“বুড়িটা বোঝেনি সে কথাগুলো”
-তন্ময় সিংহ রায়
এ গ্রহের উদ্ভিদ বড়োজোর আর ক’টা দিন তাকে অক্সিজেন দেবে! বিভিন্ন প্রসাধনীতে যে ত্বক একদিন ধরে রাখতো তার লাবণ্য, বেশ কয়েক বছর হোলো শেষ নিঃশ্বাসটাও ত্যাগ করেছে সেটা! অসংখ্য ভাঁজে সে হারিয়েছে তার স্বাভাবিক রুপ! শিরা ধমনীগুলো প্রতি মুহুর্তে উপেক্ষা করে তাকে(ত্বক)। যে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে ছিলো পরম মমতার কোমল স্পর্শ, সে ঝাপসা দৃষ্টি আজ চরম অনাদরে ও অবহেলায় ভাসে নোনাজলে!
আজ প্রায় বছর দেড়েক হোলো, প্রতিদিন বিকেল চারটে বাজলেই বুড়িটা জানালাটার লোহার রডগুলোকে ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে ওই মাঠটার দিকে! কৌতুহলদীপ্ত জনা-তিনেক বৃদ্ধা মনের জানার প্রবল ইচ্ছাকে দমন করতে না পেরে অবশেষে একদিন বুড়িটা বলে বসে, তার একমাত্র আদরের সোনার টুকরো জীবন, তার ছোট্ট ছেলেটা নাকি ভীষণ চঞ্চল! কোথায় খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বিষম চোট পায়, রক্ত বেরোয় কেটে গিয়ে, কি করে বসে!… তাই প্রতিদিন খেলার সময়ে তিনি তাকে অস্পষ্ট নিষ্পলক দৃষ্টিতেও দুর্বল রেটিনায় বসিয়ে নাকি নজরবন্দী করে রাখেন।…….পরম মমতার এরূপ মর্মান্তিক প্রতিফলনে বিষ্ময়ে হতবাক চশমাবৃত ছ’টা দুর্বল চোখের অশ্রুগ্রন্থি নিঃসৃত করেছিলো কিছু সুপরিচিত বেদনাশ্রু!….বোঝানোর সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম সত্বেও সে বুড়ি বোঝেনি যে তাঁর সোনার টুকরো ছেলে আজ প্রাপ্তবয়স্ক, এ পৃথিবীর অনেক কিছুই এখন সে বোঝে, একটা বউ এনেছে ঘরে…. আর বউয়ের অপছন্দটা ছেলের কাছে আজ তাঁর (বুড়ির) চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।……মূল্যটাকে হীন করে অব্যবহৃত প্রাণহীন আসবাবপত্রের মতন তাঁকে(বুড়িকে ফেলে রেখে গেছে এই ঘরেই…. তাঁদের (অন্যান্য বৃদ্ধাদের) সাথে। তার শেষ জীবনের ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া-পাওয়া, আশা, স্বপ্ন, ভরসা সবই তাচ্ছিল্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে এই আবদ্ধ ইঁটের খাঁচায়। বুড়িটা বোঝেনি যে, আজ আর তার সোনার টুকরো ছেলেটা রাতে দুধের জন্যে ডুকরে কেঁদে ওঠেনা, তাকে আজ আর পরাতে হয়না যত্ন করে কাজল টিপ!… ছোট্ট আঙুলটা ধরে অতি যত্নে গুটি গুটি পায়ে সে আর মায়ের সাথে হাঁটেনা…..স্কুল থেকে এসেই ঝপাস করে ব্যাগটা ফেলে অভুক্ত মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আজ আর বলেনা….”মা খিদে পেয়েছে, ভাতটা মেখে খাইয়ে দাও”…… বুড়িটা বোঝেনি সে বোঝানো কথাগুলো।
একদিন গহীন রাতে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে বুড়িটা চিৎকার করে বলে উঠলো “সোনা আমার, ওদিকে যাসনা বাবা… ওদিকে পুকুর আছে !”
…সেই জানালাটা তেমনি আছে, আছে দিগন্ত বিস্তৃত সেই খোলা মাঠটাও, কিন্তু শুষ্ক ত্বকের মমতা মাখানো দু’টো হাত বিকেল চারটে-তে আর কোনোদিনও ধরেনি লোহার রডগুলোকে সেদিন রাতের পর।।