোমীর মাথা ঘুরছে, গা গোলাচ্ছে একটা অস্থির অস্থির ভাব। মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রাণটা গেল। সাত পাঁচ না ভেবে সোমী ঘুমন্ত সোনাইকে ওর ঠাম্মির কাছে দিতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেল শাশুড়ির ঘরের সামনে ।অর্নবকে ফোনে বলছে সোমীর শাশুড়ি, “আজই শেষ হবে বুঝলি তো। পুরো প্যাকেটটাই দিয়েছি। এ বিষ খুব ভালো। এটা খেয়ে আজ পর্যন্ত কেউ বাঁচেনি। তুই তো অফিসে আর আমিও এক্ষুণি আমার বোনের বাড়ি চলে যাচ্ছি কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।”

এই সব কথা শুনে সোমী মাতালের মতো টলতে টলতে সোনাইকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা গিয়ে নেতিয়ে পড়লো। সোমী পাড়ার লোকজনকে শুধু এইটুকু বললো,”আমাকে ওরা বিষ দিয়েছে।” সব শেষ।হসপিটালে যেতে যেতে। অমীরা খবর পেয়ে পুলিশের কাছ থেকে সোনাইকে নিয়ে নিল। অর্নব ও তার মা পুলিশের হাতে ধরা পড়লো।

সোমীর শেষকৃত্য সমাপন হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। ঝড় বৃষ্টি তুফান হচ্ছে। সোনাইটাও বড্ড কাঁদছে।অমী সামলাতে পারছে না। অমীর মা’ও পারছে না।হঠাৎ অমী লক্ষ্য করলো জানলাটা আস্তে আস্তে কে যেন খুলছে, এবার দমকা হাওয়ার সাথে পুরো জানলাটা খুলে গেল। সোনাই এর কান্না থেমে গেল।সোনাই বুঝি তার মাকে পেল। একটা ছায়া মূর্তির কোলে দুলছে সোনাই। অমী ও মা দুজনেই জ্ঞান হারালো। রাতের ঘটনা কাউকেই কিছু বললো না। বেশ কয়েক দিন এইরকম ঘটনা ঘটলো। সোনাই কাঁদলেই অমী বলে, “এই তো মাম্মাম এক্ষুনি আসবে।” এই বেশ ভালো আছে মা ও মেয়ে। একদিন অমির মা কথা প্রসঙ্গে বাড়ির সবাইকে রাতের ঘটনাগুলো বলতে থাকলো। অমীর কাকা জ‍্যেঠুরা ভয় পেয়ে ঠিক করলো শান্তি সংস্থান করবে। তাহলে সোমীর আত্মা শান্তি পাবে। আর বাড়িতেও উপদ্রব করবে না। পরের দিন সব কাজ কর্ম হবে ঠিক হলো। সেই রাতে সোমী এলো দমকা হাওয়ার সাথে। সোনাইকে কোলে নিয়ে মা বোনের উদ্দেশ্যে বললো, “আমার সন্তানকে কেউ আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”
সোমী.. সোমী…সোনাইকে দে। সোমীর মার চিৎকারে কোন কাজ হলো না। সোনাই এর সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। জানলার পাশে পড়ে আছে। সোনাই এর নিথর দেহ। পরের দিন সকালে থানা থেকে ফোন এল সোমীর শাশুড়ি আর অর্নব এর চোখ দুটো কাল রাতে কে যেন খুবলে নিয়েছে। অপরাধী পলাতক। অমী আর তার মা বুঝল কাজটা কে করেছে। সোনাই যদি বেঁচে থাকতো তাহলে আনন্দটা একটু অন্য রকম হতো।

Loading

Leave A Comment