Site icon আলাপী মন

ছলনা

ছলনা
-পারমিতা চ্যাটার্জী

 

 

 

অপরাজিতা নামটা তার বাবার দেওয়া। একটু বড়ো হবার পর বাবা তাকে বলেছিলেন – “মা এই নামের মানে জানতো?” মানে হচ্ছে জীবনে সর্বক্ষেত্রে তুমি অপরাজিত থাকবে।
মেয়ে একগাল হেসে বলেছিল তখন – “হ্যাঁ বাবা আমি নিশ্চয়ই থাকবো।”
ছোট্ট বেলা থেকেই অপরাজিতার নাচে খুব আগ্রহ, গান শুনলেই সে আপনমনে তাল মিলিয়ে নেচে যেত। অপরাজিতার বাবা অনুপমবাবু মেয়েকে ছোট্ট থেকেই ভালো গুরুর কাছে নাচের জন্য ভর্তি করে দেন। এই নাচ নিয়েই তার উত্থান শুরু। সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে সে নাচ শিখেছে। নৃত্য শিল্পী হিসেবে যখন বেশ নাম করেছে তখনই সে নজরে পরে বাংলা ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির একজন নামকরা পরিচালকের। অপরাজিতার বাবা তখন বেঁচে ছিলেন না, থাকলে হয়তো এত বড়ো পদস্খলন তার হতোনা।
সে নাচের জগত থেকে চলে আসে ঝলমলে রূপালী পর্দায়, এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই অভিনেত্রী হিসেবে বেশ নাম করে ফেলে।
বয়েসের দোষে জীবনে তার প্রেম আসে আর ভেসেও যায় এক মিথ্যা প্রেমের জোয়ারে।
সেই পরিচালকই ছিলেন তার প্রেমিক যে তাকে মিথ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমপর্ব চালিয়ে যায়।
এরই মধ্যে একদিন সে বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে। যখন এ কথা সে তার প্রেমিককে জানিয়ে বিয়ে করার কথা বলে তখনই ভালোবাসার মুখোশটা খুলে যায়। লোকটি সম্পূর্ণ রূপে তার সন্তানের পিতৃত্বকে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় ইণ্ডাষ্ট্রিতে রটিয়ে দেয়, ও একটা দুশ্চরিত্রা…কার না কার সাথে কি সম্পর্কে প্রেগন্যান্ট হয়েছে এখন আমাকে ফাঁসাতে চাইছে, বলে কিনা আমাকে বিয়ে করতে? আমার ঘরে স্ত্রী, পুত্র সব আছে আমি কি করতে ওকে বিয়ে করতে যাবো?
এই ঘটনা অনেকে অবিশ্বাস করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও অনেকে কিন্তু বিশ্বাসও করেছিল যারা এইরকম জালে ফেঁসেছিল, কিন্তু ক্যারিয়ার ও সম্মানের ভয়ে সবাই চুপ ছিল।
কিন্তু অপরাজিতা তো হারবার মেয়ে নয়। সে এক ঝটকায় সিনেমা জগত থেকে বেরিয়ে আসে আর বাবার বাড়িতে চলে আসে একদম একলা। শুধু সাথে ছিল বাপেরবড়ির পুরানো লোক রমলামাসী। একমাত্র মেয়ে সে বাবার বাড়ি তাই পুরোটাই তার। বাবার কিছু অর্থ তার জন্য রাখা ছিল, নিজেরও কিছু উপার্জিত অর্থ ছিল। তাই সম্বল করে সে জীবন যুদ্ধে নামে। একসময়ের নৃত্য শিল্পী তার ওপর অভিনেত্রীর তকমা গায়ে লেগেছে, বাড়ির একাংশে সে যখন একটি নাচের স্কুল গড়ে তোলে তখন ছাত্রী পেতে তার অসুবিধা হয়নি।  সেই ছোট্ট স্কুলটি এখন বিখ্যাত এক নৃত্য অ্যাকাডেমিতে পরিণত হয়েছে।
এই সবে সে টিম নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে পারফর্ম করে যথেষ্ট স্বীকৃতি অর্জন করে এসেছে। সামনের মাসে তার কলকাতার এক বিরাট হলে প্রোগ্রাম। তাই ছাত্রীদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যাস্ত।
এদিকে তার মেয়ে তিতাস এখন ক্লাস টেনের ছাত্রী এবার সি.বি.এস.সি. পরীক্ষা দেবে, মেয়েকে ও টিউশন থেকে এনে নিজে হাতে তার প্রিয় ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাইয়ে তবে নাচের মহড়ায় এসেছে।
আজ থেকে দু’বছর আগে তিতাসকে তার জীবনের চরম সত্যটা বলে দিয়েছে। কারণ সে মনে করে সত্য কখনও ঢাকা থাকেনা, একসময় তিতাস ঠিক জানতে পারবে আর তখন তার পক্ষে মেনে নেওয়াটা আরও অনেক কঠিন হবে। তিতাস তখন সবে ক্লাস এইটে পরে, সেসময় সে জানতে চায়, “মা আমার বাবা কি আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছে?”
সে উত্তর দিয়েছিল- “তিতাস তোমার বাবা মারা যায় নি, সে একজন ক্রিমিনাল তাই তার জায়গা এখন জেলে। হ্যাঁ, সব সত্য সেদিন সে মেয়েকে বলে, এবং পরিচালক মহাশয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন কেস চলে, অবশেষে ডি.এন.এ. টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তার কন্যার বাবা কে? তখন বাধ্য হয়ে তাকে স্বীকার করতে হয়- “হ্যাঁ, এই শিশুটি আমার।” এখন শুনেছে দীর্ঘ চোদ্দবছর কারাবাসে থেকে সে মুক্তি পেয়েছে।
তিতাসের বয়স এখন পনেরো।
সে তো অপরাজিতা, কোন ছোট বেলায় বাবাকে কথা দিয়েছিল, বাবা আমি কোনদিন হেরে যাবো না সেই কথা সে রেখেছে।
আজ যখন সে ছাত্রীদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত তখন রমলা এসে তাকে বলে, “দিদি কেউ একজন তোমাকে ডাকছে।”
আমি একটু আসছি, বলে বাইরে এসে যাকে দেখল তাকে দেখার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলনা–“আচমকা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “আবার কি সুযোগ সন্ধানের জন্যে এসেছেন এখানে?”
 “আমার তো অনেক শাস্তি হলো, এবার কি ক্ষমা পাবো?”
“ক্ষমা? যা করেছেন আপনি? তাতে সারাজীবন কোনো ক্ষমা হয়না। ভুলে গেছেন সেদিনের কথা, যেদিন ইণ্ডাষ্ট্রিতে একঘর লোকের সামনে আমাকে বেশ্যা বলে অপমানে জর্জরিত করে নিজের সন্তানের পিতৃত্বকে অস্বীকার করেছিলেন? আমি কোনদিন তা ভুলবো না। আপনি চলে যান এখুনি, আর কোনোদিন এখানে আসার সাহস দেখাবেন না তাহলে আমি আবার পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হবো।
নিঃশব্দে উঠে চলে যাচ্ছে একসময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অম্লান রায়।
অপরাজিতা দাঁড়িয়ে দেখছে, সে চলে যাচ্ছে, তার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা, তার সন্তানের বাবা।
চোখে কি কিছু পরেছে? হবে হয়তো, না চোখের জল এটা নয়।

Exit mobile version