Site icon আলাপী মন

পাতাল ঘরের অশরীরি

পাতাল ঘরের অশরীরি
-প্রলয় কুমার নাথ

 

 

(১)
সালটা ১৯৪৭। গোটা দেশ জুড়ে শোনা যাচ্ছে এত কাল ধরে চলে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যুদ্ধজয়ের দামামা। দেশভাগের রণক্ষেত্র লাল হতে শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষদের বুকের তাজা রক্তে। হিন্দু মুসলমান আজ একে অপরের প্রধান শত্রু। ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে চলেছে জমিদারি প্রথা। অতীতের বংশ গৌরব আর আভিজাত্যের ইতিহাস বুকে নিয়ে, আজ এই সকল বনেদী পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা সাধারণ মানুষের সমান।

এমনই এক পরিবার হল পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, মোহনপুরের রায়চৌধুরীরা। স্বর্গীয় ইন্দুভূষণ রায়চৌধুরী ছিলেন এখানকার দাপুটে জমিদার। এই গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের আরো চার পাঁচটি গ্রাম জুড়ে ছিলো তার জমিদারি। মৃত্যুকালে তিনি তার সকল বিষয়সম্পত্তি সমান ভাবে ভাগ করে দিয়ে যান তার দুই ছেলে, ফণীভূষণ আর শশীভূষণের মধ্যে। তবে বড় ছেলে ফণীভূষণ সংসারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাউন্ডুলে প্রকৃতির, যাকে বলা হয় এই অভিজাত বংশের কলঙ্ক। বাপের জমিদারির ওপর উদাসীন ফণীভূষণ অবিবাহিত অবস্থাতেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। তাই বর্তমানে এই পরিবারের কর্তা হলেন ষাটোর্ধ্ব বিপত্নীক শশীভূষণ।

শশীভূষণের একমাত্র ছেলে অমূল্যভূষণ ছোটবেলা থেকেই মা বাবার কাছ থেকে দূরে বিলেতে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। কয়েকমাস হল সে সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছে। বর্তমানে বিষয়সম্পত্তি যেটুকু আছে তা খুব খারাপ নয়, তবে জমিদারি থেকে আর তাদের তেমন আয় হয় না। তাই অমূল্যের ইচ্ছা দেশে ফিরে ওকালতি শুরু করার। তবে তার এখানে ফেরার পেছনে আরেকটি কারণও আছে।

বাঁশবেড়িয়া নিবাসী ধনী ব্যবসায়ী সুকুমার মিত্র মহাশয় হলেন ফণীভূষণের ছাত্র জীবনের বাল্যবন্ধু। পরবর্তী ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, একদিন হঠাৎ করেই এই বাড়িতে আগমন ঘটে সুকুমার বাবুর। নিজের পুরোনো বাল্যবন্ধুকে এত দিন পর দেখে খুব খুশি হন ফণীভূষণ। তার যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি রাখলেন না তিনি। পরে অবশ্য সকলেই বুঝতে পারলো, সুকুমার বাবুর আগমনের প্রকৃত হেতু। তিনি চান তার একমাত্র মেয়ে, পারুলকে এই বাড়িতেই পাত্রস্থ করতে। অবিবাহিত ফণীভূষণ বন্ধুর এই আব্দার শোনালেন ভাই শশীভূষণের কাছে। দুই পক্ষেরই মতের মিল থাকায়, স্থির হয়ে যায় যে অমূল্যর পড়াশোনা শেষ হলেই তাকে দেশে ফিরে এসে বিবাহ বন্ধনে অবন্ধ হতে হবে পারুলের সাথে।

এখনো সঠিক ভাবে এক সপ্তাহই হয়নি, পারুলকে বিয়ে করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে অমূল্য। মা বাবার জন্য মন কেমন করার সাথে সাথেই, কেমন যেন বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে পারুলের এই বাড়িতে। মাত্র আঠেরো বছর বয়সী পারুল হল অসামান্য সুন্দরী। তাই ফুলশয্যার রাত থেকে আজ অবধি অমূল্য যেন তাকে চোখে হারায়। সন্ধ্যা হতে না হতেই সে জরি পাড় ধুতি পরে, গায়ে আতর মেখে ঘুরঘুর করতে শুরু করে বিছানার কাছে।

তবুও যেন দিনের বাকি সময়টা, যখন অমূল্য ওকালতির কাজে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়, তখন এই বাড়িতে থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করে পারুলের। এতবড় পাঁচ মহলা বাড়িতে লোকসংখ্যা কত? সে, তার স্বামী, শ্বশুরমশাই এবং এক দু’জন চারক বাকর! বাড়ির যেদিকে সে তাকায়, সেদিকেই যেন খা খা করে ওঠে! অতীতের প্রাচুর্যের তপবন যেন আজ পরিণত হয়েছে কোনো জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তরে!

(২)
এই বাড়ির পেছনে বেশ বড় আমবাগান, তার একপাশে বাঁধানো পুকুরঘাট। শীতের দুপুরের সময়টা ঘুম আসেনা পারুলের। এই সময় অমূল্যও বাড়ি থাকে না। তাই দুপুরের খাওয়া দাওয়া হতেই সে রোদ পোয়াতে চলে আসে পুকুরঘাটে। তারপর পাথরের সিঁড়িতে আরাম করে রোদে পিঠ দিয়ে বসে এক মনে তাকিয়ে থাকে সামনের শ্যাওলায় ভরা পুকুরের সবুজ জলের দিকে। কিংবা কখনো কখনো এলোমেলো ভাবে ওল্টাতে থাকে কোনো গল্পের বইয়ের পাতা। কিন্তু পড়ায় মন বসে না। ছেলেবেলার কথা, বাবা মায়ের কথাই মনে পড়ে বেশি। তারপর সূর্য অস্ত যেতেই সে তড়িঘড়ি ফিরে আসে পড়ন্ত আলোয় দৈত্যপুরীর মত দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়ির ভেতরে।

এমনই একদিন দুপুর বেলায় বেশ আনমনা হয়ে পারুল পুকুরঘাটে বসে তাকিয়ে ছিলো জলের দিকে। এমন সময় পেছন থেকে এক নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরলো তার,

“ওমা আমার কি হবে! নতুন বউ নাকি? তা এমন ভর দোপর বেলা একলা একলা এই পুকুরপারে বসি থাকতে হয় বুঝি?”

পারুল চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখে এক মাঝ বয়সী মহিলা, সাধারণ সাদা শাড়ি পরণে, এক হাতে একটা মাটির কলসী নিয়ে তার দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে।

“আ…আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না…”

“ওমা তোমি আমারে চিনবা কেমনে, নতুন বউ! তুমি এ গাঁয়ের নতুন মানুষ, এই অল্প কডা দিনে আমাদের চিনবা কি করে!…আমার নাম চাঁপা, গো চাঁপা…এই গাঁয়েই আমার বাস।”

মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে আসে পারুলের দিকে। এক কালে যে খুব সুন্দরী ছিলো এই মহিলা, তা তার সাজগোজ বিহীন চেহারা আর সাধারণ পোশাকের ভেতর থেকেই ফুটে উঠছে। মহিলা প্রসন্ন চিত্তে বলে ওঠে, “বাহ, কেমন লক্ষী ঠাকরুনের মত বউ হয়েছে আমাগো ছোট দাদাবাবুর!”

পারুল নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় চোখ নিচু করে, মহিলা পুকুরের জলের দিকে এগিয়ে যায় কলসীটাকে নিয়ে। পারুল জিজ্ঞাসা করে, “তা চাঁপা মাসি, তুমি কি রোজ এই পুকুর থেকেই জল নিতে আসো? কই, আগের কটা দিন তো দেখিনি তোমাকে? আর তুমি আমাকেই বা চিনলে কেমন করে?”

“ওমা, ছোট দাদাবাবুর বৌভাতে যে আমরা সারা গাঁ খেয়ে গেলুম গো, তা তোমারে চিনবো না? তুমি হয়তো আমারে খেয়াল করো নাই…আর কিছু দিনের জন্য আমি যে কুটুম বাড়ি গিয়েছিলুম গো ভিন গাঁয়ে, তাই জল নিতে আসি নাই”, প্রত্যুত্তরে বলে মহিলা।

এরপর থেকে পারুল আর চাঁপার বেশ ভাব হয়ে গেল। দু’জনেই প্রতিদিন দুপুরে পুকুরঘাটে এসে গল্পগুজব করে। চাঁপার বাড়ি এই গ্রামেই, অনেক ছোটবেলায় তার এক বৃদ্ধের সাথে বিবাহ হয় কৌলীন্য প্রথা রক্ষার্থে, আর তারপর তার বিধবা হতেও বেশি সময় লাগেনি। এই গ্রামের পূবদিকের একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে সে থাকে। বাপের রেখে যাওয়া অল্প কিছু জমিজমার ফসল আর কয়েকটি পোষ্য গরু ছাগলের দৌলতে তার পেট চলে যায়।

একদিন কি মনে হতে হঠাৎ চাঁপা পারুলকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাগো নতুন বউ, তোমাগো ওই অত্ত বড় বাড়িডায় থাকতে কখনো ভয়ডর লাগে না তো?”

পারুল বেশ অবাক হয়ে ওঠে এই কথা শুনে। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে, “কেন বলো তো মাসি? ভয় করবে কেন শুনি?”

চারিদিকের পরিবেশকে থমথমে করে মহিলার মুখে নেমে আসে এক আতঙ্কের ছাপ, “ও ছাড়ো তাহলে…লোকের মুখে শোনা কথা কখনো সত্যি হয় নাকি…”

আরো অবাক কণ্ঠে বলে ওঠে পারুল, “কি ছাড়বো শুনি? কি কথা লোকে বলে, মাসি? বলো…বলতেই হবে তোমায়…”

“ও থাক বাছা, আমি এখন উঠি, কেমন?…এই সুয্যি ডুবলো বলে…”, প্রসঙ্গ পাল্টে কলসীটাকে কাঁখে করে তড়িঘড়ি উঠে পড়ে মহিলা।

(৩)
সেদিন রাতে ঘুম এলো না পারুলের। অমূল্যর কামোত্তেজিত আলিঙ্গনের মাঝেও এক নিথর ভোগ্যবস্তুর মতই নিস্তেজ হয়ে তার শরীর পড়ে রইলো বিছানার ওপরে। বিষয়টা অমূল্যও লক্ষ্য করে একটু অবাক হয়েছিলো, কিন্তু এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি সে পারুলকে। গভীর রাতেও দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না পারুল। ওপাশে অমূল্য নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, এদিকে পারুল তাকিয়ে আছে পাশের খোলা জানলার বাইরে, রাতের আকাশের দিকে।

“তার মানে কি সত্যিই এই বাড়িতে এমন কিছু আছে, যাকে ভয় পাওয়াই উচিত! কোন কথা বলতে চেয়েছিলো চাঁপা মাসি? লোকের মুখে শোনা কথাটাই বা কি?”, এই প্রশ্নগুলোই ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিলো পারুলের মাথায়।

তাই পরদিন দুপুরে পুকুরপারে চাঁপাকে পেয়ে পারুল নাছোড়বান্দা। আজ চাঁপাকে বলতেই হবে গতকাল সে কোন কথা বলতে চেয়েছিলো পারুলকে। উপায় না দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মহিলা। শীতের দুপুরের হিমেল হাওয়ায় এদিক ওদিকে উড়তে লাগলো তার রুক্ষ কেশরাশী। যেন বলতে গিয়ে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো তার ঠোঁটদুটি।

“এ গাঁয়ের লোকেরা বলে, যে তুমার জ্যাঠা শ্বশুর নাকি যে সে লোক ছিলেন না! ছোটবেলা থেকেই তেনার জমিদারির কাজে মন ছিলো না গো…তেনার ওঠা বসা ছিলো এই গাঁয়ের শ্মশানে বাস করা তান্ত্রিকদের সাথে!…তেনাদের দীক্ষা নিয়েই নাকি পিশাচসিদ্ধ হয়েছিলেন তোমার ফণীভূষণ বটঠাকুর!”

“পিশাচসিদ্ধ!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো পারুল।

“হ্যাঁ গো হ্যাঁ”, বিস্ফারির চোখ মেলে বলে উঠলো চাঁপা, “সকলে বলে, তোমাগো বাড়ির নীচে একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে, যেখান গিয়ে গেলে একটি ‘পাতাল ঘরে’ পৌঁছনো যায়…সেখানেই করতেন তিনি এই সব তন্তর মন্তর!”

“তারপর?”, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো পারুল।

“তারপর আর কি? সকলে বলে যে তিনি নাকি মন্তর বলে কোন এক প্রেতাত্মাকে নিজের বশে করেছিলেন! কিন্তু তাকে মুক্তি দেওয়ার আগেই হঠাৎ মারা গেলেন তোমার জ্যাঠা শ্বশুর! আর সেই আশরীরি আজ অবধি বন্দী হয়ে আছে তোমাগো বাড়ির ‘পাতাল ঘরে'”, এতটা বলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো মহিলা।

একটা অজানা আতঙ্কে দুরু দুরু করে উঠতে লাগলো পারুলের বুক!

(৪)
সেদিন রাতে বিছানায় তার শরীরটা ভোগ করতে এলেই, এক ঝটকায় স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় পারুল। বিরক্ত হয়ে অমূল্য কিছু বলে ওঠার আগেই, স্বয়ং পারুল নিজেই বলে উঠলো,
“আপনার জেঠামশাই, শ্রী ফণীভূষণ রায়চৌধুরী কি তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন?”

এমন দুর্বল মুহূর্তে এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ে অমূল্য। তবুও সে জানতে চায় এমন প্রশ্ন করার কারণ কি। পারুল তাকে খুলে বলে চাঁপার কাছ থেকে শোনা সমস্ত কথা। মুহূর্তের মধ্যে সকল কামোত্তেজনা উধাও হয়ে যায় অমূল্যের মধ্যে থেকে। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
“জেঠু যে তেমন কোনো গুপ্তবিদ্যা শিখেছিলেন, সেই কথা কিছু কিছু আমিও শুনেছি…কিন্তু ওই পাতাল ঘরের কথা, বা তার ভেতর কাউকে আবদ্ধ করে রাখার কথা!…নাহ, এইসব তো কখনো শুনিনি আমি!…তাছাড়া ছোটবেলা জেঠুকে দেখেছিই বা কতটুকু, পড়াশোনার খাতিরে এই বাড়িতে থাকাই হয়নি তেমন…কে না কে কি বললো, আর তুমি আজকালকার মেয়ে হয়ে বিশ্বাস করলে সেই কথায়?”

সেই রাতে আর বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। পারুল অমূল্যর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই তার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে পড়েছিলো। অমূল্যও আর বেশি জোরাজুরি করেনি পারুলকে।

তবে সেই রাত্রে দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না অমূল্য। তখন বোধহয় রাত এগারোটা হবে। বিছানায় উঠে বসলো অমূল্য। শীতের রাত্রির নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে গোটা বাড়ি জুড়ে। পাশের খোলা জানলা দিয়ে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে পারুলের ঘুমন্ত মুখের ওপর। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, এই মুহূর্তে তার প্রতি খুব একটা আকর্ষণ উপলব্ধি করতে পারলো না অমূল্য। সে ধীর পায়ে বিছানা থেকে উঠে, আলতো হাতে ঘরের দরজা খুলে শয়ন কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলো। দ্রুত পায়ে ছুটে চললো তার বাবার ঘরে।

শশীভূষণের ঘরে তখনো আলো জ্বলছে। অমূল্য জানে, যে তার বাবা অনেক রাত ধরে মদ্যপান করে, তারপর ঘুমোতে যান। সেই ঘরের ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো অমূল্য। কাঁচের টেবিলের ওপর রাখা রঙিন তরলের সকল সরঞ্জাম নিয়ে সেগুন কাঠের আরাম কেদারায় বসেছিলেন শশীভূষণ। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখলেন অমূল্যর দিকে। তার কিছু বলার আগেই অমূল্য বলে উঠলো,
“এই সময় তোমাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি, বাবা…কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর যে এখনই না পেলে নয়…”

“কি প্রশ্ন আছে তোমার?”, গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন প্রৌঢ়।

“বাবা, এই কথা জানি যে জেঠু তন্ত্র মন্ত্র শিখেছিলেন! কিন্তু আমাকে বলো, এই বাড়ির নিচে কি কোনো গুপ্তকক্ষ আছে? সেখানে কি কোনো অশরীরিকে তন্ত্রমতে বন্দী করে রেখেছেন তিনি?”, চিৎকার করে বললো অমূল্য।

চমকে উঠলেন শশীভূষণ, উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো তার দু’চোখের মণি। আতঙ্কের বশে তার হাতে ধরে রাখা কাঁচের পাত্র সমেত হুইস্কির অবশেষটুকু সশব্দে ছড়িয়ে পড়লো ঘরের মেঝের ওপর!

(৫)
“বৌমাআআআ….বৌমাআআআ….”

ঘুমের মধ্যেই একটি অস্ফুট পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ কানে গেল পারুলের। “কে…কে ডাকে আমায়?”, ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো পারুল।

“আমি তোমার জ্যাঠা শ্বশুর, বৌমা…স্বর্গীয় ফণীভূষণ রায়চৌধুরী!”, অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে প্রত্যুত্তর এলো সেই পুরুষকণ্ঠের।

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো পারুল। সে দেখলো সে গোটা ঘরের জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে এক দীর্ঘদেহী পেশীবহুল পুরুষের অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার চোখের সামনে। ঠিক তার বিছানার সামনেই তার দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। খালি গা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরণে কাপালিকদের লাল রঙের ধুতি। আবার শোনা গেল সেই অশরীরি কণ্ঠস্বর,
“তুমি সঠিক জেনেছো, বৌমা…আমারই একটা ভুলের জন্য সে এতবছর ধরে বন্দী হয়ে আছে এই বাড়ির ‘পাতাল ঘরে’!…তার মুক্তি না হলে যে আমারও মুক্তি নেই, বৌমা…যাও, তাকে মুক্ত করো বৌমা, তাকে মুক্ত করো!”

“কিন্তু সেই ‘পাতাল ঘর’ কোথায়? কিভাবে পৌঁছবো আমি সেখানে?”, চিৎকার করে উঠলো পারুল।

“এই বাড়ির একতলার পূবদিকের প্রথম ঘরটাই ছিল আমার শয়নকক্ষ। এই ঘরে, আমার পালঙ্কের নীচেই পাবে সেই সুড়ঙ্গমুখে ঢোকার রাস্তা। তবে সেখানে ঢোকার আগে, আমার ঘরে রাখা সিন্দুকের ভেতর থেকে ‘পাতাল ঘরের’ দরজায় লাগানো তালার চাবির গোছাটা যেন নিয়ে যেতে ভুলো না!”, বলে উঠলেন ফণীভূষণ।

“কে সেই অশরীরি? কাকে আবদ্ধ করে রেখেছেন আপনি ওই ঘরে? বলুন, আমার কথার জবাব দিন…”, আবার জানতে চাইলো পারুল।

কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না ফণীভূষণ। শুধু তার মর্মভেদী কন্ঠস্বর শোনা যেতে লাগলো, “মুক্ত করো তাকে, বৌমা…মুক্ত করো!” পারুল দেখলো যে তার দেহটা স্থির থাকলেও, ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে তার মুন্ডুটা।কিছুক্ষণের মধ্যেই পারুলের দিকে মুখ করে সম্পূর্ণরূপে পেছনে ঘুরে গেল তার মুন্ডুটা! পারুল ভয়ার্ত দৃষ্টে চেয়ে দেখলো, যে ছবিতে দেখা তার মুখের সাথে এই মুখের কোনো পার্থক্য নেই, শুধু এই ক্ষেত্রে তার চক্ষু কোটরদুটি ফাঁকা!

একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে বিছানায় উঠে বসলো পারুল। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো! দ্রুত গতিতে নিশ্বাস নিতে নিতে সে বিছানায় পাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হল, অমূল্যর জায়গা ফাঁকা! কোথায় গেল সে? কিন্তু সেই মুহূর্তে, অমূল্যর চিন্তার থেকে বেশি তাকে ভাবাচ্ছিলো স্বপ্নে শোনা ফণীভূষণের কথাগুলো। তার মানে তো চাঁপা ঠিক কথা বলেছে তাকে! সাহসে বুক বেঁধে মনে মনে সংকল্প নিলো সে, যেভাবেই হোক তাকে যেতে হবে সেই ‘পাতাল ঘরে’! মুক্ত করতেই হবে সেখানে বন্দী অশরীরিকে! বিছানা থেকে উঠে পড়ে পারুল, দ্রুত পায়ে এই ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে চলে ফণীভূষণের ঘরের উদ্দেশ্যে।

রাতের অন্ধকারে, ফণীভূষণের ঘরের ভেজানো দরজা খুলে চোরের মত ভেতরে ঢুকে পড়লো পারুল। ফণীভূষণের মৃত্যুর পর বহুদিন ধরে ফাঁকা পড়ে আছে এই ঘর। তবে বাড়ির বহুদিনের পুরোনো চাকরটির গুণে আজও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঘরের চতুর্দিক। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে, পারুল ছুটে গেল অদূরে একটি টেবিলের ওপর রাখা সিন্দুকটার দিকে। সৌভাগ্যজনক ভাবে তাতে তালা দেওয়া নেই। মুহূর্তের মধ্যে তার ডালা খুলে ‘পাতাল ঘরের’ দরজার তালার চাবির গোছাটা বার করে নিতে খুব বেশি সময় লাগলো না পারুলের।

সেই মুহূর্তে তার মনে হল, যেন কোনো অপার্থিব শক্তি এসে ভর করেছে তার দেহে। নাহলে সেই ঘরের অত ভারী পালঙ্কটির পায়া ধরে, এক ধাক্কায় সেটাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া তার মত মেয়েমানুষের কম্ম নয়! এরপরই সে নিজেই অবাক হয়ে গেল…পালঙ্কের নীচে মেঝের সাথে খাঁজে খাঁজে বসানো রয়েছে একটি লোহার ডালা। তার হাতলের একটি অংশে চাপ দিতেই সেটি খুলে গিয়ে বিকশিত করলো একটি আঁধারে ভরা সুড়ঙ্গপথের মুখ, যার ভেতর দিয়ে নেমে গিয়েছে সারি সারি সিঁড়ি!

আর একটুও সময় নষ্ট না করে, হাতে চাবির গোছাটা নিয়ে, যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত পারুল অগ্রসর হতে লাগলো সেই সিঁড়ি দিয়ে। চারিদিকে জমাট বাঁধা অন্ধকার, ওপরে ঘরের ভেতর চাঁদের আলো যেটুকু পড়েছিল, সেটাও এখানে নেই। তবে এই সুড়ঙ্গপথ যে বহুদিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, এমন কিন্তু নয়। খুব বেশি ধুলোবালি বা অপরিচ্ছন্নতা এখানে নেই, বোঝাই যাচ্ছে যে নিয়মিত এই পথ ধরে কারোর যেন যাওয়া আসা আছে! সিঁড়ির সারি শেষ হয়ে এলে, পারুল হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছলো একটি সমতল জায়গায়। তার সামনেই রয়েছে একটি ঘরের তালাবন্ধ দরজা। চাবির গোছাটা ধরে সেদিকে এগিয়ে এলো পারুল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে, সেই ঘরের দরজার তালাটা হাত দিয়ে উপলব্ধি করে, এক এক করে চাবিগুলো ব্যবহার করে খোলার চেষ্টা করতে লাগলো তালাটা। এক সময় তার প্রচেষ্টা সফল হল, সশব্দে খুলে গেল তালাটা। সেটাকে দরজার হাতল থেকে খুলে নিয়ে, এক ঝটকায় পারুল সশব্দে খুলে ফেললো সেই ঘরের দরজাটা!

সেই ঘরের ভেতর অগ্রসর হয়ে, জমাট অন্ধরারের মধ্যে সামনে চোখ রাখতেই যেন তার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো। সে অস্ফুট স্বরে নিজের মনেই বলে উঠলো, “একি!…এটা তো…এটা তো…”

(৬)
“ওই ঘরে কোনো অশরীরিকে আবদ্ধ করে রাখা নেই, খোকা…ওখানে বন্দী করে রাখা রয়েছে তোর আমার মতই একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষকে!”, কম্পিত গলায় শশীভূষণ বলে উঠলেন অমূল্যর উদ্দেশ্যে।

বিস্মিত চোখে বাপের দিকে চেয়ে রইলো অমূল্য। তিনি বলেই চললেন, “ভালো হল তুই নিজে মুখেই এই কথা তুললি, খোকা…কারণ আমি নিজেই চাইছিলাম এই বিষয়ে তোদের বিস্তারিত জানাতে। দগ্ধে দগ্ধে মরছিলাম এতদিন এই পাপের কথা চাপা রেখে। শুধু কোন মুখে এই কথা তোদের জানাবো, সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না এত দিন ধরে!”

“সেই সময় তোর ঠাকুরদা ইন্দুভূষণ রায়চৌধুরী বেঁচেছিলেন। তোর জ্যাঠামশাই, মানে আমার দাদা, ফণীভূষণের সবে মাত্র মৃত্যু হয়েছে। এমন সময় এই বাড়ির কাজ থেকে ছুটির জন্য অনুরোধ করে এক অকালবিধবা সুন্দরী কাজের মেয়ে। পরে জানা যায় যে সে ছিলো অন্তঃসত্ত্বা! এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। কয়েকবছর পর, একটি দু’বছরের ছোট্ট ছেলেকে কোলে করে এই বাড়িতে প্রবেশ করলো এক বৃদ্ধ। সে বলে, যে এটি হল তার মেয়ের সন্তান, যে এই বাড়িতেই কাজের জন্য নিযুক্ত ছিল। ছেলেটির নাম সোমেশ্বর। দু’দিন আগেই কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যু হয়েছে সেই মেয়েটির, তবে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তার শেষ ইচ্ছা ছিলো, যে তার সন্তান যেন পায় উপযুক্ত পিতৃপরিচয়…সেই জন্যই তাকে এই বাড়িতে এনেছে সেই বৃদ্ধ…তার কারণ হল, ছেলেটির পিতা হল ফণীভূষণ!”

এতটা বলে থামলেন শশীভূষণ, বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইলো অমূল্য। আবার বলতে শুরু করলেন তিনি।

“কিন্তু বাবা তার কথা তো কানে তুললেনই না, বরং সেই বৃদ্ধকে এবং বাচ্চাটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন। বৃদ্ধ যাওয়ার আগে চীৎকার করে জানিয়ে দিয়ে গেল, যে জমিদার বাড়ির এই কেচ্ছা সে গ্রামের সকলকে জানিয়ে দিয়ে যাবে!…তবে বাড়ির ফটকের বাইরে বেরোতে পারলোনা তারা, তার আগেই বাবার নির্দেশে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো চারজন লেঠেল!…লাঠির আঘাত মাথায় লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বৃদ্ধের। বেঁচে যায় ছেলেটি।”

“তাকেও মারতে চলেছিলেন বাবা, কিন্তু আমি তার পা ধরে সেই যাত্রায় রক্ষা করলাম দাদার রেখে যাওয়া শেষ চিহ্নটাকে!…তবে বাবা আমাকে কথা দেওয়ালেন, যে এই অবৈধ সন্তানটি যেন এই বংশের বিষয়সম্পত্তির কোনো অংশের উত্তরাধিকার না পায়! তাকে প্রাণে বেঁচে থাকতে গেলে, সকলের চোখের অলক্ষ্যে থাকতে হবে!…আমি জানতাম দাদার তন্ত্রমন্ত্র করার গুপ্তকক্ষের ঠিকানাটা, তাই সেদিন থেকেই ছেলেটিকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য আমি রেখে এলাম সেখানে। বাড়ির এক বিশ্বস্ত চাকরের দ্বারা তার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হল…তবে বাবার মৃত্যুর পরও কেন জানিনা, তাকে দেওয়া কথা ফেলতে পারলাম না আমি। জনসমক্ষে আনতে পারলাম না দাদার সন্তানকে!…তবে আজ আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, এই পরিবারের অর্ধেক সম্পত্তির ভাগ সোমেশ্বরকে দিয়ে যেতে চাই আমি!”

এতক্ষণ শোনার পর প্রথম মুখ খুললো অমূল্য, “কে ছিলো সেই মৃত কাজের মেয়েটি, যে জেঠুর সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করেছিলো?”

“চাঁপা…গাঁয়ের লোকেরা তাকে চাঁপা বলে ডাকতো!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন শশীভূষণ।

ঠিক সেই সময় শশীভূষণের ঘর থেকে শোনা গেল একটি কান ফাটানো আর্তচিৎকার, আর সেই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার তীব্র আওয়াজ!

(৭)
‘পাতাল ঘরে’ ঢুকে পারুল ছুটে গেল সেই দীর্ঘদেহি সুপুরুষ যুবকটির দিকে, যাকে এতকাল ধরে এই ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। উস্কোখুস্কো চুল, একমুখ দাড়ি এবং মলিন বেশভূষা পরিহিত যুবকটি উবু হয়ে বসে ছিলো ঘরের মেঝের ওপর। সেও যেন খুব আশ্চর্য হল এই রাতের অন্ধকারে পারুলকে দেখে।

“আপনি তো কোনো অশরীরি নন…আপনি একজন মানুষ!…আমাদের মতই মানুষ!…কে আপনি? বলুন কে?”, চিৎকার করে ওঠে পারুল।

থরথর করে কেঁপে উঠলো যুবকের ঠোঁটদুখানি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। শুধু অস্ফুট কণ্ঠে নিজের নামটা বলে উঠলো সে, “স…সোমেশ্বর!” সেই মুহূর্তে পারুল সেই যুবকের হাত ধরে তাকে বার করে আনলো সেই ঘর থেকে, তারপর তাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে বেরিয়ে এলো বাড়ির বারান্দায়।

“ও যেই হোক না কেন, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে যে এই পরিবারের অর্ধেক সম্পত্তি আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে, পারুল!…দেখো না, বাবাও যেন এই বুড়ো বয়সে দয়ার সাগর হয়ে উঠেছেন, বলছেন কিনা এখন প্রায়শ্চিত্ত করবেন!…দিয়েছি বুড়োর মাথায় পিস্তলের বাঁটের এক ঘা, এখন সে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে নিজের ঘরে, যার দরজা আমি বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছি!…হাহাহাহা!”

কথাগুলো শুনে সচকিত হয়ে পারুল সামনে তাকিয়ে দেখলো, যে নিজের জেঠতুতো দাদার দিকে পিস্তল বাগিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অমূল্য, মুখে পৈশাচিক হাসি! অমূল্যের এই ধুর্তামির সাথে নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে রইলো পারুল। তারপর আচমকা সোমেশ্বরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে নিয়ে দৌড়ে উঠে গেল বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে, সোজা ছাদের উপর। অমূল্যও পেছন থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছুটে আসতে লাগলো তাদের পেছন পেছন।

ছাদে উঠে কার্নিশের দিকে অগ্রসর হতেই দু’জনে বুঝলো, যে আর পালাবার কোনো জায়গা নেই! ওরা দু’জনেই পেছন ফিরে চেয়ে দেখলো, যে হিংস্র মুখে সোমেশ্বরের দিকে পিস্তল তাক করে সেদিকেই এগিয়ে আসছে অমূল্য। একটি বিকট হাসি হেসে পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দিতে গেল অমূল্য, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে নিলো সোমেশ্বর! ঠিক সেই মুহূর্তে, অমূল্যের সামনে খোলা ছাদের মাঝে রাতের বাতাসের ধূলিকণাগুলো মিলেমিশে সৃষ্টি করলো এক নারীর আবছা অবয়বকে! ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো অমূল্য, পিস্তলটি পড়ে গেল তার হাত থেকে! পারুল জানে, এই অশরীরি আর কেউ নয়…সোমেশ্বরের মৃত মা, চাঁপা!

নিজের ছেলেকে এই বন্দী দশা থেকে উদ্ধার করার জন্যই সে অশরীরি হলেও বন্ধুত্ব করেছিলো পারুলের সাথে। এই ‘পাতাল ঘরে’ কি আছে, সেটা জানার কৌতূহল সৃষ্টি করেছিলো সে পারুলের মনে। আর আজ এই মুহূর্তেও নিজের ছেলেকে মৃত্যুর মুখে থেকে সেই উদ্ধার করতে এসেছে!

ধীরে ধীরে চাঁপার অপার্থিব দেহটি এগিয়ে চলেছে অমূল্যর দিকে, আতঙ্কে কম্পিত পায়ে সে এক পা দুই পা করে পিছিয়ে চলেছে। অমূল্য বুঝতেও পারলো না, সে ছাদের বিপরীত দিকের কার্নিশের কতটা নিকটে চলে এসেছে সে! কিন্তু চাঁপার প্রেতাত্মা তখনও একই গতিতে অগ্রসর হতে লাগলো তার দিকে…আর নিজের শরীরের ভার সামলাতে পারলো না অমূল্য…তাল সামলাতে না পেরে, শেষ আর্তচিৎকার করে তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল তার দেহ…নিচে পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিথর হয়ে গেল অমূল্যর রক্তাক্ত শরীরটা!…সেই মুহূর্তে চাঁপা পেছন ফিরে তাকালো আতঙ্কিত সোমেশ্বর আর পারুলের দিকে, মুখে প্রসন্নতার হাসি। এরপরই একটা দমকা হাওয়ার বাতাসের সাথেই চিরবিদায় জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল চাঁপার অবয়ব!

(৮)
এক মাস পরের ঘটনা:
———————————
মাথায় লাগা আঘাতটা থেকে এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন শশীভূষণ। নিজের ছেলের জায়গাতেই তিনি বসিয়েছেন সোমেশ্বরকে। এখন সমস্ত বিষয় সম্পত্তির ভার তার ওপর। শশীভূষণ নতুন করে এই বাড়িতে পারুলকে ফিরে পেতে চান, সোমেশ্বরের স্ত্রী হিসাবে। স্বামীকে হারিয়ে কিছুদিনের জন্য ভেঙে পড়েছিলো পারুল, এখন সেও মত দিয়েছে সোমেশ্বরের সাথে নতুন করে বাঁচার। তবুও মাঝে মাঝে তার একটা কথাই মনে হয়:

“অশরীরিদের কথা মনে হলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, যে তারাও মানুষের বন্ধু হতে পারে! আমাদের সাহায্য করতে পারে! আর সর্বোপরি, এই রক্ত মাংসে গড়া মানুষদের প্রবৃত্তিও অশরীরিদের থেকে আরো কত বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে!”

Exit mobile version