ফিরে আসা
– রুদ্র প্রসাদ
(১)
“এ্যাই…, দরজা খোল।” দুমদাম ধাক্কার শব্দে বিরক্ত হয়েই আধখাওয়া বিড়িটা ফেলে দিয়ে দরজা খুলে দিল সায়ন, হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসা অমরেশকে পাশ কাটিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছিল, এমনসময় “ কি গুরু… আজ বিধবা ছেড়ে মামুতে একাই সুখটান দিচ্ছো…?” চোখ টিপে ফুট কাটল। মেজাজটা এমনিতেই খিঁচড়ে ছিল, তবুও কিছু না বলে সরে এল। কব্জি উল্টে ঘড়িতে দেখল টিফিন শেষ হতে আরও মিনিট দশেক বাকি। ক্লাশ করার ইচ্ছা কোনোকালেই বিশেষ থাকে না, আজ আর আড্ডাবাজি না করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে একসময় এসে ফাঁকা পার্কের বেঞ্চে বসে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিল। গত পরশুরই কথা, “সানু, ন’টা বাজে।” বাবার গম্ভীর গলা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েছিল। “স্কুলের রিপোর্ট কার্ড নিয়ে ওঘরে আয়।” অবাক হয়ে ভেবেছিল সায়ন, ‘গতকালের মক টেস্টের রেজাল্টের কথা কে বলে দিল!’
“তিনটে সাবজেক্টে সিঙ্গল ডিজিট! তোর লজ্জা করে না! নিশ্চয়ই গার্জেন কল করেছে?”
“না মানে…”
“ইয়েস অর নো?” নীরবে মাথা নেড়েছিল তখন।
“তোর জন্য কি একটুও স্বস্তিতে থাকা যাবে না! দাসবাবুর মেয়েকে দেখে শিখতে পারিস না। সবার সামনে অপমানিত হওয়া ছাড়া তোর থেকে কি আর কিছুই আশা করা যায় না? তোর জন্য সবার কাছে মাথা নিচু করে থাকবে হবে! ছিঃ!”
“স্যরি বাবা…,” দাসবাবুর মেয়ে মানে বাণীব্রতার কথা উঠতেই একটা গালাগাল জিভের ডগায় এসে গিয়েছিল, কষ্ট করে সামলে নিল।
“শ্যাট আপ। অ্যানুয়্যাল পরীক্ষায় যদি পাশ না করতে পারিস, নিজের ব্যবস্থা দেখে নিস। বসিয়ে বসিয়ে তোকে গেলাব আর তুই সোসাইটিতে আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে বেড়াবি, এ আমি বরদাস্ত করব না। দিস ইজ ইওর লাস্ট ওয়ার্নিং”, রাগে গজগজ করছিলেন মিঃ সেন।
(২)
এখন ক্লাশ ইলেভেন। যখন ওয়ানে পড়ত, তখন মাত্র তিনদিনের অজানা জ্বরে মাকে হারিয়েছিল সায়ন। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মধুছন্দা দেবীকে ঘরণী করে আনেন মিঃ সেন। নিয়ম মেনেই তার পরের বছর আসে সায়ক। এই দু’জনকে কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না সায়ন। বিশেষ করে মায়ের জায়গায় ঐ ভদ্রমহিলাকে দেখলেই একটা অন্ধরাগে যেন বোবা হয়ে যায় সে। অত্যন্ত সহৃদয়া হ’লেও ‘সবই লোক দেখানো ভড়ং’ ভেবে নিজেদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে রেখেছে সে। আর যত আক্রোশ গিয়ে পড়ে ছোটো ভাইয়ের ওপর, সুযোগ পেলেই গায়ের ঝাল মেটাতে নির্দয়ভাবে পেটায়। গতকাল একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে। সামান্য টিভি দেখা নিয়ে মেরে নাক-মুখ ফাটিয়ে রক্ত বের দিয়েছে, ভেবেই নিজের মনে গভীর অনুশোচনায় জ্বলতে থাকে সায়ন। মা-হারা ছেলে বলে সকলের অনুকম্পার পাত্র হলেও ওর উদ্ধত স্বভাবের জন্য সকলেই ওকে অপছন্দ করে, একমাত্র মধুছন্দা দেবী ছাড়া।
ছবিটুকু ছাড়া নিজের মায়ের কথা কিছু মনেই পড়ে না, জন্মদাত্রী কবে যে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে টেরই পায়নি। ‘মা’ বলে কখনো না ডাকলেও ‘মায়ের স্বরূপ’ বলতে তার চোখের সামনে মধুছন্দা দেবীর মুখটাই ভাসে। ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করে সায়ন। মনে মনে স্থির করে, ‘আমাকে বদলাতেই হবে। এখনই শোধরাতে হবে নিজেকে। উঠে দাঁড়াতে হবে।’ ভেতরের ছটফটানি নিয়ে অস্থিরভাবে সামনে তাকাতেই চোখ পড়ে পার্কের দেওয়ালে আঁকা স্বামী বিবেকানন্দের ছবিতে, মনে মনে বলে, ‘হে স্বামীজী, পথ দেখাও…।’
(৩)
অন্যমনস্কভাবে বাড়ি ফিরে দেখল ছোটো সায়ক বসে টিভি দেখছে। মুখে-মাথায় ব্যাণ্ডেজ দেখে মনের অপরাধবোধের কষ্টটা যেন আরও বেড়ে গেল। কিছু না বলে চুপচাপ নিজের রুমে এসে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল। ঐ ঘটনার পর থেকে সায়কও কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। বাড়ির থমথমে পরিবেশ যেন গিলে খেতে আসে সায়নকে, মনে মনে ভাবে, ‘এসবের জন্য আমিই দায়ী। আমাকেই সবকিছু ঠিক করতে হবে।’ আস্তে আস্তে নিজেকে পড়াশোনায় ডুবিয়ে দেয় সে। এই পরিবর্তনটুকু আর কারোর চোখে না পড়লেও মধুছন্দা দেবীর চোখ এড়ায় না।
একদিন পড়ার টেবিলে সায়ক বৃত্ত আঁকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ঠিকমতো পেরে উঠছিল না দেখে নিজেই এঁকে দিয়ে “দ্যাখ সুকু, পেন্সিল কম্পাসের ওপরে ধরে আঙুল দিয়ে ঘোরাবি, দু’হাতে ধরলে কম্পাস নড়ে যাবে, আর কম্পাস নড়ে গেলে রেডিয়াসটা কমবেশি হয়ে যাবে, তখন সার্কলটা ঠিক হবে না, বুঝলি?” বলে তার মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিল। ছোট্ট সায়ক গাঁট্টার বদলে অন্যরকম ব্যবহার পেয়ে চমকে গেলেও মধুছন্দা দেবীর বুঝতে কিন্তু অসুবিধা হয়নি, সব দেখে তিনি চোখের জল আড়াল করতেই চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে সরে গেলেন।
সায়ককে মেরেছিল বলে বাবা বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছিলেন। তারপর থেকে বাবার সাথে কথাবার্তাও বন্ধ। বাকিরা যে যার মতো আছে। কথা না বললেও রাতে পড়ার সময় হাতের কাছে গরম হরলিক্সের মগটা দেখলেই নিজেকে আরও ছোটো মনে হ’তে থাকে সায়নের। জামাকাপড় থেকে শুরু করে নিজের বিছানা, খাওয়ার – সব জায়গাতেই তাঁর নীরব উপস্থিতি খোঁচা দেয়। অবাক হয়ে মনে মনে ভাবে, ‘মা কি এমনই হয়!’
(৪)
স্কুল, কোচিং, খেলার মাঠ আর বাড়ির মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া সায়ন আস্তে আস্তে খেয়াল করে এখন সায়ক একটু হ’লেও দাদার পেছনে লাগে। যে সায়ক দাদার কাছে বসা তো দূরের কথা, দেখলেই দৌড়ে পালাতো, সে এখন তার অনুপস্থিতিতে তারই ঘরে ঢুকে নিশ্চিন্তে গল্পের বই পড়ে, গান শোনে, গেম খেলে, যদিও ধরতে গেলেই পালায়, দূর থেকে মুখ ভ্যাঙচায়।
মেলামেশা কমিয়ে দেওয়ার কারণে পুরোনো বন্ধুদের সংখ্যাও কমে গেছে, আজকাল অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলে। আর যারা ভালো ছাত্র-ছাত্রী বলে পরিচিত, তারা আগের সায়নকে মনে করে মিশতে ভয় পায়। সবমিলিয়ে একা হয়ে গেলেও সায়নের খারাপ লাগে না। সে তার লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছে। ক্লাশের পড়া বাদে সে এখন অনেক বই পড়ে। স্বামীজীর বাণী তার চিন্তাধারা বদলে দিয়েছে।
স্কুলে তাদেরই ব্যাচের ফার্স্টগার্ল বাণীকে একবার প্রপোজ করে সবার সামনে অপমানিত হয়েছিল। তখন ভেবেছিল, ‘একবার সুযোগ পাই, দেখে নেব। এমন হাল করব, কোথাও মুখ দেখাতে পারবি না।’ এখন ভাবে, ‘সত্যিই কি মূর্খ ছিলাম! ঝোঁকের বশে যদি ভুলভাল কিছু করে ফেলতাম!’ এখন বুঝতে পারে সেই ভালো লাগাটা আজও রয়ে গেছে! ভাবতে ভাবতে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে সায়নের মুখে। ‘আমাকেও ভালো হ’তে হবে’ ভাবনায় আরও বেশি করে পড়াশোনায় ডুবে যায়।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সময়। ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়া সায়ন আরও ভালো করার লক্ষ্য নিয়ে নিজেকে তৈরী করে। টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টে নিজের নাম প্রথম দশের মধ্যে দেখে মনে মনে মুচকি হাসে আর ভাবে, ‘এই তো সবে শুরু, আরও অনেক দূর এগোতে হবে।’
সায়কের দুষ্টুমি একটু একটু করে কমিয়ে আনলেও সম্পর্কের শীতলতা পুরোপুরি কাটছিল না। একরকম ঝড়ের বেগেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ভালোভাবে দেওয়ার পর চুটিয়ে খেলা আর টিভি দেখার ফাঁকে পছন্দের বেশ কিছু বই পড়ে ফেলেছে সায়ন। খেলতে যাওয়া আসার ফাঁকে দেখত ছুটিতেও কম্পিউটার ক্লাশে বাণীর যাতায়াত।
(৫)
রেজাল্টের দিন যত এগিয়ে আসছিল, ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা তত বাড়ছিল। রেজাল্ট বেরোনোর দিন সকালে ইন্টারনেট থেকে জেনে গিয়েও বিশ্বাস হয়নি, দুপুরে স্কুলে গিয়ে মার্কশিট হাতে পেয়েও বিস্ময় কাটছিল না সায়নের। সে শুধু ভালোভাবে পাসই করেনি, নম্বরের দিক দিয়ে শুধু বাণীকে টপকেও যায়নি, একেবারে মহকুমাতে দশম স্থান অধিকার করেছে!
মার্কশিট হতে নিয়ে সবার অভিনন্দনের বন্যায় কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলছিল, এমন সময় “কনগ্রাচুলেশনস্” কথাটা শুনে পিছন ফিরে দেখল বাণী। ভ্যাবাচাকা খেয়ে একটু সময় নিয়ে বলল, “থ্যাঙ্কস্।” তারপর একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, “তোর দু’মিনিট সময় হবে? কিছু বলার ছিল…।”
নীরব সম্মতি পেয়ে বলল, “তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, গতবছরের আগের বছর সরস্বতী পূজার দিন তোকে প্রপোজ করেছিলাম। সেটা নিয়ে তোরা সবাই মিলে খুব হ্যাটা করেছিলি, সেই সব কথা নয়। সেদিন আমি তোর সামনে দাঁড়ানোর যোগ্য ছিলাম না, আজও নই। বাট আই লাইক ইউ। সেদিনও লেগেছিল, আজও লাগে। আই রিয়েলি ডু। আমার বন্ধু হবি…?”
পড়ন্ত বেলার আলোতে ব্যালকনিতে দাঁড়ানো বাণীর মুখটা তখন লাল হয়ে উঠেছে। কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “আই লাইক ইউ টু সায়ন। বাট, কান্ট বি জাস্ট ফ্রেণ্ডস। ভেবে জানিও। আর একটা কথা এই নতুন সায়ন ঠিক আছে কিন্তু পুরোনো সায়নকে হারিয়ে যেতে দিও না। একটা দারুণ কেয়ার ফ্রী অ্যাটিচিউড আছে তোমার মধ্যে অ্যাণ্ড আই লাইক দ্যাট। বি বোল্ড, বি অ্যাগ্রেসিভ, বাট উইথ কশাসনেস। আই অ্যাম এক্সপেক্টিং আ লট ফ্রম ইউ।”
হঠাৎ বাণীর মুখে ‘তুমি’ শুনে একটু অবাক হ’লেও কিছু বলল না। একটু থেমে বাণী আবার বলল, “এখন থেকে নিজেদের তুই-তোকারি বাদ দাও, আমি পছন্দ করি না। সময়ই আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। তবে আমি তোমার পাশে থাকব, কথা দিলাম। আর হ্যাঁ, আমার কাছের মানুষেরা সবাই আমাকে ‘বৃষ্টি’ বলেই ডাকে, আজ থেকে তুমিও তাই বলে ডেকো।”
“থ্যাঙ্কস্। আই ওন্ট লেট ইউ ডাউন… প্রমিস। অ্যাণ্ড… লাভ ইউ বৃষ্টি।” বলে আলতোভাবে বাণীর হাতটা ছুঁয়ে দিল সায়ন আর কিছু না বলে মুখ নামিয়ে নিল বাণীব্রতা। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বড়ো রাস্তায় পৌঁছে পরস্পরকে তখনকার মতো বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
(৬)
ছেলের রেজাল্ট বলেই আজ অফিসে যাননি মিঃ সেন, মোটামুটি সব জানার পর অধীর আগ্রহে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সায়ন ফিরে দেখল বাবার মুখটা আনন্দে চকচক করছে। নিজের পরিকল্পনা মতো বাবাকে কিছু না বলে মধুছন্দা দেবীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমবার তাঁকে প্রণাম করে তাঁর হাতে মার্কশিটটা দিয়ে বলল, “মা, এটা তোমার জন্য।” ভাববিহ্বল মধুছন্দা দেবীর দু’চোখে তখন আনন্দধারা। মিঃ সেন আগের কথা ভেবেই ছেলেকে বললেন, “যাও, মাকে দেখিয়ে এসো।”
ততক্ষণে সায়ন জড়িয়ে ধরেছে মধুছন্দা দেবীকে। ছেড়ে দিয়ে ধরা গলায় বাবাকে বলল, “ঐ ছবিটুকু ছাড়া মায়ের কোনোকিছুই আমার মনে পড়ে না। ‘মা’ বলতে যা বুঝি তা এই মাকেই বুঝি। এতোদিন বলতে সাহস হয়নি। তোমার শেখানো ‘নতুন মা’ বা ‘ছোটো মা’ বলার ইচ্ছে কখনো হয়নি।”
“দূর বোকা, মা তো মা-ই হয়, তার আবার নতুন কি আর ছোটো কি!” বলে আবার বুকে টেনে নিলেন সায়নকে। তখন মিঃ সেনের চোখেও জল। ছোটো সায়ক বুঝতে পারছিল না ‘দাদা ভালো রেজাল্ট করেছে তো কান্নার কি হয়েছে!’ বড়োদের কান্নার মাঝে সে কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সেই সময়ই ঘরের নীরবতা ভেঙে মোইবলটা তারস্বরে বেজে উঠল। রিংটোনের খ্যানখ্যানে শব্দে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চন্দ্রবিন্দুর বিখ্যাত গান, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়…।’
বাঁধন বেশ ভালো ।
ধন্য যোগে কৃতজ্ঞতা সতত স্যার…।
অপূর্ব ! ভীষণ ভালোলাগা।
অশেষ ধন্যবাদ
ভালো লাগলো লেখা টা
ধন্য যোগে কৃতজ্ঞতা সতত…।