গিফ্টি
-পারমিতা ভট্টাচার্য
গঙ্গার ধারে একটি ছোট্ট গ্রাম সুন্দরপুর। নামেও যেমন, গ্রামটিও ঠিক তেমনি সুন্দর। নদীর ধারে ঠিক ছবির মতো সুন্দর সেই গ্রাম। গরীব লোকের বাসই সেখানে বেশি। ক্ষেতি তিনফসলি জমি আর মাছ ধরেই জীবন চলে গ্রামের মানুষের। গ্রামের এক পাশে ‘বসু ভিলা’, বনেদি বাড়ি। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই এই বসু ভিলার সম্পত্তি দেখভাল করে দিন গুজরান করে। তেমনই গফুর মিঁয়াও বসুদের একটি ট্রলার দেখাশোনা করে। এই গ্রামেই গফুরের টালির চালের ঘরে দিনে সূর্য আর রাতে চাঁদ এসে উঁকি দেয়। অভাব থাকলেও তার বিবি লতিফা কে নিয়ে শান্তি ছিল গফুরের ঘরে। গফুর একজন জেলে। সে ভোরে বের হয়, বিকেল হয় যায় তার ঘরে ফিরতে। গফুর ‘জেলে’ হতে পারে, কিন্তু লতিফা ‘জেলেনী’ নয়। গফুরের বুকের পাঁজর সে। গরিবীয়ানা তেও যে সুখের এতো উষ্ণতা থাকে, তা এদের না দেখলে বোঝা যায় না। গফুর যতটা পারতো লতিফা কে সুখে রাখার চেষ্টা করতো। রাত্রে তাদের সুন্দর স্বপ্ন গুলোর সাক্ষী থাকতো চাঁদের আলো আর আকাশের তারারা। বেশ কাটছিলো তাদের দিন গুলো। ঘরে চাঁদের আলোর মতোই চুইয়ে এলো খুশির খবর। একটা একটা করে মাস কাটাতে কাটাতে এলো সেই দিন। লতিফা জন্ম দিলো তার মেয়ের। আনন্দে গফুর সে দিন কেঁদে ফেলেছিল। কতো দিন আগে আম্মি কে সে হারিয়েছে। আবার আম্মি ফিরে এসেছে তার কাছে।
যত্নের কোনো ত্রুটি নেই গফুরের। কিন্তু ওই আর কি! মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। আমরা সব কিছু কে সাজাই নিজের মতো করে, আর বিধাতা খেলে দেয় অন্য রকম করে। সে ভাবেই গফুরের সাজানো সংসার তছনছ হয় যায়। এক মাসেই ছোট্ট মেয়েটির নিভে যায় জীবন দীপ। সেপটিসেমিয়া হয় যায় তার। অনেক চেষ্টা করেও কবরের অন্ধকার থেকে নিজের মেয়ে কে রক্ষা করতে পারে না গফুর। অন্য দিকে লতিফা? পাগলের মতো গফুরের বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। কী করে তাকে সামলানো যায় সেটাই গফুরের মাথায় আসে না।
একটা একটা করে দিন চলে যায় তার নিজেস্ব নিয়ম মেনে। লতিফাও এখন নিজেকে সামলে নিয়েছে অনেকটা। গফুরও দিন গুজরানের জন্য কাজে বেরোতে থাকে।
ডিসেম্বর মাস, হাড় কাঁপানো বিকেল। ঘরে ফেরা পাখির ডানায় ভর করে আসতে আসতে সন্ধ্যা নামছে সুন্দরপুর গ্রামে। গঙ্গার জলে আগুন ধরিয়ে সূর্য যাচ্ছে অস্ত। গফুর নৌকা আর মাছের হিসেব মিটিয়ে বাড়ি ফিরছে হালকা অন্ধকারে, মাঠের আলপথ ধরে। মনটাও তার ভারী। একটু নেশার ঘোর। এমন সময় মির্জাদের বেগুন ক্ষেতের পাশ দিয়ে আসার সময় গফুর একটা গোঙানি আওয়াজ শুনতে পায়ে। প্রথমে সে ভাবে মদের নেশায় সে হয়তো ভুল শুনছে। অনেকক্ষণ পরে সে বোঝে এটা নেশার ঘোর নয়, এটা সত্যি। হাতের টর্চের আলোয় বেগুন বাড়ি তে নেমে চারিদিকে সে খুঁজতে থাকে সেই শব্দের উৎস। হঠাৎ সে দেখে এই প্রচন্ড ঠান্ডায় সেখানে পড়ে আছে কাপড়ে জড়ানো একটা প্রাণ। সাথে সাথেই কোলে তুলে নেয় গফুর। প্রচন্ড ঠান্ডায় আর ক্ষিদেয় কাহিল প্রাণটা এতটাই কাহিল ছিল যে গলা দিয়ে স্বরও বেরোচ্ছিল না। তার নিজের গায়ের চাদরটা দিয়ে প্রাণটা কে ভালো করে জড়িয়ে, বুকে করে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসেছিল গফুর। কত দূর থেকে যে লতিফা কে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে উদভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছে তা সে নিজেও জানে না। লতিফা প্রথমে ভয় পেয়েই গিয়েছিল খানিকটা। কিছুতেই মানতে চাইছিল না গফুরের কথা। লতিফা ভাবছিল, তার কষ্টের কথা মাথায় রেখে কারুর কাছ থেকে বাচ্চা চুরি করে নিয়ে এসেছে আজ। গফুরের চোখে জল। মদ খেয়েও সে আজ পুরো হুঁশে। লতিফার কোলে বাচ্চাটা দিতেই সে অল্প নড়ে উঠলো। লতিফার কাছে মায়ের স্তন্যসুধায় বাচ্চাটির হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক হতে লাগলো। তার বুকের গরমে শিশুটির শরীরে উষ্ণতা ফিরে এলো।
আজ 24 ডিসেম্বর। তাদের মৃত মেয়ে ফিরে এলো তাদের কাছে, সান্টাক্লসের দেওয়া গিফ্টি হয়। সান্টাক্লস যে আজ রাতেই মানুষের জীবনে গিফ্ট দিয়ে যায় তা হয়তো এই অর্ধশিক্ষিত পরিবারের জানা নেই। কিন্তু, আজকের এই শ্রেষ্ঠ উপহারটি ওদের সুখ হারানো জীবনে একটা নতুন অধ্যায় সূচনা করলো।
এদিকে বনেদি বাড়ির মেয়ে তুলি সারা দিন বিছানায় উপুড় হয় পড়ে আছে। মা, কাকিমার তীর্যক বাক্যবাণে বিদ্ধ সেই তরুনী। বনেদি বাড়ি, তাই সমস্ত ঘরের কথা অন্দরমহলেই সীমাবদ্ধ রাখাটাই রীতি। তুলি ছিল মাতৃ সম্ভবা। বাড়ির কেউ জানতো না। অবশ্য শেষ রক্ষা হলো না। মায়ের চোখে সে ঠিকই ধরা পড়ে যায়। ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা, নিচের মাল পত্তর রাখার ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। সেখান থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে চিৎকার। ঘরের বাইরে কাষ্ঠ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে তুলির মা। বিস্ফোরিত চোখ, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কান্না আটকে রাখতে সে পারলো না তুলির বাবা কে দেখার পর। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল তুলির মা – ‘মেয়েটা বাঁচবে তো শেষ অবধি?’
ওদিকে ঘরের ভিতর সব চিৎকার চুপ হয় নিস্তব্ধতা কে খানখান করে কেঁদে উঠল একটি শিশু। পরক্ষণেই দাইমা শিশুটি কে দরজা খুলে বাইরে অপেক্ষমান রতনের হাতে দিয়ে দিলো। সে কাপড়ে দলা পাকিয়ে সেই প্রাণটি কে শুইয়ে দিয়ে আসে গফুর কে দেখে। রতন জানতো সদ্য কন্যা হারা গফুর বাচ্চাটা কে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। পৃথিবীর দুই দিকে অশ্রুজল বয়, কোথাও খুশির…. কোথাও বা দুঃখের। বনেদি বাড়ির চাপা ইতিহাস চার দেওয়ালের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস আটকে মরতে থাকে। অন্য গফুর, লতিফার জীবনে এলো তাদের হারিয়ে যাওয়া শবনম। এ ভাবেই সমাজের মাঝে দানা বাঁধা অসুখ আরোগ্য লাভ করে জীবনে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এসে।