মন্দ ভালোবাসা
-রুদ্র প্রসাদ
(০১)
অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা মনের মতো বেস পেয়ে অ্যাটাকটা শুরু করেছে, সীজ মেশিন দিয়ে ওয়াল ভাঙার পর পরপর জায়ান্ট, ভাল্ক, কুঈন ছেড়ে দিয়ে সবেমাত্র হিলিং স্পেলটা দিতেই যাচ্ছিল এমন সময় কাঁধে টোকা পড়তে বিরক্ত হয়েই তাকিয়ে দেখল তুম্বোমুখে প্রফেসর জে.বি.! গম্ভীর গলায় বললেন, “বোর্ডে যে প্রবলেমটা লেখা আছে, তার সলিউশন কি হবে?”
“আই… আই ডোন্ট নো স্যার।”
“ওকে দেন, এক্সপ্লেন দ্য ফরমূলা।”
“স্যরি স্যার।”
“শো মি।”
“ইটস নাথিং স্যার।”
“গুড, কখনোসখনো গেমস্-এর মতো পরীক্ষাতেও স্কোর করে দেখাস, ইডিয়ট। নাউ গেট আউট অফ মাই ক্লাস, ইউজলেস ফেলো। আই’ল টক টু দ্য প্রিন্সিপাল অ্যাবাউট ইউ অ্যাণ্ড মেক সিওর দ্যাট ইউ ওন্ট এবল টু অ্যাটেণ্ড মাই ক্লাসেস এগেন, ব্লাডি ব্যাকবেঞ্চার।”
ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে এলোমেলো চিন্তা করতে করতে গত সপ্তাহের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। কলেজের একটা বাওয়াল নিয়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ার জন্য গার্ডিয়ান কল হয়েছিল, মামা এসে মিটিয়ে দিলেও বাড়ি ফিরে যথারীতি মামার ঘরে ডাক পড়েছিল, “গোঁফ-দাড়ি গজিয়ে গেছে বলে কি নিজেকে বিশাল হনু ভেবে বসেছিস নাকি? মস্তান হয়ে গেছিস! শক্তি দেখাচ্ছিস? শক্তি সবার মাঝে মাথা উঁচু করে বাঁচার মধ্যে, তোর স্ট্রেন্থটা কোথায়? কলেজে অ্যাডমিশনটাও তো আমার ইন্ফ্লুয়েন্সে। আমার একটা নাম আছে, স্যোসাইটিতে প্রতিষ্ঠিত বলে সম্মান আছে, আর তুই কি করছিস? পাশকোর্সে বিএসসি! অনার্স জোটানোর মুরোদটুকুও নেই। ভালোই হয়েছে তোর বাপ-মাকে এই দিন দেখতে হয়নি, তাদের অনেক সৌভাগ্য।”
“যদি সৌভাগ্যই হ’ত তাহলে তোমাদের স্যোসাইটি মাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিত না, বাবাকেও হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করতে হ’ত না।”
“জুতিয়ে মুখ ভেঙে দেব হারামজাদা। দু’বেলা বসিয়ে বসিয়ে গেলাচ্ছি আর নবাবপু্ত্তুর এখানে মুখে মুখে তর্ক করছিস!”
“তোমাদের নাম আর সম্মানের বহর নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। মানসিকতা তো ছেড়েই দিলাম। থাকতে আর দু’বার খেতে দিয়ে যে সারাদিন বেগার খাটাও, তার বেলা? একটা কাজের লোক রেখে দেখো, তাহলেই বুঝবে…;” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একটা সপাটে আছড়ে পড়া চড় আর বাছাই করা কিছু শব্দব্রহ্ম থামিয়ে দিল সুজয়কে। কথাগুলো মনে পড়তেই ভেতরটা তেতো হয়ে গেল।
(০২)
বেয়ারা এসে বলে গেল প্রিন্সিপালের অফিসে দেখা করতে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্যান্টিন ছেড়ে বেরিয়ে অলসভাবে গিয়ে দেখল অফিসে কেউ নেই। করিডরে ফিজিক্সের প্রফেসর জে.বি.-কে দেখে আর ক্লাসের দিকে যেতেও ইচ্ছে হ’ল না। ‘কেন যে মালটা বেছে বেছে আমার পেছনেই কাঠি মারে কে জানে!’ ভাবতে ভাবতে হেডফোন কানে গুঁজে জয়তীর ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ শুনতে লাগল।
হঠাৎ বামাকণ্ঠের ডাকে সম্বিত ফিরল, “এক্সকিউজ মি, ইজ প্রিন্সিপাল ইন?”
আপাদমস্তক ভালো করে দেখল সুজয়, স্লিম ফিগার তবে হাইটে প্রায় তার সমান, মাজা মাজা গায়ের রঙ, হলুদ-সাদা সালোয়ারে দেখতে নেহাৎ মন্দ নয়, বরং সুন্দরীই বলা চলে। ‘হবে কোনো ফ্রেশার’ ভেবে নিজেকে সিনিয়র বোঝাতেই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “কোন স্ট্রীম? পার্সেন্টেজ প্রবলেম? নাকি কম্বিনেশন প্রবলেম?”
“কোনোটাই নয়”, আর কিছু বলার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল, “হ্যালো, না এখনও দেখা হয়নি, ওয়েট করছি, দেখা হলে কথা বললে বোঝা যাবে চান্স আছে কি না।”
“ডোন্ট ইভন থিঙ্ক অ্যাবাউট ইট।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সুজয় আবার বলল, “অ্যাডমিশনের চক্কর তো? এই কলেজের ট্র্যাক রেকর্ড জানা আছে? গত দশ বছরে একটাও ফার্স্টক্লাস বেরোয়নি। আর এখানে যত টীচার আছে, সবার যেন একটাই কোয়ালিফিকেশন। বেছে বেছে সব বোরিং আর খাড়ুশদেরই আনা হয়। আমাদের যে ফিজিক্স পড়ায়, তার পড়ানো নিউটন বা আইনস্টাইন হ’লেও বুঝত কিনা সন্দেহ, আমরা তো কোন ছার!” দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল, মেয়েটা কিছু বলছে না দেখে “জাস্ট আ কশান, চয়েস ইজ ইয়োরস্” বলেই হাঁটা দিল ক্যান্টিনের দিকে।
(০৩)
সারা উইকএণ্ডটা যথারীতি গাধা মজুরি করে আর মুখঝামটা খেয়ে কাটিয়ে সোমবার কলেজে এসে এমনিই ক্লাসে বসে সবার সাথে আড্ডা মারছিল এমন সময় হঠাৎ প্রিন্সিপাল ক্লাসে এলেন। সাথে আগের দিনের দেখা সেই মেয়েটা! প্রিন্সিপাল সোজা ডায়াসে উঠেই বললেন, “গুড মর্নিং ক্লাস, আজ থেকে তোমাদের ম্যাথস্ পড়াবেন প্রফেসর অঞ্জনা দত্ত। ম্যা’ম, নাউ ইটস্ অল ইওরস। হ্যাভ আ গুড টাইম এভরিবডি।”
“হ্যালো স্টুডেন্টস।”
সুজয়ের মনে হচ্ছে এখনই একছুটে পালায়। পরিচয়পর্বের মাঝেই “এক্সকিউজ মি ম্যা’ম” বলেই বেরিয়ে এল।
নির্ধারিত সময়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক কোণে একা বসে দাঁতে নখ খুঁটতে থাকা একটা পরিচিত মুখ দেখে নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে অঞ্জনা বলল, “স্ট্রেঞ্জ! প্রথম ক্লাসটাই বাঙ্ক মেরে দিলে!”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সুজয় বলল, “আই নো আই অ্যাম আ ব্যাড স্টুডেন্ট, ভেরি ব্যাড ইনডিড। আপনি নতুন লেকচারার। বাট সেদিন যখন আমি কলেজ নিয়ে যাচ্ছেতাই বলছিলাম, তখনই আপনি বলতে পারতেন আপনি পড়তে নয়, পড়াতে এসেছেন। ইউ শ্যুড নট এমব্যারাস মি লাইক দ্যাট। অ্যাট লিস্ট আমারও কিছু সেল্ফ-রেসপেক্ট আছে ম্যা’ম।”
“তোমাকে এমব্যারাস করার কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না। ইন ফ্যাক্ট, আই শ্যুড থ্যাঙ্ক ইউ। কারণ তোমার জন্যই আমি ভাবতে শুরু করেছি যে এই বোরিং সাবজেক্টটা কিভাবে সবার কাছে ইন্টারেস্টিং করে তোলা যায়। প্লীজ অ্যাটেণ্ড মাই ক্লাস, যদি বোর হয়ে যাও তাহলে আমার বাকি ক্লাসগুলো বাঙ্ক করতে পারো। ওকে?”
পরেরদিন ক্লাসে কোনো চ্যাপ্টার নয়, ম্যাথকে কেন ‘মাদার অফ অল সায়েন্স’ বলে সেটাই আলোচনা করলেন অঞ্জনা ম্যা’ম, আর এতো প্রাঞ্জল করে বোঝালেন যে সুজয়ও ইন্টার-অ্যাক্ট না করে পারল না। ক্লাসের শেষে “এনি প্রবলেম রিগার্ডিং দিস সাবজেক্ট, ইউ ক্যান কন্ট্যাক্ট মি থ্রু” বলে বোর্ডে লিখে দেওয়া ফোন নম্বর আর ই-মেল আইডিটা সেভ করে নিতেও ভুল হ’ল না তার।
(০৪)
সকালের কাজ সেরে তৈরী হতে গিয়ে চোখে পড়ল রোজকার মতো আজও বরুণের মুখ ব্যাজার। সব গুছিয়ে এগিয়ে দিতে দিতে অঞ্জনা বলল, “এই নাও তোমার পার্স আর রুমাল।”
“রেখে দাও।”
“কাল ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে? কিছু বলল?”
“ডাক্তার আবার কি বলবে!”
“তুমি এভাবে রিঅ্যাক্ট করছ কেন?”
“কারণ তুমি অহেতুক প্রশ্ন করছ। সময় নষ্ট না করে গিয়ে দেখো টিফিন রেডি হল কিনা।”
আর কিছু না বলে রান্নাঘরে গিয়ে মেডকে বলল, “মণি, দাদাবাবুর খাওয়া হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ দিদিমণি।”
“টিফিনটা এখনও প্যাক করো নি! ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি খেতে বসে যাও দিদিমণি, আমি এখনই করে দিচ্ছি।”
নিজের খাওয়ারটা নিয়ে সবে বসেছে, তখনই বরুণের “এখনও হয়নি! ডিসগাস্টিং!” শুনেই “না, না, এই তো হয়ে গেছে।” বলেই সব ফেলে উঠে পড়তে হল। সব গুছিয়ে বরুণ অফিস বেরিয়ে যেতে আবার খেতে বসতেই যাচ্ছিল, তখনই শাশুড়ীমা এসে পড়লেন। বিরক্তকর গলায় বললেন, “সক্কালে উঠেই বাঁজাটার মুখ দেখতে হল, সারাদিনটাই বরবাদ। কতজনার কত কি হয়, তোর কিছু হয় না! মরলেও শান্তি পেতাম ‘আপদ গেছে’ বলে। সাজানো সংসারটা নষ্ট করে দিল! গোপাল, তুমি দেখো।”
আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, “মা, ডাক্তারী রিপোর্টে আমার কোনো সমস্যাই ধরা পড়েনি। আপনাদের কোনো ব্যাপারে কখনও আপত্তি তো করিনি। ডাক্তার-বদ্যি থেকে তাবিজ-কবচ, তুক-তাক কিছুই তো করতে ছাড়েননি। আর কত? খালি মুখেই বলেন ‘সব গোপালের ইচ্ছা!’ সত্যি পারেনও বটে!”
“আমার গোপালের দিব্যি, এই শ্রাবণের মধ্যে পোয়াতি হলি তো বেঁচে গেলি, নইলে যদি তোকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় না করেছি তো আমার নাম সুভদ্রা নয়। তারপর আবার খোকার বিয়ে দেব। আমার বংশপ্রদীপ না দেখে আমি মরব না গোপালের কৃপায়।”
রোজ রোজ একই ব্যাপার। বেডরুমে গিয়ে বাবাকে ফোন করল, সব কথা শুনে বাবা সবই কপালের দোষ বলে চালিয়ে দিলেন। মাও বললেন, ‘এমন সোনার টুকরো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা। তার বংশরক্ষা করা তোমার কর্তব্য। আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করো।’ নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় অঞ্জনার, বিনা দোষেই সে আজ সবার চোখে অপরাধী। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মণির “দিদিমণি, তুমি কিছু খেলে না?”এর জবাবে “কলেজে কিছু খেয়ে নেব” বলে বেরিয়ে পড়ল।
(০৫)
কোনোরকমে একটা ক্লাস নেওয়ার পরই পেট জানান দিতে শুরু করল যে কাল থেকে কোনো দানাপাণি পড়েনি। ক্যান্টিনে কিছু খেতে গিয়ে সুজয়কে বসে থাকতে দেখে সামনে গিয়ে বলল, “তুমি এখন এখানে! নো ক্লাস?”
“বাঙ্ক মেরে দিয়েছি ম্যা’ম।”
“আই লাইক ইওর অনেস্টি, বাট হোয়াই?”
“অনেস্টলি ম্যা’ম, পড়াশোনা পৃথিবীর সবচেয়ে বোরিং কাজ। এতে আমি কোনো ইন্টারেস্ট পাই না। এক একটা লেকচার যেন এক একবছরের জেলের সাজা বলে মনে হয়, শেষ হতেই চায় না। কিন্তু আপনার ক্লাস আমার ভালো লেগেছে, আই রিয়েলি এনজয়েড ম্যা’ম, ভেরি নাইস। বেসিক্যালি আমি কলেজে অ্যাডমিশন এজন্যই পেয়েছি কারণ বেশ কিছু সীট খালি ছিল প্লাস মামার ইন্ফ্লুয়েন্স, এই জন্য নয় যে আমার এই মোটা মোটা বইগুলোর প্রতি খুব বেশি ইন্টারেস্ট আছে। সত্যি বলতে কি পড়াশোনায় আমার তেমন আগ্রহ নেই। আমি ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্র হলেও কলেজে আমার অলরেডি পাঁচবছর হয়ে গেছে।”
“এনিওয়ে, কোন ক্লাস বাঙ্ক করলে?”
“ফিজিক্স ম্যা’ম, এই বইটা দেখলেই আমার মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। আই মীন লুক অ্যাট দ্য সাইজ! এটা দিয়ে এক্সারসাইজ করে মাসল্ বানানো যেতে পারে। আর ভেতরের যত বিদঘুটে ল, থিওরী, ফরমূলা আর কম্পোজিশন? মাঝে মাঝে ভাবি বিজ্ঞানীগুলোর আর কোনো কাজ ছিল না বলে নিজেদের সারাজীবন নষ্ট করেও ক্ষান্ত হয়নি, এখন সিলেবাসে ঢুকে আমাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। আই ডোন্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড হোয়াই!”
“তো? তোমার কি পছন্দ?”
“আমার কোনো পছন্দ নেই ম্যা’ম।”
“হ’তেই পারে না। হয়তো তুমি দেখেও দেখোনি, বা হ’তে পারে তোমার মধ্যে অন্য কোনও গুণ আছে হুইচ ইজ ইয়েট টু বি এক্সপ্লোর্ড।”
“আমি খুবই সাধারণ ম্যা’ম, আমার মধ্যে কোনো গুণই নেই।”
“এনিওয়ে, ইউ মে ট্রাই দিস, মনে হয় না তোমার অপছন্দ হবে,” বলে একটা গল্পের বই এগিয়ে দিয়ে আবার বললেন, “পড়ে দেখো, যদি ভালো লাগে তাহলে ঐ মোটা বইটা তারপরে পড়ে দেখো।”
“গ্রেট এক্সপেক্টেশন আই মাস্ট সে ম্যা’ম, বাট আই’ল ট্রাই টু।”
পরেরদিন সকালে সুজয়ের ফোনে একটুও অবাক হল না অঞ্জনা। কল রিসিভ করতে শুনলেন, “বইটা পড়লাম ম্যা’ম কিন্তু বেশ কিছু জায়গা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি।”
“না বোঝার কারণ হচ্ছে অনেককিছুই ঐ গল্পে পরিষ্কার করে বোঝানো হয়নি, যা বোঝার জন্য তোমাকে ফিজিক্স পড়তে হবে। এবার তুমি তোমার মনে আসা প্রশ্নগুলোকে মাথায় রেখে তোমার সেই মোটা বইটা পড়ে দেখো। আই অ্যাম সিওর, তোমার এখন পড়তে আর ততটা বোরিং লাগবে না।”
“ওকে ম্যা’ম, থ্যাঙ্ক ইউ, হ্যাভ আ নাইস ডে। বাই ম্যা’ম।”
(০৬)
এভাবেই সময় বয়ে চলে আপন গতিতে আর একটু একটু করে আপন থেকে আপনতর মনে হতে থাকে প্রিয় অঞ্জনা ম্যা’মকে। সাথে সাথেই এক অদ্ভুত টানাপোড়েন চলতে থাকে সবসময়। সবকিছুই যেন কেমন হেঁয়ালি লাগে। ঠিক-বেঠিক, যদি-কিন্তুর মাঝে পিষতে থাকে, কিভাবে, কেন, কোন মাপকাঠি আর কিসের গণ্ডী – এসবের মাঝে মন আর মাথার দড়ি টানাটানিতে রক্তাক্ত হ’তে থাকে। একসময় হৃদয়ের আবেগ জয়ী হয়, জীবনে চলার পথে কখন কোনদিকে যেতে হবে যে কোনোদিন ভাবেনি, সেই নিজের কাছে অন্তত পরিষ্কার হ’তে পারে। যদিও পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছুই আলোচনা হয়নি কখনো, তবুও জীবনের প্রতি মুহূর্তে ব্যর্থতার কানাগলিতে ঠোক্কর খেতে খেতে, অন্ধকারে একমাত্র আলোর রেখা মনে হয় অঞ্জনার সান্নিধ্য। তিল তিল করে সাহস সঞ্চয় করে ভাবে, ‘হয় এসপার, নয় ওসপার’, কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। কোথায় যেন আটকে গেলেও কলেজে যাওয়া-আসার পথে সঙ্গী হতে ভুল হয় না কখনও।
পুজোর ছুটি পড়ার দিন কলেজ শেষে বন্ধু-বান্ধবকে ‘বাই’ বলে গেটের কাছে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিল, ‘অনেক হয়েছে, আর নয়, আজ বলেই ফেলব’, এমন সময় কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল – অঞ্জনা ম্যা’ম। “আরে তুমি এখনও ওয়েট করছো! চলো, চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ পর অঞ্জনার খেয়াল হ’ল সুজয় যেন একটু বেশি চুপচাপ, “কি ব্যাপার? ছুটির সব প্ল্যানিং কি এখনই সেরে ফেলবে নাকি?”
একটু ইতস্ততঃ করে বলতে গিয়ে আটকে যায় সুজয়, “না, মানে… ম্যা’ম…;”
“কি ব্যাপার বলো তো? কি বলতে চাও বলে দাও। ডোন্ট হেজিটেট, টেল মি।”
“ম্যা’ম, আই কান্ট।”
“কান্ট! হোয়াই?”
“আই ডোন্ট নো হোয়াট আই অ্যাম ফীলিং অ্যাণ্ড হাউ টু টেল ইট টু ইউ। বুঝতে পারছি না ঠিক না ভুল, খুব নার্ভাস লাগছে।”
“রিল্যাক্স। ওয়েট আ সেকেণ্ড, টেক আ ডীপ ব্রেথ। তাছাড়া তুমি যখন কোনো কথা আমাকে বলতে চাও, তখন এতো নার্ভাস হওয়ার দরকার নেই। নিশ্চিন্তে বলো। কাম অন, টেল মি।”
“আই লাইক ইউ ম্যা’ম, আই রিয়েলি ডু।”
“দ্যাট’স সো নাইস অফ ইউ।”
“নো, ম্যা’ম, আই মীন টু সে… আই লাভ ইউ। বুঝতে পারছি ইট’স উইয়ার্ড, বাট আজ পর্যন্ত আমি কারোর জন্য এমনটা ফীল করিনি বা কেউ আমাকে এমনটা ফীল করায়নি। আমার বোঝানোর ভাষা নেই ম্যা’ম। অনেস্টলি, আমার চোখে আপনি এক অসাধারণ মানুষ, আ ভেরি ভেরি স্পেশাল পার্সন। আজ আমার মধ্যে যতটুকু সেল্ফ-কনফিডেন্স এসেছে, যা আমি ফীল করতে পারি বা যা আমার কাজে দেখতে পাচ্ছি, সেটা শুধু আপনার কারণে।”
“সুজয়…;”
“ম্যা’ম প্লীজ, আজ বলতে দিন। আজকাল আমি শুধু আপনার কথাই ভাবি, ভাবি কি করলে আপনাকে খুশি দেখতে পাব। সিরিয়াসলি ইওর স্মাইল মীনস্ আ লট টু মি ম্যা’ম। আই অ্যাম ডীপলি ইন লাভ উইথ ইউ…;” বলতে বলতে গলা ধরে আসে সুজয়ের।
“থ্যাঙ্কস্ সুজয়, নিজের ফীলিংস এতো খোলামেলাভাবে এক্সপ্রেস করাটা মুখের কথা নয়, তার জন্য সৎসাহস লাগে। তবে কি জানো, তোমার কথাতে আমি রাগ করিনি বা কষ্ট পাইনি, কারণ তোমার এই ফীলিংসে ভুল কিছু নেই। ভুল হতে পারত যদি তুমি তোমার ফীলিংস নিয়ে অবসেশড হ’তে বা আমি তোমাকে রেসিপ্রোকেট করতাম। এনিওয়ে, এই জন্মে তো হবে না, হয়তো পরের জন্মে, হয়তো… এখানেই বা অন্য কোথাও, হয়তো… আমরা পরস্পরের সঙ্গী হতে পারি।” একটু থেমে হঠাৎ হাসতে হাসতে আবার বলল, “শেষের কথাগুলো জাস্ট মজা করে বললাম। বাট অন আ সিরিয়াস নোট, আমি বিবাহিতা এবং তুমি আমার ছাত্র অর্থাৎ সন্তানতুল্য, কাজেই এই ব্যাপারে কথা বলা বা ভাবনাচিন্তা করাটাও সমাজের চোখে পাপ আর আমার পক্ষেও অনুচিত। কাজেই এইসব চিন্তাগুলোকে মাথা থেকে বের করে দাও। তুমি তোমার ফীলিংস আমার সাথে শেয়ার করলে, দ্যাট’স গুড, কিন্তু এখন সব ভুলে স্টাডিতে কনসেন্ট্রেট করো, পরীক্ষা বেশি দূরে নেই। অ্যাণ্ড আই হোপ তুমি আমাকে অন্তত নিরাশ করবে না। নাও, চোখ মোছো, রাস্তার মাঝে সিনক্রিয়েট হচ্ছে। এবার চলো, পুজোর ছুটির শুরুটা আমরা ফুচকা দিয়ে সেলিব্রেট করি।”
(০৭)
রোজকার মতো ভোর চারটের সময় বেরিয়ে দৌড়াতে গিয়ে সুজয়ের মনে কোথাও যেন একটা আনন্দের সুর বাজছিল। প্রায় একমাসের ছুটি শেষ। আবার কলেজে যাওয়া মানেই অঞ্জনার সান্নিধ্য। লেভেল ক্রসিংটা টপকানোর সময় হঠাৎ ট্রেনের হুইসল্ শুনে সেদিকে তাকাতেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। একটা আবছায়া স্ত্রী-মূর্তি লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে আর সেই লাইনেই এগিয়ে আসছে ট্রেন! হতভম্ব হয়ে পড়লেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করল সে। ছায়ামূর্তিটাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে যখন পাশের পাথরের ওপর গড়িয়ে পড়ল, ঠিক তখনই হুইসল্ বাজিয়ে বিকট শব্দে পাশ দিয়ে চলে গেল এক্সপ্রেস ট্রেনটা। কয়েকটা জায়গায় কেটে-ছড়ে যাওয়া ছাড়া আঘাত গুরুতর না হলেও ধাতস্থ হ’তে একটু সময় লাগল। উঠে বসার সময় একটা কাতর গলার অস্ফুট গোঙানি “আমাকে মরতে দাও, প্লীজ” কানে আসতেই এক বিশাল ধাক্কা লাগল সুজয়ের – অঞ্জনা ম্যা’ম! ঘোরটা কাটিয়ে কোনোমতে ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু সুস্থ করে তুলল। সুজয়কে চিনতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল অঞ্জনা। স্ট্রীটলাইটের আলোতে ভালো করে দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠল সুজয়, এই ক’দিনেই যেন শুকিয়ে দড়ি পাকানো চেহারা হয়ে গেছে! দেখে মনে হচ্ছে যেন মানুষ নয়, একটা পোড়া চ্যালা কাঠ!
একটু শান্ত হওয়ার পর ‘কি হয়েছে’ জানতে চাইতেই বিশ্রীভাবে উন্মোচিত হ’ল এক অজানা কদর্য দিক। বিয়ের তিনবছরেও বাচ্চা না হওয়ার কারণে আঙুল উঠেছে অঞ্জনার দিকে। ডাক্তারী পরীক্ষায় কোনো ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও সেই সবার কাছে দোষী। ঘরে বাইরে মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হতে জীবনের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। পরিচিত গণ্ডীতে আকারে ইঙ্গিতে নোংরা প্রস্তাব দেওয়া তো আছেই। পুজোর সময় মা-ছেলে মিলে মারধর করে জোর করে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। দাদার বিয়ের জন্য দেখাশোনা চলছে। যতই নিজের মেয়ে হ’ক, একে ডিভোর্সী তায় বাঁজা, তার দায়ভার কে নেবে? মেয়েকে সাপোর্ট করতে গেলে যদি ছেলের অমঙ্গল হয়, তখন? তাই বাপের বাড়ির দরজাও বন্ধ।
সব শোনার পর কিছুক্ষণ ভেবে সুজয় বলল, “ম্যা’ম, কাছাকাছি একটা পিজি ফর ওয়ার্কিং উইমেন আছে, আপাততঃ ওখানেই চেষ্টা করে দেখা যাক। যদি খালি রুম পাওয়া না যায় তাহলে শেয়ারে থাকতে হবে। পরে অন্য কোথাও দেখা যাবে। ট্রাস্ট মি ম্যা’ম, দু’জনে মিলে কিছু না কিছু একটা জোগাড় ঠিক করে ফেলতে পারব। আর সুইসাইডের চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিন।”
ভাগ্যক্রমে একটা খালি ঘর পাওয়া গেল। মোটামুটি থাকার মতো গোছগাছ করে যখন বাড়ির দিকে পা বাড়াল, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। বুঝতে পারল আজ দারুণ অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে।
(০৮)
টাকার জোরে কি না হয়! কিছুদিন যেতে না যেতেই ডিভোর্সের মামলায় সরকারী সীলমোহর পড়ে গেল। কিন্তু পেছনে রসালো মন্তব্য বন্ধ হ’ল না। দেওয়ালে কান পাতলেই ফিসফাস শোনা যেতে লাগল। সুজয়ের সঙ্গটুকু ছাড়া সব দিক থেকেই ক্রমশঃ একা হয়ে যেতে লাগল অঞ্জনা। সরস্বতী পুজোর কারণে ক্লাসও তেমন নেই, কলেজও ফাঁকা ফাঁকা। লাইব্রেরিতে বসে সব দিক নিজের মতো করে ভেবে নিয়ে মনস্থির করে একটা চিঠি লিখতে শুরু করল।
‘সু,
আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর দামী মুহূর্তগুলো উপলব্ধি করানোর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ। গত কয়েকটা দিনে জীবনের অনেক অদেখা, অচেনা দিকের সাথে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমার কষ্টের সময় তুমি পাশে ছিলে সবসময়। কোনোদিন ভুলব না তোমায়। তোমার উপস্থিতি যেভাবে আমাকে পূর্ণতা দিয়েছে তাতে আগামীকাল আমি যদি না থাকি, তাহলেও জীবনের কাছে অন্তত আমার কোনও আক্ষেপ থাকবে না। মনে আছে তোমার, একবার মজা করে বলেছিলাম, হয়তো পরের জন্মে, হয়তো অন্য কোথাও আমরা একে অন্যের হব – আই মীন ইট টুডে। হ’তে পারি আমি তোমার টীচার, কিন্তু তুমি আমাকে শিখিয়েছো ভালোবাসার প্রকৃত মানে। কাউকে ভালোবাসি বলাটা যত সহজ, তার গভীরে গিয়ে তাকে অনুভব করা আর জীবনভর সেই দায়িত্ব নিষ্ঠাভরে পালন করা রীতিমতো কষ্টসাধ্য, যা তুমি অনায়াসে করে দেখিয়েছো। ভালোবাসার সার্থকতা প্রাপ্তিতে নয়, ত্যাগে। তোমার সঙ্গলাভে আমি ধন্য।
এখন আমি রিজাইন করে চলে যাচ্ছি, এই যাওয়া সত্যিই খুব জরুরী তোমার জীবনের জন্য। কারণ থেকে গেলে তোমার জীবনটা আমার চারপাশেই শেষ হয়ে যাবে, যা কখনোই কাম্য নয়। জানি আমাকে ভুলতে তোমার কষ্ট হবে, কিন্তু সময় সব ঠিক করে দেবে। অলওয়েজ বি হ্যাপী অ্যাণ্ড কীপ স্মাইলিং, যদিও মন চাইছে এক ছুটে গিয়ে তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তোমার বুকে খুঁজে নিই নিজের ঠিকানা, চোখে চোখ রেখে বলি আই লাভ ইউ, বাট হয়তো পরের জন্মে… দেখে নিও তখন আর আমার নামের পাশে বাঁজা বা ডিভোর্সীর অপবাদ থাকবে না।
ভালো থেকো সবসময়,
অঞ্জনা।’
চিঠিটা লেখা শেষ করেই বুঝতে পারল গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে উঠেছে। উঠে আসা কান্নাটাই তাকে বুঝিয়ে দিল ‘এর শিকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত হয়ে গেছে তার অজান্তেই।’
(০৯)
স্থানুর মতো বসেছিল, হঠাৎ কাঁধে এক ফোঁটা ঈষদুষ্ণ জল পড়তেই চমকে উঠে ফিরে দেখল কখন সুজয় এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। তার চোখের জল বুঝিয়ে দিচ্ছে চিঠিটা সে পড়ে ফেলেছে। তাকে কিছু বলার চেষ্টা করতেই হাত তুলে থামিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় “হাউ ক্যান ইউ বি সো সেলফিশ টু মি ম্যা’ম?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই বেরিয়ে গেল।
তার পেছনে অঞ্জনাও বেরিয়ে এসে ফাঁকা করিডোরের এক কোণে গিয়ে তাকে ধরল, “তুমি কেন বুঝতে চাইছো না? এই সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না। তাছাড়া আমি বয়সেও তোমার চেয়ে বড়। একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লীজ;”
“বয়স? ডাজ ইট ম্যাটারস্? আমার আর কে আছে যে মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন আসছে? মামার বাড়িতে নাকি টাকাপয়সার হিসেব মিলছে না। আমাকে একরকম ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিল! এক বন্ধুর মেসে নিজের সামান্য জিনিসপত্র রেখে আপনার কাছে এসেছি, আপনি যে আমার শেষ আশ্রয়, ইউ কান্ট লীভ মি লাইক দিস ম্যা’ম।”
কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল অঞ্জনা। ঠিক তখনই গলা খাঁকরানির শব্দে পেছন ফিরে দেখল প্রফেসর জে.বি. তাদের দিকেই আসছেন! কাছে এসে বললেন, “ডোন্ট ওয়্যারী, তোমাদের কথাবার্তা সবই জানি।” এই গলা যে এতো অমায়িক হ’তে পারে, তা ধারণার বাইরে ছিল সুজয়ের, বিস্ময়ে চুপ করে গেল। জে.বি. বলে চললেন, “আজকাল কানাঘুষোয় অনেক কথাই শুনি। আই ডোন্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড, হাউ ক্যান পিপল্ বি সো ইনহিউম্যান! বাট ফর ওয়ান থিঙ আই মাস্ট থ্যাঙ্ক ইউ ম্যা’ম। আজ একটা বখাটে ছেলেকে রেসপন্সিবল্ জেন্টলম্যান হতে দেখছি, অল ক্রেডিট গোজ টু ইউ। তবে… বলি কি, তোমরা বিয়ে করে নাও, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তোমরা পরস্পরের পরিপূরক হ’তে পারবে।” হতবাক দু’জনের কারোরই মুখে কোনো কথা যোগালো না। জে.বি. আবার বললেন, “সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, চিন্তার কিছু নেই।”
অঞ্জনা ইতস্ততঃ করে বলল, “কিন্তু স্যার…;”
চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে জেবি বললেন, “প্রিয়জনের সঙ্গলাভের সৌভাগ্য সবার হয় না। আর যারা পেয়ে হারায়, তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নয়। তোমরা হারিয়ে যেও না। ইউ টু লুক ‘মেড ফর ইচ আদার’ টু মি।” তারপর সুজয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বেশ কিছুদিন ধরে যেভাবে ম্যা’ম মিসবিহেবের শিকার হচ্ছিলেন, সেটা দেখে তোমাকেও ঐ ক্যাটেগরির বলে ভেবেছিলাম। যদিও তোমার কথা জানতাম, তবুও পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি, আজ যদি কিছু কড়া কথা শোনানোর ইচ্ছে নিয়ে এখানে না আসতাম, তাহলে হয়তো কখনো বিশ্বাস করতাম না। স্যরি ইয়ংম্যান। ডোন্ট লীভ ইচ আদার, লেটস্ কাম হোয়াট মে।”
জেবি চোখের আড়াল হতেই অঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁকে এঁকে দিল এক প্রগাঢ় চুম্বন, তারপর মাথা চুলকে বলল, “স্যরি, কন্ট্রোল করতে পারলাম না।” প্রথমবার সুজয় দেখল অঞ্জনাকে ব্লাশ্ করতে।
(১০)
এর পরের কয়েকটা দিন ঝড়ের মতো কেটে গেল। সাধ্যের মধ্যে পছন্দের বাড়ি পেয়ে সব গুছিয়ে উঠতেই কোথা দিয়ে সময় কেটে গেল বোঝাই গেল না। তারপর জে.বি. স্যারের সৌজন্যে আর কলেজের বন্ধুদের সহযোগিতায় রেজিস্ট্রি করে বিয়েটাও সুষ্ঠুভাবে হয়ে গেল। বিয়ের পর প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই জেবি বললেন, “এতোদিন যেভাবে ম্যা’মের গাইডেন্স ফলো করেছো সেইভাবে এবার থেকে বউয়ের গাইডেন্স মেনে চলবে। বুঝলে?” হকচকিয়ে সুজয় “ইয়েস স্যার” বলতেই সবাই হেসে উঠে তার অপ্রস্তুত ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিল।
সব কাজ সেরে যখন বাসাতে ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যা। নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় গিয়ে বসতে অঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, “টায়ার্ড?”
উত্তরে “ইয়েস ম্যা’ম, আ বিট” বলেই বড় করে জিভ বের করে বলল, “স্যরি।”
তার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে অঞ্জনা বলল,“আর যদি ‘ম্যা’ম’ বলেছো তো নো মোর ফুলশয্যা মনে রেখো।”
সুজয়ও এবার হাসতে হাসতে বলল, “ইয়েস ম্যাডাম।” তারপর সব ক্লান্তি উপেক্ষা করে পরস্পরের সান্নিধ্যে সুখের সাগরে তৃপ্ত উত্তাপে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল দুজনে।
(১১)
দেখতে দেখতে ফাইন্যাল পরীক্ষাও হয়ে গেল। অঞ্জনার কথামতো সুজয় যেমন হ’ক একটা চাকরীর খোঁজের সাথে সাথে ইউ.পি.এস.সি. পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিতে থাকল। এভাবেই কাটছিল দাম্পত্যের দিনগুলো। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পর অঞ্জনার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা দেখে সুজয় জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?”
“হুমম, শরীর ঠিকই আছে তবে একটা খবর আছে।”
“তাই? ভালোই হয়েছে, তবে আমার কাছেও একটা খবর আছে তোমার জন্য।”
“কি খবর? তাড়াতাড়ি বলো;”
“না, আগে তুমি বলো, লেডি’স ফার্স্ট।”
“হুমম, লেডি’স ফার্স্ট মানে আমি আগে শুনব, প্লীজ বলো…;”
“ওকে, আপাততঃ একটা চাকরী পেয়েছি, বিশেষ কিছুই নয়, তবুও…;”
“মেনি মেনি কনগ্রাচুলেশনস্” বলেই তাকে জড়িয়ে ধরল।
“এবার তুমি বলো।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে খুব আদুরে গলায় বলল, “আমি প্রেগন্যান্ট।”
“সত্যি???” সুজয় যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
নতমুখে মাথা নেড়ে অঞ্জনা বলল, “এ মাসের পিরিয়ডটা মিস্ হ’তেই মনে হয়েছিল। কিট্ নিয়ে টেস্ট করে পজিটিভ দেখার পরেও সন্দেহ পুরোপুরি কাটেনি। আজ ফেরার পথে ডাক্তারের সাথে কথা বলে কনফার্ম হলাম।” আর কিছু বলার আগেই খেয়াল করল সুজয় তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে এঁকে দিচ্ছে ভালোবাসার স্পর্শ। বুকের ওমটুকু নিতে নিতে অঞ্জনা উপলব্ধি করল লোকে যে যতই মন্দ বলুক, সুজয়ের ছোঁয়ায় সে পেয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসার সুলুকসন্ধান। তখন বাইরের আকাশে গোধূলির রক্তিম আভায় অপরূপে রাঙিয়ে দিয়েছে চরাচর।
সমাপ্ত