Site icon আলাপী মন

ভালবাসার মানুষ

ভালবাসার মানুষ

-শুভায়ন বসু

 

 

“বাবা আসছেনা কেন?” এই নিয়ে পাঁচবার প্রশ্ন করল মিতুন ।প্রথম প্রথম বিরক্ত হচ্ছিল অপরাজিতা।বলছিল “আমি কি করে বলব কেন আসছে না? ঠিক আসবে এখন।” ঘরের কাজ করতে করতে বারান্দা দিয়ে দূরে রাস্তায় চোখ চলে যাচ্ছিল বারবার। মিতুনেরও আজ পড়ায় মন নেই ।সবে তো বাজল মাত্র সাড়ে ছটা। মানুষটা আসার সময় পেরিয়ে যায়নি এখনো।
টিভিতে আজ মন বসলো না অপরাজিতার। এত দেরী করেনাতো অভী সচরাচর। কিছু বলেও যায়নি সকালে। ফোনটাও কখন থেকে সুইচড্ অফ। একটু চিন্তা হচ্ছে, রাস্তাঘাটের ব্যাপার। সব সময় খারাপ চিন্তাটাই আগে মাথায় আসে ।মেয়েটা যখন বারবার ঘ্যানঘ্যান করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল, শেষে মিথ্যে করেই বলে দিল অপা “বাবার অফিসের কাজ ছিল বোধহয়, ফিরতে তাই দেরি হচ্ছে। তুমি হোমওয়ার্ক করে ফেলো।”
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো অপা। মেয়েটাও সঙ্গ ছাড়ছে না ।মেয়েটা বড্ড বাবার ন্যাওটা ,যত রাতেই বাবা ফিরুক না কেন, একছুটে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর অভীরও কোন ক্লান্তি নেই ,ব্যাগ-জুতো-মোজা কোথায় কোথায় ছুঁড়ে ফেলে, মেয়েকে নিয়ে খাটে গড়াগড়ি, আদর।
“তুমি এখানে কি করছ মিতুন? যাও ঘরে। হোম টাস্ক গুলো হলো না এখনও ?বাবা এখনই আসবে, যাও বলছি।” মৃদু শাসনের সুর অপরাজিতার গলায়।ওর দুশ্চিন্তামগ্ন অন্যমনস্কতা ছ’বছরের মেয়েরও নজর এড়ায়না বোধহয়। তাই মেয়ে কাছ ছাড়ে না মায়ের। দুজনে তাকিয়ে থাকে তৃতীয় ব্যক্তিটির ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ।মায়ার বাঁধন একেই বলে।
টিভিতে কোন প্রোগ্রামই তেমন ভাল লাগছে না আজ। আরও একবার চেষ্টা করেছে অভীর মোবাইলে। এখনো সুইচড্ অফ।এবার একটু দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো অপার। আর কাকে ফোন করবে, কোথা থেকে খবর পাবে?অভীর কোন বন্ধুকে ফোন করবে কি ?কিন্তু এই ডিপার্টমেন্টে তো ওর সবেমাত্র বদলি হয়েছে, সে রকম কোনো কলিগের নাম্বারও নেওয়া হয়ে ওঠেনি ।কি করবে ও?
আটটা বাজল, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে না খেয়েই। মোবাইলে একটা ফোন এলো, বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ও,বাবার ফোন ।অভী ফেরেনি শুনে বলল, “দ্যাখ ,আজও তো অবরোধ হয়েছে কলেজ স্ট্রিটে। কলকাতার রাস্তাঘাট যা ,কারো বাড়ি ফেরার টাইমের ঠিক নেই ।চিন্তা করিস না ,ঠিক ফিরে আসবে।”বাবারা এরকমই হয়,কত সহজে অস্থির মনে শান্তির আশ্বাসবাণীটুকু ভরে দিতে পারে।মনে একটু বল পায় অপা।কিন্তু রাস্তার জ্যাম, মিটিং ,মিছিল ,অবরোধ তো আগেও হয়েছে ।অভীও জানিয়ে দিয়েছে যে বাড়ি ফিরতে দেরী হবে ।কিন্তু আজকে একটাও ফোন করলো না কেন ?মোবাইলটাই বা সুইচড্ অফ কেন? দুশ্চিন্তাটা আবারও ঘিরে ধরেছিল অপাকে ।কিছু ভাল লাগছিল না ,অসহায় লাগছিল।
ঘড়ির কাঁটা কথা শুনছে না, ন’টা ছুঁইছুঁই ।বাবাকে আবারও ফোন করতে হল অভীর অফিসে একবার ফোন করে খোঁজ নেবার জন্য। পুরনো ডিপার্টমেন্টের তন্ময়দা, সৌভিকদা সবাইকে ফোন করা হয়ে গেছে, কেউ কিছু বলতে পারেনি। বুকের মধ্যে উৎকণ্ঠাটা এখন অনেক বেড়ে গেছে বুঝতে পারে অপা। একবার গেট অব্দি হেঁটে গিয়ে ঘুরে এসেছে। দারোয়ান শিবপ্রসাদ বলেছে “বাড়ি যান ম্যাডাম, বাবু ঠিক ফিরে আসবে। আজকে রাস্তায় বহুৎ জ্যাম আছে।” কিন্তু কোথাও কোনো খবর পাওয়া গেলনা। দুশ্চিন্তাটা গ্রাস করে ফেলল অপাকে। অথচ মেয়েটা কি নিষ্পাপ মুখে শান্তির গভীর নিদ্রায় মগ্ন ।কি নিশ্চন্তে মিথ্যে আশ্বাসটুকুকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে।হায়রে কেউ যদি এমন আশ্বাস দিতে পারত অপাকে,কেউ যদি দিত একটু মনের শান্তি।কি হলো অভির?
অপা আর ভাবতে পারেনা। অনেক পুরনো কথা মনে আসতে লাগলো, অনেক অযথা ঝগড়া, অনেক অভিমান ।”আজ আসুক অভী, আর ঝগড়া করব না কখনো”, মনে মনে বলে অপা।চোখে একরাশ জল কোথা থেকে জমা হয়েছে, মনে ঝড় ।”কোথায় গেলে অভী? কি করব আমি একা?”, বিপন্ন,বিপর্যস্ত অপা।বড্ড অসহায়।
দরজা খোলাই ছিল,হঠাৎ মনে হয় কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে ।চমকে ওঠে অপা। ” একি, সব অন্ধকার কেন? কি করছো তোমরা ?”চেনা স্বরে সম্বিত ফেরে অপরাজিতার। বুঝতে পারে মানুষটা ফিরেছে। নিমেষে সব উৎকণ্ঠার অবসান ,হঠাৎ এত আবেগ উঠে আসে ওর গলা দিয়ে !জীবন-মরণ যাই বল, সব তো এই টুকুই ।এই অভী আর মিতুন ।নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা অপা। একটা আশ্রয় চাই। ঝাঁপিয়ে পড়ে অভির বুকে। চেনা ঘামের গন্ধে মুখটা গুঁজে দিয়ে ডুকরে ওঠে ,”কি করছিলে এত রাত পর্যন্ত ,কেন এত দেরী করলে, কেন একবারও জানাওনি ……..”
সব ভালবাসার মানুষই জানে এই সময় কিছু বলতে নেই। শুধু পাল্টা অনুভূতির উত্তাপে মুড়ে ফেলতে হয়, জড়িয়ে নিতে হয় আশ্লেষে।

Exit mobile version