অভিমান
-পারমিতা চ্যাটার্জী
ছোটবেলা থেকেই তুমি আমার হিরো ছিল রঙ্গনদা।দু’টো পাশাপাশি বাড়িতে অনেকটা এক পরিবারের মধ্যে আমাদের বড়ো হয়ে ওঠা। তুমি ছিলে অনেক মেধাবী এক ছাত্র, তুলনায় আমি ছিলাম নিতান্তই সাধারণ মানের ছাত্রী। তুমি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তে, আমি তখন সিক্সের ছাত্রী। অঙ্ক ছাড়া আর সব সাবজেক্টই আমি ভালো ছিলাম। ছোট থেকেই ছিলাম সাহিত্য অনুরাগী, পড়ার বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে পাকা পাকা উপন্যাস পড়তাম। তখন থেকেই একজন উপন্যাসের নায়কের জায়গায় তোমাকে বসিয়ে আর নায়িকার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মনে মনে কল্পনার জাল বুনতাম। তুমি কখনও জানতে পারোনি আমার এই ভালোবাসার কথা। আমি তোমাকে বুঝতেও দিইনি। মনের কথা লুকিয়ে রাখার সংযম তখন থেকেই ছিল, খুব প্রবলভাবে। একদিন অঙ্কের নাম্বার কম হওয়াতে মা খুব বকছিলেন, তুমি শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে ধরে বললেকি হয়েছে কাকীমা? আমি ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছি অঙ্ক। সেই থেকে তুমি আমায় অঙ্ক দেখাতে আরম্ভ করলে আর আমিও ধীরে ধীরে অঙ্কের ভয়টা কাটিয়ে উঠে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলাম। তারপর উচ্চমাধ্যমিকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে তুমি চলে গেলে খরগপুর আই.আই.টি. তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আমিও এগিয়ে চললাম একধাপ একধাপ করে। মাঝে মাঝে তুমি ছুটিতে আসতে তখন কিরকম যেন এক লজ্জা আর আড়ষ্টতায় তোমার কাছে যেতে পারতামনা- তুমি যখন আসতে বলতে যে কি রে? পরীক্ষা তো এসে যাচ্ছে, অঙ্কটা মন দিয়ে করিস কিন্তু। আমি প্রথমবিভাগে পাশ করা সত্বেও আর্টস নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। তুমি তখন পুরোপুরি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছ। আমার দিকে চেয়ে অবজ্ঞার চোখে বললে- ফাস্ট ডিভিশন পেয়েও আর্টস নিলি কেন?
আমি বললাম- আমি যে সাহিত্য খুব ভালোবাসি। তুমি ঠোঁট উল্টে বললে, দূর তোর দ্বারা কিচ্ছু হবেনা।
আমি নিরুত্তর থাকলাম। শুধু আমার এতোদিনের সাজানো ভালোবাসার রঙটায় যেন বেরঙা তুলির টান পড়তে লাগলো।
আমার সংযম আমার রুচি, আমার সম্মান তোমার কাছে একবারের জন্যেও ছোট করবোনা। এই ছিল আমার প্রতিজ্ঞা। শুধু যেদিন তুমি চলে গেলে আর আমায় একবারের জন্যেও বলে গেলেনা। সেদিন সবার অলক্ষ্যে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
কানাঘুষোয় খবর পেলাম, তোমার কোন এক সহকর্মীকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করতে চাইছো। এ নিয়ে তোমার সাথে কাকু কাকীমার মতান্তর চলছে।
তারপর একদিন আবার শুনলাম তোমার সহকর্মীনির সাথে তোমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তুমি নাকি আমাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি হয়েছো। দুই পরিবার কখন যে নিজেদের মধ্যে এরকম কথাবার্তা স্থির করে রেখেছে তা তুমি জানলেও আমার কাছে পুরোটাই অজানা ছিল।
আমি তখন পি.এইচ.ডি. করছি আর একটা কলেজে পার্টটাইম পড়াচ্ছি।
কাকীমা যখন আমাকে এসে বললেন রঙ্গন তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তখন আমার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। সবকিছু নীরবে মেনে নিতে নিতে আমিও ক্লান্ত।
আমিও আর সংযমের বাঁধকে বেঁধে রাখতে পারলামনা। কাকীমাকে বললাম- তুমি তো আমায় মেয়ের মতো ভালোবাসো? তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো? তোমার মেয়ের সাথে যদি এমনটা হতো তুমি কি করতে? সব মতামত শুধু তোমার ছেলেই দেবে? কখনও প্রত্যাখ্যান, কখনও দয়া করে বিয়ে করতে চাওয়া… আমার কি সম্মান বলে কিছু নেই? আমি কি এতটাই ফেলনা যে কারুর দয়ার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে? আমাকে ক্ষমা কর কাকীমা, এ বিয়ে আমি করতে পারবনা।
তারপর নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, তোমার কোন খবর রাখিনি। নিজে এখন একটা সরকারি কলেজের অধ্যাপক। কিন্তু বিয়েও করিনি, মনে মনে যে সেই ছোট্ট থেকে তোমাকে বরের আসনে বসিয়ে রেখেছিলাম। সে যতই বেরঙা হয়ে যাক, তবু তাকে ফেলে দিতে পারিনি।
হঠাৎ বদলির অর্ডার এলো। মালদায় কলেজে যেতে হবে আমাকে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে বহু পুরাতন মাসী রমলামাসীকে নিয়ে রওনা হয়ে পরলাম মালদার উদ্দেশ্যে।
ওখানে যে আমার জন্য এমন চমক অপেক্ষা করছে তা কি করে জানব?
মালদায় পৌঁছে যখন কাজের ভার বুঝে নেওয়ায় জন্য ডাইরেক্টরের ঘরে ঢুকলাম, দেখি তুমিও একজন ডাইরেক্টর। আমি আমার চমকে যাওয়ায় ভাবটাকে দমন করে কাজ বুঝে নিয়ে সেদিনের মতো সরকারি কোয়ার্টারে ফিরে এলাম।
কোয়ার্টারগুলো ভারী সুন্দর দিয়েছে। সামনে পিছনে সুন্দর বাগান। নানান রঙের ফুল ফুটে আছে, দিনের প্রায় শেষ তখন ক্লান্ত হয়ে বসে এককাপ চা নিয়ে ভাবছিলাম, কি প্রহসন? সেই তোমার আণ্ডারেই আসতে হল।
হঠাৎ গেট খুলবার শব্দে চমকে তাকালাম, দেখলাম গেট খুলে তুমি ঢুকছো। আমায় খুব স্বাভাবিক গলায় বললে- আমায় চা দিবিনা?
আমি তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে বললাম- মাসী একটু চা দিয়ে যাও না বাইরে।
তারপর বললে- রাতে কি খাবি?
বললাম- বাজার তো চিনিনা। তাই আজ মাসী বললো- চাল, ডাল একটু নিয়ে এসেছিলাম তাই একটু ফুটিয়ে নেবো।
-ও সব ঠিক করে ফেলেছিস তাহলে?
-আমি আজ রাতের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-কোথা থেকে পাঠাবে?
-আমার কোয়ার্টার থেকে, অবশ্য আমার কোয়ার্টার খুব দূরে নয়। আমার রান্নার ছেলেটা বেশ ভালোই রাঁধে।তুই চাইলে ওখানে গিয়েও খেতে পারিস।
আমতা আমতা করে বললাম- তোমার ফ্যামেলি?
– ফ্যামেলি আর হল কোথায়?
– মানে?
– একজনের জন্য অপেক্ষা করছি এখনও..যদি সে কখনও রাজি হয় তবেই।
আমি বললাম- ও আচ্ছা..
– তুই এখনও একা কেন?
– আমার কথা বাদ দাও?
– এখনও অভিমান?
– কিসের অভিমান?
– আমার ওপর প্রতিশোধ তো নিয়ে নিয়েছিস আমায় প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু আমি জানতাম তোর ওই প্রত্যাখ্যান ছিল গভীর অভিমান থেকে। তোর মতো নীরবে যে এতবছর ধরে অপমান সহ্য করেও নিজেকে একা করে রেখে দেয়, কাউকে আসতে দেয়না সেই ভালোবাসার জায়গায়…এমন সংযমী গভীর ভালোবাসা আমি আর কোথায় পাবো রে? এখনও কি বলতে হবে আমার অপেক্ষা কার জন্য?
– আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলামনা – দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আর তুমি কাছে এসে দু’হাতে আমার মুখটা তুলে ধরে বললে- আর কত কাঁদবে তিথি? এবার তো একটু হাসো।
পূর্ণিমার চাঁদটাও সেদিন আকাশে যেন খুব জ্বলজ্বলে, জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে ”আমরা হাত ধরলাম দু’জনে দু’জনের ।