পাথরে লেখা নাম
-শুভায়ন বসু
পূর্বা আর পৃথা দুই পিঠোপিঠি বোন। মাত্র দু’বছরের ছোট বড়ো। একেবারে একই স্বভাব, একই গলার স্বর। যদিও পূর্বা ফর্সা, সুন্দরী আর পৃথার একটু চাপা রং, দেখতেও তেমন সুন্দরী নয়। দু’জনে খুব ভাব, খুব মিল। শুধু দুই বোন বলে নয়, ওরা একে-অপরের সবচেয়ে ভালো বন্ধুও,যেন হরিহর-আত্মা। রামপুরহাটের নিশ্চিন্তপুরে, সবাই জানত দু’বোনের এমন মনের মিলের কথা।
ওদের বাবা প্রতীকবাবু ওদের একই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। দু’জনেই পড়াশোনায় ভালো। দিদি পূর্বা খুব খেয়াল রাখে ছোট বোন পৃথার, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে দু’জনে দু’জনকে। পৃথাও দিদি বলতে অজ্ঞান, দিদিই তার টিচার ।দিদিই সবকিছু দেখিয়ে দেয়। পড়াশোনা, ছবি আঁকা, খেলাধুলা যাই হোক না কেন।
হঠাৎই এই দুই বোনের মধ্যে অযাচিতভাবে এসে পড়ল একটি ছেলে। পূর্বা তখন পরে ক্লাস টুয়েলভে। হঠাৎই বরুণ স্যারের কোচিং এ আলাপ হল রুপমের সঙ্গে।একটা ছটফটে দুরন্ত ছেলে, তার সঙ্গে তার স্বপ্নীল চোখ আর পড়াশোনায় দারুণ রেকর্ড, যেন ঠিক ম্যাচ করত না। দুজনেরই ভালো লেগে যায় দু’জনকে ।কোচিং যাওয়া-আসার পথে, একটুখানি পথ একসঙ্গে চলা, এই ছিল ওদের অস্ফুট প্রেম।
হঠাৎই পৃথার নজরে পড়ে যায় ব্যাপারটা। রূপমের বাইকে পূর্বা না! ব্যস আর যায় কোথায়? পূর্বা ধরা পড়ে যায় ।তারপর খানিক মান-অভিমান, রাগ। “কেন আমাকে বলিসনি আগে?” পৃথা কেঁদেই ফেলে। শেষকালে দুই বোনে রফা হয়। রুপমের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে পৃথার, পৃথাও বাড়িতে কাউকে কিছু বলবে না।
কিন্তু সমস্যা শুরু হল তখনই। যখন রুপমের সঙ্গে পরিচয়ের পর, তার কথা বলা, তাকানো, স্টাইল, সব কিছু ভাল লেগে যায় পৃথারও। মুখে কিছু বলতে পারে না, দিদির বয়ফ্রেন্ড বলে কথা। চোরাচাউনিতে চেয়ে থাকে শুধু, চোখে মুখে মুগ্ধতা। বারবার বোঝায় নিজেকে, না, এটা ঠিক হচ্ছে না, ওকে পিছিয়ে আসতেই হবে। মনে কোন দুর্বলতার স্থান নেই। দিদিকে যে সে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসে, তার সঙ্গে কোনো অন্যায় সে করতে পারবে না। সব ঠিকই, পিছিয়েও সে আসে জোর করে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে, কিন্তু গোপন মুগ্ধতা থেকেই যায়। দুর্গামন্দিরের পশ্চিমে, পাথরের উপর বসে, বিকেলের আলোয় যখন পূর্বা আর রুপমের প্রেম জমে উঠতো, আড়াল থেকে মাঝে মাঝে নজর রাখত পৃথা। ঈর্ষা? হয়ত বা।আসলে মানুষের মন তো! তার উপর মেয়ে হয়ে জন্মেছে দু’জনেই। স্বাভাবিক এই মুগ্ধতা। চোরাচাউনিতে বন্দী, অক্ষম গোপন প্রেম, কতই তো মরে যায়। এও হয়ত তারই নামান্তর।
ধীরে ধীরে পূর্বা আর পৃথার মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। পৃথা ঈর্ষা করতে শুরু করে পূর্বার দামাল প্রেমকে। দুই বোনে ক্ষণিক মানসিক দূরত্বও তৈরি হয়। পূর্বা হয়ত বুঝতে পার একটু, ভালোবাসা দিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করে বোনকে। বোন তো তার প্রাণাধিক প্রিয় ,কেউ নয় তার আগে। কিন্তু প্রেমের জোয়ারে ভাসতে শুরু করলে কোনকিছুই আর বেঁধে রাখতে পারে না কাউকে, প্রেমিকের চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না তখন।
তাই হল। ওদের বাইকে করে ঘুরে বেড়ানো বেড়ে গেল। কোচিং কামাই করে প্রেম, আর তার ফলে অবধারিতভাবেই পূর্বার রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল। প্রতীকবাবুর কানে এসেছিল কিছু কথা। একদিন বড় মেয়েকে ডেকে শুনিয়ে দিলেন দু’ চার কথা। ব্যাস! এইটুকুই। পূর্বা মনে করল ছোট বোনই নিশ্চয়ই লাগিয়েছে বাবাকে। দুই বোনে কথা বন্ধ, মনোমালিন্য, রেষারেষির শুরু সেই থেকে। হায়রে, রক্তের সম্পর্ক ,জন্মগত ভালোবাসা কোথায় গেল!
তবে ভালোবাসা মরে না, ভেতরে ভেতরে ঠিকই বইতে থাকে তার গোপন ধারা। দুই বোনে যতই ঝগড়া অভিমান হোক না কেন, হয়ত মিটেও যেত একদিন। কিন্তু হল না।
তার আগেই বিজয়া দশমীর দিন সন্ধ্যায় ঝড়ের বেগে এলো সেই দুঃসংবাদটা। বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে রূপম -পূর্বার ।দামাল গতিতে কোথায় যেন যাচ্ছিল দু’জনে মেনরোড ধরে, লেন ভেঙে উল্টোদিক থেকে এসে পড়েছিল এক কালান্তক ডাম্পার। সব শেষ! রুপম হাসপাতালে যাবার আগেই, পূর্বা খুব লড়েছিল মৃত্যুর সঙ্গে। কিন্তু দু’দিন পরে সেও আর চোখ খুলল না, ঢলে পড়ল রুপমের চলার পথে। নিস্তব্ধতা নেমে এলো নিশ্চিন্তপুরে, বাড়ি বাড়ি অরন্ধন।
তিন দিন ধরে কিচ্ছু খায়নি পৃথা। মা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন, বাবা বাকরুদ্ধ। সবাই ঘিরে রেখেছে ওদের।বাড়িতে শুধু কান্নার রোল, নানা স্বরে, নানা প্রেক্ষিতে।স্মৃতি বড় অবুঝ, মনটাও। কিছুতেই বাঁচতে দেবে না যেন। পাগলের মত হয়ে গেছে পৃথা। মনে তার ঝড়। দিদি নেই, ভাবতেও পারে না সে। এত আপনার জন, এইভাবে, দুম করে চিরতরে চলে যায় নাকি? বিশ্বাস হয় না পৃথার। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে, লাল চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ।এই বুঝি দিদি ফিরে এল। কেন, ফিরে আসবে না?
দু’দিন পরের কথা। পৃথা বাড়ির বাইরে প্রথম পা রাখে ।পায়ে পায়ে চলে আসে সেই দুর্গা মন্দিরের কাছে। এক অদৃশ্য অমোঘ টানে, এগিয়ে চলে পাথরের টিলাটার কাছে, যেখানে বসে থাকতো রুপম আর পূর্বা। কতদিন, কত প্রেম জমে উঠত ওদের এখানেই, লুকিয়ে দেখত পৃথা ,অদম্য আকর্ষণে। হঠাৎ পা আটকে যায় মাটিতে। একটা পাথর, তার ওপর খোদাই করা নাম “রুপম + পূর্বা”। একটু যেন হালকা হয়ে গেছে লেখাটা ক’দিনে। চোখ সরাতে পারে না পৃথা ।ও এই লেখা খোদাই করতে দেখেছে ওদের। ছোট একটা পাথরের মাথাটা ঘষে ঘষে ধার করে নিয়ে লিখেছিল ওরা । দুর্গা মন্দিরের আড়াল থেকে দেখেছিল পৃথা। এই সেই লেখা। অজান্তে চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে আসে পৃথার, পাগলের মত খোঁজে একটা নুড়ি। তারপর ছুটে যায় সেই পাথরের কাছে, আর জীবনের যত রাগ- দুঃখ- অভিমান সব যেন ঘায়ে ঘায়ে নেমে আসে সেই পাথরের উপর। ফোঁপাতে থাকে “দিদিভাই ,তুই এইখানে থাক, তুই আমাকে ক্ষমা করে দে দিদিভাই, তুই কোথায়, দিদিভাই ?” বারবার বলতে থাকে পৃথা। যেন এখনই জ্ঞান হারাবে, উত্তেজনায় ।আর তার পর ছোট্ট একটা পাগলামি আর আবেগের বশে,হাঁপাতে হাঁপাতে, অপটু হাতের আঘাতে রুক্ষ পাথরের উপর ফুটে উঠতে থাকে সেই দুটো নাম।ঘষে ঘষে সেই লেখা আবার জ্বলজ্বলে করে তোলে ও।মানুষ দু’টো নেই,শুধু পরিষ্কার হয়ে যায় পাথরে খোদাই করা “রুপম + পূর্বা”। দিনের আলো ঢলতে শুরু করে মন্দিরের আড়ালে।