বহ্নি গর্ভ গল্প
-অণুশ্রী দাস
আজকে বাড়ি ফিরতে কত রাত হয়ে যাবে, সারাদিনের শেষে ট্রেনে জানলার ধারে হাওয়াটা খুব আপন মনে হয়, আবার একটা দিন শুরুর আগে এই হাওয়ার দলই যেন কানে কানে স্পৃহা জাগায়, ফোনটা কেপে উঠল জিন্সের পকেটে, রাহুলের ফোন -কোথায় আছো তপু? আর কতক্ষন লাগবে পৌঁছোতে?
– এখন বালি ছাড়ল… আধাঘন্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব..
বাড়ির দরজা খুলে ঢুকতেই গা টা গুলিয়ে উঠল তামাক পোড়ার ধোঁয়ায়… দূরে হালকা আলো জ্বেলে টেবিলে ঢুলছে প্রসূন,ও আমার অগ্নিস্বাক্ষী করা বর… যদিও আদতে বর্বর…
হাত পা ধুয়ে উঁকি মারলাম ছেলের ঘরে আয়া ওকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে তারপর বাড়ি যায় ৯টার পর। কত নিষ্পাপ ওর মুখটা দেখলেই মায়া হয়, প্রতিদিন আমার কাজে বেড়নোর আগে আমাকে আটকাবে হামাগুড়ি দিয়ে পা ধরে, খুব খারাপ লাগে মনটা মোচোড় দিয়ে ওঠে, তবুও ওকে ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে হয় সময় মতো.. টাকা ছাড়া কিছুই হয় না, বুঝেছি সেটা তাই ওর ভবিষ্যতটা ভালো করার আশায় সকালে বেড়িয়ে পড়ি..
-কি গো খেতে দেবে না আজ, রাত বিরেতে ছেলেকে নিয়ে আদিক্ষেতা করার সময় হয়েছে।
– আহ্ আস্তে… উঠে পড়বে তো রিবান…
সত্যি তো আমি কতটুকু আর সময় দিই রিবানকে, আর মায়ের ভালোবাসা বোঝার কি ক্ষমতা আছে ওর বর্বরটার.. তাই আদিক্ষেতা মনে হয়, নিজের তো সংসার চালানোরই পয়সা জোটে না তারপর নাটকের দল নিয়ে মাতামাতি…
খেয়ে পিঠ পেতেছি ফোনে মেসেজ এল সুর করে… রাহুলের মেসেজ… ‘খেয়েছ? আজ রাতে ফোন করবে প্লিজ..’
রিপ্লাই করলাম..’কেন তোমার বউ আজ বাড়ি নেই..?’
রাহুল আমার কলিগ, আমার থেকে সিনিয়র ওর পজিসন, ও বিবাহিত কিন্তু নিঃসন্তান। বিগ বাজারে সেলসে চাকরিটা পেতে ও আমাকে হেল্প করেছিল। তারপর থেকেই বন্ধু হয়ে যাই, এমনিতে ও গায়ে পড়া গোছের ছেলে । কিন্তু ওর কথাগুলো, ওর সঙ্গ, ওর আমায় এত কেয়ার করে সেটা আমার ভালোলাগে, এই ভালোলাগাটাই কখন ভালোবাসা আর আকাঙ্খা হয়েছে বুঝিনি!
যেমন গরমের দাপটে উষ্ম ফাঁকা স্থান দখল করতে ধেয়ে আসে জলীয়বাষ্প পূর্ণ ভারী বায়ু, তেমনই রুক্ষ, বিরক্তি আর দুশ্চিন্তায় ভরা শূন্য ভালোবাসার জীবনে রাহুল এনেছে আবেগ আর ভালোবাসার নিন্মচাপের বৃষ্টি…
কেঁপে উঠল ফোন টা… ওপারে রাহুলের কাঁপা, আর জড়ানো গলায় আমাকে না পাওয়ার আক্ষেপ, টাল মাটাল কথায় রাত্রি গভীর হয়, ওপারে গলার স্বর বুজে আসে। পাশে সোয়া ছেলের মুখটায় তাকালে অসহায় মনে হয় নিজেকে। প্রসূন আমার সাথে ঘুমোয় না ওর নিজের জগৎ, নিজের ঘর আলাদা।যে মানুষটার শিল্পী সত্ত্বাকে ভালোবেসে পা বাড়িয়েছিলাম আজ সেটাই দূরে সরিয়েছে আমাদের। সংসারে বাড়ন্ত দশায় ছেলের দুধ কেনার পয়সা থাকে না কিন্তু মঞ্চ সজ্জার জন্য টাকা ওড়ানো যায়।
সকাল হলেই ছোটা শুরু …ট্রেনে জায়গা ধরার জন্য হুরোপাটি কখনো তর্কাতর্কি।
-কিরে তপস্যা কাল জমাইষষ্ঠীতে ছুটি নিচ্ছিস তো?
– না রে, আমার আর জামাইষষ্ঠীতে খেতে যাওয়া! প্রসূনেরই সময় নেই ..আর তাছাড়া ছুটি মানেই তো ৩৫০টাকা কাটা। লোককে তো আর বলা যায়না বাপের বাড়িতে আমার কোনো জায়গাই নেই, দাদা ভয় পায় আমি যদি সম্পত্তির ভাগ চাই তাই নানা অছিলায় আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেনা মাকেও রাখতে দেয় না..
-ওই দেখ পরকীয়ার রাধা এসে গেছে।
অফিসে আমাকে ঢুকতে দেখেই কয়েকজন হাসাহাসি করতে শুরু করল…কাজের চাপ তার মধ্যেও এদের কানাকানি করার সময় আছে আমাকে আর রাহুলকে নিয়ে, সত্যি খুব বিরক্ত লাগে মনে হয় কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাই! কিন্তু সে উপায় কি আছে..!
এসব ভাবছি রাহুল পেছন দিক থেকে পিঠে টোকা দিয়ে বলল, -হাই তপু, আজকে একটা গুড নিউজ আছে, আমি টিকিট বুক করেছি ৪টে ৭টা সো তে যাব সিনেমা দেখতে , আমি আর তুমি, আর তোমাকে চিন্তা করার দরকার নেই এদিকটা আমি মেনেজ করে নেব।
সিনেমা হল থেকে আমি বেড়িয়ে এসেছি হাফ টাইম হবার আগেই, রাহুলের কামুক স্পর্শে আমার চোখের সামনে প্রসূনের মুখটাই ভেসে উঠছিল। আমি আমার নিজের বিবেকের কাছে আজ অনেক নীচে নেমে গেছি। নেশার ঘোরের মতো টলতে টলতে বাড়ি ফিরে বিছানায় উজার করেছি নিজের কষ্ট আর দংশনকে…
আমি নিজেই নিজের প্রশ্নের কাছে হতভম্ব একটু করে উপলব্ধি করেছি নিজের ভুলকে। আমি নিজেকে বিকিয়েছিলাম পয়সার জন্য, অর্থ কতটা বদলে দিয়েছিল আমাকে। আমি জানতাম বরাবর প্রসূনকে ওর উদাসীনতাকে কিন্তু তা সত্তেও আমি নিজের সুখ খুঁজতে গেছিলাম পর পুরুষের কাছে। আমাকে রাহুল জানিয়ে দিয়েছিল এই সম্পর্কের স্বীকৃতি সে দিতে পারবে না আমিও চাই নি নিতে …! তাহলে কি মোহে মজেছিলাম আমি… শুধুই অর্থ, আর পজিশন ? এ কোন তপস্যা.. ? আমার মনও আজ অচেনা স্বার্থের ধোঁয়া মাখা কোনো দামী সুগন্ধীতে ম ম করছে। কিন্তু আমি এটা চাই না আমি ঐ তামাকের পোড়া গন্ধকেই যে ভালোবেসেছিলাম…!
ভোররাতে উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম প্রসূনের ঘরে, সেই পুরনো আমার চিরচেনা প্রসূনকে যেন দেখতে পেলাম বহুবছর পর আমার মনের কোনে নিভৃতে ভালোবাসার মন্দিরে যে দেবতার সাধনা করেছি বাস্তবের হানাহানিতে লোভ কামনায় এ মন কি করে হতে পারল অপরের, অসময়ের দাবদাহে একসাথে পথ হাঁটার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমি সেই আমি কি করে বদলে গেলাম….!
সকাল হয়েছে ফুরফুরে রোদ্দুরে… প্রসুনের মাথায় হাত রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি একঝলক জানি না… একটা আলতো হাতের আলাপনে ঘুম ভেঙ্গে দেখি প্রসূন ঠিক আগের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে ওর আঙ্গুল গুলো আমার চুলের ভাঁজে ভাঁজে কথা বলছে।
তারপর ঝড় উঠেছিল দমকা.. এ ঝড় ক্ষয়ের নয়, আঘাতের নয়, নিঃস্ব করা মনখারাপের নয়… এ ঝড় স্তবকে স্তবকে জমা মান অভিমান উড়িয়ে নিয়ে গেছে তার বদলে দিয়ে গেছে ভালোবাসার নবাঙ্কুর, আর অতীতের তপস্যা প্রসূনের চিঠির গান..।