শেষের পথে
-রুদ্র প্রসাদ
(১)
আলোর আবছায়া রেখা জানালা গ’লে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘরের ভেতর। আধপোড়া ধূপের ধোঁয়া এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। তার মাঝে আট বাই বারোর ফ্রেমে আটকে থাকা মুখে লেগে আছে হালকা হাসির আভাস। সদ্যফোটা রজনীগন্ধার মালা যেন আরও মোহময়ী করে তুলেছে অনুপমাকে। দেখতে দেখতে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিলেন শান্তনু, এমন সময় মোবাইলের টুংটাং শব্দ তাঁকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।
সামনে অনেক কাজ। গত কয়েকটা দিনেই বেশ কিছু মুখোশ কদর্যভাবে খসে পড়ে বেরিয়ে এসেছে আসল চেহারাগুলো। তিক্ত হ’লেও কঠোর সিদ্ধান্তটা একরকম নিয়েই ফেলেছেন, এবার শুধু জানিয়ে দেওয়ার পালা। ‘আরও একটা যুদ্ধ অপেক্ষা করছে, যা কুরুক্ষেত্রের তুলনার কোনো অংশে কম নয়। অর্জুনের তবুও একটা শ্রীকৃষ্ণ ছিল, কিন্তু এখানে চক্রব্যূহে একেবারেই একা। কোথাও নিজের বলে কেউ নেই! তবুও অভিমন্যুর মতো বিজিত নয়, জয়ী হতেই হবে, তা সে যেভাবেই হ’ক না কেন…’, ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তাঁর। যদিও বয়সের সংখ্যাটা সত্তর ছুঁয়ে ফেলেছে, তবুও শিরা-উপশিরায় পুরোনো আগুনে দাপাদাপিটা অনেকদিন পর বেশ টের পাচ্ছিলেন। একসময় “অনুর অশান্ত” বলে খুব খ্যাপানোর চেষ্টা করত অনুপমা, আর তিনি সেটা বেশ উপভোগও করতেন। কিন্তু গত কয়েকদিনেই সব কেমন আমূল বদলে গেছে! কথাগুলো মনে পড়তেই মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল, চোখ বন্ধ করে বসে পড়লেন নিজের প্রিয় আরামকেদারায়। মনের ক্যানভাসে ভেসে বেড়াতে লাগল দগদগে ঘায়ের মতো কিছু সদ্য ঘটে যাওয়া অতীত।
(২)
গত বেশ ক’বছর হ’ল তেমনভাবে বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোনো হয়নি। দু’জনার সংসার হ’লেও ঘর ছেড়ে বেরোতে নানা ঝামেলা – ব্যাগ গোছানো, টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং ছাড়াও পেপারওয়ালা, দুধওয়ালা, কেবলওয়ালা, কাজের লোকেদের বারণ করা, তালাবন্দী ইত্যাদি হাজার একটা বাধা। বয়সের কারণে একটু নিরিবিলি আর নির্ঝঞ্ঝাট থাকার প্রয়াসী শান্তনু পুরো সংসার অনুপমার হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। অন্য কোনো পরনির্ভরতাও নেই। স্বচ্ছলতার সাথে থাকা অভাবটুকু শুধুই মানসিক, জীবনের সায়াহ্নে এসে দু’জনেই সেটা অনুভব করেন। একসময় নিয়ম করে বছরে দু’একবার বেরোতেন, কিন্তু ইদানিং গ্যাস, অম্বল, প্রেসার, সুগার – সবমিলিয়ে আর পেরে উঠছেন না। আগে ছেলেরা আসত, গত বছর পাঁচেক হ’ল তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, কাজের চাপ, সাংসারিক ঝামেলা, নানা অজুহাতে আর এমুখো হয়নি। যতটুকু যোগাযোগ ঐ মুঠোফোনের বদান্যতায়, তার তাগিদও এই তরফেরই।
শান্তনু সরকারি চাকরিতে যখন ছিলেন, তখন ছুটি বিশেষ মিলত না। আর এখন তো সারাক্ষণই ছুটি। আগে ভাবতেন, ‘ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসারের চাপমুক্ত হওয়া যাবে আর চাকরির পরে তো অঢেল সময়, তখন যেখানে খুশি যাওয়া যাবে’। কিন্তু তেমনটা আর হ’ল কোথায়!
হায়দরাবাদে এক বেসরকারী কোম্পানির উঁচু পদে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনীয়র বড়ো ছেলে, সাম্যদীপের কাছে অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তনু আর অনুপমা, ইচ্ছে ছিল সপ্তাহখানেক কাটিয়ে নিজাম প্যালেস, গোলকুণ্ডা ফোর্ট, রামোজী সিটি দেখার ফাঁকে আশেপাশে ঘুরে ছেলে, বৌমা, নাতনীর সাথে সময় কাটিয়ে, ফেরার আগে নিজেদের স্মৃতির ঝুলি ভরে নেবেন অবসরে রোমন্থনের জন্য। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই ধাক্কা খেতে হ’ল। সদ্য পরিচিত এক স্থানীয় প্রবাসী বাঙালির আমন্ত্রণে গিয়ে ফিরতে একটু সন্ধ্যাই হয়ে গিয়েছিল। ঘরে ঢোকার মুখে শুনেছিলেন বৌমার বিরক্তিমাখা গলা, “আমাদের জ্বালানো ছাড়া কি তোমার বাবা-মায়ের আর কোনো কাজ নেই! তুমি কিছু বলবে? না আমাকেই সব করতে হবে?”
দু’জনেই খুব আশা নিয়ে ছেলের জবাবের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু যখন কানে এল, “যদি কিছু বুঝতে না চায়, কি আর করি বলো। দুটো দিন দাও। কিছু বলতে গেলেই তো রাগারাগি আর অশান্তি। যদি বুঝতে না চায়…”, আর কিছু শোনার প্রবৃত্তি হয়নি। বিচলিত শান্তনু সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করেছিলেন, ‘ঋতু পরিবর্তনে কেবল দিন বদলায় না, অনেক কিছুরই বদল ঘটে, স্বজনেরাও তার বাইরে নয়।’ পুরোনো দিনের মানুষ শান্তনু স্বভাবে গম্ভীর, জেদী ও নির্ভীক, হয়তো মুখের ওপর অপ্রিয় কথা বলেই দিতেন, কিন্তু অনুপমার মৃদুস্বরে “কিছু ব’লো না” আকুতি তাঁর কণ্ঠরোধ করে দিয়েছিল।
বৌমার উষ্মা আর বড়ো ছেলের আলগা ব্যবহার মন ভেঙে দিয়েছিল। হয়তো আধুনিক সমাজে তাঁদের উপস্থিতি বেমানান বা ফ্ল্যাট কালচারে আর সাহেবী কেতায় অনভ্যস্ততা অনুঘটকের কাজ করেছিল। রাতেই সব গোছগাছ করে পরের দিন নাতনীকে শেষ বেলার আদর করে বিদায় নিতে হয়েছিল সব অনিচ্ছা অগ্রাহ্য করেই।
(৩)
মনের জ্বালা জুড়াতেই এক রকম বিনা নোটিসে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ছোটো ছেলের কাছে। এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিলেন মুম্বইয়ের খার অঞ্চলে থাকা নামজাদা ট্যাক্স কনসাল্টেন্ট ছোটো ছেলেকে। সায়নদীপ বেশ কিছু পরে এসেছিল নিজের নতুন কেনা গাড়িতে চড়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, “একটা খবর দিয়ে তো আসতে হয়। বয়স তো অনেক হ’ল, ম্যানার্স বলে কি কিছুই শেখোনি! এবার কি হবে? আমরা তো কালকেই চলে যাচ্ছি, এই ট্যুরটা কোনোভাবেই ক্যানসেল করা যাবে না।”
অনুপমার ইশারায় চুপ করে গিয়েছিলেন তখনকার মতো। নিজেদের জিনিসপত্রের ব্যাগ আর খোলেননি। সন্ধ্যায় জনান্তিকে ধরা গলায় বলেছিলেন, “ছেলেদের কাছে আমরা বোঝা হয়ে গেছি। বুঝতে পারছি না কেন এলাম এদের কাছে! চলো, আমরা সকালেই ফিরে যাই।” নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল অনুপমা।
রাতে যখন ওঁদের ফেরার কথা বললেন, তখন ছেলের নীরবতা দেখে বেশ ভেঙে পড়লেও সারসত্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি অনুপমার। তার আগে পর্যন্ত টানাপোড়েনের শিকার হয়েই ছিল, একদিকে স্নেহের বাতুলতা আর একদিকে নিজের মানুষটার যন্ত্রণা, মাঝখানে পিষে যাচ্ছিল প্রতিটা মুহূর্তে। আসার সময় প্ল্যান করেছিল সবাইকে নিয়ে সিদ্ধিবিনায়কে পুজো দিতে যাওয়ার। দু’চার দিন থেকে মেরিন ড্রাইভ, মহাবালেশ্বর ঘুরে বহুকাঙ্ক্ষিত এলিফ্যান্টা কেভস্ দেখে ফিরবে।
কিন্তু মন ভাবে এক, হয় অন্য কিছু। অনাহূত অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঠিকই, তবে অবাঞ্ছিত হিসেবে তো আর থাকা চলে না। প্রায় পঞ্চান্ন বছরের চেনা মানুষটা সময়ের সাথে সাথে একটু অভিমানী হয়ে উঠলেও এই বয়সে তাঁর মনে জ্বালাটা ঠিক কোথায় আর কিভাবে বেজেছে, তা বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি অনুপমার। বেঁচে থাকার জন্য সামান্য সহমর্মিতাটুকু ছাড়া আর কিছুরই তো প্রয়োজন ছিল না। সব বুঝত বলেই নিঃশব্দে চোখের জল ফেললেও সব সময় আগলে আগলে রাখত, কখনও একা ছাড়েনি তাঁকে। ‘কিসের টানে আর কাদের জন্য এতদূরে ছুটে এসেছিলাম? একটু সময় আর মনোযোগ দেওয়া কি এতোটাই দুঃসাধ্য ছিল? ছেলেরা একটু বুঝতেও চাইল না!’ – এই সব চিন্তার মাঝে কোনোরকমে কেটে গিয়েছিল বিনিদ্র রাতটা। সকালে বুকের কষ্ট বুকে চেপে, নাতিকে আদর করে বিদায় নিয়েছিলেন দু’জনে। গাড়িতে ওঠার আগে অনুপমা সস্নেহে “কি আর করবি বল, জানিসই তো তোদের বাবাকে। সাবধানে থাকিস, নিজেদের খেয়াল রাখিস…”, বললেও কোনো কথা বলেলনি শান্তনু।
(৪)
দু’জায়গাতেই প্রত্যাখ্যানের অপমানে মূক হয়ে যাওয়া শান্তনু মুখ খুলেছিলেন ফিরতি পথে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে, “চলো না অনু, গঙ্গার ধারে একটু বসি।” ভাঙাচোরা মানুষটাকে তখন আর কিছু না বলে অনুসরণ করেছিল অনুপমা। মিঠে-কড়া রোদে পৌষালী শীত আর গঙ্গার হাওয়া মিলে বেশ লাগছিল। কিছুক্ষণ পর অনুপমা প্রস্তাব রেখেছিল, “আর এক জায়গায় তো যাওয়া বাকি রয়ে গেল। চলো না সোনুর কাছ থেকে ঘুরে আসি। তোমারই তো মেয়ে।”
মুহূর্তে নড়ে উঠেছিল স্মৃতি। তাঁদের মেয়ে সন্দীপা, একমাত্র বলেই হয়তো পক্ষপাতিত্বের পাল্লাটা বরাবর তার দিকেই বেশি ছিল। গ্র্যাচুয়েশন কমপ্লিট করার আগেই একদিন নিজের পছন্দের মানুষ বেছে নিয়েছিল। কৌলীন্য বা শিক্ষা-দীক্ষায় কোনোভাবেই সমতুল্য না হলেও মেয়ের জেদে সবই মেনে নিয়েছিলেন। প্রথাসম্মতভাবে বিয়ে দেওয়ার পর যতদিন চাকরি ছিল, ততদিন পর্যন্ত মেয়ের সমস্ত অন্যায় আবদার মেনে সাধ্যমতো চাহিদা পূরণ করে গেছেন। যতদিন দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, ততদিনই সুসম্পর্ক বজায় ছিল। অবসরের পর থেকেই মেয়ের সাথে যোগাযোগ ক্রমশঃ কমে আসছিল, গত বছর পাঁচ-সাতেক হ’ল সেটাও বন্ধ। ট্রান্সপোর্টের ব্যবসাদার জামাই কোনোদিনই তাঁকে ‘বাবা’র জায়গা দেয়নি, বরং তাঁদের সহৃদয়তাকে বরাবর সন্দেহের চোখে দেখে এলেও সবসময় সুযোগ বুঝে ফায়দা লুটে এসেছে।
পুরোনো বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মনটা বিষিয়ে থাকলেও ডুবন্ত মানুষ যেমন হাতের কাছে খড়-কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে, ঠিক তেমনি অনুপমার কথায় কোথাও যেন একটু আশার আলো দেখেছিলেন সেদিন। যদিও অতীতের কথা ভেবে বলতে চেয়েছিলেন, ‘এতোকিছুর পর সব জেনে বুঝেও আবার?’ কিন্তু অন্তহীন শূন্যতার মাঝে হাহাকারের মতো বেজেছিল অনুপমার কথাগুলো, আকুলতা কোথাও স্পর্শ করেছিল শান্তনুকেও। আত্মজাকণ্ঠে স্বজনধ্বনি শোনার লোভ সংবরণ করা সহজ ছিল না। সব স্মৃতিকে দূরে সরিয়ে বলেছিলেন, “যাবে? চলো তাহলে। তবে বিশেষ কিছুর আশা মনে রেখো না। কম তো দেখা হ’ল না।”
ট্যাক্সি ধরে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল। নিউটাউনে মেয়ের ফ্ল্যাটে পৌঁছে একরকম শীতল অভ্যর্থনাই জুটেছিল। মায়ের সাথে কথাবার্তা সামান্য বললেও বাপের প্রতি নিরাসক্ত ব্যবহারই করেছিল মেয়ে। পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকা নাতির সাথে আর দেখা হয়নি। জামাই বাবাজীবনের দেখা মিলেছিল রাতে খাওয়ার সময়। স্খলিত কণ্ঠে নিয়মমাফিক কুশল বিনিময়ের পরই রণজয় তার স্বরূপ দেখাল। বলেছিল, “সবই শুনলাম। এমন তো হওয়ারই কথা। এতোদিন ধরে মাথায় তুলেছেন যখন মাথাব্যথা না হয়ে আর যাবে কোথায়। আপনারা যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতেই পারেন, তবে আপনার সম্পত্তির অর্ধেক আমার নামে লিখে দেবেন। অথবা পঞ্চাশ লক্ষ নগদে আমার অ্যাকাউন্টে ফেলে দেবেন। বলেন তো কাল সকালেই উকিলের সাথে কথা বলিয়ে দেব।…”
পরের কথাগুলো আর কানে ঢোকেনি। ঐটুকু শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। অনুপমারও তখন একই হাল। পরদিন কাকভোরে মেয়েকে ডেকে বলেছিলেন, “তোমার মায়ের আগ্রহেই দেখা করতে এসেছিলাম। হয়তো এই শেষবার। ভবিষ্যতে খেয়াল রেখো যেন আমার বাড়িতে তোমাদের ছায়াটুকুও না পড়ে।”
(৫)
বাড়ি ফিরে নাওয়া খাওয়া ভুলে দু’জনেই চুপচাপ বসেছিলেন। নীরবতা ভেঙেছিল অনুপমাই, “আমাদের কোথাও কি কোনও ভুল হয়েছিল?” ধরা গলায় ভাগ্যের দোহাই দিয়ে প্রবোধ দিতে চেয়েছিলেন শান্তনু, কিন্তু প্রশ্নটা নিজের মনেও ছিল প্রবলভাবে। রাতে চোখের জলে অ্যালবামের পাতা উল্টে স্মৃতিতে সুখ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন দু’জনে। পরস্পরের সাহচর্য্যে ব্যথা ভোলার চেষ্টায় শান্তনু বুঝিয়েছিলেন, “আমরা তো কারোর মুখাপেক্ষী নই। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য পরনির্ভরশীলও নই। তাহলে যাদের কাছে আমাদের কোনো মূল্য নেই, তাদের কথা ভেবে কেন কষ্ট পাচ্ছি? এখন থেকে ভুলে যাও তোমার ছেলে-মেয়েদের কথা। আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। এখন থেকে আমরা শুধুই নিজেদের জন্য বাঁচব।” কিছুক্ষণের মৌনতার পরে আবার মতামত নেওয়ার জন্য বলেছিলেন, “ভাবছি, এই বাড়িটা বিক্রী করে দিয়ে গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব, টাকা-পয়সা আশ্রমে দান করার পর মরণোত্তর দেহদান করে সব ঝামেলামুক্ত হয়ে যাব। যা পেনশন পাই তাতে তোমার-আমার দিব্যি চলে যাবে। জীবনের আর কতটুকুই বা বাকি… কি বলো?”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর দৃঢ় গলায় উত্তর এসেছিল, “বাড়ি বিক্রী, আশ্রমে দান বা মরণোত্তর দেহদান – যাই করতে চাও, তা হবে মরার পর। এই বাড়িটাতো খালি একটা বাড়ি নয়, এটা তোমার-আমার ভালোবাসার সৃষ্টি। এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও মরতে আমি পারব না। তোমাকেও তা করতে দেব না। তবে ছেলে-মেয়েদেরকে না দিয়ে আশ্রমে দান করে দেওয়া অনেক ভালো। তোমার এই সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করি, তবে যা হবে আমাদের মৃত্যুর পর, আগে নয়। লেখাপড়া করে সেভাবেই কাগজপত্র তৈরী করে রেখো।” একটু থেমে তারপর আবার আপনমনেই বলেছিল, “আর মনটা একটু থিতু হ’ক, একবার শান্তিনিকেতন যাব। রবিঠাকুরের পরশ ছুঁতে খুব লোভ হয়। ইচ্ছে করে কবিগুরুর ঘরের অলিতে-গলিতে ঘুরে আপন সত্তাকে একটু সজীব করে নিতে। বেশি কিছু নয়, একগোছা ফুল রেখে প্রণাম করে আসব।”
নামমাত্র খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন দু’জনেই। ঘুম নয়, পুরোনো স্মৃতি ভিড় করে এসেছিল শান্তনুর মাথায়। সেই কবে এক সরস্বতী পুজোতে ক্লাশ এইটে পড়া জোড়া বেনী দোলানো মেয়েটাকে মন দিয়ে ফেলেছিলেন, যে মনটা আজও সযতনে সেখানেই রাখা আছে। বছর সাতেকের লুকোচুরি খেলার শেষে অনুর নির্ধারিত বিয়ের আগের দিন সবার অমতে শুধুমাত্র ভালোবাসার ভরসায় অনিশ্চয়তার রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে রাতের অন্ধকারে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে পা-বাড়ানো, পরবর্তী কালে ঐ ঘটনার জেরে ত্যাজ্যপুত্র হওয়া, সামান্য কেরাণী থেকে ধাপে ধাপে পদোন্নতি, এই বাড়ি তৈরী – সবই মনে পড়ছিল এক এক করে। কঠিন সময়ে সবসময় সাহস জুগিয়ে হাসিমুখে পাশে থাকা অনুপমার জন্যই আজ টিকে থাকতে পেরেছেন তিনি। কখনো প্রশ্রয়ে, কখনো শাসনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে বাঁধন। অনুপমার সৌজন্যেই তিনি আজ হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রানুরাগী, কবিগুরুর সৃষ্টিই অনুর একমাত্র মুশকিল-আসান। রবিঠাকুর ছাড়া অনু অস্তিত্বহীন আর অনু ছাড়া তিনিও তাই। ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে দেখলেন অকাতরে ঘুমোচ্ছে অনুপমা। তার গায়ের লেপখানা ঠিক করে দিতে দিতে মনে মনে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই যাব অনু, দু’জনে মিলে চষে বেড়াব সারা শান্তিনিকেতন।’
(৬)
রোজ সকালে গরম চায়ের সাথে তাঁর ঘুম ভাঙানোর কাজটা অনুপমাই করে বরাবর। সেদিন ঘুম ভেঙে দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে একটু অবাকই হয়েছিলেন তিনি, ‘এখনও শুয়ে আছে অনু!’ মনে মনে ভেবেছিলেন, ‘ক’দিনে শরীর আর মনের ওপর তো কম ধকল যায়নি। ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। রোজকার নিয়ম পাল্টে আমিই না হয় আজ চা এনে ঘুম ভাঙাই।’ চুপিসারে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে অনভ্যস্ত হাতে চা করে এনে ডেকেছিলেন, “অনু…।” সাড়া মেলেনি। কাঁধের কাছটা ধরে নাড়া দিতে গিয়ে যেন তড়িতাহত হয়েছিলেন তিনি। সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা! সে শরীরে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই! ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে তাঁর অনু!
কতক্ষণ ঠায় বসেছিলেন মনে পড়ে না। তবে ঘড়ির সুরেলা শব্দ শুনে বাস্তবে ফিরেছিলেন, আসন্ন কাজগুলোর কথা মনে করেই উঠেছিলেন যন্ত্রের মতো। কিভাবে প্রতিবেশীদের খবর দিয়েছিলেন, তা ওরাই বলতে পারবে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছিল পুরো সময়টা। ওরাই ডাক্তার ডেকে এনেছিল। ডাক্তার এসে ‘ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ বলে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার পর আর কিছুই মাথায় ঢুকছিল না শান্তনুর। পরের কাজগুলো সামলাতে এগিয়ে এসেছিল মোড়ের মাথায় ক্লাবে দিনভর আড্ডা দেওয়া সেই ছেলেগুলো, যাদের ‘বখাটে ছোঁড়ার দল’ ভেবে বরাবরই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে এসেছেন। সব বন্দোবস্ত করার ফাঁকে শান্তনুকে সান্ত্বনা দেওয়ার কাজটা তারাই করেছিল। আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ বহুকাল ছিল না। ছেলে-মেয়েদের খবর দেওয়ার কাজটা প্রতিবেশীরাই করেছিল। মাঝে কেউ একজন জানতে চেয়েছিল, ছেলেদের আসা পর্যন্ত দাহকার্য স্থগিত রাখা হবে কিনা। উত্তরে কাঁপা কাঁপা অথচ দৃঢ় গলায় শান্তনু বলেছিলেন, “কারোর জন্য সময় অপেক্ষা করে না। অনুর মুখাগ্নি আমিই করব।”
ক্লাবের কিছু ছেলে আর কয়েকজন প্রতিবেশী শ্মশান-যাত্রী হয়েছিল। সব সমাধা করে ফিরে আসার পর ফাঁকা বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসছিল। আশেপাশের লোকজন সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কিছুতেই ধাতস্থ হতে পারছিলেন না। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না অনুর এভাবে চলে যাওয়া। ডাক্তারী হিসাব যতই হৃদরোগের কথা বলুক, তিনি তো জানেন ছেলে-মেয়েদের কাছে পাওয়া একের পর এক ধাক্কাগুলোই অকালে থামিয়ে দিয়েছে তার হৃদস্পন্দন।
ছেলে-মেয়েরা এসেছিল তাদের সময়মতো। তার আগেই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয়েছে ঘাটক্রিয়া। এখন ছেলে-বৌমা, মেয়ে-জামাই মিলে ঘরে অনেকে থাকলেও একটা বিষণ্ণতা পেয়ে বসেছে তাঁকে। বাপের সাথে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাক্যালাপ না হ’লেও নিজেরা দিব্যি খোশগল্প চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে শোকের লেশমাত্র নেই! সরাসরি কিছু না বললেও ওদের কথাবার্তা যেটুকু কানে আসে, তাতেই বুঝেছেন তাদের একমাত্র চিন্তা আর আলোচ্য বিষয় ‘কিভাবে কে কতটা বেশি এই বাড়িটার ভাগ দখল করতে পারে।’ সত্যি, কি বিচিত্র মানুষের মন! এরাই কিনা তাঁর আত্মজ!
(৭)
ইলেকট্রনিক দেয়াল ঘড়ির বাজনা নৈঃশব্দ ভেঙে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল শান্তনুকে, সাথে জানান দিয়ে গেল বেলা এগারোটা বেজে গেছে। এতো সময় স্মৃতিতে এতোটাই মগ্ন ছিলেন যে খেয়ালই করেননি কখন চোখ থেকে জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। হঠাৎ যেন একরাশ অভিমান এসে জমেছে মনে, ‘কেন অনু? কেন…? কেন এভাবে একা ফেলে চলে গেলে? সারাজীবন আগলে রাখবে কথা দিয়েছিলে, কেন কথা রাখলে না?’ গলার কাছে দলা পাকানো এক বুক কষ্ট নিয়ে ভেজা চোখে একবার তাকালেন অনুপমার ছবিটার দিকে, মনে হ’ল যেন সেই চিরপরিচিত ঢঙে অনুপমা বলতে চাইছে, ‘আমি তো আছি…।’
চাদরের খুঁট দিয়ে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে করণীয় কাজগুলোর কথাই ভাবছিলেন। ‘আর দেরিতে কাজ নেই’ ভেবে নিজেকে সামলে, মনস্থির করে এগোলেন দরজার দিকে, সামনে অপেক্ষায় আর এক রণাঙ্গন। বেরিয়ে দেখলেন সম্বন্ধী-ভগ্নীপতি মিলে কিছু নিয়ে বেশ হাসাহাসি করছিল, তাঁকে আসতে দেখেই চুপ করে গেল। মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না। ওদেরকে বললেন, “বাকিদের ডাকো, কিছু কথা আছে।”
সবাই আসার পর তিনি বলতে শুরু করলেন, “আমি তোমাদের মায়ের সাথে আলোচনা করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি গুরুদেবের আশ্রমে দান হিসেবে যাবে। কাগজপত্র সেভাবেই তৈরী করা হয়েছে।”
“কিন্তু বাবা…” বলে ছোটো ছেলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই তিনি হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে বলে চললেন, “আমাদের সম্পত্তি বলতে এই বাড়িটা আর আমার সামান্য পেনশন। এই বাড়ির পেছনে আমার মেহনত আর তোমাদের মায়ের সহযোগিতা ছাড়া আর কারোরই কোনো যোগদান নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছুই আমার নেই। কাজেই আমাদের সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার জন্য আমার কারোর অনুমতির প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, তোমরা বলতেই পারো। কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমার, যা আমি নিয়ে নিয়েছি। একথা ঠিক যে তোমাদের জন্ম তোমাদের ইচ্ছায় হয়নি। তবে তোমাদের কখনো কোনোকিছুর অভাব বোধ করতে দিইনি। নিজেদের সাধ্যমতো করেছি। কোথাও কখনো কার্পণ্য করিনি। এখন তোমরা যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত, সবারই নিজের নিজের সংসার হয়েছে। তোমাদের জীবনে আমরা কখনো কোথাও অংশীদার ছিলাম না, আর তোমাদের তথাকথিত কাস্টমাইজড্ মদ্যপ কালচারে আজ কোনোভাবে হতে চাইও না। আমি কোনোভাবেই তোমাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না, নতুন করে ভবিষ্যতে হ’তে ইচ্ছুকও নই। আমাদের সম্পত্তির ভবিষ্যৎ আমার মৃত্যুর পর আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ড ঠিক করবে। তোমরা এখান থেকে কিছু পাওয়ার অহেতুক আশা কর না।” একটু থেমে আবার বললেন, “আর একটা কথা, বেলা হয়ে গেছে। তোমাদের মা বলতেন, ‘বেলায় বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে গেলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।’ শেষবারের মতো খেয়ে যেও। তবে সূর্যাস্তের পর এ বাড়িতে আর যেন তোমাদের কারোর মুখ দেখতে না হয়। এবার তোমরা আসতে পারো।”
(৮)
শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ মিটে যাওয়ার পর ফাঁকা বাড়িতে আরও বেশি করে একা মনে হ’তে লাগল শান্তনুর। জীবনের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা এসে ঘিরে ধরেছে। চারদিকে শুধুই হতাশা। একাকীত্ব যেন প্রতি মুহূর্তে হাঁ করে গিলে ফেলতে চাইছে। দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে জীবন। এমতাবস্থায় তিনদিনের মাথায় ভোরে উঠে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তার আগে অনুপমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বললেন, ‘যাওয়ার আগে তোমার শেষ ইচ্ছেটা ঠিক পূরণ করে যাব, দেখে নিও।’
গন্তব্যে পৌঁছে অতীতের স্মৃতির সাথে মেলাতে গিয়ে বর্তমানের শান্তিনিকেতনকে বেশ মলিন বলেই মনে হ’ল তাঁর। ‘হয়তো সদ্য শেষ হওয়া পৌষ মেলার সৌজন্যেই চারপাশ নোংরা লাগছে’, মনে মনে ভাবলেন তিনি। একগোছা লাল গোলাপ নিয়ে কঙ্কালীতলার বেদিতে রেখে নতমস্তকে প্রণাম করলেন নাস্তিক শান্তনু। তারপর যখন হাঁটতে হাঁটতে কোপাইয়ের পাড়ে পৌঁছালেন, তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। শীর্ণকায়া কোপাই, চারপাশের প্রকৃতি – সবমিলিয়ে পড়ন্ত বেলায় বেশ বিহ্বল করে দিল।
আকাশে এলোমেলো হালকা মেঘ আর উদাসী বাতাস বারবার অনুপমার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এক বিশাল শূন্যতা নিয়ে উপলব্ধি করলেন, ‘সব শূন্যতার বোধ ও ভাষা এক নয়। কিছু শূন্যতার গভীরতা এতোটাই যে তার সামনে জীবনটাকে অনেক ছোটো মনে হয়।’ জীবনের ছায়াসঙ্গীকে যেন প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করতে পারছেন তিনি। যেন তাঁর সাথে সাথেই পথ চলছে। তন্ময়ভাবে সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন, এমন সময় দমকা হাওয়া হঠাৎই যেন শিহরণ জাগিয়ে দিল। মনে হ’ল যেন প্রিয়তমা ছুঁয়ে গেল! আর সাথে দিয়ে গেল আগামী দিনে বেঁচে থাকার মন্ত্রগুপ্তি, শেষের পথে পাড়ি জমানোর মহা বীজমন্ত্র। প্রেমরঙা আবীরে অনুভূতি রাঙিয়ে, হাওয়ার বেশে সুপ্ত চেতনা জাগিয়ে, সেই চেনা গলায় যেন কানে গুনগুনিয়ে বলে গেল, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে… একলা চলো রে…।।’