পরকীয়া ২
-প্রলয় কুমার নাথ
(১)
অতীতের পৃথিবীর কোনো এক অজানা কোণে অবস্থিত, একটি ছোট্ট জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে নেমেছে রাতের অন্ধকার। পাথরের দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরগুলির ওপর চাঁদের আলো পড়ে সৃষ্টি করেছে এক মায়াবী জগৎ। প্রতিটি ঘরেই নিভে গিয়েছে আলোর জন্য জ্বালিয়ে রাখা অগ্নিকুন্ড, শোনা যাচ্ছে না কারোর কথা বার্তার আওয়াজ। নিদ্রাদেবীর আরাধনায় নিমগ্ন গোটা গ্রাম। মাঝে মাঝে শুধু শোনা যায় নিশাচর শেয়াল কুকুরের ডাক তথা রাতপাখিদের কর্কশ ক্রন্দন ধ্বনি। পশ্চিম দিক থেকে বইতে শুরু করেছে একটি ঠান্ডা হাওয়ার দাপট যা সমানে কাঁপিয়ে তুলেছে এই বাড়ির খোলা জানলার পাইন কাঠের পাল্লাগুলিকে। তবে সেদিকে কোন খেয়াল নেই, এই ঘরের চুণ ও মাটির প্রলেপে আবৃত পাথুরে মেঝের ওপর পাখির পালক দিয়ে তৈরি চাটাই-এ শায়িত এক নারী পুরুষ জুটির। এই মধ্যরাতেও, শরীরী ক্রিয়ায় মত্ত এই দম্পতির চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই।
দীর্ঘদেহী পুরুষটির সুঠাম দেহ ক্রমাগত ওঠানামা করছিলো তার নিচে শায়িত নগ্ন নারীদেহটির ওপর। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিলো দুজনের সুখানুভবের মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্রুত বেগে নিঃশ্বাস নিতে নিতে নারী দেহের ওপর থেকে এক পাশে ঢলে পড়লো পুরুষটি। তারপর বেশ কয়েকটি মুহূর্ত স্তব্ধ থাকার পর, হঠাৎ ক্ষিপ্ত চিতা বাঘিনীর মত নারীটি আবার জাপটে ধরলো পুরুষটির দেহটিকে। পুরুষটির পুরুষ্ঠ ঠোঁটের যতটা কাছে সম্ভব নিজের মুখটাকে নিয়ে গিয়ে, কোনো এক দুর্বোধ্য ভাষায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো নারীটি, “আর একটা রাত…..শুধু মাত্র আর একটা রাতই আমি কাটাতে পারবো তোর সাথে!”
উদ্বেগহীন গলায় বলে উঠলো পুরুষটি, “জানি….পরশু দিন সকালেই তোকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে হবে আমাকে, যেখান থেকে আর তোর কাছে ফিরে আসা কখনই সম্ভব হবে না আমার পক্ষে!”
উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো নারীটি, “কিন্তু আমি যে পারবো না রে…..পারবো না তোকে ছেড়ে একটা রাতও কাটাতে! আমি যে বাকি তিনজনের মত নই, যারা শুধুমাত্র আচার আচরণের খাতিরেই কিছুদিনের জন্য বাধ্য হয়েছিলো তোর বিছানায় আসতে! আমি যে তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি রে…..তোকে ছাড়া বাঁচবো কি করে আমি!”
পুরুষের গলায় বিস্ময়ের স্বর, “একি বলছিস তুই? তুই তো সব কিছু জেনে শুনেই……”
আবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে নারীটি, “হ্যাঁ, তুই যে এই পৃথিবীতে মাত্র কিছুদিনের অতিথি, এই কথা আমার অজানা নয়! তা জেনেই আমি তোর শয্যা সঙ্গিনী হয়েছি! কিন্তু এখন যে আমি তোকে কিছুতেই হারাতে চাই না রে!…..কাউকে কেড়ে নিতে দেবো না তোকে আমার কাছ থেকে!”
“তা অসম্ভব!”, গর্জে উঠলো পুরুষটি, “জেনে রাখিস, আমার মেয়াদ মাত্র আর এক দিন!”
“না, অসম্ভব নয়…..কারণ তার উপায় আমি আগে থেকেই বার করে রেখেছি!”, মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিলো নারীটি।
এই বলে সেই মুহূর্তে সে পুরুষটির পাশ থেকে উঠে, ছুটে চলে গেল সেই ঘরের এক কোণে। তারপর সে পাথরের দেওয়ালের গায়ে খাঁজ কাটা তাক থেকে তুলে নিলো একটি মাটির কলস। সেটার মুখের ঢাকনা সরিয়ে, তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হাস্যোজ্জল মুখে বার করে আনলো একটি চারপেয়ে ছোট্ট প্রাণীকে! জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে মেয়েটির দুই আঙুলের মাঝে ধরে থাকা সুন্দর সোনালী ছোপ ছোপ চামড়াধারী সেই ছোট্ট প্রাণীটার গায়ের ওপর। অপার বিস্ময়ে সেদিকে চেয়ে বলে উঠলো পুরুষটি, “এটা তো…..এটা তো একটা বিষাক্ত ব্যাঙ!”
“ঠিক তাই….বিষ!….এই প্রাণীটার বিষ প্রায়শয় কেড়ে নেয় কত মানুষের প্রাণ, তাই না?”, উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠলো মেয়েটির দুই কাজল কালো চোখ! সে বলেই চলল, “কিন্তু এই বিষ দিয়েই আমি যে বাঁচাতে চলেছি তোর প্রাণ!”
সেই রাতের অন্ধকারকে খান খান করে দ্বিখণ্ডিত করে সেই ঘরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির শয়তানী হাসির রেশ!
(২)
আমাকে ভুলে যাননি তো? আমি মহেশপুর গ্রামের সেই হতভাগ্য জমিদার শিলাদিত্য চৌধুরী! নিজের বন্ধু-পত্নীর রূপের ওপর লালসা যার জীবনটাকে ঢেকে দিয়েছে Fregoli Delusion এর অন্ধকারাচ্ছন্ন কুয়াশায়! নন্দিনীকে হারাবার পর থেকে এভাবেই কেটে গিয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। শুনেছিলাম অন্যত্র বিবাহ হয়েছে তার, ব্যাস এর থেকে বেশি তার সম্বন্ধে আর কোন খোঁজ খবর নেই আমার কাছে। হয়তো খুব সুখেই আছে সে, তাই তার খোঁজ নেওয়ার কোন দরকারও বোধ করি না আমি।
আজ একটি বিভীষিকাময় নিকষ কালো মৃত্যুর ছায়া ঘনীভূত এই জমিদার বাড়ির মোসাহেব খানার একটি ঘরে। সন্ধ্যার ঝড় জল আর বজ্রপাতের শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে, সেখান থেকেই ভেসে আসছে এই বাড়ির এক সদ্য মাতৃহারা তরুণ কর্মচারী, সুবলের মর্মভেদী হাহাকার! দুই সপ্তাহ ধরে আন্ত্রিকে ভুগে কিছুক্ষণ আগেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে এই বাড়ির দীর্ঘদিনের এক বিধবা রাঁধুনি, সরমা! আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম কলকাতা থেকে ডাক্তার ডেকে এনে তাকে সুস্থ করে তুলতে, কিন্তু ভাগ্যের লিখন পরিবর্তন করার ক্ষমতা বোধহয় চিকিৎসা শাস্ত্রেও লেখা নেই!
খবর পেয়েই আমি দ্রুত পায়ে ছুটে এসেছিলাম সরমার ঘরে। অন্ধকার ঘরের এক পাশে একটি কুপি জ্বলছে। মাঝে মাঝে তীব্র ঝড়ো হাওয়ার দাপটে দপ দপ করে কেঁপে উঠছে তার শিখা। ঘরটি ভরে ছিল বেশ কিছু চাকর বাকরের ভিড়ে। সকলেরই মুখে আতঙ্ক এবং শোকের ছায়া। আমাকে এই ঘরে ঢুকতে দেখে সকলেই প্রস্থান করলো সেখান থেকে। শুধু দড়ির খাটিয়ার ছোট বিছানাটার ওপর নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলো সরমার শীর্ণকায় মৃতদেহটি। আর তার বুকের ওপর মুখ গুজে এখনো কেঁদে চলেছে সুবল।
আমি গিয়ে সুবলের কাঁধে হাত রাখতেই, সে মৃত মায়ের বুক ছেড়ে হাউ মাউ করে জড়িয়ে ধরলো আমার দু’টি পা। আমি তার দুই কাঁধ ধরে নিচ থেকে উঠিয়ে, তাকে তার মায়ের পাশে বসালাম। তারপর নিজেও তার পাশে বসলাম। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, “মা তো আর রইলো না, কত্তা বাবু….এবার!…..এবার কি হবে আমার!”
আমি আশ্বাসের সুরে বললাম, “তোর কোন চিন্তা নেই, সুবল….এই বাড়িতে আগে তোরা যেমন থাকতিস, এখনো থাকবি। আমি আছি তো!…..আর শোন, মা বাবা তো চিরকালটা বেঁচে থাকেনা, বল!…..যা, যা দেখ দেখি নায়েব মশাই দাহ করার সমস্ত ব্যবস্থা করে উঠতে পারলেন কি না।”
সুবল চোখ মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও মৃতদেহের পাশ থেকে উঠতে যাবো, এমন সময় মনে হল, যে একটি বরফের মত ঠান্ডা হাত যেন চেপে ধরলো আমার ডান হাতের পাতা! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে চাইতেই আতঙ্কে শিউরে উঠলাম! কারণ যে হাতটা আমার হাত চেপে ধরেছে, সেটা আর কারোর নয়, সদ্য মৃত সরমার! আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ঝটকায় নিজের হাতটা সেই হিম শীতল স্পর্শ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলে গেলাম ঘরের দরজার দিকে, কিন্তু সেই ঘর থেকে বেরোনোর আগেই সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজার দুই পাল্লা! আমি দরজার গায়ে আছড়ে পড়ে তা খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম, ঠিক এমন সময় সেই চেনা পুরুষকণ্ঠের ডাক ভেসে এলো পেছন দিক থেকে!
“বৃথা ভয় পেয়ে পালানোর কোন দরকার নেই, শিলাদিত্য!……তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে!”
শশধরের গলার স্বর চিনতে এতটুকু দেরি হল না আমার! আমি পেছন ঘুরে, কুপির আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, যে বিছানার উপর উঠে বসে নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সরমার দেহ। রক্তের মত লাল হয়ে উঠেছে তার দুই চোখ। সম্পূর্ণরূপে শশধরের কণ্ঠস্বরে সে বলে চলল, “নাহ, আমি সরমা নই, শিলাদিত্য!…..তার মরদেহে ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় নেওয়া, তোর পুরোনো বন্ধু শশধর আমি, নিশ্চয় চিনতে পেরেছিস আমায়!”
একটি দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে মুহূর্তের মধ্যে নিভিয়ে দিলো কুপির আগুন। দুম দাম করে কেঁপে উঠলো ঘরের জানলার পাল্লাগুলি। এই আঁধারের মধ্যেই আবার শোনা গেল শশধরের কণ্ঠস্বর, “জানি আমার দেওয়া অভিশাপে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তোর জীবন! কিন্তু ততোধিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমিও, কারণ যতদিন তোর জীবনে এই অভিশাপ থাকবে, ততদিন আমিও মুক্তি পাবো না এই পৃথিবী থেকে!……তাই, খুব তাড়াতাড়ি তুই এমন একটি পরীক্ষার সম্মুখীন হবি, যার ওপর নির্ভর করবে আমার দেওয়া অভিশাপ আমি ফিরিয়ে নেবো কি না! তৈরি থাকিস কিন্তু!”
আমি কিছু একটা বলতে চলেছিলাম, কিন্তু তার আগেই শিথিল হয়ে বিছানায় ঢলে পড়লো সরমার দেহ। আলগা হয়ে গেল দরজার পাল্লার বন্ধ হয়ে যাওয়ার শক্ত ভাব! ঠিক তখনই দরজা ঠেলে বেশ কিছু লোকজনের সাথে সেই ঘরে অবাক হয়ে প্রবেশ করলেন নায়েব মশাই, শংকর বাবু। তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, “কত্তা বাবু, আপনি এই মরার ঘরে, অন্ধকারের মধ্যে দরজা বন্ধ করে করছিলেন কি!…..আমি লোক নিয়ে এলুম লাশ শ্মশানে নিয়ে যেতে……”
আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না তাকে, শুধু বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে!
(৩)
“চিকিৎসা বিজ্ঞান অশরীরী বা অতি-প্রাকৃত বিষয়গুলিকে কখনই মান্যতা দেবে না, মিস্টার চৌধুরী,” ঠোঁটের কোণ থেকে চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন ডাঃ নবারুন হালদার, “আপনার সকল অলৌকিক অভিজ্ঞতাগুলোর নানা রকমের গাল ভরা নাম দেবে সাইকোলজির ভাষায়!”
আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে, যা ধীরে ধীরে কলকাতার এই অতি প্রাচীন মানসিক রোগের হাসপাতালের লম্বা খোলা জানলার লোহার শিকগুলির ফাঁক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরে।
নবারুন বাবুর কাছে আমি বেশ কিছু বছর ধরে চিকিৎসাধীন। কলকাতার মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশ নামডাক আছে তার, এবং বর্তমানে এই হাসপাতালের বেশ উচ্চপদে কর্মরত তিনি। যদিও বা লৌকিক অলৌকিকের এই জটিল মায়াজাল থেকে আমাকে এখনো উদ্ধার করতে পারেননি তিনি, তবুও এই মিষ্টভাষী সদা হাস্যময় সুদর্শন মানুষটিকে বন্ধুরূপে পেয়ে নিজের একাকিত্ব দূর করতে পেরে যথেষ্ট উপকৃত আমি। তাই আমি দরকারে অদরকারে মাঝে মাঝেই তার সাথে দেখা করতে আসি এই হাসপাতালে উপস্থিত তার চেম্বারে। আজও তেমনই একটা দিন।
বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর কিছু একটা বলতে চলেছিলাম আমি, এমন সময় বাইরে থেকে একটা কোলাহলের আওয়াজ পেয়ে আমাদের দু’জনেরই চিন্তার ঘোর কেটে গেল! দু’জনেই ছুটে সেই চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এলাম। শব্দটা আসছে এই হাসপাতালের পেছনের দিক থেকে, যেখানে বিভিন্ন মানসিক রোগীদের ভর্তি করে রাখা হয়। সেদিকে ছুটে যাওয়ার পথেই আমাদের দেখা হয়ে গেল বেশ কয়েকজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সাথে, যারা দোতলার বারান্দায় উদ্বিগ্ন চিত্তে জটলা বাঁধিয়ে বসেছে। তাদের কাছে পৌঁছতেই গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন ডাঃ হালদার, “কি হয়েছে কি? এখানে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছো কেন তোমরা?”
“সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, স্যার…… আজ সকাল থেকে অলোকেশ বাবুকে…… মানে আসামী অলোকেশ বসুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”, কুণ্ঠিত গলায় বলে উঠলো একজন কর্মচারী।
মুহূর্তের মধ্যেই পাংশু বর্ণ হয়ে উঠলো নবারুন বাবুর মুখ, অস্ফুট স্বরে তিনি বলে উঠলেন, “সে কি!”
ঠিক তখনই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো আর একজন কর্মচারী, সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ক্ষমা করে দিন, স্যার! বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে আমার! কাল আমারই দায়িত্ব ছিল অলোকেশ বসুর সেলে রাতে পাহারা দেওয়ার। তিনি বার বার কান্নাকাটি করতে লাগলেন কাল রাতে, বললেন হাতে পায়ের লোহার চেনগুলোকে খুলে দিতে। হাতে পায়ে খুব ব্যাথা করছে, ঘা হয়ে গিয়েছে। একটু শান্তিতে ঘুমতে চান তিনি। মানুষটার ওপরে বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছিল, স্যার…… তাই আর না করতে পারিনি। সারাদিন বাড়িতে খাটা খাটনি করার পর মাঝরাতের দিকে দুই চোখ একটু বন্ধ হয়ে এসেছিল আমার……হে ভগবান, তখন কি আর জানতাম, যে সেই সুযোগে……”
“মায়া পড়ে গিয়েছে! রাবিশ! ওই জঘন্য ক্রিমিনালটার ওপর তোমার মায়া পড়ে গিয়েছে!…… তুমি জানো না, যে কত বড় ভুল করে ফেলেছো তুমি! এরপর গোটা পুলিশ মহলের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে এর জন্য!”, গর্জে উঠলেন ডাঃ হালদার। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল লোকটি। “যাও, যাও হাসপাতালের চারিদিকে খুঁজে দেখো তাকে পাও কি না……আর ওনার স্ত্রীর কাছে খবর পাঠাও, বল এখানে এসে আমার সাথে দেখা করতে। আর আমাদেরও স্থানীয় থানায় একটা টেলিফোন করে দিতে হবে! আসুন মিস্টার চৌধুরী, আসুন……”, ব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলেন নবারুন বাবু।
থানায় খবর দেওয়া হয়ে গেলে, আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না আমি। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে এই অলোকেশ বসু? আর কেনই বা তার আকস্মিক নিরুদ্দেশ হওয়ায় এত হুলস্থুল বেঁধে গিয়েছে এই হাসপাতালে?”
ডা: হালদারের মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠলো একটি চাপা আতঙ্কের চাপ। তিনি বলে উঠলেন, “প্রায় সাত আট মাস আগেকার ঘটনা। এই কলকাতা শহরের বুকে ঘটে চলেছিল একের পর এক মর্মান্তিক হত্যাকান্ড। যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছিল, তারা প্রায় সকলেই এখানকার গৃহহীন গরিব মানুষজন, যারা বাধ্য হত রাতে বিভিন্ন ওলি গলি বা রাস্তার ধারে শুয়ে ঘুমোতে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হল খুনের প্রক্রিয়া! হত্যাকারী যেন সপাটে তাদের বুকে বসিয়ে দিয়েছে কোন ধারালো অস্ত্র। তারপর তাদের প্রাণ থাকা অবস্থাতেই, তাদের বুক চিরে ছিঁড়ে বার করে নিয়েছে কম্পমান হৃৎপিন্ডটাকে!”
এই দৃশ্যের ভয়াবহতা নিজের চোখের সামনে কল্পনা করে ভয়ে শিউরে উঠলাম আমি।
“পরপর চারজনকে একই ভাবে খুন হবার পরও অপরাধী ধরা পড়ছে না জেনে যখন পুলিশ প্রশাসন চোখে সর্ষের ফুল দেখছেন, তখনই পঞ্চম ব্যক্তিটিকে খুন করার সময়, সেই রাতের ভয়ঙ্কর দৃশ্য গোপনে দেখে ফেললো এক পথচারী ভিক্ষুক। সে পরদিনই সেই কথা পুলিশের কাছে গিয়ে জানায়। তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আঁকা হয় হত্যাকারীর ছবি। এবং বলা বাহুল্য, সে আর কেউ নয়, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রীমান অলোকেশ বসু। সেদিনই খানা তল্লাশি করা হয় অলোকেশ বাবুর বাড়িতে। তার পরিবারে আছেন শুধু তার স্ত্রী এবং দুই বছরের মেয়ে। কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন তার বিধবা মা। তার বাড়ির চিলেকোঠার ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন পুলিশের লোকেরা! একটি অদ্ভুত দেখতে প্রাচীন যুগের পাথরের তৈরি পাত্রের মধ্যে ভস্মীভূত অবস্থায় পড়ে রয়েছে খুন হওয়া হতভাগ্য মানুষগুলির হৃদপিণ্ডের অবশেষ!”, এতটা বলে একটু থামলেন ডা: হালদার।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি, “সেদিনই গ্রেফতার করা হয় অলোকেশ বসুকে। সকলের মনে হয়েছিলো, হয়তো তিনি অভ্যাস করতেন কোন গোপন তন্ত্র বিদ্যা, কিন্তু তাকে জেরার পরই বোঝা গেল, যে তার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়! আদালত থেকে রায় দেওয়া হল, যে যতদিন না তিনি সুস্থ হচ্ছেন, তাকে এখানে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখতে।”
এতটা বলার পর, হঠাৎ সেই ঘরে প্রবেশ করলো আরেকজন নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী। সে বলে উঠলো, “স্যার, আপনার কথামত আমরা অলোকেশ বসুর স্ত্রীকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।” “পাঠিয়ে দাও”, প্রত্যুত্তরে বললেন নবারুণ বাবু।
ঠিক সেই মুহূর্তে, একটি কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে, বিধ্বস্ত চেহারায় একজন মহিলা প্রবেশ করলেন ডা: হালদারের চেম্বারে। তার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চমকে উঠলাম আমি। পাঁচ বছর পর, এই প্রথম দেখা হল আমার নন্দিনীর সাথে!
(৪)
“আর পারছি না আমি……পারছি না আর!”, চিৎকার করে উঠলো নন্দিনী, “নিয়ে যান আমাকে এখান থেকে……নিয়ে যান!”, কান্নায় ভেঙে পড়ে দু’হাতের মুঠো দিয়ে আমার বুকে থাকা জামাটাকে খামচে ধরে বলে উঠলো সে। সেদিন ওই মানসিক রোগের হাসপাতালে আমরা একে অপরকে চিনতে পারলেও, ডা: হালদারের সামনে না চেনার অভিনয় করেছিলাম। অলোকেশ বাবুর নিখোঁজ হওয়ার খবরটা শুনে আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকেনি নন্দিনী। আমিও কোন জরুরি কাজের অছিলায় বেরিয়ে এসেছিলাম ডা: হালদারের চেম্বার থেকে। তারপর ফিরতি পথেই নন্দিনী আমায় নিয়ে আসে তার বাড়িতে। এই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয় অলোকেশ বাবুকে।
“তুমি তো আমার অক্ষমতার কথা জানো, নন্দিনী…..তারপরেও আমার সাথে চলে যেতে চাইছো!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলাম আমি। সে এবার উন্মাদিনীর মত চেপে ধরলো আমার জামার কলার, “চাই না…..চাই না আমি শারীরিক সুখ, চাই না! আমি শুধু প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই, শিলাদিত্য বাবু!…..এই বাড়িতে যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে!…..যে মানুষ নৃশংস ভাবে একের পর এক মানুষকে হত্যা করে, তাদের শরীর থেকে হৃদপিন্ড ছিঁড়ে এনে এই বাড়িতেই কোন শয়তানের উদ্দেশ্যে আহুতি দিতে পারে, তার বাড়িতে আর একটি মুহূর্তও কাটাতে চাই না আমি!…..ওনার গ্রেফতারের পর আমি হয়তো আত্মহত্যা করে শেষ করে দিতাম নিজেকে, কিন্তু তা পারলাম না শুধু ওর মুখ চেয়ে…..” এই বলে পাশের বিছানায় ঘুমন্ত শিশুকন্যাটির দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করলো নন্দিনী।
অনেক কষ্ট করে তখনকার মত শান্ত করতে পারলাম আমি তাকে। হঠাৎ একটা চাপা কৌতূহল উপলব্ধি করলাম আমি, বললাম, “তুমি কখনো জানতে চাওনি, কেন তোমার স্বামী করতেন এই ঘৃণ্য কাজ?”
সে বিদ্বেষ মেশানো গলায় বলল, “বিছানায় উপভোগ্য সামগ্রী ছাড়া আর কোন কিছুই মনে করতেন না তিনি আমাকে! আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোন দরকার বোধ করেননি তিনি কখনো! মাঝে মাঝে আমিও উপলব্ধি করতাম তিনি গভীর রাতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যান। এছাড়া চিলেকোঠার ওই ঘরে গোপনে কিছু করেন। মাঝে মাঝে সেখান থেকে শুনতে পেতাম কোন এক অদ্ভুত ভাষায় তার কথা বার্তার শব্দ! কাঁচা মাংস পোড়ার আঁশটে গন্ধও আসতো নাকে! কিন্তু ওই ঘরে যাওয়ার কোন অনুমতি ছিল না আমার!”
এই বাড়িটা বেশ বড় এবং পুরোনো আমলের বনেদি ধাঁচে গড়া, যদিও বা তা মহেশপুরের জমিদার বাড়ির ধারে কাছেও আসে না। আমি আর নন্দিনী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম চিলেকোঠার ঘরটি দেখার অভিপ্রায়ে। বিশেষতঃ, সেই প্রাচীন পাথরের পাত্রটি, যার ওপর অলোকেশ বাবু হৃদয়গুলিকে ভস্মীভূত করতেন, সেটাও এখনো রাখা আছে সেখানে, সেটা দেখাই আমার কৌতূহলের মূল কারণ।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো নন্দিনী, “তবে, কি জানেন, আমি শাশুড়ি মায়ের কাছে শুনেছি, ছোটবেলায় নাকি মাঝে মাঝে কোন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত আমার স্বামীর! যদিও বা, এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলতে চাইতেন না তিনি…..তবে ঘুমের মধ্যে প্রায়ই দু’টো অদ্ভুত শব্দ বলে উঠতেন তিনি! এছাড়াও, খানা তল্লাশি করার সময় তার ডায়েরির বেশ কয়েকটা পাতায় লেখা একটি অদ্ভুত ছড়ার হদিস পায় পুলিশ, যার অর্থ তারা আজ অবধি বার করতে পারেননি!”
“কি শব্দ? আর ছড়াটাই বা কি?”, বিস্ময়ের পারদ চড়া কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
প্রত্যুত্তরে বেশ কিছুক্ষণ মস্তিষ্কে জোর খাটিয়ে বলে উঠলো নন্দিনী, “হ্যাঁ, মনে পড়েছে! শব্দ দু’টি হল ‘ইকসিপৎলা’ এবং ‘ৎলেনামাকাক’!……আর সেই ছড়াটা হল:
উত্তরের ধূমায়িত আয়নার মন,
চায় তার সর্বদা সূর্যের তাপ,
একপেয়ে জাগুয়ারের দশম স্বর্গে ভ্রমণ,
সমাপ্ত করবে অষ্টাদশীর পঞ্চম শাপ।”
(৫)
নাহ, বহুবার ভেবেও আমার ভোঁতা মস্তিস্ক কোনই অর্থ উৎপন্ন করতে পারলো না ছড়াটার। আয়না চাইছে সূর্যের তাপ! আবার একপেয়ে জাগুয়ারই বা স্বর্গে যাবে কি করে! অষ্টাদশীর পঞ্চম শাপই বা কি! বোঝাই যাচ্ছে, যে অলোকেশ বাবু কোন এক গুরুতর রহস্য ধাঁধার মাধ্যমে লিখে রেখেছিলেন তার ডায়েরির পাতায়। এর সাথে কি কোন সম্পর্ক আছে তার দ্বারা করা নরহত্যাগুলির? চোখের সামনে যেন অন্ধকার দেখতে লাগলাম আমি! আর ওই দু’টো শব্দ তো উচ্চারণ করাই দায়!
“আচ্ছা, ওই প্রাচীন পাথরের পাত্রটি কোথা থেকে পেয়েছিলেন তিনি?” সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই নন্দিনীকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“ওনার প্রাচীন এন্টিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করার বাতিক ছিলো। শাশুড়ি মায়ের মুখে শুনেছিলাম, ধর্মতলার একটি কিউরিও দোকানের মালিকের সাথে বেশ ভাব ছিলো ওনার। সেখান থেকেই নাকি তিনি কিনতেন এই ধরণের সামগ্রী!” বলে উঠলো নন্দিনী।
আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম চিলেকোঠার সেই ঘরের দরজার বাইরে। অলোকেশ বাবু গ্রেফতার হবার পর থেকে এই ঘরের চাবি থাকে নন্দিনীর কাছে। তালা খুলে, দরজার হাতল ধরে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যাবো, ঠিক এমন সময় এই বাড়ির নিচের তলা থেকে ভেসে এলো একটি বাচ্চা মেয়ের আকস্মিক চিৎকার করার আওয়াজ। আমি অবাক হয়ে চাইলাম নন্দিনীর দিকে। সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠলো, “মনে হয় মাধুর…..মানে আমার মেয়ে মাধুরীর ঘুম ভেঙে গিয়েছে……ঠিক আছে, আপনি ওই ঘরে গিয়ে পাত্রটিকে দেখুন, আমি একবার নিচে গিয়ে মাধুকে দেখে আসি!” আমার সম্মতিসূচক সারা পেয়ে নন্দিনী হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পথ ধরলো। আমি এগিয়ে গিয়ে ওই ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
সময়টা দুপুর বেলা হলেও, এই ঘরের মধ্যে যেন অন্ধকার রাত্রি বিরাজমান। একটা স্যাঁতস্যাঁতে অদ্ভুত গন্ধ চারিদিকে। খুব অদ্ভুত ভাবে ওই একটি দরজা বাদ দিয়ে আর কোন জানলা বা দরজা নেই এই ঘরে। এখানে ঢোকা মাত্রই একটি কর্কশ আওয়াজ করে নিজে থেকেই ভেজিয়ে গেল দরজার দুই পাল্লা। এই ঘরের এক কোণে থাকা ঘুলঘুলি দিয়ে যেটুকু আলো আসে, সেটার সাহায্যেই আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো ঘরটির বিভিন্ন আসবাসপত্র। বেশিরভাগই রয়েছে কিছু প্রাচীন যুগে পাথরে খোদাই করা মূর্তি, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, কিছু পুরোনো দিনের বই এবং তৈলচিত্র। তবে ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা রয়েছে সেই বস্তুটি যাকে দেখার জন্যই আমি ছুটে এসেছি এই ঘরে।
ঠিক যেন পাথরের ওপর একটি মস্ত বড় ঈগল পাখির শরীর খোদাই করা আছে। অনবদ্য শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার চোখ, ঠোঁট এবং শরীরে উপস্থিত পালকের প্রতিটি সূক্ষ্ণ কারুকাজ! তার পিঠের উপর উপস্থিত একটি বেশ বড় গর্ত! আমি এগিয়ে গেলাম বস্তুটির খুব কাছে। মেঝেতে উবু হয়ে বসে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম সেটাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে! এখনো একটা আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে তার চারিপাশে, গর্তটির ভেতরের দেওয়ালে লেগে রয়েছে ছাই ভস্ম!
“তোনা!……তোনা!……ইসৎলি!…….ইসৎলি!”
হঠাৎ একটা অপার্থিব কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি! এতক্ষণ ধরে পাত্রটির কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখছিলাম আমি, এবার মাথা তুলে সামনের দেওয়ালের দিকে চাইতেই একটা হিমশীতল স্রোত যেন বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া জুড়ে! দেওয়ালের গা জুড়ে একটা মানুষের অবয়ব ধীরে ধীরে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার চোখের সামনে! যেন মাকড়সার মত দেওয়ালের গায়ের সাথে আটকে আছে সে! এবার দেওয়াল থেকে এক লাফে সে নেমে এলো নীচে। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধে ভরে উঠলো গোটা ঘরের বাতাস। সম্পূর্ণ সাদা, মণিহীন নিষ্পলক চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল এই অদ্ভুত পোশাক পড়া, অর্ধনগ্ন ছায়ামূর্তিটি! মনে হল যেন ধীরে ধীরে সে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছে…..আমার খুব কাছে!…..আর একটু হলেই স্পর্শ করবে আমার বুক! আবার কোন দুর্বোধ্য ভাষায় শোনা গেল তার হাড় হিম করা কণ্ঠস্বর:
“চালচিউয়াৎল!…….চালচিউয়াৎল!”
আর এক মুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা না করে আমি ছুটে গিয়ে একটানে দরজা খুলে, সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর সটান বাইরে থেকে সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে, মেঝেতে বসে হাঁপাতে লাগলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন ভেতর থেকে কোন ভয়ঙ্কর ধাক্কায় কেঁপে উঠলো পুরোনো দিনের দরজার পাল্লা দুটি। তার সাথেই শোনা যেতে লাগলো আবার ওই দুর্বোধ্য শব্দগুলোকে! নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি তর তর করে দ্রুত গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। নাহ, এই বাড়িতে কোন অশুভ শক্তি আছে! এখানে নন্দিনীকে আর এক মুহূর্ত রাখা যাবে না! তাকে আমি আমার বাড়িতেই নিয়ে গিয়ে তুলবো!
আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে এই বাড়ির একতলায় নন্দিনীর ঘরে ঢুকে তাকে এই সমস্ত কথা বলতে যাবো, এমন সময় দেখলাম যে সে বিছানায় বসে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! আমার পায়ের শব্দ শুনে, সে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, সশব্দে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলো আমাকে! তারপর চিৎকার করে বলে উঠলো, “মাধুকে এই বাড়ির কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, শিলাদিত্য বাবু!……সেই সময় ওর কান্নার শব্দ পেয়ে নীচে এসে দেখি ও বিছানায় নেই!…..তারপর সারা বাড়ি খুঁজলাম ওকে, কিন্তু কোথাও পেলাম না…..কোথাও না!”
আমি কিছুই বলতে পারলাম না তাকে, শুধু তার দ্রুত হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি উপলব্ধি করতে লাগলাম নিজের শরীর দিয়ে!
আবার অনেক কষ্টে শান্ত করলাম নন্দিনীকে। অলোকেশ বাবুর ওপর তার কোন টান নেই, তাই তার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় সে। কিন্তু তার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা, তার দুই বছরের ফুটফুটে মেয়ে মাধু……তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও কাটানো খুব কষ্টকর নন্দিনীর পক্ষে! সে উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠলো, “আমি মাধুকে ছাড়া বাঁচবো না, শিলাদিত্য বাবু…..ওকে আমার কাছে নিয়ে আসুন!…..যেখান থেকে হোক ওকে ফিরিয়ে আনুন আমার কাছে!”
“শুধু তোমার মেয়েকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনা নয়, নন্দিনী…..তোমার স্বামীর সমস্ত ক্রিয়াকলাপের রহস্যভেদও করতে হবে আমাকে!….কিন্তু এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না তোমার, কারণ ওই চিলেকোঠার ঘরে হয়তো কোন অশরীরিকে আবদ্ধ করে রেখেছেন তোমার স্বামী!…..তার কাছেই হয়তো তিনি নিবেদন করতেন ওই ভস্মীভূত হৃৎপিণ্ডগুলি! কিন্তু যতক্ষণ না এর সম্বন্ধে বিশদে জানতে পারছি…..”
“না শিলাদিত্য বাবু, আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলেছি! আমি আমার মেয়েকে না নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোবো না!…..এমনিতেই তো মরে মরেই বেঁচে আছি আমি, আর কোন অশরীরির হাতে মৃত্যুভয় নেই আমার!”, আমার কথা শেষ করার আগেই দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো নন্দিনী। অনেক চেষ্টা করেও তাকে কোন মতেই রাজি করানো গেল না। অগত্যা তাকে বিদায় জানিয়ে আমিই বেরিয়ে এলাম সেই বাড়ি থেকে। যাবার আগে নন্দিনীর কাছ থেকে নিয়ে এলাম সেই কিউরিওর দোকানের ঠিকানা, যেখান থেকে অলোকেশ বাবু ওই প্রাচীন সামগ্রীগুলিকে কিনেছিলেন।
(৬)
কলকাতার মধ্যে বেশ প্রসিদ্ধ এই কিউরিও দোকানটি। পুরনো আমলের তিনতলা বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখে তেমন কোন সাজসজ্জার আড়ম্বর চোখে পড়ে না। শুধুমাত্র সদর দরজার ওপর ঝোলানো আছে একটি বেশ পুরোনো সাইন বোর্ড। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, যে দেশ বিদেশের বহু প্রাচীন বস্তু মজুত আছে সেখানে। মূর্তি, মুখোশ, শিলমোহর, অস্ত্রশস্ত্র, পাত্র, পোশাক ইত্যাদি আরও কত কিছু, মনে হয় যেন যেন সদ্য ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে সেগুলো। তবে সেই সব জিনিসের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ ছিল না। সেখানে ঢুকতেই স্বয়ং অভিজাত চেহারার মাঝ-বয়সী দোকান মালিক আমায় সমাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। ভদ্রলোক হাসিমুখে জানতে চাইলেন, যে আমি কি কিনতে ইচ্ছুক। আমি সরাসরি তাকে জানালাম আমার আসার কারণ, আর সেই কথা শুনে তার হাস্যজ্জ্বল মুখটি কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল।
আমার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে, অনিচ্ছা সত্বেও বলে উঠলেন তিনি, “দেখুন, আপনি যে পাত্রটার কথা বলছেন, সেটা আমি আনিয়েছিলাম সুদূর মেক্সিকো থেকে। সেখানে নাকি প্রাচীন কোন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের খননকার্যের সময় পাওয়া যায় সেটা। তবে এর বেশি আমি আর কিছুই জানি না ওটার সম্বন্ধে! সেখানকার যে ব্যবসায়ী আমাকে সেটা বিক্রি করেন, তিনি এখন মারা গিয়েছেন। অলোকেশ বাবুও বা ওই পাত্রটিই কেন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন এখান থেকে, সেটাও আমি জানি না!….. আপনি যদি এখান থেকে কিছু কিনতে ইচ্ছুক হন তাহলে ঠিক আছে, নাহলে……”
এই কথা শুনে আমি আর কথা বাড়ালাম না তার সাথে, তাকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলাম দোকান থেকে। সেই দোকান থকে বেরিয়ে আসতেই মনে হল, যে বাতাসের স্রোতের মাঝে একটি পরিচিত অদৃশ্য পুরুষ কণ্ঠ যেন ফিসফিসিয়ে আমার কানে কানে বলল, “তোর পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে, শিলাদিত্য! এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে সক্ষম নয়, হয়তো তার উত্তর খুঁজে পাবি ইতিহাসের পাতায়!”
(৭)
কলকাতা শহরের সুশোভিত চওড়া সড়কে ঝরে পড়ছে অস্তমিত সূর্যের মিঠে রোদ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি এলোমেলো ভাবে হেঁটে চলেছিলাম এই রাস্তা থেকে সেই রাস্তা ধরে। নিজের ধুলো মাখা চটিজুতা আর মলিন বেশভূষা দেখে নিজেকেই যেন চিনতে পারছিলাম না আমি! কোথায় গেল মহেশপুরের সেই বৈভব, সাজসজ্জা, আমাকে ঘিরে মোসাহেবদের ভিড় বা জুড়ি গাড়ি চেপে কোন বাইজির মেহেফিলে যাওয়ার সেই মুহূর্তগুলো? এই শহরে যে কেউ চেনে না আমায়, এখানে যে কেউ কারোর জন্য নয়! আমার হাতে যে বেশি সময় নেই! কোথায় গেলে পাবো আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে এই রহস্যের জট খোলার সুযোগ?
মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো আমার…..ঠিক এমন সময় চোখ চলে গেল রাস্তার ধারে একটি সুবিশাল ঐতিহ্যশালী ইমারতের দিকে, যার বুকে স্পষ্ট ইংরাজি অক্ষরে লেখা আছে “ন্যাশনাল লাইব্রেরি”! এখানে গেলে কি পাবো আমি সকল প্রশ্নের উত্তর? একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি! আমি উন্মাদের মত ছুটে গেলাম সেইদিকে। তারপর গ্রন্থাগারের গেটের দারোয়ানের কাছে বিস্তর অনুরোধ করে এবং কিঞ্চিৎ পয়সা খাইয়ে জোগাড় করলাম ভেতরে ঢোকার অনুমতি। কোনদিকে না তাকিয়ে আমি সোজা ঢুকে পড়লাম এই গ্রন্থাগারে একটি সুবৃহৎ কক্ষের ভেতর। ছিমছাম নিস্তব্ধ আবহাওয়ার মাঝে রাশি রাশি বইয়ের সারি চারিদিকে। তার মাঝেই জায়গা মতো বসে একাগ্রচিত্তে পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে আছেন বেশ কিছু পাঠক পাঠিকা! মনে পড়ে গেল, যে এই পড়াশোনাকেই আমি জীবনভর অবহেলা করে এসেছি, যার ফলে পর পর তিনবার পরীক্ষা দিয়ে তবে কোনমতে বি.এ. পাশ করতে পেরেছি! নিজের প্রতি হীনম্মন্যতায় আমার চোখে জল এসে গেল!
এমন সময় সেখানকার গ্রন্থাগারিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। তবে তার কিছু বলার আগেই আমি ঝড়ের গতিতে তাকে একের পর এক সব কথা খুলে বললাম, হাত জোড় করে অনুরোধ করলাম যে আমাকে ওই দুর্বোধ্য শব্দগুলি এবং ওই প্রাচীন পাত্রটির সম্বন্ধে সকল অজানা তথ্য খুঁজে বার করার সুযোগ করে দিতে! আমার কথা তার বিশ্বাসযোগ্য মনে হল কি না জানিনা, তবে ঠিক আমার পেছন থেকে কেউ যেন গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
“এই শব্দগুলি ‘নাহুৎল’ (Nahuatl) ভাষায় বলা হয়েছে, আর ওই পাত্রকে বলা হল ‘কুয়াউহক্সিকালি’ (cuauhxicalli)!”
আমি চমকে উঠে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম একজন ধোপদুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ব্যক্তিকে, যিনি এই কথাগুলির বক্তা! এতক্ষন তিনি আমার খুব কাছেই বসেছিলেন, তাই তিনি শুনেছেন গ্রন্থাগারিককে বলা আমার সকল কথা! মৃদু হেসে বলে উঠলেন সেই ব্যক্তি, “নমস্কার, আমার নাম শ্রীযুক্ত সুধাময় পাত্র, আমি স্থানীয় প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক।” এতক্ষণ পর যেন অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পেলাম আমি! উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছিলো আমার বুক, মুখে যেন কিছুই বলতে পারলাম না আমি! শুধুই বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
সুধাময় বাবু চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে পাশে থাকা বইয়ের সারির মধ্যে ঢুকে গেলেন, তারপর বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর বের করে আনলেন একটি বহুদিনের পুরোনো বই। “আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর পাবেন এই বইয়ের ভেতর’, আমার সামনে বইটি রেখে বললেন তিনি! বইটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আমি…….বড় বড় অক্ষরে তার প্রথম পাতায় নামকরণ করা রয়েছে: “The History of Aztec Civilization” (এজটেক সভ্যতার ইতিহাস)! আমি এলোমেলো ভাবে বইটার পাতা উল্টে দেখতে লাগলাম, কিন্তু এই স্বল্প সময়ে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। তাই নিজের মুখেই বলে চললেন সুধাময় বাবু, খুলতে লাগলো একের পর এক অজানা রহস্যের জট!
“আন্দাজ বারশো থেকে পনেরোশো শতকের মাঝে মেক্সিকোর বুকে গড়ে উঠেছিল এই এজটেক সভ্যতা, যেখানে ব্যবহার করা হত এই নাহুৎল (Nahuatl) ভাষা। সারা বিশ্ববাসীর মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে সেখানে চলতো কিছু বর্বরতম ভয়ঙ্কর প্রথা!…..এদের দ্বারা পুজিত নানাবিধ দেবতার মধ্যে একজন হলেন ‘তেজকাৎলিপোকা’ (Tezcatlipoca), যাকে সন্মান জানাতে পালন করা হত ‘টক্সকাৎল’ (Toxcatl) অনুষ্ঠান।”
“এই অনুষ্ঠানে যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি করা শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হত সবচেয়ে সুদর্শন এক নবযুবককে। এক বছর ধরে তাকেই এই দেবতা রূপে পুজো করতো সাধারন মানুষ, তাকে মনে করা হত এই দেবতার মনুষ্যরূপ, বা ‘ইকসিপৎলা’ (Ixiptla). যেহেতু শাস্ত্রমতে এই দেবতার চারজন স্ত্রী আছেন, তাই অনুষ্ঠানটি হওয়ার এক মাস আগে এই যুবকটির সাথেও চারজন যুবতীকে বিবাহ দেওয়া হত! সে তাদের সাথে নিজের ইচ্ছামত সহবাস করার অধিকার অর্জন করতো।”
“তারপরেই আসতো অনুষ্ঠানের ভয়াবহ দিনটি! সেই দিন এই যুবককে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে ওই দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হত! তাকে একটি পাথরের স্তবকের ওপর হাত পা বেঁধে শুইয়ে দেওয়া হত, এবং ‘ৎলেনামাকাক’ (Tlenamacac) নামক গোত্রের এক পুরোহিত একটি ফ্লিন্ট-এর তৈরি চাকু দিয়ে তার বুক ছিরে হৃৎপিণ্ডটিকে কম্পমান অবস্থাতেই ছিঁড়ে বার করে এনে তা আগুনে আহুতি দিত ওই ‘কুয়াউহক্সিকালি’ (cuauhxicalli) নামক পাত্রে! তবে এই কাজ করার আগে, সেই পুরোহিতকেও নিজের শরীরের জিব, কান বা যৌনাঙ্গ কেটে রক্ত বা ‘চালচিউয়াৎল’ (Chalchiuatl) উপহার দিতে হত দেবতার উদ্দেশ্যে!”
“তারা মনে করতো, যে হৃৎপিণ্ড বা ‘তোনা’ (Tona) হল সূর্যের তেজের একটি অংশ বা ইসৎলি (Istli), যা নরবলির মাধ্যমে সূর্যের কাছে ফেরত পাঠিয়ে পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধি করা হচ্ছে!…..এই বিভীষিকা এখানেই শেষ নয়! এরপর মৃতদেহটির মুণ্ডচ্ছেদ করে, তার থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তা পরিধান করে নৃত্য করতো পুরোহিতরা! কাটা মুণ্ডুটিকে মন্দিরের একটি skull rack-এ গেঁথে রাখা হত, এবং মৃতদেহের শরীরের বাকি অংশের মাংস ভক্ষণ করতো এই অনুস্থানের সকল অংশ-গ্রহনকারীরা! এর সাথেই, পরের বছরে আবার যাকে বলি দেওয়া হবে, তার নামও ঘোষণা করা হত এই অনুষ্ঠানে।” থামলেন সুধাময় বাবু।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে, আমি এতক্ষণ শুনছিলাম এই নিদারুণ বর্বরতার কথা। তিনি বলা শেষ করতেই আমি তাকে বলে উঠলাম সেই অদ্ভুত ছড়াটার কথা, যা অলোকেশ বাবু তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন। সেটা শুনেই তিনি মৃদু হেসে বলে উঠলেন,
“এটার অর্থ বুঝতো গেলে এজটেকদের বিষয়ে আরো কয়েকটা কথা জানতে হবে! ‘তেজকাৎলিপোকা’-কে ‘উত্তর দিকের দেবতা বা ধূমায়িত আয়নাও’ (Smoking Mirror) বলা হয়। ‘তার সর্বদা সূর্যের তাপ চাই’ মানে হল, যে তার উদ্দেশ্যে সর্বদা নরবলি দিয়ে হৃৎপিন্ডগুলিকে আহুতি দিতে যেতে হবে।”
“এজটেকদের পুরান অনুযায়ী ‘জাগুয়ার’ হল এই দেবতার বাহন, বা বলা যেতে পারে তার আর এক রূপ। এই বিশ্বের সৃষ্টির সময় এই দেবতার একটি পা খেয়ে নেয় সিপাৎলি নামক এক সামুদ্রিক দানব, তাই সে ‘একপায়ে’! এছাড়াও এরা মনে করে ‘স্বর্গের’ তেরোটি স্তর আছে, যার ‘দশম’ স্তরে বাস করেন এই দেবতা। আরো জানতে হবে, যে এজটেকদের ক্যালেন্ডারে কুড়ি দিন করে ‘আঠেরোটি’ মাস আছে, যার ‘পঞ্চম’ মাসে পালিত হত এই অনুষ্ঠানটি।”
“এখানে ‘একপেয়ে জাগুয়ার’ বলতে কিন্তু ওই দেবতাকে বোঝানো হচ্ছে না, বোঝানো হচ্ছে সেই দেবতারূপী মানুষটিকে। শুধুমাত্র তাকেই যদি সেই দেবতার কাছে ‘দশম স্বর্গে’ পাঠানো যায়, অর্থাৎ বলি দেওয়া যায়, তাহলে ‘সমাপ্ত হবে অষ্টাদশীর পঞ্চম শাপ’ অথাৎ পরবর্তী ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আর অন্য কাউকে বলি দেওয়ার দরকার হবে না!”, যথার্থ ব্যাখ্যা দিলেন সুধাময় বাবু।
ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। গ্রন্থাগার বন্ধ হওয়ার সময়। সুধাময় বাবুর এজটেকদের সম্বন্ধে জ্ঞান দেখে আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম তার দিকে। তারপর হঠাৎ কি মনে হতে, আমি তাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে, দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেলাম সেখান থেকে!
(৮)
মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করতে করতে, মাঝ রাতের দিকে দুই চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিলো নন্দিনীর। হঠাৎ একটি তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। আওয়াজটা এসেছে বাড়ির সদর দরজার দিক থেকে! সে রাতের অন্ধকারের মধ্যে পড়ি মরি করে ছুটে গেল সেদিকে। তার আন্দাজ মতোই হাট করে খোলা রয়েছে দরজার দুই পাল্লা, ভাঙা অবস্থায় রয়েছে ভেতরের ছিটকিনিটা! অর্থাৎ এখনই কেউ এই বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে! সেই মুহূর্তে তার মনে হল একটি পুরুষের ছায়ামূর্তি যেন নিজের কাঁধের ওপরে কিছু নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে ওপরে চলে যাচ্ছে! আর তাকে চিনতে বাকি রইল না নন্দিনীর, সেও সেই ছায়ামূর্তির পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো, আর চিৎকার করে উঠলো, “অলোকেশ!…..দাঁড়াও…..দাঁড়াও, অলোকেশ!”
মুখ বাঁধা অবস্থায় মাধুকে কাঁধে নিয়ে অলোকেশ ছুটে গিয়ে ঢুকে গেল চিলেকোঠার ঘরে! তারপর ভেতর থেকে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করতে গেলে, নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নন্দিনীও দরজায় ধাক্কা মেরে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। মুখ বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো মাধুর শরীর, ওদিকে অলোকেশ ছুটে গিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো সেই ঘরের দরজা। এরপর সে একটি বিকট শব্দ করে কুৎসিত হাসি হেসে বলে উঠলো, “ঠিক আছে, ঘরের ভেতর ঢুকেই যখন পড়লে, তখন মাধুকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার দৃশ্যটা না হয় নিজের চোখেই দেখবে!”
“তুমি…..তুমি মাধুকে মারতে চলেছো!….অলোকেশ, মাধু আমাদের একমাত্র সন্তান…..তুমি কি করে…..”, আতঙ্কিত গলায় বললো নন্দিনী।
“কি করবো বলো, আর যে অন্য কাউকে জোগাড় করতে পারলাম না আজকে!”, দাঁত বের করে হাসতে লাগলো অলোকেশ।
“কিন্তু…..কিন্তু তুমি এমন কেন করো, অলোকেশ? এইভাবে কোন মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করে কি লাভ হয় তোমার?” চিৎকার করে ওঠে নন্দিনী।
“তাহলে তোমাকে সব কিছু খুলেই বলি আজ” এই বলে অলোকেশ নন্দিনীকে বলতে লাগলো এজটেকদের দ্বারা পালিত ‘টক্সকাৎল’ অনুষ্ঠানের সমস্ত বিবরণ! তারপর নন্দিনীর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে সে বললো, “তুমি নিশ্চয় ভাবছো, যে আমার সাথে কি সম্পর্ক এই প্রাচীন প্রথার, তাই তো? তাহলে শোনো……..”
“হয়তো কোন পূর্বজন্মে আমিই ছিলাম তেমনই এক হতভাগ্য শত্রুপক্ষের সৈন্য যাকে এজটেকরা এই অনুষ্ঠানে বলি দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলো, প্রথা অনুসারে তার এক মাস আগে আমার সাথে বিবাহ দেওয়া হয় চারজন যুবতীকে। এমনই এক যুবতীর সাথে আমার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ট হয়ে উঠলো, সে আমাকে ভালোবেসে ফেললো। সে চাইতে লাগলো, যে আমাকে যেন তাকে হারাতে না হয়! পরিকল্পনা মাফিক, যে গোপনে লোক পাঠালো সেই পুরোহিতের বাড়িতে, যে দুই দিন পরেই আমাকে বলি দিতে চলেছে! তার দ্বারা জোগাড় করা এক প্রকার বিষাক্ত ব্যাঙ-এর বিষ তারা মাখিয়ে দিয়ে এলো সেই চাকুটার ফলার ওপর, যেটা দিয়ে সে আমার বুক চিরে হৃদপিন্ড বার করতে চলেছে!”
“আগেই বলেছি, নরবলি দেওয়ার আগে, সেই পুরোহিতকে নিজের শরীরের কোন অংশ একই চাকু দিয়ে কেটে দেবতাকে নিজের রক্ত উপহার দিতে হয়! সেই অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা মাফিক, সেই বিষাক্ত চাকু দিয়েই সে তার জিব কেটে রক্ত উপহার দিতে যায় দেবতাকে! ব্যাস, তার রক্তে সেই বিষ মিশে গিয়ে, আমাকে বলি দেওয়ার আগেই, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। সেই অনুষ্ঠানের বাকি কর্মকর্তারা এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তারা মনে করলেন, যে দেবতা আমাকে বলি হিসাবে নিতে অস্বীকার করলেন, তাই মৃত্যু হল পুরোহিতেরই! ব্যাস, মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গেলাম আমি!”
“কিন্তু কাজ অসমাপ্ত রেখে সেই পুরোহিতের আত্মা শান্তি পেল না। সে আমাকে অভিশাপ দিলো, যে যতদিন না আমাকে হত্যা করে, আমার বুক চিরে হৃৎপিন্ডটি দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হচ্ছে, ততদিন আমাকেই বিভিন্ন মানুষকে একই ভাবে বলি দিয়ে তাদের হৃৎপিন্ডকে আহুতি দিতে হবে এই পাত্রে। ওই পুরোহিতের প্রেতাত্মাকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমি, সে এখনও এই ঘরেই উপস্থিত!”
“প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারতাম না আমি, এই দুঃস্বপ্নগুলোকে দেখেই চিৎকার করে ঘুম ভেঙে যেত আমার, উচ্চারণ করতাম অসংলগ্ন কিছু এজটেক শব্দ! কিন্তু সেই কিউরিওর দোকানে এই পাত্রটি দেখে সব কথা মনে পড়ে গেল আমার। তাই সেটাকে কিনে আনলাম এই বাড়িতে! সেদিন থেকেই বুঝতে পারলাম যে এই পুরোহিতের প্রেতাত্মার রোষ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল, আমাকেই প্রতিনিয়ত একটি করে মানুষের হৃদয় আহুতি দিতে হবে এই পাত্রে। এই বিষয়টাই ধাঁধার আকারে লিখেছিলাম আমি ডায়েরির পাতায়।”
নন্দিনী চিৎকার করে ছুটে এলো মেঝেতে পড়ে থাকা মধুর কাছে, তারপর সে বললো, “না অলোকেশ, না…….মাধুকে হত্যা করতে কিছুতেই দেবো না আমি তোমাকে…..কিছুতেই না!” নন্দিনী মাধুকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে, অলোকেশ ছুটে এসে এক ঝটকায় তাকে কেড়ে নিল নন্দিনীর কাছ থেকে। নন্দিনী তাকে বাধা দিয়ে চাইলে, সে সপাটে তার চুলের মুঠি ধরে তাকে নিক্ষেপ করলো ঘরে দেওয়ালের গায়ে। নন্দিনী গিয়ে আছড়ে পড়লো সেদিকে, দেওয়ালের গায়ে সশব্দে মাথা ঠুকে গিয়ে, রক্তাক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে সে ঢলে পড়লো ঘরের মেঝেতে!
আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অলোকেশ নিজের পকেট থেকে বার করলো একটি বাঁকানো ছোরা! তারপর উদ্যত হল সেটা ছোট্ট মাধুর বুকে বসানোর জন্য!….কিন্তু যে মুহূর্তে তার সেই হাতটি মেঝের ওপর শোয়ানো মাধুর শরীরের ওপর নেমে আসতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ভেঙে, সেই ঘরে প্রবেশ করলাম আমি! মাধুর শরীর স্পর্শ করার আগেই আমি ছুটে গিয়ে ধরে ফেললাম ছোরাটির তীক্ষ্ণ ফলাটিকে! আমার হাত কেটে টিপ টিপ করে রক্ত ঝরতে লাগলো মাধুর বুকের ওপর!
“কে রে তুই? ওহ, বুঝেছি! নন্দিনীর সেই নপুংসক নাগর, জমিদার শিলাদিত্য চৌধুরী বুঝি? অনেক শুনেছি তোর কথা!”, গর্জে উঠলো অলোকেশ।
“মাধুকে ছেড়ে দিন, মিস্টার বাসু…..ভুলে যাবেন না সে আপনার সন্তান!”, প্রত্যুত্তরে বলে উঠলাম আমি। অলোকেশ অবাক হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। এক টানে ছোরাটিকে সরিয়ে নিলো আমার হাতের ভেতর থেকে! আমি আবার চিৎকার করে বলে উঠলাম, “আপনার যদি কাউকে হত্যা করতেই হয়, তাহলে আমি আছি তার জন্য…..আমাকে মেরে আমার হৃৎপিন্ড উৎসর্গ করুন আপনার দেবতার কাছে…..কিন্তু মাধুকে ছেড়ে দিন!…ওকে ছাড়া যে নন্দিনী বাঁচবে না!”
“বাবা, এখনো এতো দরদ তোর নন্দিনী আর মাধুর প্রতি!….ঠিক আছে, যেমন তুই বলিস!”, একটি পৈশাচিক হাসি হেসে বলে উঠলো অলোকেশ, “নে, চিৎ হয়ে শুয়ে পর দেখি মেঝের ওপর…..আমার হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই!”
আলোকেশের কথামত মাধুর শরীরের পাশে শুয়ে পড়লাম আমি! ছোরাটি হাতে নিয়ে আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো সে! মনে মনে ভাবলাম, এমনিতেই তো অভিশপ্ত জীবন আমার, লাভ কি আর বেঁচে থেকে! ক্ষতি কি, যদি নিজের জীবন দিয়ে মাধুকে নন্দিনীর কোলে আবার ফিরিয়ে দিতে পারি! মৃত্যভয়ে চোখ বন্ধ করে নেবার নেওয়ার আগে স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে অলোকেশের পেছনে লোভাতুর মুখে আমাদের দিকে চেয়ে আছে সেই অর্ধ-নগ্ন পুরুষের অবয়বটি! আবার কানে আসছে সেই দুর্বোধ্য শব্দগুলো! তার মানে এই হল সেই পুরোহিতের প্রেতাত্মা, সে অপেক্ষা করছে কখন আমার হৃদয়টিকে পাশে রাখা পাত্রে আহুতি দেবে অলোকেশ। আর আতঙ্ক সহ্য করতে না পেরে বন্ধ করে নিলাম দুই চোখ……অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ছোরাটির তীক্ষ্ণ ফলা এসে গেঁথে যাবে আমার পাঁজরের ভেতর!
হঠাৎ অলোকেশের কণ্ঠের একটি তীব্র আর্তচিৎকার শুনে অবাক হয়ে চোখ খুললাম আমি! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম, যে এই ঘরে ওই পুরোহিত বাদেও উপস্থিত হয়েছে আরেকজন অশরীরি, যে নিজের অপার্থিব হাত দিয়ে ধরে আছে অলোকেশের ছোরা ধরা হাতটিকে! সে আর কেউ নয়, আমার বাল্যবন্ধু, শশধর!……শশধরে অবয়ব এক ঝটকায় অলোকেশের দেহটিকে তুলে দিলো শূন্যে!…..আর তারপর তার হাতে ধরে থাকা ছোরাটাই সপাটে গেঁথে গেল অলোকেশের বুকের ভেতর!…ফিনকি দিয়ে ঝরে পড়লো তার রক্তধারা! মৃত্যুযন্ত্রনায় শেষ চিৎকার করে উঠলো সে! শূন্য থেকে নিচে পতিত হল তার রক্তাক্ত দেহ!
ঠিক তখনই তার কাছে ছুটে এলো সেই অর্ধ-নগ্ন পুরোহিতের অবয়বটি, নিজের অপার্থিব হাতের হ্যাঁচকা টানে সে অলোকেশের হৃৎপিন্ডটি বার করে আনলো তার বুক চিরে!….কম্পমান হৃদয়টাকে সে ছুড়ে দিলো পাশে রাখা ওই পাত্রের ওপর! সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো পাথরের পাত্রটিতে! সেই আগুনের তাপে সশব্দে বিস্ফারির হল পাত্রটি, এক নিমেষের মধ্যে ঘরের মেঝেতে পড়ে রইল শুধু ছাই আর পাথরের টুকরো। তার সাথেই অদৃশ্য হয়ে গেল পুরোহিতের প্রেতাত্মা, পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি পেল সে।
ততক্ষণে নন্দিনীর জ্ঞান ফিরে গেছে। সে মেঝে থেকে মাধুকে তুলে নিয়ে, তার মুখের বাঁধন খুলে, তাকে কোলে নিয়ে ছুটে এলো আমার কাছে। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি, নন্দিনী ডুকরে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো আমায়। প্রসন্নতার স্বরে বলে উঠলো শশধরের আত্মা, “আমার নেওয়া পরীক্ষায় তুই পাশ করেছিস, শিলাদিত্য! নারী যে শুধু পুরুষদের ভোগ্যবস্তু নয়, শারীরিক সম্পর্ক না রেখেও যে কোন নারীকে নিজের জীবনের থেকেও ভালোবাসতে পারে কোন পুরুষ…এই কথাগুলিই তোকে দিয়ে প্রমাণ করাতে চাইছিলাম আমি। তুই জানিস, যে নন্দিনীর শরীরটাকে পেতে তুই সক্ষম নোস, তবুও তুই নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচতে চলেছিলিস মাধুকে, যে তোর নিজের সন্তানই নয়…..শুধুমাত্র নন্দিনীকে সুখে রাখার জন্য! সত্যিকারের ভালোবাসা এ ছাড়া আর কি!”
“তাই আজ আমি তোকে মুক্ত করলাম আমার দেওয়া অভিশাপ থেকে। আজ থেকে আর সঙ্গমকালে নন্দিনীর মধ্যে আমাকে খুঁজে পাবি না তুই। শারীরিক এবং মানসিক, উভয় রূপেই নন্দিনী শুধু তোর! সুখে রাখিস নন্দিনীকে…..আর মাধুকে দিস নতুন পিতৃপরিচয়!….আজ থেকে আমি মুক্ত রে শিলাদিত্য, মুক্ত আমি!”, স্বস্তির সুরে বলে উঠলো শশধরের প্রেতাত্মা। তারপর আমার, নন্দিনী আর মাধুর চোখের সামনে ধীরে ধীরে সেই ঘরের বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে গেল তার অবয়ব, আর কখনো ফিরে না আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে!
সেই মুহূর্তে শুনতে পেলাম ভোরের প্রথম পাখির ডাক, সূর্যের হালকা নরম রশ্মি প্রবেশ করলো সেই ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে। নতুন একটা সকালের সাথেই শুরু হল আমার, নন্দিনীর আর মাধুর নতুন এক জীবন!
(সমাপ্ত। গল্পটিতে উল্লিখিত এজটেক সভ্যতার সমস্ত তথ্য যথাসম্ভব সঠিক দেওয়ার চেষ্টা করেছি।)