একান্ত ব্যক্তিগত
-সুস্মিতা সাহা
(নিজের কথা থাক্ নিজেরই কাছে …মনের কথা মনেই )
“ও বৌদি, রাগ কোরো না গো…কালও কিন্তু ভোর ভোর উঠে দরজা খুলে দিতে হবে। ঠিক পাঁচটার সময় এসে তোমার বাসন মেজে, ঘর ঝাড়পোঁছ করে দিয়ে যাবো” – মেঝেতে বসে আটা মাখতে মাখতে জানালো চামেলী…
সঙ্গে সঙ্গে রুমনার ভুরু কুঁচকে গেলো। একরাশ বিরক্তির সাথে ও বললো- ” আবার সেই ভোর পাঁচটা ? জানিস কত রাত পর্যন্ত আমার কল্ থাকে? আমি ঘুমাতে যাই ই তো রাত দুটো আড়াইটের সময়…তারপর আবার ভোরবেলা উঠে তোকে দরজা খুলে দেওয়া…উফ্ এরকম করলে চলে না “
মৃদুস্বরে চামেলী বলে- “রোজ রোজ এরকম করি না কি? ঠিক সময়েই তো আসি…মাঝেমাঝে এক আধটা দিন”…
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রুমনা আরও একটু ঝাঁঝিয়ে বলে- ” মাঝেমাঝে নয় চামেলী, আজকাল তুই প্রায়ই … খুব ঘনঘন এরকম করছিস।”
মুখ নীচু করে চামেলী উত্তর দেয়- “কি করবো বলো বৌদি…ভাই এর মেয়েটার বিয়ে, বাপ মা মড়া মেয়ে…আমার মা এমন কান্নাকাটি করে…ভাই, ভাই এর বৌ তো নেই, আমরা চার পিসী দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে না দিলে “…
রুমনা একটুও নরম হয় না, বিরক্ত কণ্ঠে সে বলে- “সে দাও না বিয়ে, যত খুশি বিয়ে দাও…আমি তো একবারও বারণ করছি না। আমাকে একজন বদলী লোক ঠিক করে দিয়ে তুমি পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে নাও। বারবার এই টাইম চেঞ্জ করা…আমাদের অফিস-করা লোকেদের খুব অসুবিধা হয়। আমি না হয় বেলা সাড়ে এগারোটা বারোটায় বেরোতে পারি…দাদাদের তো একেবারে সাড়ে ন’টার মধ্যে অফিসে পৌঁছাতে হয়। সময়ের একটুও এদিক ওদিক হলে চলে না। রাতের ঘুমটা ঠিকমতো না হলে…”
এইবার চামেলী একটু নড়েচড়ে বলে ওঠে- “হ্যাঁ গো বৌদি, দাদা তো কদিন ছুটিতে আছে…এই সপ্তাহের ক’টা দিন তুমি একটু মানিয়ে নাও না গো”…
একটু চমকে উঠলো রুমনা, দু’ সেকেন্ড থমকালো। প্রবাল যে গত বেশ কয়েকদিন ধরে বাড়িতে থাকছে- সেটা চামেলী কিভাবে জানতে পারলো?
প্রত্যেকদিন বেলার দিকে অফিসে বেরোনোর আগে রুমনা পই পই করে স্বামীকে নানারকম ইনস্ট্রাকশন দিয়ে বেরোয় -“ফ্ল্যাটের দরজা একদম খুলে বাইরে বেরোবে না, ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই , খাবার দাবার সব রেডি থাকবে, মাঝেমাঝে কিচেনে গিয়ে মাইক্রোওভেনে গরম করে নিলেই হবে।” মোদ্দা কথা -বেডরুমের বাইরে যাওয়ারই দরকার নেই । অ্যাটাচড বাথরুম তো আছেই , ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে দরকারী কাজগুলো সেরে ফেলা যেতেই পারে…
এসব সত্ত্বেও চামেলী কিভাবে টের পেলো যে প্রবাল গত কয়েকদিন ধরে বাড়িতেই থাকছে ?
মেজাজটা আরও একটু তিরিক্ষি হয়ে উঠলো রুমনার। সেটা কোনোরকমে সামলে নিয়ে ও বললো- “সে তো গত দু’দিন তোর দাদার ওয়ার্ক ফ্রম হোম ছিল মানে বাড়ি থেকে কাজ করছিল তাই।”
চামেলী তবুও বলে চললো-” দু” একদিন কি গো ? আমি তো দশ পনেরোদিন ধরে রোজই দেখি …ওই টিয়াদিদিদের ফ্ল্যাট থেকে… দুপুরবেলা ঘর মোছার সময়…তোমাদের শোওয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাদা সিগারেট খায়…ওই দুপুরবেলায়…”
রুমনাও ঝটপট বললো- ” হ্যাঁ হ্যাঁ , হতে পারে…দাদাদের অফিসে আজকাল মাঝেমাঝেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম …বাড়ি থেকে কাজ করতে হচ্ছে “
চামেলী তবুও থামেনা, সে বলে- “সেসব তো তোমার অফিসে হতো গো বৌদি, দাদাকে তো আগে কখনও দেখিনি বাড়ি থেকে কাজ করতে…দাদার তো সেই লম্বা লম্বা ট্যুর, দেশ বিদেশে যেতো…ইদানিং আর তেমন …”
মানুষের প্রতিটি কথপোকথনেই চোরাগোপ্তা থাকে এক ধরণের “পাওয়ার গেম্”।রুমানা দেখল বলটা বারবার চামেলীর কন্ট্রোলেই চলে যাচ্ছে। রাশ টেনে ধরার জন্য ও বলে উঠলো- “ওসব বাদ দে, দাদার অফিস নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। তুই আমাকে অন্য কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দে, নিজে পনেরো দিনের টানা ছুটি নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে বিয়েবাড়ি কাটিয়ে আয়।”
মাথা নীচু করে কিছুটা যেন কান্না মেশানো মৃদুস্বরে চামেলী বলে- “ওখানে গিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগেনা গো বৌদি।”
রুমনাও ছাড়বেনা, সে বলে- “কেন? তোরা তো চার বোন…সবাই আসবে, হৈ হৈ করবি ক’টা দিন”
ম্লান মুখে চামেলীর উত্তর- “না গো বৌদি, একসাথে থাকলেই কত কথা প্রকাশ পেয়ে যায়…বড় লজ্জা করে, ভালো লাগেনা”
সত্যিই অবাক হয়েই এবার প্রশ্ন করে রুমনা- “তার মানে ?”
চামেলী বলে- “কি আর বলবো বলো বৌদি …আমার বোনদের সব ভালো বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে, ওদের স্বামীরা প্রত্যেকেই ভালো কাজ করে, হাতে ভালো পয়সা…একসাথে হলেই কত খরচাপাতি করে…শুধু আমারই পোড়া কপাল…”
খুব গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চামেলী বলেই চলে- “জানো বৌদি, আমার স্বামীও কিন্তু ওই মোটর কারখানায় মজুরের কাজ ভালোই করছিল…সে কন্ট্রাক্টে হলেও…। কারখানাটাই বন্ধ হয়ে গেলো…কাজটাও চলে গেলো…। তারপর থেকে কত কিই যে চেষ্টা করলো লোকটা, কোনোটাই ঠিকমতো হলো না। সোনারপুরের দিকে আমাদের অল্প জমিজমাও ছিল গো…শাশুড়ির ক্যানসার ধরা পড়লো, চিকিৎসার জন্য সেগুলোও সব বেচে দিতে হলো। প্রোমোটাররা তো ওৎ পেতেই ছিল। বিপদের দিনে তাড়াহুড়োয় ভালো দামও পাওয়া গেল না।”
চামেলীর সব কথা আর শেষ পর্যন্ত কানে যাচ্ছিল না…রুমনা নিজের চিন্তায় ক্রমশঃ নিজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলো…
প্রবালদের কোম্পানিতে অর্ডার আসছে না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। তাকে স্মার্ট সাইজ করার গ্লোবাল ডিসিশন নিয়েছে ম্যনেজমেন্ট। ডিক্লেয়ার করা হয়েছে ভি.আর.এস অর্থাৎ ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কীম। যাদের বসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই লিস্টের একেবারে প্রথম দিকেই প্রবালের নাম…
সম্বিত ফিরলো আবার চামেলীরই কথায়- “ও বৌদি আমি কিন্তু বাপের বাড়িতে মা বাবাকে , আমার বোনদের কারুকেই আজও বলিনি আমার বরের কাজ চলে যাওয়ার কথা। আমি নিজেও যে লোকের বাড়িতে বাসন মাজি, ঘর ঝাড়পোঁছ করি সেকথাও কেউ জানে না গো । তাই তো ওখানে গিয়ে থাকতে পারি না । কত যে নকল অভিনয় করতে হয়…ওদের আমি বলি- সকাল সকাল ফ্যাক্টরি যাওয়ার আগে আমার স্বামীকে টিফিন বানিয়ে দিতে হয় রোজ, আমার বাপু রাত্তিরে অন্য কোথাও থাকা চলে না…”
রুমনার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। নরম কণ্ঠে সান্তনা দিয়ে ও বললো- “তাতে কি হয়েছে চামেলী , তুই নিজেই তো এখন আট নয় বাড়িতে কাজ করিস…ভালোই তো রোজগার তোর…আর কোনো কাজই ছোট নয়…”
রুমনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চামেলী বললো- “বৌদি গো, আমিও কোনো কাজকেই ছোট ভাবি না, খারাপ ভাবিনা …তাই তো পায়খানা-বাথরুম ধোওয়ার কাজ বললেও আমি করে দিই… কিন্তু ওই যে আত্মীয়স্বজন…। আসল কথা কি জানো বৌদি, নিজের জীবন দিয়ে টের না পেলে কেউ অন্য কারুর কষ্ট বোঝে না গো। পেটের ক্ষিদে যে কি জিনিস…নিজের না পেলে কি টের পাওয়া যায়…বলো?”
সত্যিই তো, নিজের জীবন দিয়ে টের না পেলে অন্যের কষ্ট, অন্যের মনের কথা কিছু টের পাওয়া যায় না- চামেলীর কথাগুলো রুমনার মনের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকলো…
রুমনা নিজেও তো আই.টি. সেক্টরে মোটামুটি ভালোই একটা কাজ করে, তবুও প্রবালকে ওদের কোম্পানি জোর করে ভি.আর.এস. দিয়েছে- এই কথাটা কারুকে জানাতে এতো লজ্জা করছে কেন? কেন অফিসে বেরোনোর আগে ও পই পই করে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যায় স্বামীকে- “ব্যালকনিতে দাঁড়াবে না, ফ্ল্যাটের বাইরে যাবে না, কেউ যেন টের না পায় তুমি বাড়িতে বসে আছো…বেডরুমে বসেই নেটে নূতন চাকরির খোঁজ কোরো …কেউ যেন কিছু জানতে না পারে “
গত সপ্তাহেই পাশের বিল্ডিং এর তানিয়ারা বিশাল বড় একটা পার্টির আয়োজন করেছিল, সৈকতের প্রমোশন উপলক্ষ্যে। প্রবাল রুমনা সযত্নে সেটা এড়িয়ে গেলো মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে। বাপেরবাড়ি, দেওরের বাড়ি সব জায়গাতেই সামাজিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। প্রবাল-রুমনা আজকাল ব্যস্ততার অজুহাতে কোথাওই যাচ্ছে না।
কোনো মানুষই বোধহয় অপরের মনের কথা, কষ্ট সঠিক বোঝে না। হঠাৎ রুমনার মনে হলো-ও নিজেও কি পারে অন্যের কথা সত্যিই উপলব্ধি করতে ?
এই তো গত বছর, ওদের এই হাউসিং কমপ্লেক্সের স্যান্যাল দম্পতির একমাত্র ছেলের বিয়ে … অনুষ্ঠানের মাত্র তিনদিন আগে ভেঙ্গে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার সঠিক কারণ নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী গুঞ্জনে মেতে উঠলো। যেন তারা পেয়ে গিয়ে গিয়েছে এক রহস্যগল্পের খোরাক। রুমনা নিজেও কি একেবারেই কান পাতেনি সেই গল্পে? যোগদান করে নি?
তারপর যখন জানা গেলো, ডি ব্লকের কেয়ার মেয়েকে নিয়মিত নিয়ে যেতে হয় সাইকায়াট্রিস্ট এর কাছে কাউন্সিলিং এর জন্য। তখন? মহিলা মহলের আড্ডায় কত আলোচনা…কত অ্যানালিসিস…কেয়াদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। রুমনা কি একবারও তার প্রতিবাদ করেছিল?
আরও, আরও আছে…যখন স্কুলের বন্ধুমহলে খবর পাওয়া গেল- শৈশবের বান্ধবী সঞ্চারীর একমাত্র সন্তানটি ড্রাগ অ্যাডিকট্ হয়ে গিয়েছে…তখন?
কিম্বা নীপা সমরেশের বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ে? কজন ব্ন্ধু খবর নিয়েছিলো ওদের মনের অবস্থার? রুমনা নিজে? কতটুকু অনুভব করেছিলো? তার বদলে বন্ধুমহল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল নীপার বিবাহিত জীবনের পোস্টমর্টেমে। সিমপ্যাথী, এমপ্যাথি শব্দগুলো আসলে শুধুই ভেসে বেড়ায় ডিকশনারির পাতায়। মানুষের চরম বিপদের দিনে এখনও একজন দু’জনকে পাশে পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু মনের সূক্ষ বেদনা, দুঃখ, চিন্তা ভাগ করে নেওয়ার জন্য সত্যিই কি কারুকে পাশে পাওয়া যায়?
চামেলী তখনও বলেই চলেছে – “কি লাভ বলো বৌদি, নিজেদের দুঃখের কথা…অসুবিধার কথা অন্যকে জানিয়ে। মেজ বোনটা ছোটোবেলা থেকেই বড্ড হিংসে করতো। আমার অভাব অনটনের কথা শুনে মনেমনে হয়তো খুশিই হবে। বড় দিদিটা শুনলে বড্ড দুঃখ পাবে গো। মা বাবাও কাঁদবে…আমি ঝিয়ের কাজ করি জানতে পারলে…আনন্দ তো আর পাবে না…কি দরকার বলো নিজের কষ্টের কথা অন্যকে জানিয়ে …”
খাওয়ার টেবিলে বসা রুমনার চোখ দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো ক’ফোঁটা চোখের জল- বাস্তবটা যে এমনই …সত্যিই কেউ নেই পাশে …কেউ থাকে না। আজকের পৃথিবীতে মানুষ একা, একেবারে একা…নির্জন দ্বীপের মতো। ফেসবুক, ওয়াটস্আ্যপে ব্ন্ধুতালিকা উপচে পড়ছে। সুখের ছবি, সুখের গল্প তাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে বেশ লাগে …মন্দ কি? কিন্তু জীবন তো নয় নিরবচ্ছিন্ন সুখ…তবে?
ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল রুমনা। গ্যাসের ওভেনে চায়ের জল চড়ালো…তিন কাপ। প্রবাল, রুমনা আর চামেলী আজ একসাথে চা খাবে। তবে ওইটুকুই…ওই পর্যন্তই । গ্যাসের আগুনের দিকে তাকিয়ে রুমনা মনেমনে বললো- “নিজের কথা থাক্ নিজেরই কাছে…হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে…মনের কথা থাক্ মনেই। “