“হতভাগিনী মা”
-তন্ময় সিংহ রায়
আমার দশ বছরের জন্মদিনে তুমি বাবাকে বলেছিলে…’কি গো শুনছো? এবারে পূজোয় আমি তোমার কাছে কিছুই চাইবো না, তুমি আমার সোনাকে একটা সাইকেল কিনে দাও।’ আমার স্বাধীনচেতা বাবার কাছে চাকরীটা ছিলো হুকুমের গোলাম-এর মতন। স্বভাবতই বাবার ইচ্ছেটা চাকরীর বিপক্ষে বলাটাই এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আদর্শবান নিম্ন মধ্যবিত্তের যে কত জ্বালা বাবা সেটা বুঝতেই চাইতেন না বলতেন, ‘তোমরা কি না খেয়ে-পরে আছো? প্রয়োজনগুলো কি খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছে তোমাদের?’ মনে হতো পরোক্ষভাবে বাবা বোঝাতে চাইতেন, গ্রামের রবীন খুড়ো, দিপু’র মা, শুক্লাদি, ঝুনু মাসি ওদের ছায়ায় বসে অনুপ্রেরণা কুড়াও গভীর মনযোগে। বিশেষত অর্ধাহারে, অনাহারে থাকা পাড়ার যত পড়াশুনা করা ছেলে-মেয়ে, প্রায় বেশিরভাগের-ই উপকরণসহ যথাসম্ভব শিক্ষা সরবরাহের একমাত্র অফিস ছিলো যেন বাবার ওই প্রাচীন আধখাওয়া ফ্যাকাসে লাল উন্মুক্ত ইঁটগুলোর ঘরটা। কেউ সারামাস পড়ে একটা লাউ, কেউ দু-কৌটো চাল আবার কেউবা তার পুকুরের মাঝারি সাইজের দু’টো পোনা মাছ নিয়ে হাজির হতো। এক্ষেত্রে বাবার অপছন্দটা বিশেষ গুরুত্ব পেতো যে না, তা আমি আর মা বেশ ভালোই বুঝতাম। একনিষ্ঠভাবে সারাটা জীবন পাড়ার ছেলেমেয়ে মানুষের দায়িত্বেই বাবা হয়ে গেলেন বার্ধক্যের বাহাত্তর। আমার তখন সাতাশ বছর তিন মাস দু-তিনদিন বোধ হয় হবে, হঠাৎ-ই একদিন গভীর রাতে অসম্ভব বুকের যন্ত্রণা, মুহুর্তেই সব শেষ! একটা জমকালো নিস্তব্ধ রাত হিংস্রভাবে যেন কেড়ে নিলো বাবার জীবনটা। যে মানুষটা আমাদের জন্যে, গ্রামের ছেলে-মেয়েদের জন্যে প্রায় সারাটা জীবন এতো কিছু করলেন, সুযোগ-ই দিলেন না তিনি তাঁর জন্যে শেষ সময়-ও কিছু করার। চোখের সামনে জীবন্ত দেখলাম ওই কালো রঙা প্যাঁচাটা’র সাথে আমার ‘বাবা’ শব্দটা উড়ে বেরিয়ে চলে গেলো বহু দূরে। সারাজীবনের মতন জীবন থেকে হারিয়ে গেলো আমার ‘বাবা’ ডাক-টা। অসম্ভব বুকের যন্ত্রণাসহ জল ভরা দু-চোখ নিয়ে একজন আদর্শবান নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবার চিতার হলুদ-লালচে আগুনকে আমি পাথর দৃষ্টিতে দেখেছিলাম। সেই থেকে ভগ্নহৃদয়ের অসহায়া মা-এর একমাত্র দুশ্চিন্তার কারণ হলাম আমি। আর্থিক সামর্থ্য ছিলো না আমার বাবার, একটা মধ্যবিত্ত/উচ্চমধ্যবিত্ত স্বামী কেনার, তায় দেখতে আমি মন্দ। বেশ ভালোই বুঝতে পারতাম আমার মায়ের ঢাকা যন্ত্রণা-টা। সেই প্রবাদ বাক্যটার স্মৃতিচারণে (একে রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর) কাটতে লাগলো আমার অতি সাধারণ পিতৃহারা জীবন অর্থাৎ বাবার মৃত্যু শোকে মা ছিলেন মর্মাহত তার ওপরে আবার আমার দুশ্চিন্তা! শুরু হয়ে গেলো গ্রামের কানাঘুষো….’বুড়ি মেয়েটা ঘরে বসে আছে, আর কতদিন এভাবে চলবে কে জানে! বিয়ে হবেনা ওর… কে নেবে ওকে!’ মনে হতে লাগলো বাবার আদর্শের প্রতিফলন বুঝি এমন-ই হয়! পাড়ায় বেরোলেই নানা লোকের নানা নেতিবাচক মন্তব্যে বৃদ্ধা অসহায়া মা-টা আমার বাড়িতে ফিরতো যন্ত্রণাকে দ্বিগুণ করে। বেশ কয়েকবার-ই অনুভব করেছি, রাতে না ঘুমিয়ে মায়ের ডুকরে কান্নার শব্দ! সহ্য একদিন লঙ্ঘন করলো তার সীমা, আর দেখতে পারলাম না আমার মায়ের এ কষ্ট! বারে বারেই আমায় রেটিনায় গঠন হতে থাকলো শুধু আমার বৃদ্ধা মায়ের কষ্টের প্রতিবিম্বটা। একদিন গভীর রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম সোজা চলে পাশের গ্রামের প্রধানে’র একমাত্র চরিত্রহীন, মোদো-মাতাল, বখাটে ছেলেটার দামি নরম গদি’র বিছানায়….,ক্ষুধার্ত নেকড়ের সহজপাচ্য খাদ্য হয়ে বললাম,’ সিঁথিতে আমায় সিঁদুরটা অন্তত টেনে দিস, একটা স্থায়ী ভোগ্য বস্তু পাবি আর পাবি সেবা দাসী।’ সেদিন ভোরে সিঁথি রাঙিয়ে আমি হলাম একজন চরিত্রহীনা কলঙ্কিতা ও চুড়ান্ত অবহেলিত স্ত্রী। বহুদিন আর ফিরিনি গ্রামে। দিন গেছে, রাতের পর রাত পেরিয়ে আবার নতুন ভোরের আলোয় আলোকিত হয়েছে প্রকৃতি। বারে বারে মনে পড়েছে আমার বৃদ্ধা মা-টাকে। কেমন আছে আমার মা-টা? কি খাচ্ছে? কে করে দিচ্ছে ঘরের কাজগুলো, নিশ্চয়ই বুড়ি হয়ে গেছে অনেক? প্রশ্নগুলো অসহায়ভাবে কেবলি ছটফট করেছে সারা মন জুড়ে। যন্ত্রণার তিক্ষ্ণ ফলায় রক্তাক্ত হয়েছি বারে বারে, তবুও যেতে পারিনি আমার গ্রামটায়, আমার মায়ের কাছে।….. কখনও চিৎকার করে হাউ হাউ করে কেঁদে জানতে ইচ্ছে করতো ‘মা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না? আমি তোমার যোগ্য সন্তান হয়ে তোমার কোলে ফিরতে পারিনি মা’… কেন?… তার উত্তর খোঁজেনি কেউ! হঠাৎ-ই আগুনের একটা হলকা’র ছেঁকা গায়ে লাগতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলাম আমি। চারিদিকে লোকজন, কারো হাতে বাঁশ…কারো হাতে মাটির কলসী আর মাঝে মধ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে ধ্বনি…. ‘বল হরি, হরি বল!’ দেখলাম দাউ দাউ করে জ্বলছে আমার হতভাগিনী মা-টা।….. আজ অনেকদিন পরে সেই কলঙ্কিতা আমি আমার মায়ের ঝলসে যাওয়া দেহের সামনে বসে।।