“রায় দান ও আমরা”
-রাণা চ্যাটার্জী
মাঝে মাঝেই খুব রাগ হতো, যখন পেপারে দেখতাম কোনো বোম্ব ব্লাস্ট ,অপরাধ হবার পর দোষীকে ধরে ,তাকে দোষী জেনেও বাঁচিয়ে রাখা দেখে। তখন অবশ্য ছোট ছিলাম, আইনের ,বিচারব্যবস্থার এত কিছু নিয়ম জানতাম না। শুধু ভাবতাম বুদ্ধিদৃপ্ত পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী যখন তাদের তৎপরতায় ধরে ফেলেছেন, তারপরও বিচার ব্যবস্থায় বছরের পর তাদের বহাল তবিয়তে ঘেরা টোপে রেখে দেওয়া কেন! এক বহুল চর্চিত হিন্দি সিনেমায় নায়ক সানি দেওলের সেই বিখ্যাত ডায়লগ, সময়ের পর সময় নষ্ট করার কথা আম আদমির পুঞ্জীভূত ক্ষোভের নমুনা হওয়ায় বেশ হাততালি কুড়িয়েছিল সেই সিনেমার সিন।
প্রতিনিয়ত দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ইভটিজিং, না পেয়ে এসিড ছুঁড়ে মনোবল ভেঙে দেওয়া, ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, সর্বোপরি মিথ্যা কেচ্ছা রটিয়ে দেওয়া, ডাইনি সন্দেহ আরো কত কি ঘটনা রটনার ঘনঘটা। সব ঘটনা সুচারু ভাবে ঘটিয়ে ভালো মানুষ সেজে, বুক দর্পে ঘুরে বেড়ানোরও ঝুড়ি ঝুড়ি উদাহরণ প্রতিনিয়ত চোখের সামনে। অবশ্য এ আর নতুন কি, এই সব নিয়েই তো আমাদের অভ্যস্ত চেনা সমাজের দিন যাপনের এক্কা দোক্কা।
এই কয়েক মাসে বিচার ব্যবস্থা বেশ শচীনের স্টাইলে ঝড়ো ব্যাট করে স্কোর বোর্ডে আম আদমিকে আলোচনার টেবিলে, যুক্তি তর্কে বিভোর করে তুলেছে। এমনিতে চপ মুড়ি, কুচি কুচি আদা, লঙ্কা, পেঁয়াজ, চানাচুর মেখে বাঙালিকে যুক্তি তক্কে বসিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। এদিকে ২২দিনের মাথায় গ্যাস শেষ হবার খবর, শূলে র মতো বুকে বিঁধলো। সিলিন্ডার দিতে এসে ডেলিভারির ছেলেটি দেখি গত মাসের তুলনায় প্রায় ৫০ টাকা বেশি বিল করলো ।
আমার পরিচিত এক ভাই, কর্মঠ ছেলেটি পুঁজির অভাবে কিছু একটা করবে করবে করেও করতে পারছে না দেখে ওকে একটা সরকারি স্কিমের কথা বলে লোনের জন্য ব্যাঙ্ক পাঠালাম। কদিন চক্কর কেটে এসে দগ্ধ অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিল। ম্যানেজারের একটু সাক্ষাৎ পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে করে বিরক্ত সে দরজার ফাঁকের কাছে এসে দাঁড়াতেই কানে এলো ভেতরে প্রবেশকারী ক্ষমতাবান ভদ্রলোকটিকে ম্যানেজার উৎসাহ দিচ্ছেন রাইস মিল বসানোর জন্য। আর উনি এটা শুনে যতবার না করছেন,ম্যানেজার আশ্বস্ত করছেন এটা বলে যে, “চিন্তা কি, ব্যাঙ্কই ফান্ডের ব্যস্ততা করে দেবে।” কি আশ্চর্য্য তাই না, একটা বেকার ছেলে তাকে, সরকারি স্কিমে সামান্য লোন দিতে কত অনীহা রক্ত মাংসের ম্যানেজারের আর তিনিই তেলা মাথায় তেল দিতে সিদ্ধহস্ত।
এই কিছুদিন আগে পেলাম সমকামিতা নিয়ে কিছু আলোচনা। ভীষণই প্রয়োজনীয় স্মার্ট বিষয় এটা।অবশ্যই তাদের সরিয়ে রেখে এই বিভাজন আধুনিক সমাজের পক্ষে ঠিক নয়। সমাজ ই তাদের ঘৃণা, তাচ্ছিল্য করে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এই সমকামীদের মুক্ত বাতাসে স্বাধীন ভাবে শ্বাস নেবার অধিকার আছে এটা মানতে হবে। ছোট থেকে সন্তানের মধ্যে আমরাই আদতে, অনেক সময় এটা নয়, সেটা করো, হাত দিয়ো না, বাইরে বেড়িয়ো না, ছেলে না হওয়ার আক্ষেপে মেয়েকে ছেলের পোশাক পরিয়ে রাখার ইত্যাদি নানা রকম কান্ড করে রাখি। শিশু মনে এগুলোর গভীর ইম্প্যাক্ট যা ভবিষ্যতে তাকে সঠিক নিয়ম নীতির বিপরীতে পথ হাঁটতে শেখায় কখনো ।
গতকাল পরকীয়া নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় বয়ে গেল, আজও সমান তালে চলছে সে চর্চা। আচ্ছা রায় তো সুপ্রিম কোর্ট দিলেন ,দিতে পারার অধিকার আছে। কিন্তু এই রায় সঠিক ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা দেখাও কোর্টের দরকার। আজও যেখানে ভাই বোনে একসাথে পথ হাঁটলে ফিস ফাস গুঞ্জন, প্রাপ্তবয়স্ক দুই ছেলে মেয়ে লুকিয়ে দেখা করলে মাতব্বররা, নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়। ভালোবাসার পবিত্রতা নয়, জাতপাত নিয়ম, শেকল আরো বেশি করে করে চেপে বসছে আমাদের ওপর।
প্রচুর উদাহরণ আমাদের দেশে, আইনকে নিজেরা হাতে তুলে নিয়ে অদ্ভুত শাস্তি ঘোষণার।
বীরভূমের লাভপুরের প্রেমিকা ও বিবাহিত প্রেমিককে জনসমক্ষে গাছে বেঁধে ১০হাজার করে টাকা চাওয়া হয়। ছেলেটির পরিবার কোনো রকমে দিতে পারলেও অভাবে মেয়েটির পরিবার না দিতে পারলে, তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ১৩ জন বলাৎকার করে জরিমানার টাকা উসুল করে। এমন বিধান আমরা কি পেলাম পরকীয়ার দায়ে মেয়েটির ওপর এমন নিষ্ঠুর অত্যাচারে! আজও মেয়েটি লজ্জায় বাড়ির বাইরে বেরুতে পারে না, কোনো কাজ পেতে কুন্ঠিত বোধ, বুকের মাঝে কাটার মতো খোঁচা খচ খচ করে বেঁধে বোবা কান্না।এমন লাখো উদাহরণ দগদগে ঘায়ের মতো মায়া, লক্ষী, রেহানাদের জীবন শেষ করে দিয়েছে, দিচ্ছে দেশের আনাচে কানাচে।
আর এক নজরকাড়া রায় দেখলাম। দক্ষিনের রাজ্য কেরলে শবরিমালা মন্দিরে ১০ থেকে ৫০বছর বয়সী মহিলাদের নাকি প্রবেশ নিষেধ ছিল যা সুপ্রিম কোর্ট খণ্ডন করেছে। কি আশ্চর্য্য পুরুষের তৈরি নিয়ম কানুন না? ঋতুময়ী মহিলারা মন্দিরে প্রবেশ করলে নাকি বিগ্রহের কৌমার্য ব্রত ভেঙে যাবে এই কারণের ওপর ভিত্তি করে এত বড় নির্মমতা। শারীরিক ঋতু চক্রের ওই নির্দিষ্ট দিনগুলোতে মেয়ে, মহিলারা নাকি অপবিত্র এই ধারণার বেড়ি এমন ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কৌশলে, যে মহিলারাও নিজেদের ওই সময়ে অপবিত্র তকমায় শুভ কাজ থেকে সরিয়ে নেন। আদতে কি তাই? আমাদের জটিল মনের মধ্যে সামান্য যদি পবিত্র অংশ থেকে থাকে কি বলে শুনি। মহিলাদের ওই ক’টা দিন নতুন কিছু সৃষ্টির বার্তা দেয়, প্রজন্ম গঠনের সূচক যেন, তাকে অপবিত্র বলি কি করে। এইভাবে মহিলাদের হেয় প্রতিপন্ন করার নানান পন্থা আমাদের সমাজে মজুত আছে।
সমাজে, দেশে নানান সমস্যা আছে, থাকবে। আজও দু’ মুঠো ভাত প্রতিটা দেশবাসীর কাছে সুরক্ষিত নয়।এর বিনিময়ে কেবল আঙুল ছাপ, মনির ছাপ কেন সব কিছু দিয়ে দিতেও দরিদ্র পরিবারগুলি রাজি যদি নূন্যতম বাঁচার, খাবারের ছাড়পত্র সুপ্রিম কোর্ট সুনিশ্চিত করে। তা সত্ত্বেও এই যে প্রগতির দেশে সুপ্রিম কোর্টের স্মার্ট রায় তা স্বাগত।