আলাপ থেকে হৃদ্যতা
-শচীদুলাল পাল
২৭ শে জানুয়ারি ‘১৯। মৌলালি। যুব কেন্দ্র।বিবেকানন্দ অডিটোরিয়াম। কলকাতা। সাহিত্যের আঙিনায়, আলাপি মন ওয়েব ম্যাগাজিনের প্রথম বার্ষিক মুদ্রণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরুর কিছু আগেই পৌঁছে গেলাম।যাদের এতদিন ফেসবুকের পেজে ওয়েব সাইটে দেখেছিলাম তাদের চাক্ষুষ দেখলাম। একে অপরের সাথে দেখা সৌজন্য বিনিময়। অমল দাস আর বিভুতি ভূষন বিশ্বাস ছাড়া কেউ পূর্ব পরিচিত নয়। একে অপরের সাথে আলাপে মশগুল।
আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন অন্যতম কর্নধার রীনা চ্যাটার্জি। তার সহৃদয় ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম।
এরপর অনুষ্ঠান শুরু হলো। রীনা চ্যাটার্জির বক্তব্য রাখছিলেন। লক্ষ্য করলাম শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলঘরে চমৎকার সাউন্ড সিস্টেম। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে। বক্তব্যে তিনি বলছিলেন সংস্থায় তার মেয়ের অবদানের কথা। বিদেশে থাকে। আসতে পারেনি। বলতে বলতে তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে গেলেন। তার স্নেহ মমতা এতটা আবেগময় যে তিনি তার বক্তব্য সমাপ্ত করতেই পারলেন না। তার নীরবতায় এক অব্যক্ত কান্নার ধ্বনি শুনতে পারলাম। মনটি তার নারকেল ফলের মতো।বাইরে বজ্রকঠিন, ভিতরে শাঁস ও জলের মত।
স্বরচিত কবিতা পাঠ শুরু হলো। আমার নাম ডাকলে আমি মঞ্চে উঠলাম। পাঠ শেষে যথারীতি করতালি। ‘কিসের অহংকার’ স্বরচিত কবিতা পাঠ শেষে ধীর পদক্ষেপে নিজ আসনের দিকে এগিয়ে আসছি। হঠাৎ এক তরুণী মহিলা নিজ আসন থেকে সবার সামনে উঠে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। বলল “আপনার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। আমি আপনার অনুরাগী”। তার হাসবেন্ডকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল। হাসবেন্ডকে বলল “উনি গুরুজন ব্যক্তি। নমস্য। ছবি তুলে দাও। তারপর আমার সাথে অনেক ছবি ও সেলফি তুলল। যা আজও স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি বহু মঞ্চে বহু কবিতা পাঠ করেছি। অসংখ্য করতালি পেয়েছি কিন্তু পাঠ শেষে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম এক সহপথিক অচেনা কবির কাছ থেকে পেয়ে নিজেকে গর্বিত বোধ করলাম। এই প্রণামগুলি আমার প্রেরণা হয়ে থাকবে। মেয়েটির নাম দীপালী পাল।এডভোকেট বারাসাত কোর্ট।
জীবন নদীর স্রোতের মত বহমান। জীবনে চলার পথে নিত্যনতুন মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। কিন্তু আমি শুধু লিখছি ইদানিং সাহিত্য সংস্কৃতিতে যুক্ত ব্যাক্তিদের সাথে প্রথম পরিচয় ও আলাপের কথা।পারিজাতের সাহিত্য পত্রিকার কাব্য সম্মাননা ২০১৯ ও স্বপ্না বিশ্বাস সাহিত্য স্মৃতি পুরস্কার -২০১৯ গ্রহণ করলাম আন্তর্জাতিক বইমেলা কোলকাতায়। অনুষ্ঠানে আলাপ থেকে আন্তরিকতায় স্থান পেল তিনজন। প্রথম প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক কবি ও গবেষক বরুন চক্রবর্তী (অতন্দ্র), দ্বিতীয় বাচিক শিল্পী, অভিনেত্রী সঞ্চালিকা সর্বানী চ্যাটার্জি। তৃতীয় মৌ নামে এক অতি সাধারণ ঘরের অল্পশিক্ষিতা মেয়ে।
বরুন চক্রবর্তী। প্রথম আলাপে জানলাম হৃদয়টি দরাজ, আবেগময়, প্রভূত জ্ঞানী। বৃক্ষ যেমন ফলভারে নত হয়। তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি নম্র হয়। ‘বিদ্যা দদাতি বিনায়াং’।এত শক্তি এত কলমের জোর থাকা সত্ত্বেও হৃদয়টি নির্মল।কবিতা পাঠ করতে করতে আবেগ তাড়িত হয়ে চোখে জল এসে গেল।
উপস্থিত অনেক কবি লক্ষ্য করল। আমি বললাম “কবির স্বরচিত কবিতা সন্তানের মতই প্রিয়”।কবি সম্মেলনে বা প্রকাশিত পুস্তকে অন্যের কবিতাগুলি সবাইকে মনযোগ দিয়ে শোনা বা পড়া উচিত। কবি যখন কবিতা লেখে তখন সে তার সমস্ত বিদ্যা উজাড় করে সেরাটুকু দেয়। তার অবদানকে সম্মান জানানো উচিৎ”।বরুন বাবু বললেন “আমার নামে আরোও কয়েকজন লেখক আছে।সেজন্য আমি আমার নাম লিখি বরুন চক্রবর্তী (অতন্দ্র)।আমি একজন যুক্তিবাদী নির্বিবাদী লেখক। গদ্য পদ্য দু’টোতেই লিখি।মানুষের বিপদে আপদে পাশে থাকার চেষ্টা করি।সমাজ সচেতক,মুক্তমনা। বিগত কয়েক দশক ধরে লিখে আসছি বিভিন্ন পত্রিকায়। টালিগঞ্জে অনেক সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছি। সাহিত্যের টানে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় বাংলাদেশ মধ্যপ্রদেশ, সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও মাসাধিককাল ইউরোপ ভ্রমণ করেছি এবং নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিল্লি থেকে ডঃআম্বেদকার ন্যাশনাল ফেলোসিপ এওয়ার্ড পেয়েছি। তার সাথে আবার সাক্ষাৎ হলো কল্পসাগর, যুথিকা, আন্তরিক,ও মেঘদুত যৌথ কবি বাসরে কলকাতা বইমেলায়। সেদিন ত অনেকটা সময় আমার সাথেই কাটালেন। অনেক খোলামেলা আলোচনা করলেন। এক কথায় আমাকে তার যে ভালো লেগেছে এবং কবিতা ও পঠন ভঙ্গিমা ভাল সেটি বলেই দিলেন।”
তার বাড়ীতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সেদিন প্রথম সাক্ষাৎ হলো সর্বগুণসম্পন্না শিল্পী সর্বানী চ্যাটার্জির সাথে। তিনি একাধারে বাচিক শিল্পী, অভিনেত্রী, সঞ্চালিকা। ডি.এ.বি. মডেল স্কুল আই.আই.টি খড়গপুরের প্রাক্তন শিক্ষিকা। Ex. Student of NIFFA Kolkata (acting).
উন্নত মানের ফিল্ম করেছেন। আলাপচারিতায় তিনি বললেন ‘এক ফিচার ফিল্ম করেছেন নাম তার ‘তার গল্প’,। ক্যানসারের উপর এই ফিল্মে তিনি এক নার্সের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বিশিষ্ট ভূমিকায় আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।”
এরকম এক গুণী মহিলার সাথে আলাপ হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আলাপ থেকে ঘনিষ্টতা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি। এখন তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। আমার বিষয়ে নিজে থেকেই বললেন “আপনার কবিতা ও কবিতা পাঠের কলাও ভাল লেগেছে। আপনি সরল প্রকৃতির মানুষ”। আমি বললাম শত্রু মিত্র সবাই এই কথায় বলে। তার মত এক বিশিষ্ট ভদ্রমহিলার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। সুগন্ধুযুক্ত ফুল যেমন আদরণীয় তেমনি এই মহান শিল্পী আমার হৃদয়ে চির বিরাজ করবে। তার এক বিশেষ গুণ যে এতবড় মাপের মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে দ্বিধা বোধ করেন না। পারিজাত সাহিত্য পত্রিকার কলকাতা বই মেলা অনুষ্ঠানে সাক্ষাত হলো মৌ নামে এক অতি সাধারন মেয়ের সাথে।মেয়েটি কবি।পারিজাতে কবিতা লেখে। কখন চাক্ষুষ দেখিনি। হঠাৎ মেয়েটি এসে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। বলল “আপনার সাথে ফোটো তুলতে চাই।” স্বামীকে বলল “ছবি তুলে দাও”। বলল “আপনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আপনার বাস্তববাদী কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। মন ছুঁয়ে যায়।আমি একবার ফেসবুকে লিখে ছিলাম কবিতা লেখা ছেড়ে দেব। আমি শিক্ষিত নই।মাধ্যমিক পাশ”। তখন আপনি লিখেছিলেন “রবীন্দ্রনাথ কোনো স্কুল কলেজে পড়েনি। কোনো ডিগ্রী ছিলনা। তুমি লেখো।” মেয়েটির নাম মৌ।বলল, “আপনার প্রেরণায় আমি লেখা ছাড়িনি। এবারতো দ্বিতীয় সারিতে নাম।”
তার ব্যাক্তিগত জীবনের কাহিনী উজাড় করে জানাল।সে বলল “এখন আমার বয়স ২০ আমি ছোটোবেলা থেকে একটি ছেলেকে ভালবাসতাম। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভালবেসে তাকেই বিয়ে করলাম। আমরা গরীব। ছেলের পরিবার আমাদের বিয়েকে মেনে নিল না। আমরা ঘর ছেড়ে অন্যত্র ভাড়া বাড়ীতে থাকতাম। দীর্ঘদিন ভাড়া বাড়ীতে কাটাবার পর এখন আমি শ্বশুর বাড়ীতে ঠাঁই পেয়েছি। আমার কাজে কর্মে পরিবারকে খুশি করেছি। আমাকে পড়বার অনুমতি দিয়েছে। আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি।শ্বশুরবাড়ীর মন জয় করেছি। এখন তারা আমাকে ভালোবাসে। মাঝখানে আমি একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। শাশুড়ি মা রাত জেগে আমার দেখভাল করেছিল। আমি ছিলাম অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আমার গর্ভস্থ সন্তানকে বাঁচানো যায়নি। এছাড়া তাদের অনেক প্রেম কাহিনী জানিয়েছিল। আমি বললাম “এতো চিরন্তন- পারো দেব দাস। কিন্তু পারোর সাথে দেবদাসের বিয়ে হয়নি। তুমিতো তোমার প্রেমিককে বিয়ে করেছ। তুমিতো সৌভাগ্যবতী। “