Site icon আলাপী মন

গল্প নয় সত্যি

গল্প নয় সত্যি
-রাণা চ্যাটার্জী

 

 

“আপনি কোথাও ভুল করছেন ম্যাডাম। আমি তো আপনাকে কিছুতেই চিনতে পারছি না,একটু যদি নিজের পরিচয় দেন” এই ছিল সুনন্দ স্যানালের প্রথম উত্তর ওই অপরিচিতা মহিলার অনেকগুলো ম্যাসেজ,অনেকদিন ধরে ইনবক্সে পড়ে থাকা দেখে।

আসলে হয়েছে কি, সুনন্দের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কোনভাবে পাসওয়ার্ড হারিয়ে খোলাই যাচ্ছিল না। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি, চেষ্টার পরেও ব্যর্থ প্রচেষ্টায় খুলতে না পেরে অগত্যা নিজের নামে আর একটা অ্যাকাউন্ট খোলে সে।কিন্তু প্রায়ই মিস করত সে, পুরনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বন্ধুদের। তাদের বেশিরভাগই বাইরের দেশের হওয়ায়, তাদের আদব কায়দা, কথপোকথনে সেই সব দেশের আচার আচরণ, শিল্প সংস্কৃতি, উৎসব এসব সুনন্দকে আকর্ষণ করতো বরাবর। আসলে ওর মধ্যে একটা দারুণ গুণও ছিল। খুব সহজেই অন্যের সঙ্গে মিশে গিয়ে, মানিয়ে নেওয়ার, অন্যকে চটজলদি আপন করে নেওয়ার।পুরনো অ্যাকাউন্ট খুলতে না পারার কষ্টের প্রলেপে, নতুন ফেসবুক আইডি, মলম হয়ে যখন ক্ষত প্রায় সারিয়ে তুলছিলো, একদিন অফিসের লকারে, পুরানো ডায়েরির পাতায় পাসওয়ার্ডটা লেখা পেতেই আনন্দে আটখানা হয়ে ওঠে সুনন্দ। পাসওয়ার্ড ফিরে পাওয়ার শুভ মুহূর্তেই ফেসবুক লগ ইন করে দেখে বাপরে বাপ, পায় হাজারের উপর নোটিফিকেশন। সব ধীরেসুস্থে দেখতে দেখতেই নজর পড়ে রুশা চৌধুরী নামে এক অপরিচিতের প্রচুর ম্যাসেজ। যিনি কিনা খুব ঘন ঘন ম্যাসেজ করেই গেছেন লাগাতার এই ক’মাস। খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব মেসেজগুলো দেখে শুনে সুনন্দ, বুঝতে পারল ইনি নিশ্চয়ই তাকে ভুল ভেবে ম্যাসেজ করে চলেছেন হয়তো বা কাউকে খুঁজছেন, কেমন যেন হন্যে হয়ে!

ওনার ম্যাসেজ গুলো খুবই সরল ছিল,এই রকম
“কেমন আছো সাড়া দিচ্ছনা যে!”
“সনু,তুমি ভালো আছো তো?”
এভাবে ছেড়ে যাচ্ছ আমায়!
কতদিন কথাই বলো না!
কি হয়েছে তোমার?
এই ধরনের একটা একটা লাইনে-যেন একটা আকুতি, কাছের কাউকে খোঁজার! আপনারা কি ভাবছেন, কোনো ফাঁদ তাই তো? হ্যাঁ,সে তো দিনকাল খারাপ, সেটা সুনন্দ যথেষ্টই জানে, কিন্তু কোথায় যেন তার মন অনুভব করেছিল, হতেও তো পারে সত্যি সত্যি কাছের বন্ধুটিকে তার প্রয়োজন। কিন্তু একটা খটকাও লাগছিল, তাকে কেন ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে!

সে দিনটা ছিল শনিবার,সুনন্দ পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই, অপর প্রান্ত থেকে আবার প্রশ্ন আসে, “আগে বলো তুমি কেমন আছো? কেন আনফ্রেন্ড করেছো আমায়? একটা যেন কোথাও জোর, অধিকার প্রশ্ন করার মধ্যে, এটা উপলব্ধি করে সুনন্দ লিখেছিল,”হ্যাঁ, আমি ভালো আছি কিন্তু আপনি কে, আমাকে কি সত্যিই চেনেন?” পরক্ষণেই উত্তর এসেছিল “চিনতে পারছ না এখন আমায়, আমার কিন্তু মন বলছে তুমি আমার বন্ধু সনুই ।”

সুনন্দ সমাজ বিদ্যার ছাত্র হলেও এই বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত “মনস্তত্ত্ব” ভীষণভাবে আকর্ষিত করতো তাকে। ফ্রয়েডের চিন্তাভাবনা, স্বপ্ন তত্ত্ব, মানুষের জটিল মন, চেতন অবচেতন এইসব আগ্রহের বিষয় বরাবরই তার অতি পছন্দের তালিকায় ছিল।

চাকরির শুরুতে সুনন্দ বছরখানেক দিল্লিতে সরকারী প্রকল্পে কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করেছিল। সে সামনে থেকে উপলব্ধি করেছে সাক্ষাৎকার সহ কথাবার্তায়, মাতাল ব্যক্তি হোক আর প্রসূতি, বখে যাওয়া সন্তান বা আফিম নেশাগ্রস্থ ব্যক্তিগণ বা মানসিক ভারসাম্যহীনদের সাথে একটু বন্ধুর মতো মিশলে তারা গল গল করে সব উগরে দেয় তাদের যাবতীয় সমস্যা সহ। অর্থাৎ কথোপকথনে, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির একটা বন্ধুত্বমূলক পরিবেশ তৈরি করতে পারলে আখেরে উপকার হয় মানসিক চাপগ্রস্থ ব্যক্তির। যদিও সুনন্দ এটা নিশ্চিত নয় যে, এই অপরিচিতা রুশা চৌধুরীর কোনো মানসিক চাপ চলছে! তবে ওনাকে একটু সময় দেওয়া উচিত বন্ধুর মতো মিশে, আর এটা যে খুব দরকার সে বিষয়ে সুনন্দের কোনো দ্বিমত নেই,যদি সত্যিই ওনাকে উপকার করা যায়।

এই ক’দিনে সামান্য চ্যাট করে সুনন্দ, রুশাকে কিছুটা হলেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে- উনি যে সুনন্দকে খুঁজছেন,এই সুনন্দ সে নয়। প্রমাণ স্বরূপ সুনন্দ তার নতুন ফেসবুক আইডি দেখতে দিয়েছে, যেখানে তার পরিবার,সহধর্মিনী,মেয়ের ছবি আছে।সুনন্দ উপলব্ধি করেছে, যত সে নিজেকে অন্য সুনন্দ, তার সনু নয় এটার প্রমাণ দিয়েছে, রুশার যেন একটু একটু করে আফসোসের পাল্লা ভারী হয়েছে, ফুটে উঠেছে কখনো হতাশা, কখনো বিরক্ত করার জন্য দুঃখবোধ।

বন্ধুর মতো মিশে সুনন্দ পরিবেশ হালকা করে দিতেই জড়তা কাটিয়ে রুশা জানিয়েছিল, “এই নামে এক বন্ধু ফেসবুকে ভীষণ আপন হয়ে যায় তার। প্রতিদিন তারা কত গল্পই না করতো। তিনি ভয়ঙ্কর রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সন্তান হওয়ার পর, নার্ভ জনিত সমস্যায় একপ্রকার জর্জরিত।এতটাই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল যে,কচি বাচ্চার পাশে উনি মরার মত অবশ শরীরে শুয়ে দিন কাটাতেন। কোন শক্তি ছিল না, নড়া চড়া করার, চুপ করে মরা মানুষের মত পড়ে থাকতেন মাসের পর মাস আর সিলিং এর ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতেন, একদিন যদি দাঁড়াতে পারি, ঠিক ঝুলে যাবো।” এই সব কথাগুলো শুনে সুনন্দের একদম ছবির মতো ভাসতো রুশার অসহনীয় পরিবেশ, মানসিক অবস্থা। রুশা আরো জানিয়েছিলেন, “আশে পাশের প্রতিবেশী যারা দেখতে আসতো, তাঁদেরকে উনি জনে জনে আকুতি নিয়ে অনুরোধ করে বলতেন, আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে যাও না গো তোমরা কেউ, নইলে ও মারা যাবে আর বাঁচবে না।”

ঠিক এই প্রতিকূল পরিবেশে সুনন্দ সান্যাল নামে এক বন্ধুর আবির্ভাব হয় রুশার ফেসবুকে, সে তাকে এতটাই উৎসাহিত করতো সে ঋণ ভোলা সম্ভব নয়। তার জন্যই রুশা, একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠেছে।বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে রুশাকে, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে স্বামীকে নিয়ে ফ্লাইটে করে মরা মানুষের মতো ব্যাঙ্গালোরে যাওয়া করিয়েছে। কখনো কলকাতার ডাক্তার, কখনো গৌহাটির ডাক্তার এই সব করে, ওই সুনন্দর জন্যই যখন বেঁচে ওঠা, নতুন এই জীবন, ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ করে সুনন্দ তথা তার সনুর গায়েব হওয়া। যত শুনছিল, খুব খারাপ একটা মনকষ্ট সুনন্দকে আরো যেন গুম করে তুলছিল। কিন্তু কি আর করতে পারে, সে যে অক্ষম সেই রুশার সুনন্দের জায়গা পূরণ করতে।

তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে ফেসবুকে যত ওই এক নামের “সুনন্দ সান্যাল”পেয়েছে, রুশা তাদের প্রত্যেককে মেসেজ করেছে, যদি তার সুনন্দ, সনুকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু এটা দুর্ভাগ্য যে কেউ উত্তর দেয় নি কেবল সুনন্দ ছাড়া। আর একদিন রুশা, ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলো, “আমার মন বলছে আপনি আমার সেই বন্ধু, প্লিজ বলুন না, কেন এমন করে দূরে সরে গিয়ে শাস্তি দিচ্ছেন আমায়,আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমি হয়তো আর বাঁচবো না” মাঝে মাঝে এসব শুনে ভীষণ অসহায় লাগতো সুনন্দের,ভাবতো এ কাকে ও এত করে বোঝালো, প্রমাণ দিলো, গিন্নির সাথে পরিচয়ও সব কি তবে বৃথা, এখনো কিনা ভেবে চলেছে এই সুনন্দই তার পূর্ব পরিচিত, হে ভগবান! এর উত্তর ও সে পেয়েছিল রুশার কাছে, রুশা বলতো আর অবাক হতো, দু’টি ভিন্ন মানুষ হয়েও আচরণ, ম্যাসেজে ব্যবহৃত শব্দ সমুহেরও কি সাংঘাতিক নাকি মিল। রুশার এসব কথার কোনো বিজ্ঞান সম্মত জবাব দিতে পারে নি সুনন্দ, বুঝতো রুশার জীবন ওই সুনন্দ নামেই বিভোর হয়ে রয়েছে।

ঘটনার গভীরতা যে কত দূর শেকড় ছড়িয়েছিল, বুদ্ধিমান সুনন্দের বুঝতে বাকি ছিল না। ততদিনে সুনন্দের জানা হয়ে গেছে তার বাপের বাড়ি মুর্শিদাবাদের কান্দিতে।উনার স্বামী কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদে কর্মরত ও রুশারা থাকে গৌহাটি । আস্তে আস্তে খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে এরা দু’জন। এরই ফাঁকে লোকসভার ভোট চলে আসে, ভোটের ডিউটিতে কি কি নিয়ে যেতে হবে এত সুন্দর ভাবে যত্ন নিয়ে লিস্ট বানিয়ে দিয়েছিল রুশা যে সুনন্দ কল্পনাও করতে পারেনি যে সে এত ভাগ্যবান হবে।

সুনন্দের একটা বড় গুণ ছিল, কোন কিছু লুকোছাপা না করে, ফ্রি ভাবে বন্ধুর মতো মিশে যাওয়া, যেন কতখানিই না সে চেনে। তাই প্রতিটা বিষয়ে সে গল্প করতো, ছোট ছোট বিষয়গুলোকে চেষ্টা করত খেয়াল রাখার। ব্যস্ত কৃত্রিমতার জীবনে এই উপলব্ধিটাই সত্যি বলতে কি অনেক। সুনন্দ তার সহধর্মিনী রমার সাথেও ফেসবুকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলি। যখন ওরা দু’জন পরমা, ও রুশা গল্প করতো ভীষণ ভালো লাগতো দেখে সুনন্দের, আর তার মন বারংবার প্রার্থনা করতো যেন রুশার আগামী ভালো কাটে।

ভোটের ডিউটিতে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা, খাওয়া-দাওয়ার কি ব্যবস্থা হল, শোবার রাত্রে কোনো অসুবিধা নেই তো এই সব খুঁটিনাটি রুশা বার বার খবর নিচ্ছিল সুনন্দকে ফোন করে সুনন্দের সহধর্মিনী পরমার মতোই। পরে অবশ্য এক প্রশ্নের উত্তরে স্বীকার করে, সে তার অপরিহার্য বন্ধু সনুকে মনে করেই এত খুঁটি নাটি ফোন, খবরাখবর নিয়েছিল! ওই অচেনা পরিবেশ, কিন্তু অচেনা হলেও আপন করে নেওয়া রুশার খোঁজ খবর, নিজেকে খুব গর্বিত লাগছিল সুনন্দের। সে খুব অবাক হয়ে ভাবতো, এত ভালো বন্ধু পেয়ে যে কেউ হঠাৎ গায়েব হয়, এটাই চরম অবাক হওয়া বিষয়।কখনো তার মনে হতো, অনেকবার বলতে চেয়েও বলতে পারেনি যে, “রুশা,তোমার সনু হয়তো ফেক আইডি ছিল, তোমার ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে গায়েব হয়েছে” আবার এটাই বা বলবে কি করে, সে তো সত্যিকারের বন্ধুর মতো কাজ উৎসাহ দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে, সত্যিই তার অনেক অবদান।

“কিন্তু সে চলে গেল কেন, তবে কি তার কোনো বিপদ হয়েছে” এই চিন্তা করে রুশা আবার একদিন বলছিল, “আমি কিভাবে বিশ্বাস করব বলতে পারেন আপনি অন্য ব্যক্তি, এতো মিল আপনাদের দু’জনের মধ্যে, আদব কায়দা,আচরণ, এমনকি ম্যাসেজ লেখার ধরনও”-এর কোনো উত্তর দিতে পারে নি সুনন্দ বিস্ময় ভরে। সুনন্দ অবশ্য বারবার, রুশার কাছ থেকে তার সনুর ছবি চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল, পরে অবশ্য রুশা ছবি দেখিয়েছিল কিন্তু বলেছিল, “ওর ছবি দেখানোর দিব্যি দেওয়া আছে।” সুনন্দের মাথায় ঢোকেনি, একটা ছেলে কখন বলতে পারে, যে তার ছবি কাউকে না দিতে, এর জন্য দিব্যি দেওয়া কিসের! তবে ছবিটা দেখে কিন্তু সুনন্দ সান্যাল এর মানুষটাকে বেশ ভালই লেগেছিল অনেকটা তার মত যেন ভাবুক, উদাস চাহনি, খুব সুন্দর মিষ্টি মুখমণ্ডল।

হঠাৎ করেই একদিন রুশা আবেগ তাড়িত হয়ে জানালো যে,”জানো কি হয়েছে, তার সুনন্দ মানে সনু ফিরে এসেছে”-হঠাৎ এক ঝলক খুশির মাঝেও উদাস, অভিমানী গলায় বলেছিল সুনন্দ, “খুব খুব ভালো খবর রুশা,ৎতবে তো আমার ছুটি বন্ধু, আসি বিদায়! “
কিন্তু সুনন্দ এসব চাইলে কি হবে, মনে আছে হোয়াটসঅ্যাপে রুশা ভয়েস দিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে বলেছিলো, “প্লিজ এভাবে বলোনা, আমি তোমাকেও কোনদিন হারাতে চাই না, কথা দাও কোনোদিন তুমি এভাবে ভাববে না, তুমি ওই সময় আমায় পাশে থেকে উৎসাহ না দিলে আমি হয়তো মরেই যেতাম এতদিনে,তোমরা দুই সুনন্দ আসলে আমার কাছে একই মুদ্রার দুই পিঠ।”

এই কথাগুলো শুনে আর কিছু বলার থাকতে পারেনা, আজও সুনন্দ ও রুশা পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু। মানুষের জীবনে কোথাও এমন ভালো বন্ধু, খুব খুব দরকার, একদম যেন দখিনা বাতাস হয়ে বিরাজ করে হাত বাড়ালেই বন্ধুর মতো। রুশার সুনন্দ ফিরে এলেও, সে আর রুশা আছে নিজেদের মতো, তাতে এই সুনন্দ সান্যাল ও রুশা চৌধুরীর বন্ধুত্বে কোনো চিড় ধরে নি, ধরবেও না এই বিশ্বাসেই উভয়ে কোনোদিন সাক্ষাৎ না করলেও দিব্যি খাসা আছে ফেসবুক আইডির পাস ওয়ার্ড ভুলে আলাপের সূচনা থেকে।

Exit mobile version