লাজবন্তীর কথা

লাজবন্তীর কথা
-প্রলয় কুমার নাথ

(পর্ব-১)

 

 

আজও কি গিলবো নাকি কয়েকটা?
দুরুদুরু বুকে, ঘুমের ওষুধের ট্যাবলেটের কৌটোটা হাতে নিয়ে ভাবতে বসলো সোনালি। আজও কি বিছানায় শুয়ে, এদিকে ওদিকে ছটফট করতে হবে? চোখ বন্ধ করলেই কি সেই অজানা ছবিটা দুঃস্বপ্নের মতো ভেসে উঠবে চোখের সামনে? আর কতদিন….আর কতদিন তাকে সহ্য করতে হবে, একটু শান্তিতে ঘুমোতে না পারার এই জ্বালা? দু চোখ বুজলেই, কেন ওই দৃশ্যটা বার বার ভেসে আসে চোখের সামনে? কি মনে করিয়ে দিতে চায় সেটা সোনালিকে? এই সব প্রশ্নের উত্তর সোনালি আজ অবধি পায়নি। কৌটোটা খুলে দুটো ঘুমের ওষুধ হাতের তালুর ওপর ঢাললো সোনালি। তারপর সেদুটিকে মুখে ঢুকিয়ে জলের বোতলের ছিপি খুললো। বিছানায় বসে দুহাতের মাঝে মুখ ঢুকিয়ে একবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। বায়োকেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি পাঠরতা সোনালি জানে, যে মানব শরীরে এই ওষুধটি রোজ ব্যবহার করার কুফল কতটা, কিন্তু তার যে কিছুই করার নেই। আর যাইহোক, কিছুক্ষন সাময়িক শান্তি তো দেবে সেটা, কিছুক্ষন তো দু চোখের পাতা এক করতে পারবে সে, কিছুক্ষনের জন্য তো ঝাপসা হয়ে আসবে সেই রোজকার দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবিগুলি!

রোজকার মতোই সকাল দশটা নাগাদ, রাজাবাজারের মোড়ে বাস থেকে নামলো সোনালি। গন্তব্য রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। এই জায়গাটা একদম ভালো লাগে না সোনালির। সবসময়ই যেন চারিদিকে মারামারি, হৈহট্টগোল আর ট্রাফিকের যানজট। এখানে একটা দুর্গন্ধও পাওয়া যায় সবসময়। সোনালি দেখল যে তার বান্ধবী সুচেতাও নাকে রুমাল চেপে ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। সোনালি ওকে ডাকলো,
– এই সুচি, দাঁড়া একটু……আমিও আসছি….
সুচেতা ওকে দেখতে পেয়ে নাক থেকে রুমাল সরিয়ে মিষ্টি হেসে নিজের চলার গতি মন্থর করলো। তারপর সোনালি ওর কাছে এলে জিজ্ঞাসা করল,
– কি রে কাল রাতে কি ঘুম হয়েছে? নাকি সেই এক অবস্থা?
সোনালি ম্লান মুখে বলল,
– এই ইনসমনিয়া বোধহয় আমার আর পিছু ছাড়বে নারে সুচি, কালও খেতে হলো ঘুমের ওষুধ…….ওই একটু হয়েছে কোনোরকমে…..
– আর ওই স্বপ্নটা?
– ওটা ঠিক স্বপ্ন নয় রে সুচি, স্বপ্ন মানুষ দেখে ঘুমিয়ে পড়ার পর, কিন্তু আমি ঐ দৃশ্যটা দেখি চোখ বন্ধ করলেই রে, হয়তো একটু তন্দ্রা এসেছে…….ঠিক তেমন সময়।
– সে যাই হোক, সেটা কালও দেখেছিলিস কি?
সোনালি কোনো উত্তর দিলো না সেই কথার, শুধু একবার ম্লান হাসলো। সুচেতা পেয়ে গেল তার প্রশ্নের উত্তর। পরমুহূর্তেই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য সে বলল,
– ওরে বাপ রে, ঘড়ির দিকে চোখ আছে? দেখ দশটা পঁচিশ! সাড়ে দশটায় এ.কে.জি-র ক্লাস…….এক মিনিট দেরি হলে আর ঢুকতে দেয়না…..চল, চল……

সোনালি বরাবরই পড়াশোনায় খুব ভালো ফল করে এসেছে। শ্রীরামপুরের আকনা গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী সে। স্কুলের এক থেকে পাঁচজনের মধ্যে তার নাম প্রতিটা ক্লাসেই থেকেছে। তারপর শ্রীরামপুর কলেজ থেকে কেমিস্ট্রি ওনার্স। সেখানেও তার কলেজের মধ্যে সব থেকে বেশি ছিল তার প্রাপ্ত নম্বর। এরপর প্রথম মেধা তালিকাতেই সে পড়ার সুযোগ পায় বায়োকেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। সোনালি বরাবরই ইচ্ছা গবেষক হওয়ার, আর এখানে সেটার পরিপূর্ণ সুযোগ। ব্যাংকে উচ্চ পদে কর্মরত তার বাবাও যথেষ্ট উন্নত-মনস্ক, তিনি সবসময়ই চেয়েছেন যে তার মেয়ে যেন জীবনে অনেক বড় হয়, সে যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, কখনো কারোর গলগ্রহ হয়ে সে যেন দিনপাত না করে। খুব অল্প বয়সেই সোনালি তার মা কে হারায়, তাই বাবাকেই ছোটবেলা থেকে তার বাবা এবং মা, এই দুজনেরই সম্পূর্ন দায়িক্ত পালন করে আসতে দেখেছে সে। নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবতী মনে করত সে, সবই তো ঠিকঠাক হয়ে আসছিল তার জীবনে এতদিন। কিন্তু হঠাৎ করেই, প্রায় একবছর ধরে, তাকে দেখা দিচ্ছে এই দুরূহ সমস্যাটা যার কোনো ব্যাখ্যা সে আজ অবধি পায়নি।

দুটো পরপর টানা ক্লাস, প্রতিটা এক ঘন্টা করে। এখন ক্লাসে বেশ অমনোযোগী হয়ে উঠেছে সে, সেটা নিজেই বুঝতে পারে সোনালি। কোনো কিছুই আর যেন তার মাথায় ঢুকছে না, সবসময় যেন একটা ক্লান্তি আর ঝিমুনি ভাব বিরাজ করছে ওর সর্বশরীরে। পড়াশোনার বাইরেও তো লোকে আরো কতকিছু করতে আসে কলেজে, এই যেমন ক্লাস চলাকালীন, সুচেতা এ.কে.জি-র দিকে কম আর তন্ময়ের দিকে বেশিই চেয়ে আছে, যেন সবসময় চোখের ঈশারাতে কথা হচ্ছে ওদের দুজনের মধ্যে……এমন প্রেম পিরিতি তো সেও করতে পারে কোনো সুপুরুষ নবযুবকের সঙ্গে। কিন্তু কই, তার তো এসব কিছুই ভালো লাগে না। এক বার তাকিয়েও দেখে না ক্লাসের ছেলেগুলোর দিকে। সবসময়ই যেন নিজের সেই সমস্যাটা নিয়ে ব্যস্ত সে…..ধুর, ভালো লাগে না কিছু!

দ্বিতীয় ক্লাসটির অধ্যাপক ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই ক্লাসটা ক্লাবে পরিনত হল। এরপর বোধহয় ক্লাস নেই খুব একটা, বেশিরভাগ ছেলে মেয়েরাই ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ল বেরোবার তাগিদে। কেউ বাড়ি ফিরবে, কেউ বা তার প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে যাবে কোনো পার্কে, কেউ বা যাবে সিনেমায়……এই নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল সকলের মধ্যে। সোনালির গন্তব্য শুধুই তার বাড়ি। সে ব্যাগ গুছিয়ে ওঠার আগেই সুচেতা ওর কাছে এসে বলল,
– সোনু শুনেছিস, আজ নাকি সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে একটা সেমিনার আছে দুপুর তিনটে থেকে।
সোনালি ওর কথায় খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বলল,
– হুম……
সুচেতা এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
– ওফ……শুনছিস তুই? আজ সেখানে একজন খুব ইয়াং গবেষক স্পিচ দিতে আসছেন………ড: তুষার মল্লিক……..যাবি নাকি?
– নাহ, তুই গেলে যা, সুচি…..
সুচেতা মুচকি হেসে বলল,
– আর টপিকটা যদি হয় “দা ডার্ক সাইড অফ আনকনসিয়াস মাইন্ড: ইন্টারপ্রিটেশন এন্ড এনালাইসিস”……..তাহলেও যাবি না?
একবার সুচেতার দিকে তাকিয়ে ভাবলো সোনালি। যে ব্যাপারে বক্তব্য রাখতে চলেছেন সেই গবেষক, তা সোনালির সমস্যার সাথে অনেকটাই মেলে। সত্যিই তো, এতদিন ধরে শুধু ঘুমের ওষুধ খেয়ে গেছে সে, কখনো তো কোনো সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করার কথা ভাবেনি! আজকাল এসবেও নাকি বেশ লাভ হয়েছে অনেক মানুষের। যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার…….এই সব সাত পাঁচ ভেবে সেখানে যেতে রাজি হলো সোনালি।

সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমটাকে আজ খুব ভালো করে সাজানো হয়েছে। রাখা হয়েছে সারি সারি চেয়ার শ্রোতাদের জন্য। মস্ত বড় স্টেজে গন্যমান্য অতিথিদের বসার জায়গা, সেখানে রাখা নতুন জলের বোতল আর ফুলদানি, প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য প্রজেক্টরের পর্দা, বলার জন্য মাইক্রোফোন আর তার সাথে বড় দুটো সাউন্ড বক্স……..এসবের পরিপাট্যেও কোনো কমতি নেই। আসতে আসতে শ্রোতায় ভরে গেল গোটা হল ঘর। সুচেতা আর সোনালি সামনের দিকেই বসেছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হলো অনুষ্ঠান। প্রথমেই সাইকোলজির হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট-এর সাথে প্রবেশ করলেন বাকি সমস্ত অধ্যাপক অধ্যাপিকারা। তারা তাদের আসন গ্রহল করলে, হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট একটি ছোটো ভাষণ দিয়ে শ্রোতা দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আজকের সেমিনারের মূল বিষয় বস্তু। এর সাথেও ড: তুষার মল্লিকের উজ্জ্বল কেরিয়ারের সম্বন্ধেও দু চার কথা বললেন। এর পর শ্রোতাদের মধ্যে থেকেই এক জন করে করে ছাত্র ছাত্রীদের স্টেজে ডেকে নেওয়া হলো স্টেজের সমস্ত অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। সোনালি আর সুচেতা অধীর আগ্রহে বসে ছিল ড: তুষার মল্লিককে দেখার জন্য।

অবশেষে স্টেজে উঠে সকলকে নমস্কার জানালেন একজন সুপুরুষ যুবক। লম্বা, ফর্সা চেহারা, ঢেউ খেলানো চুল, লম্বা মুখ, টিকলো নাক এবং চোখে রিমলেস চশমা। ইনিই হলেন ড: তুষার মল্লিক, সে কথা ঘোষণা করলেন হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট। সোনালি হা করে তাকিয়ে ছিল তার দিকে, কোথায় যেন…..এর আগে কোথায় যেন…….সে দেখেছে এই ভদ্রলোকটিকে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না সে। সে মস্তিষ্কে আরো চাপ দেওয়ার চেষ্টা করল, যেন কয়েকটা আবছা ছবি দেখতে পাচ্ছে সে ওই পুরুষটির, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও স্পষ্ট হচ্ছে না তা কিছুতেই! জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল সোনালি, এই এ.সি ঘরেও ঘেমে উঠল সে। এমন সময় সুচেতা ওকে কুনুইয়ের গুঁতো মেরে বলল,
– কি রে…..ওঠ……যা……তোকেই তো হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট ডাকছেন তুষার বাবুকে ফুলের তোড়া দেওয়ার জন্য……
অগত্যা কম্পিত শরীরে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো সোনালি। ওপরে উঠে ফুলের তোড়াটা ট্রে থেকে নিয়ে দিতে গেল তুষারবাবুকে………কিন্তু, হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল সোনালির! উন্মাদের মতো, ফুলের তোড়াটা নিচে ফেলে দিয়ে, রাগে গর্জন করতে করতে চিৎকার করে ছুটে গেল সে তুষারবাবুর দিকে। তারপর তার জামার কলার ধরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
– তোকে শেষ করে দেবো আমি…….শেষ করে দেবো…….কিছুতেই বাঁচতে দেবো না আমি তোকে………কিছুতেই না……চিনতে পারছিস আমি কে?…….কি রে চিনতে পারছিস?……আমি লাজবন্তী……..সেই লাজবন্তী রে………সেই লাজবন্তী!

                                                                (পর্ব-২)

 

সোনালির এই অদ্ভুত আচরনে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন তুষার বাবু। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা অবধি করলেন না। এই অবাক করা দৃশ্য দেখে হৈ-হৈ করে উঠল শ্রোতার দল, তাদের মধ্যে কারোর কারোর বেশ মনোরঞ্জনই হচ্ছিল এই দৃশ্য দেখে। তারা আবার আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। স্টেজের সমস্ত অধ্যাপকরা ছুটে এলেন সোনালি আর তুষার বাবুর দিকে, সুচেতাও ছুটে চলে এলো স্টেজের ওপরে। ওরা সবাই এসে দেখল, ততক্ষনে শিথিল হয়েছে, তুষার বাবুর জামার কলার ধরে থাকা, সোনালির দুই হাতের মুঠো। সে আসতে আসতে চোখ বন্ধ করে টাল সামলাতে পারল না, হয়তো পড়ে যেত নিচে, কিন্তু সেই সময়ই তুষার বাবু তার বলিষ্ঠ দুই বহু দিয়ে আঁকড়ে ধরে ফেললেন সোনালির দেহ। চিৎকার করে তিনি বললেন,
– কেউ একটু জল নিয়ে এসো…….তাড়াতাড়ি……

সোনালির যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে সায়েন্স কলেজের লেডিজ কমন-রুমে। সেখানে একটা বেঞ্চের ওপর শুয়ে আছে সে। তার চারিদিকে কলেজের অন্যান্য ছাত্রীরা কৌতূহলী মুখে চেয়ে আছে তার দিকে। সুচেতাও তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালি চোখ মেলে উঠে বসলেই, সুচেতা বাকি সব মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলল,
– দেখেছিস তো সবাই…..ও ঠিক আছে……এখন তোরা সব যা, আশা করি, ওকে হাজার প্রশ্ন করে আরো অসুস্থ করে তুলতে চাইবি না কেউই……
বাকি ছাত্রীরা চলে গেলে, সুচেতা সোনালির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– এখন কোনো প্রবলেম হচ্ছে না তো আর তোর……আর একটু জল খাবি?
সোনালি করুন চোখে সুচেতার দিকে তাকিয়ে বলল,
– সুচি……সুচি, কি হয়েছিল রে আমার? কি করছিলাম আমি? কি বলছিলাম, হ্যাঁ?……. কেন জ্ঞান হারালাম আমি?
ভয়ার্ত কণ্ঠে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সোনালি। সুচেতা কৌতূহলী স্বরে সোনালিকে জিজ্ঞাসা করল,
– তুই কি ড: তুষার মল্লিককে আগে কোথাও দেখেছিস?
সোনালি আতঙ্কে সুচেতার বুকের সালোয়ার খামচে ধরে বলল,
– মনে করতে পারছি না…….মনে করতে পারছি না রে, কিছুই মনে করতে পারছি না…..
সুচেতা ওকে আবার সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞাসা করল,
– এছাড়া…….তুই তুষার বাবুর জামার কলার ধরে বলেছিলিস যে তুই নাকি তাকে বাঁচতে দিবি না………
সোনালি এবার ছুটে গিয়ে কমন রুমের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করল, সুচেতা তখনই বলে উঠল,
– তুষার বাবুকে খুঁজে লাভ নেই রে সোনু, এখন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা বাজে……সেমিনার অনেক্ষন আগেই শেষ হয়ে গেছে, তিনি চলে গেছেন……তবে যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে তোর একটা খোঁজ অবশ্যই নিয়েছিলেন…….
সোনালি আবার ছুটে এলো কমন রুমের মধ্যে, তারপর পাগলের মতো সুচেতাকে ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– আর কি বলেছিলাম আমি তখন……বল সুচি, বল…..আর কি বলেছিলাম আমি?
– তুই বলেছিলিস যে তোর নাম হলো লাজবন্তী!
সোনালি কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে রইল। সুচেতা আবার জিজ্ঞাসা করল,
– কে এই লাজবন্তী, সোনু?……..কে এই লাজবন্তী?
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে সোনালি বলে উঠল,
– জানিনা…….আমি কিছু জানিনা রে……..কিছু জানিনা আমি……
সুচেতা এবার ওর কাছে এগিয়ে এসে ওর দু কাঁধ ধরে ফিসফিস করে বলল,
– সোনু, আমার মন বলছে…….এতদিন ধরে তোর সাথে যা কিছু ঘটে চলেছে, তোর সেই সব ঘুমহীন রাত্রির জ্বালা যন্ত্রনা, সেই অদ্ভুত দৃশ্যগুলো……..হোক না হোক…..এগুলো কোনোভাবে এই “লাজবন্তী”-র সাথে জড়িয়ে আছে……সোনু, তোকে খুঁজে বার করতেই হবে, এই লাজবন্তী কে ছিল……তোকে করতেই হবে এই লাজবন্তীর রহস্যের সমাধান……
অধৈর্য হয়ে সোনালি বলল,
– কে বলবে আমায়, যে এই লাজবন্তী কে ছিল, বল?…….কে করবে এই রহস্যের সমাধান?
সুচেতা একটু মৃদু হেসে বলল,
– তুই তো এই “লাজবন্তী” নামটা আগে কখনো বলিসনি……তোর হঠাৎ তুষার বাবুকে দেখেই কেন মনে পড়ে গেল এই নামটার কথা?…….তাই আমার মতে, তোকে যদি এই বিষয়ে সব থেকে বেশি কেউ সাহায্য করতে পারেন, তা হল খোদ তুষার বাবু……
সোনালি বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল সুচেতার দিকে, সুচেতা আবার বলে উঠল,
– তোর কোনো চিন্তা নেই, সোনু…….আজকে উনি যখন আমায় তোর কথা জিজ্ঞাসা করেন, তখনই আমি তার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে রেখেছি, আর তাকে বলেও রেখেছি যে কালই আমি তোকে তার কাছে নিয়ে যাব……..

পরদিনই ওরা কলেজ কমাই করে ড: তুষার মল্লিকের বাড়িতে গেল। তুষার বাবুর বাড়িটা ভবানীপুরে, ইন্দিরা সিনেমা হলের খুব কাছেই। বেশ বড় সেকেলে আমলের দোতলা বাড়ি। দরজার গায়ে বড় বড় ইংরাজি হরফে লেখা “ড: তুষার মল্লিক, এম.বি.বি.এস, এম.ডি – সাইকিয়াট্রিস্ট।” তার পেশেন্ট দেখার চেম্বারটি বাড়ির নিচের তলায়। তবে আজ সেখানে কেউ নেই। বোঝাই যাচ্ছে যে উনিও বেশ অভিভূত হয়ে সোনালি আর সুচেতার অপেক্ষায় আছে। তবে আজ সোনালি আর সুচেতার সাথে, সুচেতার বয়-ফ্রেন্ড তন্ময়ও এসেছে সেখানে। ডোর-বেল বাজাতেই, দরজা খুললেন স্বয়ং তুষার বাবু। সাদা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে আছেন তিনি, মুখের দাড়ি চকচকে করে কমানো, মাথার চুল পরিপাটি করে ব্যাক-ব্রাশ করা। তাকে যেন আজ, আগের দিনের থেকেও, আরো বেশি সুপুরুষ লাগছে। সোনালির যেন চোখ সরছিল না তার দিক থেকে। এটা বুঝতে পেরে সুচেতা আর তন্ময় নিজেদের মধ্যে একবার চোখ টিপে মুচকি হেসে উঠল।

ওরা সবাই একসাথে গিয়ে বসল তুষার বাবুর চেম্বারের ভেতর। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো ঘরটি, চারিদিকের সো-কেসে মধ্যে কতই না মনোরোগবিদ্যার বই রাখা রয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাড়ির কাজের লোক সকলের জন্য কফির ট্রে নিয়ে হাজির হল। কাঁচে ঢাকা টেবিলের ওপর পেপার-ওয়েটটা একবার নাচিয়ে, সবার আগে নীরবতা ভাঙলেন খোদ তুষারবাবু, বললেন,
– তোমরা সাইকোএনালিস্ট সিগমান্ড ফ্রেউড-এর নাম শুনেছ?
ওরা সবাই এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। তুষারবাবু আবার বলতে লাগলেন,
– ফ্রেউড-এর মতে, মানুষের মনের তিনটে স্তর আছে। এই মুহূর্তে চলাকালীন সমস্ত মনের ভাবনা, যা আমরা বিচার বিবেচনা করে প্রমান করতে পারি, তা থাকে আমাদের কনসিয়াস মাইন্ড-এ……….এরকমই পূর্বের কোনো স্মৃতি, যা দরকার হলে আমার আবার নিজের মগজে নিয়ে এসে বিচার বিবেচনা করে প্রমান করতে পারি, তা থাকে আমাদের প্রিকনসিয়াস মাইন্ড-এ……..
ওরা স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগল। তুষারবাবু বলে চললেন,
– আর আমাদের মনের সবথেকে বড় স্তরটা হলো আনকনসিয়াস মাইন্ড, যার মধ্যে এমন কোনো স্মৃতি জমা হয়ে থাকে যা এই মুহূর্তে আমাদের বিচার বিবেচনার বাইরে বলে মনে হয়………তবে যে পরিস্থিতিতে সেই স্মৃতিগুলো আমাদের মনে জমেছে, সেই পরিস্থিতিতে আবার ফিরে গেলে, তা মনে পড়লেও পড়তে পারে…….
একটু থেমে তিনি সোনালিকে বললেন,
– আমার মনে হয় তোমার আনকনসিয়াস মাইন্ড-এ এমনই কোনো স্মৃতি লুকিয়ে আছে, যার রহস্যভেদ করতে গেলে আমার দরকার যেকোনো একটা ক্লু……যার সাহায্যে আমি তোমাকে সেই জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, যেখান থেকে তোমার মনে ওই স্মৃতিগুলির সৃষ্টি হয়েছে……..তবে তার জন্য তোমাকে আমার থেরাপির মধ্যে আসতে হবে……..বলো, তুমি কি রাজি?
কিছুক্ষন ভেবে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে, সোনালি কম্পিত গলায় বলল,
– হ্যাঁ……আমি রাজি!

                                                             (পর্ব-৩)

কথাটা বলার পরেও একবার সুচেতার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সোনালি। সুচেতা চোখের ইঙ্গিতে ওকে আশ্বাস দিয়ে, তুষারবাবুকে জিজ্ঞাসা করল,
– অবশ্যই মিস্টার মল্লিক, আমরা তো সকলেই চাই, যে এতদিনের এই মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাক সোনালি……..আর তাছাড়া, আমাদের জানতেই হবে এই “লাজবন্তী”-র সাথে কি সম্পর্ক ওর…….তবে আপনার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, মিস্টার মল্লিক, আপনার থেরাপির মধ্যে গেলে, ওর কোনো ক্ষতি হবে না তো?
তুষারবাবু একটা মিষ্টি হেসে বললেন,
– এ কথা মানতেই হবে যে, যেকোনো ধরনের ট্রিটমেন্টের যেমন এফেক্ট আছে, তেমন সাইড-এফেক্টও আছে, এখন আমাকে বুঝতে হবে আমার কোনটা দরকার…….সারা জীবন ধরে ঘুমোনোর আগে ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলির সম্মুখীন হওয়া, নাকি থেরাপির মধ্যে এসে তার সাইড-এফেক্টে জর্জরিত হওয়া…….
সোনালি হঠাৎ অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠল,
– তুই আর উনাকে কিছু বলিস না রে, সুচি……..আর বাধা দিস না উনাকে……..আমার যা হওয়ার তা হবে, কিন্তু নিজের মনের ভেতর লুকোনো সমস্ত স্মৃতি আমাকে উদ্ধার করতেই হবে………আমাকে জানতেই হবে এই “লাজবন্তী”-র সাথে কি সম্পর্ক আমার….এর জন্যে যদি আমাকে মরতেও হয় আমি রাজি আছি……এরকম ভাবে রোজ মরে মরে বেঁচে থাকার চেয়ে, একবারে মরে যাওয়া অনেক ভালো…….
দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সোনালি। সুচেতা ওর কাছে এগিয়ে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিতে লাগল, তারপর তুষারবাবুর দিকে তাকিয়ে, সে দৃড় গলায় বলল,
– আপনি শুরু করুন, মিস্টার মল্লিক……….

তুষারবাবু ওদের পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের, শুধুমাত্র ঢোকা আর বেরোবার জন্য একটা দরজা আছে মাত্র। কিন্তু কোনো জানলা নেই সে ঘরে, অর্থাৎ বাইরের আলো প্রবেশ করার কোনো জায়গাই নেই সেখানে। এমনকি এই ঘরে কোনো লাইটের ব্যবস্থাও নেই, আছে শুধু একটা এ.সি। চারিদিকের কালো রং করা দেওয়ালগুলো যেন ঘরের জমাটে অন্ধকারটাকে আরো গাঢ় করে রেখেছে। সে ঘরে কোনো আসবাসপত্র নেই, আছে শুধু পেশেন্টের জন্য একটি বেড, আর কয়েকটি চেয়ার। বোঝাই যাচ্ছে, এই মূহুর্তের বাইরের জগতের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ থেকে বঞ্চিত হয়ে, শুধুমাত্র নিজেই নিজেকে খোঁজার আদর্শ জায়গা এটা। তুষারবাবু সোনালিকে বললেন ওই বেডে গিয়ে বসতে, আর সুচেতা আর তন্ময়কে কাছে রাখা চেয়ারগুলি দেখিয়ে দিলেন, তবে মুখের ইশারায় জানালেন, যে তার ট্রিটমেন্ট চলাকালীন কোনো সাড়াশব্দ করা চলবে না। এরপর তিনি একটা ওষুধের স্ট্রিপ থেকে একটা ট্যাবলেট বার করে সোনালির কম্পিত হাতে দিলেন। তারপর বললেন,
– ভয় নেই, এটা একটা মাইল্ড ট্রানকুইলাইসার, এটা খেলে তোমার সাময়িক এংসাইটি কিছুটা হলেও কমবে…….
সোনালি কোনো কথা না বাড়িয়ে মুখে পুড়ল সেটা……অবশ্য, ঘুমের ওষুধ খেয়ে খেয়ে তার যা অবস্থা হয়েছে, এখন আর কোনো ওষুধ খেতেই কোনো ভয় পায়না সে………
তুষারবাবু আশ্বাসের সুরে বললেন,
– তুমি এখন এখানে একটু রেস্ট নাও…….আমি আধঘন্টা পর থেকে শুরু করব…….
ওষুধটা খাবার কিছুক্ষনের মধ্যেই কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব চলে এলো সোনালির সর্বশরীরে। সে আর নিজের শরীরের ভার সহ্য করতে না পেরে শুয়ে পড়ল বেডের ওপর। আসতে আসতে যেন, তুষারবাবু, সুচেতা আর তন্ময়ের দৃশ্যটা ঝাপসা হয়ে আসছে ওর চোখের সামনে থেকে, একটা প্রগাঢ় অন্ধকার ছায়া যেন সেটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে, ঠিক সেভাবে, যেভাবে আগুন ধূলিসাৎ করে দেয় কোনো ফটোগ্রাফ কে। অন্ধকার……চারিদিকে অন্ধকার……এ কোথায় চলে এলো সোনালি? সে চিৎকার করে এর বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন লোপ পেয়ে গেছে ওই ওষুধটার গুনে! কই, ঘুমের ওষুধ খাবার পর তো এরকম কখনো মনে হয়নি সোনালির। তাহলে আজ কি হলো তার?

সেই অশেষ অন্ধকার জগতের মধ্যে ক্রমাগত হাস-ফাঁস করে উঠছিল সোনালি। এমন সময় হঠাৎ যেন দূরে একটা আলোকের ছোট বিন্দু দেখতে পেল সে, কানে এল তুষারবাবুর পুরুষালি গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর,
– সোনালি…..সোনালি, তুমি ঠিক আছো?
মাদকের নেশার মতো চরম আছন্নতার ঘোরে সোনালি বেশি কিছু বলতে পারল না, শুধু বলল,
– হ….হুম….
আবার তুষার বাবুর গলার আওয়াজ পেল সে,
– কোথায় আছো তুমি এখন?
সোনালির অস্ফুট গলার আওয়াজ শোনা গেল,
– জানি না…….জানি না…….
– চারিদিকে তাকিয়ে দেখো…….কিছু দেখতে পাচ্ছ কোথাও?
– অন্ধকার……চারিদিকে অন্ধকার……শুধু….
– শুধু?
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে সোনালি বলে উঠল,
– শুধু একটা আলোর গোলা……একটা বিন্দু থেকে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সেটা…….বড়……আরো বড়…….
– ভালো করে বোঝার চেষ্টা করো, সেই আলোর গোলাটা কিসের আকার নেওয়ার চেষ্টা করছে……
কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে রইল সোনালি, তারপর আছন্নতার মাঝেই যেন আরো উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠল সে। সুচেতা ওর দিকে এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু তুষারবাবু তাকে বারন করলেন। তিনি নিজেই বললেন,
– কি হলো সোনালি? কি দেখছো তুমি?
উত্তেজনায়, আতঙ্কে সোনালি চোখ বন্ধ করেই বলে চলল,
– ওই আলোটা আসতে আসতে একটা মেয়ের রূপ নিয়েছে……মেয়েটা…..মেয়েটা ছুটে আসছে আমার দিকে…..কাছে……আমার আরো কাছে চলে এলো সে…….কিন্তু……একি!…….একি দেখছি আমি!
তুষারবাবু কৌতুহলী কণ্ঠে বলে উঠলেন,
– কে সোনালি……কে সেই মেয়েটি?
সবাই কে অবাক করে দিয়ে সোনালি বলল,
– আমি……আমিই হলাম সেই মেয়েটি……নিজেকে দেখতে পাচ্ছি আমি!
সেই ঘরে উপস্থিত সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।

এরপর বিস্ময়ে হতবাক সুচেতা, তন্ময় আর তুষারবাবুকে সোনালি, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠা দৃশ্য সবিস্তারে বলে চলল……
একটা রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে সে, তার শরীর যেন ক্ষতবিক্ষত, পরনের কাপড়টিও শতচিত্র, চুলগুলো এলোমেলো, কপালের সিঁদুরের টিপ কখন ঘেঁটে গিয়েছে, ঠোঁটের কোষ দিয়ে ঝরছে একটা সরু রক্তের রেখা, ক্ষতবিক্ষত পায়ের পাতা দিয়ে বয়ে চলেছে রক্তের ধারা…….রাস্তাটার চারিদিকে যেন মারামারি খুনোখুনি হয়েই চলেছে, কারা যেন সবাইকে ধরে খুন করেছে বড় বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে চার-খার করে দিচ্ছে সমস্ত দোকান পাট, একটা দোকানের সাইন বোর্ড যেন তার মাথাতেই ভেঙে পড়ত আরেকটু হলে। সে চেয়ে দেখল ভাঙা বোর্ডটির এক ধারে লেখা আছে “মানিকগঞ্জের সেরা বস্ত্র প্রতিষ্ঠান”……..কারা যেন ছুটে আসছে তার পেছনে পেছনে, পুরুষের কয়েকটা গলা বলছে, “দেখো, বো ভাগ রহি হে উধর……পাকরো উসে”……..সে জোরে, আরো জোরে ছুটতে লাগল, কিন্তু পেছনের নরখাদকগুলো যেন তার কাছে……কাছে…..আরো কাছে এসে পড়ল……..
ব্যাস, এই অবধি দেখে চিৎকার করে চোখ মেলে তাকালো সোনালি…..বিস্ময়ে আতঙ্কে আঁকড়ে ধরল তুষারবাবুর চওড়া বুকের ছাতিটাকে। পরমুহূর্তেই হুঁশ ফিরে পেয়ে সে ছুটে গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকোলো সুচেতার পিঠে।
তুষারবাবু দৃড় কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন,
– আমি আমার ক্লু পেয়ে গিয়েছি, সোনালি………মানিকগঞ্জ বাংলাদেশের একটা জায়গায় নাম……
তারপর তিনি সোনালির চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,
– তোমার পাসপোর্ট আছে তো?

                                                                 (পর্ব-৪)

সোনালি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তুষারবাবুর দিকে তাকিয়ে, একবার মাথা দুলিয়ে, একটা সম্মতি-সূচক ইঙ্গিত করল। হঠাৎ তন্ময় বিরক্তি ভরে বলে উঠল,
– এত অবধি তো ঠিক ছিল…….তোর কিছু মানসিক প্রবলেম হচ্ছে, তুই তার জন্যে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে এসেছিস……..কিন্তু এর জন্যে সেই বাংলাদেশে ছোটা…….দিস ইস রিয়েলি এবসার্ড!
সবাই তন্ময়ের দিকে তাকালো এবার। তন্ময় আবার বলতে লাগল,
– দেখ সোনালি, আমার তো মনে হয় এগুলো তোর মনের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়……
সুচেতা এবার ক্রুদ্ধ গলায় তার প্রেমিককে বলে উঠল,
– বাহ, তন্ময়, বাহ…….এতক্ষন আমাদের সাথে থেকে তুমি এই কথা বুঝলে? শোনো, এ কথা ঠিক যে অনেক মানুষই একটু বেশি কল্পনা-প্রবন হন, কিন্তু তারা একেবারেই মানসিক দিক থেকে অসুস্থ নন। আমরা তো অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কথা শুনেছি, তারা অন্য মানুষদের থেকে বেশি কল্পনা করতে পারেন বলেই আজ সেই জায়গায় আসতে পেরেছেন……..কিন্তু তারা কি সোনালির মত অহরাত্রদিন এত কষ্ট পেয়ে চলেছেন? নাহ…….সোনালির ব্যাপারটা আলাদা…..আমার মন বলছে, অনেক দৃড় রহস্যের জট লুকিয়ে আছে ওর এই স্মৃতিগুলির মধ্যে…..
তন্ময় যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল,
– আচ্ছা মানলাম……..মানলাম, যে সোনালির কেসটা আলাদা…….কিন্তু আজ তো সকলের কাছে সেটা পরিষ্কার হয়েই গেল…….ও নিজেকে “লাজবন্তী” বলেছিল, রাইট? আর আজ ও নিজেকেই নিজের স্মৃতির মধ্যে দেখতে পেয়েছে……তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে যে কোনো একটা সময়ে ও লাজবন্তী নামক একটা মেয়ে হয়ে জন্মেছিল..…..ব্যাস, প্রবলেম সল্ভড……..
এতক্ষন ধরে চুপ করে সবকিছু শুনলেও, এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল সোনালি,
– কিছু সমাধান হয়নি রে তন্ময়…….কিছু সমাধান হয়নি…….অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো আমি খুঁজে পাচ্ছিনা…….আমি যদি গত জীবনে লাজবন্তী হয়ে জন্ম নিয়েই থাকি, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কত মানুষ তো কতবার জন্মায়, মরে, আবার জন্মায়……..কিন্তু শুধুমাত্র আমাকেই কেন এই আগের জন্মের স্মৃতিগুলো দিবারাত্রি এত কষ্ট দিয়ে চলেছে…….কেন?
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সোনালি, দু হাতে মুখ ঢেকে আবার সেই বেডে বসে পড়ল সে। এতক্ষন পর মুখ খুললেন তুষারবাবু, বললেন,
– এর কারন হল, নিশ্চয় আগের জীবনে তোমার কোনো কাজ……কোনো ইচ্ছা বা কোনো উদ্দেশ্য……সেই জীবনে সম্পূর্ন হতে পারেনি, তাই সেই স্মৃতিগুলো বার বার বিচ্ছিন্ন ভাবে তোমার চোখের সামনে ভেসে এসে তোমাকে মনে করাতে চাইছে সেই কাজ, ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যটাকে এই জন্মে পূরণ করতে…….
এবার সুচেতা বলে উঠল,
– তাছাড়া, এই লাজবন্তীর জীবনে কিন্তু আপনিও জড়িয়ে আছেন তুষারবাবু, নাহলে সোনালি সেদিন নিজেকে “লাজবন্তী” বলে, আপনাকে বাঁচতে দেবে না, একথা কখনোই বলত না……
এবার সোনালি আর তুষারবাবু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল একে অপরের দিকে।
তন্ময় তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠল,
– বেশ, তুই রহস্যের জট খুলতে বাংলাদেশ কেন, যে দেশে ইচ্ছা যা…….কিন্তু বাড়িতে কি বলবি তা একবারও ভেবে দেখেছিস?
তুষারবাবু এ কথা শুনে কঠোর গলায় বলে উঠলেন,
– ওর বাড়ির লোককে যা বলার তা বলবে খোদ সাইকিয়াট্রিস্ট, ডাক্তার তুষার মল্লিক……
বিস্ময়ে ওরা তিনজন এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল, তুষারবাবুর কথা শুনে!

দমদম এয়ারপোর্টে সোনালি আর তুষারবাবুকে সেদিন ছাড়তে এসেছিল সুচেতা। সোনালির বাবা তুষারবাবুর কথা শুনে কোনই আপত্তি করেননি তার সাথে সোনালির বাংলাদেশ যাত্রায়। উপরন্তু, তিনি যে নিজের মেয়ের মানসিক যন্ত্রণার কথা এতদিন বুঝতে পারেননি, একথা বলে দুঃখ প্রকাশও করেছেন। হয়তো, তুষারবাবুর সাথে কথা বলে, তিনি বুঝেছেন যে তার ওপর সত্যিই ভরসা করা যায়। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগের মুহূর্তে, সোনালি সুচেতাকে বলল,
– তুই আমার জন্য অনেক করেছিস, সুচি…….এখন শুধু একবার ভগবানের কাছে বল যে, যে উদ্দেশ্যের জন্য আমি সেই অচেনা জায়গায় পাড়ি দিতে চলেছি, তা যেন সফল হয়…….আমি যেন সেই সমস্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর সেখানে গিয়ে পাই, যেগুলো এতদিন ধরে দুঃস্বপ্ন হয়ে আমার চোখের সামনে ভিড় করে আছে…..
সুচেতা কোনো কথা বলল না আর, শুধু একবার জড়িয়ে ধরল সোনালিকে। তুষারবাবু বললেন,
– চলো সোনালি, আমাদের কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে…..

ওদের বিদায় পর্ব শেষ হবার কিছু পরেই, সোনালি আর তুষার গিয়ে পাশাপাশি বসল ফ্লাইটের সিটে। সোনালির মনে হল, আজ যে তাকে এই অজানা অচেনা মানুষটার পাশে বসে এতদূরে পাড়ি দিতে হবে, এ কথা কি স্বপ্নেও ভেবেছিল সে? মানুষের ভাগ্য তাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে আসে, তা কেউ জানে না। এই যেমন এই মানুষটাকে তো সে প্রথম দেখেছে সবে দুদিন মাত্র আগে, তাহলেও তাকে কত চেনা চেনা লাগছে……এ কি করে সম্ভব? কি ভূমিকা ছিল এই মানুষটার লাজবন্তীর জীবনে? লাজবন্তী কি কখনো তাকে ভালোবেসে ছিল? আর যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সে সেদিন এমন উত্তেজিত হয়ে কেন বলেছিল, যে এই মানুষটাকে সে আর বাঁচতে দেবে না?………এই একই প্রশ্নগুলো হয়তো তুষারবাবুর মনেও চলছিল। হঠাৎ সোনালি দেখল যে তুষারবাবুর একটা হাত স্পর্শ করল তার হাতকে, ধীরে ধীরে শক্ত হলো তার হাতের মুঠো, তার নিঃশ্বাসের বেগ হল আরো দ্রুত, কেঁপে উঠল তার ঠোঁট……. সোনালি অবাক হয়ে চেয়ে দেখল তুষারবাবুকে। তার চোখ যেন সোনালির চোখ ছাড়া আর কিছুই চেনে না, যেন কত কথা ওদের শুধু চোখ দিয়েই বলা হয়ে গেল। তার মানে কি তুষারবাবুও কিছু মনে করতে পেরেছেন, কি সম্পর্ক ছিল তার লাজবন্তীর সাথে? নাকি, তিনি লাজবন্তীকে না চিনলেও, চেনেন শুধু সোনালিকে……যেন তিনিও বলতে চাইছেন যে সোনালি শুধু তার……শুধুই তার!

ফ্লাইটে করে কলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় দেড় ঘন্টা। তারপর সেখানকার শাহজালাল এয়ারপোর্টে সমস্ত ভেরিফিকেশন শেষ করে, ওরা সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে এল মানিকগঞ্জের একটা হোটেলে, তাতে সময় লাগল আরো আড়াই ঘণ্টা। হোটেলের রুমটা আগেই বুক করা ছিল, সিঙ্গল রুম তবে দুটো আলাদা বিছানা…….. তাই ঘরের চাবি পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তাদের। কিছুক্ষন ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার পরই হোটেলের ছেলেটা ওদের দুপুরের খাবারের জন্য ডেকে গেল। হোটেলের নিচের তলায় একটা বিশাল বড় ডাইনিং রুম, সেখানেই লাঞ্চ বা ডিনার পরিবেশন করা হয় হোটেলের সমস্ত বোর্ডারদের। সোনালিদের বোধহয় লাঞ্চ করতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল, এখন তারা ছাড়া আর অন্য কেউই খাবার টেবিলে বসে নেই। খাবার মেনু খুবই সাধারন কিন্তু আকর্ষনীয়…….ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, সর্ষে ইলিশ, চাটনি, পাঁপড়। হোটেলের ছেলেটা খাবার পরিবেশন করতে করতে তুষারবাবুকে বলল,
– জানেন তো স্যার, আপনাদের মত আরেকজন কাপেলও আমাদের হোটেলে এসেছে কলকাতা থেকে কাল রাতে…….
সোনালির মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, তবুও তারা ছেলেটাকে জানাল না তাদের আসল পরিচয়। ছেলেটা বোধহয় জানেনা, যে ওদের ঘরটা এক হলেও, বিছানাটা আলাদা। ছেলেটা বলেই চলল,
– কালকে রাতেই সেই ভদ্রলোক আর তার মিসেস-এর সাথে অনেক কথা হচ্ছিল আমার………
তারপর সে তাদের আরো কাছে এসে মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলল,
– জানেন তো স্যার, উনি বলছিলেন যে উনার মিসেস-এর নাকি কিসব স্বপ্ন দেখার ব্যামো আছে…….
সোনালি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– মানে?
ছেলেটি ফিক করে হেসে বলল,
– তিনি বলছিলেন যে তারা এই বাংলাদেশে আগে কখনো আসেননি, কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই, তার মিসেস নাকি, এই কাছেরই একটা পুরোনো রাজবাড়ির ছবি, তার ঘুমের মধ্যে প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছেন। তাই তাদের কোনো এক সাইক্রিয়াটিস্ট নাকি এখানে এসে ঘুরে যেতে বলেছেন………সেই রাজবাড়িতেই তো তারা গেল কিছুক্ষন আগে……….পাগলের প্রলাপ…..কি বলেন স্যার, হা হা হা……..
আতঙ্কে শিউরে উঠল সোনালি……..তার মানে, আরেকটি মেয়েও আছে, যে তার মতই মানসিক যন্ত্রণার শিকার। দুরু দুরু বুকে সোনালি ভাবতে লাগল, হোক না হোক, এই মেয়েটিরও নিশ্চয় কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে তার নিজের অতীতের সাথে। তার সাথে এখনই একবার দেখা করা উচিত। এই রহস্যের জট যেন আরো গাঢ় হয়ে আসছে! এক ধাক্কায় ভাতের থালা সরিয়ে দিয়ে সোনালি কাঁপা কাঁপা গলায় তুষারবাবুকে বলল,
– ওরা যেখানে গেছে, আমাকেও সেখানে নিয়ে চলুন!

                                                                  (পর্ব-৫)

এই কথা শুনে, অবাক চোখে তুষারবাবু তাকালেন সোনালির দিকে। তারা খাওয়া ছেড়ে উঠে যাচ্ছে দেখে, হোটেলের ছেলেটি তাড়াতাড়ি তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
– কি হল…..কি হল, ম্যাডাম…..আপনাদের খাবার পছন্দ হয়নি বুঝি!
সোনালি তার দিকে তাকিয়ে দৃড় গলায় বলল,
– যে জন্য ওই দম্পতি এখানে এসেছে, আমরাও ঠিক সেই জন্যই এখানে এসেছি……আর বাকি রইল খাওয়ার কথা, তাহলে শুনে রাখো, আমার ক্ষুধা তৃষ্ণা সেদিন থেকেই চলে গিয়েছে যেদিন থেকে আমারও, ওই মেয়েটির মতই, চোখের সামনে অনেক অজানা প্রশ্নের প্রতিচ্ছবি প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে……আমারও, ওই মেয়েটির মতোই, এখন জীবনে একটাই উদ্দেশ্য……তা হল সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজে পাওয়া……….
তারপর সোনালি তুষারবাবুর হাত ধরে টেনে, অধৈর্য হয়ে বলল,
– চলুন, চলুন সেই রাজবাড়িতে…….ওর সাথে আমাকে ওখানেই দেখা করতে হবে, আর দেরি করবেন না প্লিজ…….
এই বলে সোনালি তীরবেগে তুষারবাবুকে সেখান থেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে বিস্ময়ে হতবাক সেই ছেলেটা চিৎকার করে উঠল,
– দাঁড়ান ম্যাডাম, যাবেন না…..যাবেন না ওখানে……..ওটা একটা ভূতুড়ে জায়গা ম্যাডাম, কিছুদিন আগেই ওখানকার একটা বুজে যাওয়া কুয়ো থেকে, একটা অনেক বছরের পুরোনো মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যাবেন না ওখানে ম্যাডাম, যাবেন না……

সেই রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষটা খুব একটা দূরে নয় সোনালিদের হোটেলটা থেকে। রিকশা করে সেখানে যেতে লাগল বড় জোর পনেরো মিনিট। সেই জায়গাটার কাছে আসতেই, সোনালি দুরু দুরু বুকে চেয়ে দেখল একবার ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেই রাজবাড়িটার দিকে। এখন ওখানে আর কেউ বসবাস করে না, করার পরিস্থিতিও আর নেই। সেই প্রাচীন ঐতিহ্য বহনকারী এই বাড়িটা, এক কালে যে সাত-মহলা ছিল তা দেখে ভালোই বোঝা যায়। সামনের গেটের ওপরের সিংহের মূর্তিটা যেন এখনো জীবন্ত হয়ে তাকিয়ে আছে সোনালির দিকে। অধিকাংশই ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এই বাড়িটার কোথাও এতটুকু সিমেন্ট-বালি আস্ত নেই, তা কবেই খসে গিয়ে বুকের পাঁজরের মত বেরিয়ে পড়েছে পুরোনো ইঁটের সারি। সোনালি ছুটে গেল সেই বাড়িটার ভেতরে, একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিশাল বড় উঠোনটাতে। এর চারিপাশে, দোতলা বাড়িটার অধিকাংশ ঘরেরই ছাদ ধসে পড়েছে। সামনের পরিত্যক্ত ঠাকুর দালানটি কত বছর ধরে হয়তো বঞ্চিত ঢাকের আওয়াজ থেকে। শিহরিত হয়ে সোনালি ভাবল, তাহলে কি এই বাড়িটাতেই আছে তার রহস্যের সমাধান? তার অতীত কি কখনো জড়িয়েছিল এই বাড়ির সাথে? যদি ওই প্রাচীন দেওয়ালে কান পাতে সোনালি, তাহলে কি সে পাবে শুনতে সেই ফেলে আসা দিনের পুরোনো স্মৃতির আর্তনাদ!

ঠিক এরপরেই ওর চোখ চলে যায়, কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা সেই দম্পতির দিকে। সোনালি দেখল, ভদ্রলোকটি তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু তার স্ত্রী বাড়িটা দেখতে দেখতে অনেকটাই দূরে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটি…….আতঙ্কিত মনে সোনালি ভাবল, তার মানে কি ওই মেয়েটা এখানে এসে কিছু মনে করতে পেরেছে? আর দেরি করল না সোনালি, সে সটান গিয়ে কৃত্রিম ভাবে মৃদু হেসে তার স্বামীকে বলল,
– নমস্কার দাদা, আসলে আপনারা যে হোটেলে এসেছেন, আমরাও সেখানে উঠেছি, ওই হোটেলের ছেলেটার কাছ থেকেই শুনলাম আপনার স্ত্রীর সমস্যার কথা……..আসলে ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে, তাই আমরাও চলে এলাম……ও, বাই দা ওয়ে, আমি সোনালি……
ভদ্রলোকও তাকে প্রতিনমস্কার জানিয়ে বেশ করুন কণ্ঠেই বললেন,
– নমস্কার, আমি শচীন…..শচীন মুখোপাধ্যায়। ওই যে……..আমার মিসেস, সায়নী……আসলে ওর এই মেন্টাল প্রবলেমটার জন্যই আমাদের এখানে আসা…..
এতক্ষনে তুষারবাবুও চলে এসেছেন তাদের কাছে। সোনালি তাকে দেখিয়ে বলল,
– আর উনি হলেন ডা: তুষার মল্লিক…….আমার বিশিষ্ট বন্ধু।
তুষারের সাথে শচীনের আলাপ হলে সোনালি আবার কৃত্রিম ভাবে হেসে শচীনবাবুকে বলল,
– তা একবার আলাপ করিয়ে দেবেন না আমায়, আপনার মিসেস-এর সাথে?
শচীনবাবু একবার ম্লান হেসে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সায়নীকে চিৎকার করে বললেন,
– সানু……শুনে যাও একবার এদিকে……দেখো তোমার সাথে কারা আলাপ করতে এসেছেন!

সায়নী যেন একটু চমকে উঠল তার স্বামীর ডাক শুনে। তারপর পেছন ঘুরে একবার তাকালো তাদের দিকে। সোনালি অবাক হয়ে দেখল, যে সায়নী বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তুষারবাবুর দিকে। হটাৎ যেন তার চাহনিটা কেমন পাল্টে গেল। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতে লাগল তার সর্বশরীর। একটা করুন আর্তনাদ করে উন্মাদের মত ছুটে আসল সে তুষারবাবুর দিকে। এক ঝটকায় সায়নী ধরে ফেলল তুষারবাবুর দুই হাত, তারপর চিৎকার করে কেঁদে উঠল,
– আমায় ক্ষমা করে দাও বীরেন্দ্র!……ক্ষমা করে দাও আমায়!…..অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি আমি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে…..অনেক বড় ভুল…….
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সোনালি ছুটে এল সায়নীর কাছে। ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল সায়েন্স কলেজের সেমিনারের সেই দিনটার কথা, সেদিন তো সে নিজেও এভাবেই ছুটে এসেছিল তুষারবাবুর কাছে! এই রহস্যের জালে ওর যেন মাথা ঘুরতে লাগল, দুজন নারী একজনই পুরুষকে দেখে গত জন্মের স্মৃতি স্মরণ করতে পারছে, তফাৎ শুধু একটাই, একজনের মনে সেই পুরুষটির জন্য আছে আক্রোশ আর অন্যজনের মনে আছে অনুশোচনা! এই জটিল অঙ্কের সমাধানের কোনো হদিসই কি কখনো পাবেনা সে? সোনালি ছুটে এসে চিৎকার করে সায়নীকে জিজ্ঞাসা করল,
– কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ তুমি সায়নী……বলো!….বলো কি মনে পড়ছে তোমার?
সায়নী এবার ঘুরে গেল সোনালির দিকে, তারপর করুন কণ্ঠে বলল,
– তুইও আমায় পারলে ক্ষমা করে দিস, লাজু……ক্ষমা করে দিস! আমি তোদের সকলের কাছে অপরাধী রে, লাজু……খুব ভুল হয়ে গেছে আমার…..খুব ভুল করে ফেলেছি আমি, তোদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, ইমতিয়াজ খান-এর সাথে হাত মিলিয়ে!
সোনালি কৌতুহলী হয়ে সায়নীকে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– কে এই ইমতিয়াজ খান……বলো, সায়নী, বলো……আর কে এই বীরেন্দ্র? আর কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছো তুমি?
কিন্তু সায়নী আর কিছুই বলতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল সোনালির বুকে। ভয়ে তার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলেন শচীনবাবু!

সকলের ডাকে কিছুক্ষন পরেই হুঁশ ফিরে পেল সায়নী। কিন্তু ওকে কোনো কথা জিজ্ঞাস করে লাভ হল না কারোর, কারন কিছুক্ষন আগেই ও যা করেছে বা যা বলেছে, তার কিছুই মনে নেই এখন ওর। এ আর কি নতুন কথা, ভাবল সোনালি, তার সাথেও তো ঠিক এরকমই হয়েছে। তারপর আর কোনো কথা বাড়ায়নি তারা চারজন একে অপরের সাথে। বিনা বাক্যবয়ে ফিরে এসেছিল সবাই হোটেলে, ঢুকে পড়েছিল যে যার নিজের ঘরে।

রাতে বিছানায় শুয়েও অন্যদিনের মতো ঘুম আসছিল না সোনালির। বীরেন্দ্র…….লাজবন্তী……ইমতিয়াজ খান……ওই রাজবাড়ি…….বার বার এই চারটে শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছিল ওর চোখের সামনে। কি ভাবে জড়িয়ে আছে এই চারজন একে অপরের সাথে? এই চারজনকে দিয়ে কোন সমীকরন তৈরি করলে করা যাবে এই ধাঁধার সমাধান! হঠাৎ সোনালি যেন তার চোখের সামনে সেই পুরোনো দৃশ্যটা দেখতে পেল……সেই ধ্বংস আর নরহত্যা লীলায় ছারখার হওয়া রাস্তাটা দিয়ে ছুটে আসছে সে……না,না, সে নয়……….ছুটে আসছে অসহায় লাজবন্তী! তার পেছনে ধেয়ে আসছে নিশাচর পুরুষের দল, চিৎকার করে বলছে তারা, “পাকরো উসে”……হঠাৎ ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লাজবন্তী। তার সামনে এই পুরুষের মূর্তিটা কার? এক দৃষ্টিতেই বোঝা যায় যে এ হল কোনো মুসলমান পাঠান। বলিষ্ঠ শরীর, খালি গা, গলায় তাবিজ, চোখে সুরমা, পরনে লুঙ্গি, মুখে ভর্তি দাড়ি অথচ গোঁফের লেশ মাত্র নেই…….আর তার হাতে খোলা তরোয়াল। লাজবন্তীকে দেখে দাঁত বের করে পৈশাচিক উল্লাসে হেসে উঠল সেই পুরুষ, যেন কতদিনের ক্ষুধার্ত চিতাবাঘ পেয়েছে কোনো হরিণ সাবকের সন্ধান। লাজবন্তীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নিজের লুঙ্গির গিট খুলতে শুরু করল সে। তাকে দেখে ভয়ে আৎকে উঠে দুই পা পিছিয়ে এল লাজবন্তী!

                                                          (শেষ পর্ব)

আচমকা, পেছনে পড়ে থাকা একটা মৃতদেহের কাছ থেকে একটা ধারালো চাকু খপ করে তুলে নিল লাজবন্তী, তারপর সামনে ঘুরে, কম্পিত হাতে সেটিকে ওই যুবকের দিকে এগিয়ে, চিৎকার করে বলে উঠল সে,
– খবরদার!……খবরদার, ইমতিয়াজ খান…..এক পাও আর এগিয়ে আসবে না তুমি!
এই কথা শুনে আবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল ইমতিয়াজ। তারপর বিদ্রুপের গলায় তাকে বলে উঠল,
– কি ভেবেচিলিস, হ্যাঁ? তোর ওই বীরেন্দ্রবাবু তোকে সত্যিই ভালোবাসেন? বাঁচাতে আসবেন তিনি তোকে? উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন তোকে এই দেশ থেকে?
বিস্ময়ে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে লাজবন্তী শুনতে লাগল এই কামোত্তেজিত পাঠান পুরুষটির হিংস্র উল্লাসের ধ্বনি, সে বলেই চলল,
– তোর বীরেন্দ্রবাবু তো সেই কখনই তার স্ত্রীকে নিয়ে কেটে পড়েছেন কলকাতার উদ্দেশ্যে…..জমিদারি রক্ত বইছে তার শরীরে, তোর মত এমন হাজার মেয়েমানুষের সাথে তার ফুলশয্যা হয় প্রতি রাতে…….কিন্তু তার মানে কি তাদের ভালোবেসে বিয়ে করবেন তিনি?……নাহ…….আজ আমি তাকে প্রান নিয়ে এই দেশত্যাগ করতে দিয়েছি শুধুমাত্র একটাই শর্তে, এবং তাতে তিনি এক কথাতেই রাজি হয়ে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন এই দেশ ছেড়ে!

প্রতারণার ফাঁদে পড়ে, লাজবন্তী বিহ্বল চোখে ইমতিয়াজের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
– কি সেই শর্ত? বলো ইমতিয়াজ…..কি সেই শর্ত?
কুচ্ছিত দাঁতগুলি বার করে আবার হেসে উঠে ইমতিয়াজ বলে উঠল,
– এখনো বুঝতে পারছিস না তুই?…….আজ থেকে তিনি আমায় ভার দিয়েছেন তোকে ভোগ করার……হা হা হা…..আজ থেকে আমি মজা লুটবো তোর…..আমি!…আমি!
এই বলে ইমতিয়াজ ঝাঁপিয়ে পড়ল লাজবন্তীর গায়ের উপর, এক টানে খুলে নিল তার শরীর আঁচল। আর বেশি দেরি করল না লাজবন্তী, সে সটান তার হাতের চাকুটাকে নিজের কাছে ধরে চালিয়ে দিল নিজের বুকের ওপর। চমকে উঠে ইমতিয়াজ তাকিয়ে দেখল, যে রক্তাক্ত অবস্থায় লাজবন্তী লুটিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। একবার শুধু রাস্তার মাটি আঁকড়ে ধরে চরম যন্ত্রনায় বলে উঠল লাজবন্তী,
– এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ আমি নেব, বীরেন্দ্রবাবু,……আমার সাথে মিথ্যা ভালোবাসার প্রতারণা করার শাস্তি আমি আপনাকে দেবই…..এই জন্মে না হলেও পরের জন্মে…..আমি আপনাকে বাঁচতে দেব না, বীরেন্দ্রবাবু…..বাঁচতে দেব না!
কিছুক্ষনের মধ্যেই শিথিল হয়ে গেল লাজবন্তীর শরীর!

এতটা দেখে আতঙ্কে আঁতকে উঠে, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে যাওয়ার পর, বিছানায় বসে পড়ল সোনালি। তার মানে, আগের জন্মে তুষারবাবুই ছিলেন বীরেন্দ্র! আর গত জন্মে লাজবন্তীর সাথে তার এই প্রতারণার জন্যই, তাকে প্রথম দেখার পর, আক্রোশের ভরে সোনালি তাকে বলে উঠেছিল যে, “আমি তোকে বাঁচতে দেব না”! পাশের খাটে সেই ঘুমন্ত মানুষটার দিকে একবার চেয়ে দেখল সোনালি। একি ভগবানের বিধান? গত জন্মে যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিল সে, এই জন্মে তাকেই নিজের প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলল? একবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে…….না, আর যাই হোক……এমন প্রতারকের সাথে কিছুতেই এক ছাদের তলায় আর রাত্রিবাস করবে না সে…….কিছুতেই না…..এই ভেবে সটান নিজের রুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল সোনালি। হঠাৎ সে শুনতে পেল, পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে উঠল কোনো এক মেয়ে। আরে……এটা তো সায়নীর গলা! সোনালি ছুটে গেল সেই ঘরের দিকে, সেই ঘরের বন্ধ দরজার ওপর আছড়ে পরে কড়া নাড়তে লাগল সে। কিছুক্ষন পরেই, আতঙ্কিত মুখে দরজা খুলে দিলেন শচীনবাবু।

সোনালি ছুটে গেল তার ঘরের ভেতর, দেখল যে বিছানার ওপর বসে বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে, উত্তেজনায় ক্রমাগত জোরে শ্বাস নিয়ে চলেছে সায়নী। সোনালি তার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– কি হয়েছে সায়নী?
সায়নী সোনালির দু হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল,
– আমি ঘুমের মধ্যে একটা মেয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, সোনালি……সেটা আমার নিজেরই গলার আওয়াজ……
সোনালি কৌতুহলী হয়ে বলল,
– কি বলছিল সেই আওয়াজ?
একটু দম নিয়ে সায়নী বলে উঠল,
-বলছিল যে, “আজ রাতের গাড়িতেই কলকাতার উদ্দেশ্যে পালানোর পরিকল্পনা করেছে ও আমার সাথে, সাথে নেবে বাড়ির সমস্ত টাকা পয়সা আর সোনা দানা………আর ওই মেয়েছেলেটাকেও আমাদের সাথে নিয়ে পালাবে বলেছে সে……..স্টেশনে যাওয়ার জন্য বাড়ির পেছনের কুয়োটার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবে ওর জুরিগাড়ি…….তোমাকে কাকে কি করতে হবে আর কাকে কি বলতে হবে, তা নিশ্চয় আমাকে আর শিখিয়ে দিতে হবে না তোমায়, ইমতিয়াজ!……আর তা করতে পারলেই আমি তোমার, তোমার বাঁদি হয়ে থাকব আমি সারা জীবন, নিকাহ করব আমি তোমাকে!…….আর তোমার উপরি পাওনা হবে ওই মেয়েমানুষটা, আজ রাতের জন্য……..হা হা হা হা!”

ব্যাস, সোনালি দূরে সরে এল সায়নীর কাছ থেকে। তার যেন জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়ে গিয়েছিল! এমন সময় শচীনবাবু বলে উঠলেন,
কাল রাতেই আমার কথা হচ্ছিল আমার এক বন্ধুর সাথে, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। সে অনেক গবেষণা করেছে বাংলাদেশের জমিদার বংশগুলি নিয়ে। সে বলছিল যে, ওই রাজবাড়িটার সর্বশেষ জমিদার ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্রপ্রতাপ রায়চৌধুরী, তার স্ত্রী হলেন সুরবালাদেবী। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়, একটি রাতের পর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের কারোর। আর, ইমতিয়াজ খান ছিল সেই সময়ের স্থানীয় মুসলমান দলের নেতা। তবে, স্ত্রীর থেকেও বীরেন্দ্রবাবুর টান ছিল কোন এক স্থানীয় বাইজির প্রতি, তবে তার নাম কেউ জানে না।
এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল সোনালি,
– সেই বাইজির নাম ছিল লাজবন্তী!

এতক্ষনে কোলাহলের আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে সায়নীদের রুমের ছুটে এসেছেন তুষারবাবুও। সোনালি বলে চলল,
– বীরেন্দ্র তার স্ত্রী সুরবালাকে উপেক্ষা করে ভালোবাসতেন বাইজি লাজবন্তীকে। তাই, সুরবালা ঈর্ষা করতেন লাজবন্তীকে, সহ্য করতে পারতেন না তার স্বামীকেও। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়, এক রাতে বীরেন্দ্র ঠিক করেন যে তিনি এই দেশ ছেড়ে সুরবালা আর লাজবন্তীকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন কলকাতায়। কিন্তু তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন সুরবালা। তিনি এই কথা জানিয়ে দিলেন ইমতিয়াজ খানকে। সুরবালারই পরিকল্পনা মতো, স্টেশনের উদ্দেশ্যে ঠিক রওনা হওয়ার আগেই, ইমতিয়াজ তার দলবল নিয়ে এসে খুন করে বীরেন্দ্রকে। তার লাশটাকে ফেলে দেয় ওই রাজবাড়ির একটা কুয়োর মধ্যে। এদিকে বীরেন্দ্রর কথামত লাজবন্তী এই রাজবাড়িতে এসে আর তাকে খুঁজে পায় না। তাকে ধাওয়া করে ইমতিয়াজের দলবল। সুরবালারই শেখানো মিথ্যা কথা ইমতিয়াজ লাজবন্তীকে বলে, বলে যে বীরেন্দ্র নাকি লাজবন্তীকে ইমতিয়াজের হাতে সঁপে দিয়ে, সুরবালাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। সবশেষে, ইমতিয়াজের দ্বারা আসন্ন ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে, লাজবন্তী নিজেই শেষ করে দেয় নিজেকে।
একটু থেমে একবার দম নিয়ে নিল সোনালি। তারপর আবার বলল,
– লাজবন্তীর উদ্দেশ্য ছিল বীরেন্দ্রর প্রতারণার প্রতিশোধ নেওয়া আর সুরবালা হয়তো মৃত্যুর আগে বুঝতে পেরেছিলেন নিজের ভুল, তাই তিনি ভুগছিলেন অনুশোচনার জ্বালায়। তাই এই দুজনকেই পরের জন্মে, অতীত জীবনের স্মৃতিগুলির দ্বারা এত মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছে। গত জন্মে আমি ছিলাম লাজবন্তী, তুষারবাবু ছিলেন বীরেন্দ্রপ্রতাপ রায়চৌধুরী আর সায়নী ছিল সুরবালাদেবী!

সোনালি ছুটে এগিয়ে গেল তুষারবাবুর দিকে, তারপর তার বুকের পাঞ্জাবী খামচে ধরে জিজ্ঞাসা করল,
– আমি জানতাম!…..আমার বীরেন্দ্রবাবু কখনোই প্রতারনা করতে পারেন না আমার সাথে……তিনি সত্যিই ভালোবেসেছিলেন তার লাজবন্তীকে…….আগের জন্মে আপনাকে না পেলেও, এই জন্মে আবার আপনার লাজবন্তী আপনার কাছে ফিরে এসেছে বীরেন্দ্রবাবু, আপনি কি তাকে গ্রহণ করবেন না?
কোনো কথা বললেন না তুষারবাবু, শুধু সোনালির গালদুটিকে আঁকড়ে ধরে ঠোঁট রাখলেন তার ঠোঁটের ওপর। আর এই দৃশ্য দেখে, হাসিমুখে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল সায়নী আর শচীনবাবু। সেই সময়ই, জানলার ফাঁক দিয়ে প্রথম ভোরের আলোটা এসে পড়ল ওদের চারজনের গায়ে, যেন আকাশ থেকে সূর্যদেব বলে উঠলেন,
“একটা নতুন সকাল দিলাম তোমাদের সবাইকে, সকল পিছুটান ফেলে এবার এগিয়ে যাও নতুন জীবনের পথে।”

(সমাপ্ত)

Loading

Leave A Comment