আমার মেয়ে….

আমার মেয়ে….
-বিশ্বদীপ মুখার্জী

 

 

আমি নিজের মেয়ের হত্যা করিনি। আমি তো তাকে ভালবাসতাম। কাছে থাকলে কেউ ভালোবাসার মর্ম বোঝে না, বোঝে দূরে চলে গেলে। যত দিন সে আমার চোখের সামনে ছিল, চক্ষুশূল ছিল আমার। আমাদের মত লোকেদের বাড়িতে মেয়ে অভিশাপের দ্বিতীয় নাম। ভাগ্যের পরিহাস ভেবেই স্বীকার করেছিলাম মেয়েকে। আট বছর দাঁতে দাঁত চিপে তাকে মানুষ করেছি। কিন্তু আমার সদ্য জন্মানো ছেলে হয়ে গেল আমার নয়নের মণি। সেই অভিশপ্ত রাত আমার জীবনে নিয়ে এসেছিল এক রাশ অন্ধকার। মদ্যপ অবস্থায় নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলি, নিজের অপয়া মেয়ের ওপর করি সীমাহীন অত্যাচার। তাকে দূর করে দি আমি নিজের বাড়ি থেকে।
নেশা নামবার পর বুঝতে পেরেছিলাম নিজের ভুল। মনে পড়ল নিজের ছোট্টো মেয়ের ফুটফুটে চেহারা, তার নিস্পাপ মুখশ্রী। ঘৃণা হল নিজের ওপর, নিজের পুরুষত্বের ওপর। বহু খুঁজলাম নিজের মেয়েকে পেলাম না।
আমি রিক্সা চালাই। গরমের এক দুপুরে নিজের কুঁড়েতে খেতে এসেছিলাম। আমার নবজাত ছেলে অকারণ চিৎকার করছিল। আমার স্ত্রী আমার সাথে বার্তা বিনিময়ে পূর্নবিরাম লাগিয়েছিল। এক সংসারে থাকতে গেলে যতটুকু কথা না বললেই নয় সেটাই বলতো। হঠাৎ দরজার সামনে আমার এক সহজাত এসে দাঁড়ালো। আমায় বলল- ‘পাওয়া গেছে রে, তোর মেয়েকে পাওয়া গেছে।’
আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনেই উদগ্রীব হয়ে তাকালাম তার দিকে। আমাদের দৃষ্টিতে আনন্দ, উত্তেজনা মিলেমিশে একাকার।
‘কোথায়?’ আমি খাবার ছেড়ে উঠে গেলাম।
‘দু’টি ভদ্রমহিলা নিয়ে এসেছে। তারা নাকি তোর মেয়েকে কোলকাতার এক রাস্তায় পেয়েছিল। তোর মেয়ে নিজের ঠিকানা বলতে পেরেছে।’ সে বলল।
আমার স্ত্রী ছুটে গেল রাস্তার পানে। পেছন-পেছন গেলাম আমি। রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়েছিল আমার মেয়ে। সাথে দুই ভদ্রমহিলা। আমার মেয়ে নিজের মাকে দেখে ছুটে আসছিল তার দিকে। কিন্তু নিয়তির লেখন পাল্টানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। সেই অভিশপ্ত রাতে নিজের মেয়েকে আমি বাড়ি থেকে বার করেছিলাম। আমার আত্মাভিমানী মেয়ে আর ফিরে এলো না নিজের বাপের বাড়ি। দ্রুতগামী ট্রাকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর রাস্তায় পড়েছিল আমায় মেয়ের নিথর নিস্প্রাণ দেহ। চিরবিদায় নিয়ে চলে গেল সে। আমি কন্যাদান করলাম তার মুখাগ্নি দিয়ে।

সমাপ্ত ।

Loading

Leave A Comment