গল্প

মৃত্যুর ডিগনিটি

মৃত্যুর ডিগনিটি
-সুস্মিতা

 

 

(জীবন যেমনই কাটুক , মৃত্যুর যেন একটা …)

“আচ্ছা, বৃষ্টি বাদলের সময় পাগলীটা কী করে? ও কি তখন ওর দড়ির মতো পাকানো রোগা শরীরটা নিয়ে গাছের কোটরের মধ্যে ঢুকে যায়?
বর্ষার সেই রাতগুলোতে? যখন সারা রাতের দানবীয় বর্ষণে চরাচর ভেসে যায়…তখন ?”—শুধু একা দীপু নয়, মনের মধ্যে এইরকম কৌতূহলী প্রশ্ন অনেকেরই জাগে কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘন বর্ষায় কেউই খোঁজ নেয় না- “পাগলীটা তখন কি করছে?”
প্রশ্নের রোমান্টিকতা অনেকের মনেই খেলা করে, কিন্তু সঠিক সময়ে উত্তর খোঁজার দায়বদ্ধতা কারুরই নেই…

বিশাল ঝাঁকড়া আমগাছটা আর তার নীচে বসে থাকা পাগলীটার বয়স কেউ জানেনা। হতে পারে ওরা সমবয়সী। এ পাড়ার বেশিরভাগ মানুষজনের যেদিন থেকে স্মৃতির বয়স তখন থেকেই তারা দেখছে- বিশাল মোটা গুঁড়িওয়ালা গাছটার নীচে পাগলীটা বসে থাকে। দিন রাত…সবসময়।
সে কবে প্রথম এই গাছটার নীচে এসে বসেছিল? কোথা থেকেই বা এসেছিল? না কি সে ছিল এই পাড়ারই কোনো মেয়ে বা বৌ? পাগল হলো কিভাবে? কোনো শোক বা দুঃখে? কোনো দুর্ঘটনা…অঘটন?—সেসব গল্পও এখন আর কেউ করেনা।

আধা গ্রাম আধা শহরের মতো এই জায়গাটায় যেমন ওই ন্যাড়া রেলস্টেশন অথবা তার গায়ে লেগে থাকা চায়ের দোকান কিম্বা ওই যে বুড়ো টিউবওয়েল…ঠিক তেমনই আমগাছ আর তার নীচে বসে থাকা পাগলীটা …যেন অতি স্বাভাবিক এক চিত্র। ওকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ওর জীবনের প্রতি সুস্থ মানব সমাজের সবাই উদাসীন। যে উদাসীনতা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে মরা নদী।

দীপু কলেজে যায় পাড়ার রতনকাকার স্কুটারে চেপে। বিকেলে বাড়ি ফেরে লোকাল ট্রেনে। কলেজ থেকে ফেরার সময় স্টেশনের সামনে প্রতিদিনই সে একবার পাগলীটার দিকে তাকায়। স্টেশন থেকে হেঁটে বাড়ি ঢুকতে দীপুর সময় লাগে ঠিক আট মিনিট। ওই “আট মিনিট” সময়টা দীপুর মন ও মস্তিষ্কে পাগলীর জন্য বরাদ্দ। বেশ কয়েকটা প্রশ্ন তখন দীপুর মনে প্রায় রোজই খেলা করে। দীপুর বিবেক তখন দীপুকে সুড়সুড়ি দেয়।
আবার বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে দীপু সব প্রশ্নগুলো ভুলেও যায়। পাগলীর জন্য বা সমাজের জন্য কিসের দায়বদ্ধতা?

মাঝেমাঝেই দীপু ভাবে- “পাগলীটা তবে কী খেয়ে বেঁচে থাকে? ও কি শুধুই ওই গাছের আম খায়?” তবে সেটা তো সম্ভব শুধুই গরমকালে…বছরের বাকি সময়টা? কখোনো সখনো পাগলীর সামনে দীপু এক থালা মুড়িও দেখেছে। আশেপাশের দোকানীরা হয়তো দেয়। সে মুড়ির থালা টানা দু’ তিনদিন একইরকমভাবে পড়ে থাকে। তারপরে কখন যেন শেষও হয়ে যায়। দীপু নিজে কখনও পাগলীকে খেতে দেখেনি।
পাগলী নিজের জায়গা থেকে কখনও নড়াচড়াও করেনা। যেন গাছটার মতো ওরও শিকড় গজিয়ে গিয়েছে। মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকা উকুনগুলো টেনে বের করে নখ দিয়ে টিপে মারা ছাড়া পাগলীর আর বিশেষ কোনো কাজকর্মও নেই।
“আচ্ছা পাগলীর প্রাকৃতিক কাজকর্মগুলো সারার দরকার হয় না?”
দুর্গন্ধের জন্য পাগলীটার খুব কাছকাছি যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে একদিন দীপু দেখেছিল-সবুজ জলের মতো পাতলা পায়খানা করে পাগলী তার উপরেই বসে আছে ।

দীপুর বাবা ইস্কুলের মাস্টারমশাই। পিতার কয়েকটা কথা সতেরো বছরের সন্তানের মনে নিজের অজান্তেই দাগ কেটে স্থায়ী হয়ে থাকে।
দীপু খেয়াল করেছে বাবা মাঝেমাঝেই বলেন- “জীবন যেমনই কাটুক, মানুষের মৃত্যুর যেন একটা ডিগনিটি থাকে…শেষের সেই দিনটা যেন সম্মানের হয়…।”
কথাটা বিশেষভাবে উঠেছিল সেদিন…
যেদিন দীপুরা হঠাৎ খবর পেলো- ওদের পাড়ার মুরারীজ্যেঠু কলকাতায় গিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আচমকা ফুটপাথের উপরেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন…
মুরারীজ্যাঠা খুব “শৌখিন মানুষ” হিসেবে পাড়াতে পরিচিত ছিলেন। সবসময় গিলে করা পাঞ্জাবি আর দুধ সাদা ফিনফিনে ধুতি তাঁর পোশাক ছিল, তিনি সেতার বাজাতেন।
এরকম একজন মানুষের মৃত্যু এমন স্বজনবিহীন অবস্থায় পথের ধুলোয় হবে কেন? দীপুরা খবর পেয়েছিল- মুরারীজ্যেঠুর নিথর দেহ বহুক্ষণ কলকাতার রাস্তায় একা পড়ে ছিল। উদাসীন পথচারী কেউ সেদিকে ফিরেও তাকায়নি …

নিজের জন্মমুহূর্ত নিয়ে কল্পনাবিলাসী হওয়ার সুযোগ কারুরই হয় না। কিন্তু নিজের রোমান্টিক মৃত্যু কল্পনায় কখনও গোপনে চোখের জল ফেলেনি, এমন মানুষ কমই আছে।
জীবনের একমাত্র ধ্রুবসত্যই হলো মৃত্যু। জন্মমুহূর্ত থেকেই সেইদিকে পথ চলা। কিন্তু কার মৃত্যু কখন, কোথায় কিভাবে আসবে সেটাই জীবনের সব থেকে বড়ো রহস্য। আসবে কি সে জানান দিয়ে? প্রস্তুতির সময় পাওয়া যাবে? বরণ করে নেওয়া সহজ তাকে দুু’ হাত বাড়িয়ে…হাসি মুখে ?
সত্যিই কারুর জানা নেই, তবুও সকলেরই ভাবতে ভালো লাগে, ইচ্ছে করে- “রোগ, শোক, দুর্ঘটনায় নয়…সে যেন আসে স্বাভাবিক বার্ধক্যের হাত ধরে…নিজের প্রিয় পরিচিত শয্যায় এবং প্রিয়জন পরিবৃত হয়ে।”
সত্যিই যদি সকলের এমন হতো…সত্যিই যদি …

দু’দিন ছুটির পরে সেদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় ট্রেন থেকে স্টেশনে পা দিয়েই দীপুর চোখ চলে গেল ঝাঁকড়া আমগাছটার নীচে…
আজকের দৃশ্যটা যেন একটু অন্যরকম। পাগলীকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছেনা। তার বদলে সেখানে জনা পঁচিশ তিরিশ লোকের একটা জটলা। দুর্গন্ধের জন্য পাগলীর বেশি কাছেও যাওয়া যাচ্ছেনা। সে তো আগেও যাওয়া যেতো না…
কিন্তু আজ পাগলীটা বসে নেই, কেমন যেন কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভীড়ের লোকজনদের ছেঁড়া ছেঁড়া কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল- “গত প্রায় তিনদিন ধরে পাগলীটা এরকমভাবেই শুয়ে ছিলো…। দুর্গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করতেই চায়ের দোকানের লোকেদের টনক নড়েছে।

পাগলীটাকে জানে দু’দিন না তিনদিন হলো ওখানে মরে পড়ে রয়েছে। কেউ সঠিক জানেনা। দীপুর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো…মনে পড়ে গেল বাবার সেই কথাটা- “জীবন যেমনই কাটুক, মৃত্যুর যেন অন্ততঃ একটা ডিগনিটি থাকে। যে কোনো মানুষেরই অন্তিম লগ্নটি হোক্ সম্মানের।”

নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দীপু পাগলীর মৃতদেহের একটু কাছে এগোনোর চেষ্টা করলো…
অর্ধনগ্ন দেহটাকে তখন প্রায় ঢেকে ফেলেছে ডেঁয়ো পিঁপড়ে, মাছি আর পাগলীর মাথার উকুনগুলো।
গত দু’দিন বা তিনদিন ধরে মৃতদেহটিকে সসম্মানে আগলে রেখেছে ওরাই …

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page