মা’কে লেখা শেষ চিঠি
-সৌরভ ঘোষ
মা জেলেহা’র দাবী নাকচ হল…
তাবৎ জননেতা, মানবাধিকার সংগঠন, তামাম জনগন সবাই নাকচ।
সবে সূর্যমুখী পাপড়ি চোখ মেলতে শুরু করেছে,
শিশির তখনও মুথা ঘাস আঁকড়ে, আড়মোড়া ভাঙেনি।
শাসক বদ্ধ পরিকর…
মহামান্য বিচারক ফাঁসির আদেশ দিতে বাধ্য।
সবে ছাব্বিশে পা দেওয়া তরুণী ইরানী সাবারি
জীবনের শেষ পাতায়-
চরকায় বোনা পাকানো দড়ির জলছাপ…
মা’কে লেখা শেষ চিঠিতে ইরানী তরুণীর জবানি
প্রিয় শোলেহ,
আজ জানতে পারলাম চুড়ান্ত সময় আসন্ন।
সৃষ্টিকর্তা পাহাড়ের চূড়ায় জাদু লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে
অস্থীর বাতাসের হাতে আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছে।
শুধু এই ভেবে খারাপ লাগছে
এই খবরটা তুমি আগে জানালেনা?
ফাঁসি হবে জানার পর থেকে তুমি আব্বার হাতে চুমু খেতে দাওনি।
টান বাড়াতে চাওনি না !
ঊনিশ বছরে দুনিয়ার অনেক কিছু দেখেছি ।
তোমার আদর আব্বার আদর আহ্ জান্নাত।
বেশ ছিলাম বলো?
সেদিন পূর্নিমা,উৎসবের রাত
কোথা থেকে হঠাৎ উন্মাদের মত
রাশি রাশি কালো মেঘ গোটা আকাশকে ছেয়ে ফেললো…
ইজ্জতের কালো লুটেরা-
তীক্ষ্ণ দাঁত আর দানবীয় শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো
অজগরের মত আমার সর্বাঙ্গ পেঁচিয়ে,
মাংসাশী চিলের মত শরীর ছিঁড়ে আঁচড়ে
সমস্ত নির্যাস, সবকিছু গোগ্রাসে গিললো…
সেই রাতেই মরে গেলে ভালো হত, তাই না মা!
সেই রাতেই আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে
শহরের কোণে, কোনো আস্তাকুঁড়ের উঁচু ঢিবিতে,
যেখানে আমার অবশ শরীরটা’কে
আস্তাকুঁড়ের কুকুর গুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত,
অন্তত তাড়াতাড়ি মুক্তি হত…
অবশিষ্ট হাড়গোড় পরদিন পোষ্টমর্টানে যেত,
কুকুর গুলো যদি বিক্ষত যৌনাঙ্গ ফেলে রাখত
তাহলে এটাও জানতে পারতে নিষ্ঠুর শয়তানটা সে রাতে কতবার,
কতবার ধর্ষণ করেছিল তোমার প্রিয় সাবারিকে …
ভেঙে পোড়ো না মা…
অর্থহীণ, ক্ষমতাহীন দের ভাঙতে নেই,লড়াই করেই বাঁচতে হয়।
সেদিন যদি আমি মরেই যেতাম হয়ত গুমরে কাঁদতে,
সীমাহীন বালি বালি শোক, অসহ্য মহাসাগরীয় লজ্জা তোমায় ছিঁড়ে খেত
তুমি হয়ত মরে যেতে …
বিশ্বাস কর সে-রাতে ছুরি ধরে আমার হাত একটুও কাঁপেনি।
কেমন যেন সব ওলট- পালট হয়ে গেল,না!
যদি শয়তানটা বাঁচত-
তাহলে আমার শরীরটা এভিন জেলে ছুঁড়ে ফেলা হত না,
সেখান থেকে এই অন্ধকার কারাগারের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে।
তবে,এ সব নিয়ে অনুযোগ কোরো না
এটাই হয়ত নিয়তির বিধান…
মৃত্যুতেই কি সব শেষ হয়?
তুমি শিখিয়েছিলে বাঁচার জন্য লড়াই করতে হয়।
তুমিই তো শিখিয়েছিলে শিক্ষা পাওয়ার জন্যই আমাদের জন্ম।
তুমি বলেছিলে জন্মের পর থেকেই আমাদের কাঁধে বিশেষ দায়িত্ব চাপে।
মনে পড়ছে তুমি যে গল্প গুলো শোনাতে?
“সেই লোকটা যে চাবুকের আঘাত সহ্য করতে করতে মরেই গেল
কিন্তু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি”।
সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধৈর্য তো ধরতেই হবে,
তার মাঝে মৃত্যু এলে তাও সই…
হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় বুঝিয়েছো
“যেন কোনো ভাবেই নারীসত্বাকে না বিসর্জন দিই”।
কত যত্ন করে মেয়ে দের খুঁটিনাটি সহবত শিখিয়েছিলে।
কিন্তু তুমি ভুল জানতে মা
এই ঘটনার সময় সে -সব তালিম একেবারেই অকেজো।
আদালত আমায় বলল,”ঠান্ডা মাথার খুনি”
না মা এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলিনি।
আইনের প্রতি অটুট আস্থা দেখাতে গিয়ে
বিচারক বলল,”খুনের অভিযোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমি নিস্পৃহ নিরুত্তাপ! “
তুমি তো জানো –
একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত কখনো মারিনি
হা,আমিই হয়ে গেলাম ঠান্ডা মাথার খুনি!
জানো, ছেলেবেলার কথাগুলো শুনে
বিচারপতি বললেন,আমি না কি মনে মনে পুরুষালি।
আমার লম্বা নোখের লাল নেলপালিস,
নরম তুলতুলে হাতের তালু,
ধর্ষিতা হয়েও আমি পুরুষালি?
এই অন্ধ বিচারকের থেকে এর বেশি কি বা আশা করতে পারি!
অপরাধের পুরষ্কার হিসাবে মাথা মুড়িয়ে এগারো দিন নির্জন কারাবাসের হুকুম।
দেখেছ মা, তোমার ছোট্ট সাবারি এই কয়েকদিনে কত বড় হয়ে গেছে…
এবার আমার অন্তিম ইচ্ছে বলি শোনো-
কেঁদো না ,এখন শোকের সময় নয়,
ফাঁসির পর, আমার চোখ, কিডনি, হৃদপিণ্ড,
আর যা কিছু নেবার থাকে একজনের শরীর থেকে সব নিক,
তাতে যেন কয়েকটা গরীব বাঁচতে পারে।
আমি চাই না আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক,
আমি চাই না কালো পোষাক পরে কবরের সামনে কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ুক,
বুক চাপড়াক, এমনকি তুমিও নও…
বরং তুমি আমার হাসি কান্নার দিনগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও।
পৃথিবী আমাকে ভালোবাসেনি
পৃথিবী চায়নি আমি সুখি হই।
মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গনে ইহলোক ছাড়তেই তার দেখা পাব।
তার এজলাসে নিশ্চিত সুবিচার হবে-
সেখানে কাঠগোড়ায় শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াব।
অভিযোগের আঙুল তুলব –
সেইসব পুলিশ অফিসারের দিকে,অন্ধ বিচারকের দিকে,
মিথ্যেবাদী আইনজীবীদের দিকে
বিচারের নামে যারা মিথ্যা ও অঞ্জানতার কুয়াশায়
সত্যকে প্রতিমূহুর্তে আড়াল করছে তাদের দিকে
আর তাদের দিকে যারা আমাদের অধিকার বুটের নীচে পিষে দিয়েছে…
আমার নরম মনের মা,
মনে রেখো সেই দুনিয়ায় আমি আর তুমি থাকব
অভিযোগকারীর আসনে
আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়।
এবার দেখব,সৃষ্টিকর্তা কি চায়…
একটা শেষ আর্জি –
মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরুর প্রাক মুহুর্ত পর্যন্ত
তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই মা।
তোমার যে খুব ভালোবাসি,এই দুনিয়ার থেকে অনেক বেশি…