ভুলে যাই…
-জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী
বড়ো ভুলে যাই আজকাল—-
সব ভুল হয়ে যায়,
সকাল সন্ধ্যায় তুলসি তলায় প্রণাম, পিদিম, ভুলে যাই…
ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যা বাতি দেখাতে ভুল হয়ে যায়—
ভুল হয় পরিপাটি সাজিয়ে ভাতের থালাটি ধরতে–
ভুল হয়ে যায় প্রতিদিন সন্ধ্যায়
দেখা প্রিয় সিরিয়াল….
ভুলে যাই — আগে আমি শাক, ডাল,, এগুলো খেতামই না..
ভালোবাসতাম যা যা, এখন সবই প্রায় ভুলে গেছি—
ভুলে গেছি পাখীর মতো মিষ্টি সুরে গাইতে….
কবিতা, গল্প, গান.. সব কিছু লিখতেই, বড়ো ভুল হয় আমার আজকাল…
‘বাংলা’ লিখতে গিয়ে, ভুলে ‘হিন্দি’ লিখে বসি।
ভুলে গেছি কতো কিছুই, কতো কিছুই ভুলে যাচ্ছি অহরহ…
আশ্বিনের সেই শিউলি ছড়ানো পথে চলা…
কার্তিকের বিন্দু বিন্দু শিশিরে ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে হাল্কা শীতের আমেজ নেওয়া…
ভুলেই গেছি শীতের ছুটিতে মামাবাড়ী যাবার কথা —
ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় যাবার পথে, নতুন গুড় জ্বাল দেবার অতূলনীয় মিষ্টি গন্ধ।
প্রতি সন্ধ্যায় দাদু র সাথে বাজার ফিরতি পথে দুটি মিষ্টি বরাদ্ধ….
” একটা বাড়ী গিয়ে খাবে, আর একটি কাল সকালে” … দাদুর বলা…
ভুলে যাই আরো কতোকিছু..
দিদার হাতের সেই অপূর্ব ছোটো মাছের ঝোল…
অথবা, কলসি থেকে নতুন গুড় ইচ্ছে মতো ঢেলে নিয়ে চুমুক দিয়ে অথবা চেটে চেটে.. আহা :
সব — সব ভুলে গেছি —
সমস্ত ভালো লাগার স্মৃতি আজ বিস্মরণ…..
শুধু ভুলিনা আজ ও তোমার না রাখা কথাগুলো…
ভুলিনি ধীরে ধীরে আমার ‘মেয়ে’ থেকে ‘বৌ’ হয়ে ওঠার অসম্ভব কষ্টদায়ক দিনগুলো।
ভুলিনা আজ ও সেই রাতগুলো, যেগুলো ভরে উঠতো— কেটে যেতো চাপা গুমরে ওঠা কান্নায়,
নিজেকে নির্ভুল, পটু, সফল গৃহবধূ প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় নিজের সমস্ত সত্ত্বা,
সবটুকু আমিত্বকে বিসর্জন দেওয়ার, অস্বীকার করার সফল প্রকাশের কান্নায়।
না না, কেউ দেখেনি, কেউ কোনোদিন ও জানেনি, সে কান্না, সে অসহায় আক্ষেপ।
একটি বারের জন্য ও ভুলিনি তা গোপন করতে—
ওই একটি ব্যাপারে সম্পূর্ন সফল আমি, নিজেকে ‘সুখী’ প্রতিপন্ন করতে।
তাই ভাবি, ভুলে যাই কতোকিছুই —
যা মনে করতে চাই, রাখতে চাই মনে আপ্রাণ —
ভুলে যাই — অথচ যা আমার দুঃস্বপ্নের স্মৃতি, ভুলতেই চাই একেবারে — সব কিছু জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে।।
এমনি ভাবেই ভুলতে ভুলতে হয়তো একদিন ভুলে যাবো সবই…
ভুলে যাবো তোমাকেও…
কোনো একদিন, হয়তো বা আমাকেও…
হ্যাঁ, নিজেকেও ভুলে যাবো আমি, ঠিক, কোনো একদিন..
আর সেদিন ই মুক্তি… সেদিন ই আমার মুক্তি….
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আঁধারে…”