“ন কাঠা”
-তন্ময় সিংহ রায়
‘আ…মোলো-যা, মরন দশা! মড়ার কাকগুলো ভর দুপুরে এরম বাড়ির ওপর ঘুরে ঘুরে কা কা করচে কেনো বলতো! হইই হুস্ হুস্… যাঃ! যাঃ!’ এদিকে, প্রতিদিনের আদর্শমিশ্রিত কর্তব্যকে পালনের নির্ভেজাল ইচ্ছায় সেদিনও পাশের বাড়ির পুঁটি’র বুড়ি ঠাকুমাটা হাতে এঁটো থালাটা নিয়ে ডাক ছাড়লো ‘আ তু…আঃ! আঃ!’ আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে আনুমানিক সাতাশ হাজার দুশো আলোকবর্ষ গড় দুরত্বে অবস্থিত জ্বলন্ত গ্যাসীয় পিন্ডটা সেদিন যেন বেশ রেগেই ছিলো। তার উপরে হলুদ প্রকৃতির স্বাধীনতা অর্জনকারী বাতাসটা যেন চুড়ান্ত অভিমান করে সেদিন এদিক পানে আসেইনি এমনটাই মনে হচ্ছিল। দুরে…মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল ও স্বাস্থ্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিশালাকৃতির নগ্ন বটগাছটা তাকিয়ে কেমন যেন অশুভ একটা ঈঙ্গিত করছে বলে হঠাৎ-ই মনে হোলো, নাঃ চোখের ভূল!… তখনও পর্যন্ত তিন ছেলের ক্লাস ফোর পাশ গ্রাম্য মা-টা জানতোই না যে কাকগুলো তাদের ধ্বনির মাধ্যমে কি ভয়াবহ ঈঙ্গিত বহন করছে। মা-টার ছয় বছরের বড়ো ছেলে অপু ভর্তি হয়েছে গ্রামের এক সদ্যজাত ইস্কুলে। ইস্কুল গর্ভে জনা তিনেক মাষ্টার ও বিশ পঁচিশ ছাত্র-ছাত্রী, পড়াশুনা ভালোই। মেজোটা ভোলা আর নামবিহীন ছোটোটা ঘুমাচ্ছে ঘরে। আবার বিকট কা! কা! শব্দে হঠাৎ ছোটো ছেলেটা যেনো ডুকরে উঠলো কেঁদে! কেমন যেনো অজানা আতঙ্কে আচমকা এবারে ছ্যাঁত করে উঠলো মা-টার বুকের ভেতরটা। ছুটে ঘরে ঢুকেই ছোটো ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ব্লাউজের হুকটা আলগা করতে যাবে এমন সময়ে…. “অপুর মা… ও অপুর মা, সর্বনাশ হয়ে গেছে গো! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”.. বলতে বলতে জনা সাতেক লোক ও বউ দীর্ঘনিঃশ্বাসযুক্ত কয়েকটা ব্যস্ত মনসহ আস্ত শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হোলো বাড়িতে। ক্রমবর্ধমান হৃদস্পন্দনকে সঙ্গী করে চোখে মুখে অববর্ণনীয় ভয়, চরম উদ্বেগ ও মুহুর্তের তীব্র দুশ্চিন্তাকে সারা চোখ-মুখ ও মনে মেখে হুড়মুড়িয়ে মা-টা বাইরে বেরোতেই এক জমকালো সংবাদ যেনো মুহুর্তেই ধরে উপরে নিলো তার রক্তাবৃত হৃদপিন্ডটাকে! যেনো ছিনিয়ে নিলো তার অস্বচ্ছল সংসারের সুখ, শান্তি, স্বপ্ন ও তার শিশুগুলোর ভবিষ্যৎ, যেনো কেড়ে নিলো টুকটুকে লাল এক চিলতে সিঁদুরটার অধিকার চিরকালের মতন।…… ”পরাণদা গলায় দড়ি দিয়েছে।” দুশ্চিন্তাজর্জরিত বিস্ফোরিত চক্ষুদুটোর একটা নিথর ঝুলন্ত দেহকে দেখতে সেদিন একটা প্রায় আস্ত গ্রাম হাজির হয়েছিলো পাশের পাড়ার পুরানো তেঁতুল গাছটাকে ঘিরে। দুশ্চিন্তাহীন রাখতে ঋণাক্রান্ত পরাণদা তার একমাত্র বউটাকেও সেসব বিষয়ে কোনোদিন কিছু জানায়নি ও শেষ সম্বল হিসেবে কাঠা ন’য়েক ভিটেটাকে বাঁচাতেই নাকি তার এই অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুকে নিঃশব্দে বরণ বলে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু দিনেশ।…..অনুভূতি ও প্রায় অনুভূতিহীন তিনটে শিশু মন, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো মায়ের শাড়ির রঙের পরিবর্তন। দেখলো মায়ের কপালে লাল রঙের মৃত্যু ও বাবার চিতার শেষ আগুনটা। অবশেষে অমানুষিক পরিশ্রম ও অকল্পনীয় কষ্টে, একটা জীর্ণ শীর্ণ শরীরের পুষ্টি দুগ্ধে, সাধারণ মানের খাবার ও পোষাকে পরম স্নেহ-মমতায় বেড়ে উঠলো তিন ছেলে। দুর্ভাগ্যবশতঃ পড়াশুনাটা তিনজনের কারো জীবনেই পেলোনা পূর্ণতা! আজ সাতাশটা বছর কেটে গেছে তবুও মা-টা আজও যেনো স্পষ্ট শুনতে পায়, “অপুর মা… ও অপুর মা, সর্বনাশ হয়ে গেছে গো! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”…. আতঙ্কিত চিত্তে হঠাৎ-ই কেমন যেনো সে করে ওঠে! তিন বছরের এক কন্যা শিশুর অর্ধদায়িত্ববান মদখোর বাবা অপুটা আজ কাঁচা সব্জীর দু-দুটো দোকানের মালিক। ভোলাটা নিজে নিজেই বিয়ে করে নিয়েছে। প্রায় অনেককেই বলতে শোনা যায়, একটু দেখতে সুন্দর বলে ভোলার বউটা নাকি প্রায় সময়ে মহাকাশচারীর ভূমিকায় তার অস্তিত্বের নিদর্শন রেখে চলে। একটা অটো রিক্সা কিনে বেশ ভালোই আয় করে সে, আর সেই নামবিহীন দেবুটা আজ তো রঙের কাজে বেশ রঙিন করেছে তার নাম, একটা আলাদা তিন কাঠাও নাকি কিনেছে সে।
বেশ বছর দুই হোলো, প্রায় সময়েই তিন ভাইয়ের মধ্যে ন-কাঠা নিয়ে অশান্তিটা ছাড়িয়েছে তার মাত্রাটা। কানাঘুষোয় শোনা যায়, যত দিন নাকি বউদুটো আসেনি এ সংসার বজায় রেখেছিলো তার স্বাভাবিক ধর্ম। সারাজীবনের চুড়ান্ত মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ও নিঃস্বার্থ কর্তব্যপরায়ণা পরম মমতাময়ী বিধবা বুড়ি মা-টার শেষ জীবনের এ পরিণতি পুরো গ্রামটাকে পর্যন্ত কাঁদিয়েছিলো এমনটাই শোনা যায়। একদিন ভোলার মাধ্যমিক পাশ সুন্দরী বউটা ধাক্কা মেরে তার শাশুড়িকে ঘর থেকে বর্জ্য পদার্থের মতন ফেলে দিয়ে রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপিত স্ব-শরীরে মন্তব্য করে ‘বুড়িটা মরেও না, ছেলেগুলোর ন-কাঠা ভাগ করে দিতে পারিসনি? সারাজীবন করলিটা কি?….স্বামীটাকে খেলি আর নিজে বসে শুয়ে গিলেছিস!’….একটা ঝামা ইঁটে মাথাটা লেগে ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়েছিলো গলগল করে অনেকটাই আর কোমরে হাতে ও পায়ে লেগেছিলো বিষম চোট!.. ঝামা ইঁটটা তার রুপ পরিবর্তনে ধারণ করেছিলো খয়েরি বর্ণ। বুকফাটা চাপা কষ্টে, জলভরা দুচোখে এ যন্ত্রণা ও অপমানের কারণটা সে (মা-টা) জানতে চেয়েছিলো পরম করুণাময়ের কাছে, উত্তর সে পায়নি। খুঁজেছিলো এক টুকরো নিঃস্বার্থ সহানুভূতি, তাও সে পায়নি। দিনটার সেই মুহুর্তটার সাক্ষী ছিলো কিছু প্রতিবাদহীন ও হীনা প্রতিবেশী ও প্রতিবেশিনী। যারা প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলো, চরম অপমানের বোঝা ও যন্ত্রণা কাঁধে তারা ফিরেছিলো বাড়িতে।’তোমরা আমাদের সংসারে নাক গলাতে আসো কেনো হে? আমরা তো যাইনি, এটা আমাদের সংসারের ব্যাপার, যাও যাও এখান থেকে!’ একদিন নির্দ্বিধায় খুব স্বাভাবিকভাবেই ছোটো ছেলেটা তো বলেই বসলো, ‘মা তুমি মরলে তোমার ভাগটা কিন্তু আমায় দেবে।’ কারণ হিসাবে বিশ্লেষণের প্রকৃতি এমন যে সেবারে মায়ের চোখের ছানি কাটাতে অনেক বেশি টাকা তার বেরিয়ে গেছে তার উপরে টুকটাক হাতে টাকাকড়ি দেওয়া। টানা দুবছর অবেলায়, দুপুরে দুমুঠো ডাল-ভাত খাওয়ানোয় বড় বউটা একটা বৃহৎ অধিকারের ডালাকে সুসজ্জিত করে তো সমানে বলেই চলেছে মা, ‘তোমার রুপোর চেনদুটো ও কাঠের ওই আলমারিটা কিন্তু আমায় দিও, তোমার নাতনীর বিয়েতে চেনটা ভাঙিয়ে কিছু গড়িয়ে দেবো, তোমারই তো বড়ো নাতনী বলো? আর তোমার ছেলে বলছিলো, পুব দিকটার ওই এক কাঠায় তো ও চার পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন সব্জী চাষ করে আসছে তাই ওটা যদি ওকে লিখে দাও তো…! মৃত্যুর পরে এটা ওটা নিয়ম পালন, লোক খাওয়ানো! সে অনেক খরচ!’ নির্বাক ও হতবাক অসহায়া বুড়ি মা-টা শেষ কয়েকটা দিন প্রতি রাতে অযত্নে নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে একান্তে শুয়ে হাতদুটো জড়ো করে তার স্বামীকে প্রণাম করে বলতো-”ওগো তুমি একটাবার দুচোখ মেলে দেখো তোমার তুলতুলে শিশুরা কত বড়ো হয়ে গেছে! ওরা আর আমার দুধ চায় না, তুমি ওদের বুকভরা আশির্বাদ কোরো, ওরা যেনো সুখী হয় এই তোমার দেওয়া ন’কাঠায়।”
-“পারলে আমায় ক্ষমা কোরো অপুর মা। সুখ, শান্তি ও ভালো খাওয়া-পরা, আমি কিছুই তোমায় দিতে পারিনি। তোমার বুকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা পরিবেশ, এমন নরকে পরিণত হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনোদিন, বিশ্বাস করো তুমি আমায়। যোগ্য স্বামীর পরিচয় আমি দিতে পারিনি, বিশ্বাসঘাতক স্বামীটাকে তুমি ক্ষমা কোরো। নিজে মুক্তি নিয়ে তোমায় পারিনি দিতে মুক্তি..অপুর মা! এ ঋণ পরিশোধযোগ্য নয় জেনেও, যদি অন্য কোনো জীবনে তোমায় স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়, চেষ্টা করবো তোমার এ ঋণ শোধ করার। শুধু একটা বার ক্ষমা কোরো আমায়।”
এ স্বপ্ন গভীর ঘুমে জীবন্ত হলেও, সেদিন ভোর বেলায়…অপমানিত, লাঞ্ছিতা ও অবহেলিতা কর্তব্যপরায়ণা বিধবা মা-টা আর কোনোদিন ও একটা নতুন দিন আর দেখতে পায়নি।।