আধুনিক কবিতা এবং দুর্বোধ্যতা
-সঞ্জিত মণ্ডল
এ প্রবন্ধের সামগ্রিক প্রেক্ষিতটা দু রকম দৃষ্টি কোন থেকে দেখতে চাই, প্রথমত, নিজে পাঠক হিসাবে। দ্বিতীয়ত, নিজে কবিতা লেখার চেষ্টা করি সেই হিসাবে।
মূল আলোচনায় ঢোকার আগে যেটা আমাদের জানতে হবে তা হচ্ছে, কবিতার সংজ্ঞা কী। কবিতা কাকে বলে?
কবিতা হচ্ছে কাব্য, যা ছন্দোবদ্ধ রচনা বা শ্লোক, কবিতা হচ্ছে পদ্য বা ছন্দিত মাধুর্য। তাহলে একটা ব্যাপার পরিস্কার হল যে,কবিতায় ছন্দ থাকতে হবে, আর কবিতাকে মাধুর্য মন্ডিত হতে হবে। আধুনিক পাঠক যদি আধুনিক কবিতায় এই ছন্দ ও মাধুর্যের অভাব দেখে সে তো দুর্বোধ্যতার দোহাই দিয়ে কবিতাকে পাশ কাটিয়ে যাবে। তাকে দোষ দেওয়া যায় না। রসকষহীন শুষ্কং কাষ্ঠং যেমন কবিতা হতে পারেনা, তেমনই কুবাক্য, কুকথা, বিভৎস, ভয়ংকর, আর দুর্বোধ্য শব্দও কবিতার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনা। শুধু তাই নয়, অর্থহীন ছান্দিক বাক্যসমষ্টি ও একই কারণে কবিতা পদবাচ্য নয়। পাঠকের অপছন্দের কারণ দুর্বোধ্য শব্দের সমাহারে দুর্বোধ্য বিষয়ে ঘোলাটে কবিতা, অজস্র মাথা ঘামানোর পরেও যার অর্থ উপলব্ধি করা যায় না। আমি নিজে পাঠক হিসাবে স্বচ্ছ মাধুর্য মন্ডিত সুললিত ছন্দোবদ্ধতা পছন্দ করবো। সেখানে শুষ্কং কাষ্ঠং নয়, বরং নীরস তরুবরঃ চাইবো। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য কবিরা যে সমস্ত গদ্য কবিতা লিখেছেন সেই গদ্য কবিতারও একটা অন্তর্নিহিত ছন্দ রক্ষা করেছেন, যতিচিহ্নর সঠিক ব্যবহার করে পাঠ করলে সে ছন্দের মর্মবাণী বর্ণে বর্ণে উপলব্ধি করা যায়।
কবিতার কালকে যদি চর্যাচর্যবিনিশ্চয় যুগ, রবীন্দ্র যুগ, কল্লোল যুগ আর বর্তমান যুগের প্রেক্ষিতে বিচার করি তাহলে একটা জিনিস আমাদের কাছে পরিস্ফুট হয় যে ছন্দিত বাণীর লালিত্য সমৃদ্ধ মাধুর্য মন্ডিত কবিতাই পাঠকের মনে দোলা দিয়েছে সব থেকে বেশী। বর্তমান যুগে আধুনিক কবিতা লিখিয়েরা কত জন সত্যিকারের কবি এবং কতজন ছন্দিত মাধুর্য মন্ডিত সুললিত কবিতা লেখেন সে সম্বন্ধে কোনো সমীক্ষা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।কাজে কাজেই পাঠক হিসাবে আমার অত্যাধুনিক দুর্বোধ্য কবিতা পছন্দ না ও হতে পারে, আর যথারীতি এইভাবেই কবির সাথে পাঠকের একটা দূরত্ব তৈরি হয়।
এবার আসি সামান্য একটু আধটু লেখা লেখি করি বলে সোসাল মিডিয়ার পাঠকের কাছে পৌঁছাতেই হয়।কারণ তারাই কবিতার মানদণ্ড বিচার করে। এখানেই আমার প্রশ্ন ঠিক কতজন কবিতা পড়েন সেই সঙ্গে ভালো মন্দ লাগার মন্তব্য ও করেন, আর কতজন না পড়েই মন্তব্য করেন। বহুসংখ্যক গ্রুপের সাথে জড়িত থাকার সুবাদে বেশ কিছু বিষয় না পড়া মন্তব্য সম্বন্ধে অবহিত হয়েছি। সামান্য কিছু নমুনা পেশ করতে চাই, যেমন, বেশ, ভালো, সুন্দর, খুব ভালো, চমৎকার, ইত্যাদি। এই মন্তব্য গুলো কবিতা না পড়েই করা যায়, এগুলো আসে প্রধানত এডমিনদের চাপে, কেননা এতো গুলো মন্তব্য করতে ই হবে, ছাড়া যাবে না।কেউ কেউ আবার অতিরঞ্জিত একই মন্তব্য বহু কবির কবিতার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, সে কবিতার বিষয় বস্তু যতই ভিন্নতর হোকনা কেন। আর এক ধরনের পাঠক আছেন যারা পাশ কাটিয়ে যান। বিভিন্ন আলোচনা সভায় তাদের বক্তব্য শুনেছি, কেন তারা মন্তব্য না করে পাশ কাটিয়ে যান। তাদের উত্তর শুনে অবাক হয়েছি। তাদের একদলের বক্তব্য, কেউ বলেছেন, কবি যদি কিছু মনে করেন, আর একদলের বক্তব্য, কি বলতে হবে বুঝতে পারি না বলে মন্তব্য করি না।
আমি নিজে লিখি তাই আমাকে তাদের বলতেই হয়েছে যে, আপনি কষ্ট করে পড়েছেন, যদি কি পড়েছেন তা বুঝতে না পারেন, সেটাই কবিকে সরাসরি বলুন, যে আপনার কবিতা দুর্বোধ্য তাই কিছু মন্তব্য করলাম না। তাহলে কবি অন্ততঃ পক্ষে সম্বিত ফিরে পাবে যে লেখা আরও সরল ও হৃদয়গ্রাহী করতে হবে। আর সব থেকে কষ্ট হয় যখন দেখা যায় কোনো ভাল লেখার কমেন্ট এসেছে গুড মর্ণিং, শুভ দুপুর বা গুড ইভিনিং ইত্যাদি বলে। হে পাঠক আমি মনে করি আপনি শুধু ই পাঠক নন আপনি কবির শিক্ষক ও বটে। আপনার ও কবির সুন্দর মেল বন্ধনের ফলে কবিতার উন্নতি হবে, আর সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যের উন্নতি হবে।
উপসংহারে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে দুর্বোধ্যতার দায় শুধু মাত্র কবির ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবেনা, কবিতা বোঝার জন্য পাঠককে ও যথেষ্ট দায়িত্ব নিতে হবে। কবিতা না পড়েই কবিতার বোধ্যতা দুর্বোধ্যতা বিচার করা যায় না। কবির যেমন দায়িত্ব আছে তার কবিতা সাধারণ্যে সমাদৃত হোক এমন লেখনী লেখার তেমনি পাঠকের ও দায়িত্ব থেকে যায় কবিতা পাঠ করার আর তার গুণাগুণ সম্বন্ধে কবিকে অবহিত করার।
আগেকার মতো এখন কবিতার বই কিনে কবিতা পড়তে হয় না, এখন কবিই কবিতার সম্ভার নিয়ে সরাসরি পৌঁছে যান পাঠকের দরবারে, সোস্যাল মিডিয়ার হাত ধরে। কবিতা যদি সুখপাঠ্য হয় কবি নিশ্চিত ভাবেই সুমন্তব্য তো পানই বিভিন্ন ধরণের সম্মাননা ও পান। পাঠকের করা মন্তব্য ও এডমিন দের সুবিবেচনার সৌহার্দ্যে কবিরা সম্মানিত হন। এতে একদিকে যেমন কবি আরও ভালো লেখার জন্য উৎসাহ পান তেমনি বাংলা সাহিত্যের ও কিছুটা সেবা করা হয়। কবিতার ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়।
বাঙালী অত্যন্ত আবেগ প্রবণ জাতি, আবেগ আছে বলেই কবিতাও আসে বাঙালির ই বেশী। সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন যত কবিতা লেখা হয় তার অর্ধেকই লেখে বাঙালিরা। আর সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে সে কবিতা পৌঁছে যায় পাঠকের ঘরে ঘরে। তাই লেখক লিখবে আর পাঠক তা পড়ে তার মতামত জানাবে এটাই হবে কবি ও পাঠকের সঠিক মেলবন্ধন। কবির দায়িত্ব যেমন পাঠককে কাছে টেনে নেওয়া, তেমনি পাঠকের ও দায়িত্ব কবিকে উৎসাহিত করা।