গুপ্তধন
-প্রলয় কুমার নাথ
(১)
কলকাতার একটি হাসপাতালের নামী কার্ডিওলজিস্ট, ডা: সুকল্যাণ বর্মণের চেম্বারে ভীত ত্রস্ত হয়ে বসেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব অসীম বাবু।
অসীম বাবুর কুড়ি বছরের ছেলে শুভাশিস গত এক দুই দিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি। শুভাশিসের হৃদয়ে জন্ম থেকেই একটি ফুটো বিরাজমান, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় Atrial Septal Defect. ছোটবেলা থেকেই বেশ কয়েকবার নানা শারীরিক অসুস্থতার শিকার হতে হয় তাকে, তারপরই তার দেহে ধরা পড়ে এই ভয়াবহ রোগ। তবুও ওষুধপত্রের ওপর নির্ভর করে জীবনের বেশ কয়েকটা বছর অতিবাহিত করলেও, দুই দিন আগেই মাত্র কুড়ি বছর বয়সী এই যুবকের হৃদ-যন্ত্র সাময়িক ভাবে বিকল হয়ে যায়। সেদিন থেকেই সে ভর্তি এই হাসপাতালে।
ছেলেকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন অসীম বাবু। তাকে নিয়ে সে তার অনেক স্বপ্ন। তাই তো নিজে একজন সামান্য একটি বেসরকারী সংস্থার কর্মচারী হয়েও, যথাসাধ্য পয়সা খরচা করে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন একটি নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। অসীম বাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় চার বছর আগে, তার পরিবার বলতে শুধু ছেলে শুভাশিস এবং তার বিরাশি বছরের বৃদ্ধ পিতা কালীপদ বাবু। এদের নিয়েই উত্তর কলকাতার একটি রঙ চটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে সংসার তার।
ছেলেকে নিয়ে নানা চিন্তায় ভোগেন অসীম বাবু। হৃদয়ের ওই রোগটা ধরা পড়ার শুভাশিসের কিছু মনস্তাত্বিক সমস্যাও শুরু হয়েছে।
“জানো তো বাবা, তুমি আর দাদুকে ছাড়া এই বাড়িতে আমি মাঝে মাঝেই আরেকজন ব্যক্তিকে দেখতে পাই…সে সবসময় তোমার আশে পাশেই ঘোরে…কি যেন একটা কথা বলতে চায় তোমাকে!”
প্রতিনিয়ত ছেলের এই কথাগুলো তার মনের নিরর্থক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিলেও, একবারের জন্যও যে তার গা ছমছম করে ওঠেনি, এমন নয়!
“অসীম বাবু, আমার মনে হয় এভাবে আর শুভাশিসকে বেশিদিন রাখা ঠিক হবে না…”, ডা: বর্মণের কথায় চিন্তার ঘোর কাটলো অসীম বাবুর, “এবার কিন্তু সার্জারিটা না করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে আপনার ছেলের!”
“আপনি তো জানেনই স্যার, ওই সার্জারির জন্য দরকার দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা! কিন্তু আমার যা অবস্থা তাতে…”, সংকুচিত মুখে বলে উঠলেন অসীম বাবু, তবে কথাটা শেষ করার আগেই কান্নায় আটকে গেল তার গলা।
“আমি জানি অসীম বাবু, কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও যে দেখতে পাচ্ছি না!” অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠলেন ডা: বর্মণ, “ছেলেকে বাঁচাতে গেলে আপনাকে যে ভাবেই হোক টাকাটা জোগাড় করতেই হবে! সত্যি কথা বলতে গেলে এই যাত্রাই যে আমরা শুভাশিসকে বাঁচাতে পারবো, এটাই ছিলো আমাদের কল্পনাতীত! কয়েক ঘন্টার জন্য তো মনে হয়েছিলো যে সে আমাদের ছেড়ে চলেই গিয়েছে! কিন্তু খুব আশ্চর্যজনক ভাবে তারপরই আবার ওঠানামা করতে লাগলো ই.সি.জি-র স্থির হয়ে যাওয়া লাইন! এই ধরণের Near Death Experience কিন্তু খুব কম পেশেন্টদেরই হয়…”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেই চেম্বারে প্রবেশ করলেন একজন নার্স। তিনি জানালেন যে শুভাশিসের জ্ঞান ফিরেছে, এবং সে তার বাবার সাথে একান্তে কিছু কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অগত্যা এই আলোচনার ইতি এখানেই টানতে হল। অসীম বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন তার ছেলের বেডের উদ্দেশ্যে।
(২)
চিকিৎসার জন্য দরকারী হাজারো সরঞ্জামের মাঝে, বিছানায় শুয়ে বড় বড় চোখ মেলে শুভাশিস চেয়েছিলো তার বাবার পরিশ্রান্ত মুখের দিকে। অসীম বাবু জল ভরা চোখে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলেন শুভাশিসের উস্কোখুস্কো চুলের মাঝে।
“খোকা…কেমন আছিস খোকা?” কম্পিত গলায় বলে উঠলেন অসীম বাবু।
“আমি আবার সেই লোকটাকে দেখেছি, জানো তো বাবা!”, উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দিলো শুভাশিস।
এই সময় ছেলের মুখে সবার আগে এই কথা শোনা একেবারেই আশা করেননি অসীম বাবু। তিনি শুধু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন শুভাশিসের মুখের পানে। কেন জানি না, তার মন তাকে বার বার বারণ করতে লাগলো এবারও তার এই কথাগুলো নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে।
“কি দেখেছিস তুই, খোকা?” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন অসীম বাবু।
“প্রথমে মনে হল একটা মস্ত বড় সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে একা একা চলেছি আমি…চারিদিকে ঘোর অন্ধকার!” উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো শুভাশিসের কন্ঠ, “কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর দেখলাম সুড়ঙ্গের ওই প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে চোখ ধাঁধানো আলো! আমি যেন দু’চোখ হাত দিয়ে ঢেকে আরো জোর কদমে ছুটে চললাম সেই দিকে। এরপর বুঝতে পারলাম ওই আলোর কারণ, যা আসছে সুড়ঙ্গের অপর মুখ থেকে। আমি এক ছুটে বেরিয়ে গেলাম সুড়ঙ্গের বাইরে!…সেখানে তখন রৌদ্রজ্বল দিন, আমি যেন একটা জঙ্গলের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছি…”
কিছুক্ষণ থামলো শুভাশিস। অসীম বাবু অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন আসন্ন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ছেলের এই কল্পনা শক্তি দেখে। সে আবার বলতে শুরু করলো।
“সেই জঙ্গলের চারিধারে বড় গাছপালা থাকলেও, তার মাঝে আছে একটা জলাভূমি। পেছনে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে একটি পুরোনো আমলের তৈরি বিশাল বড় বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। সেই জলাভূমির মাঝে একটি সরু আলের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন তিনি! ঠিক যেমনটা আগে দেখেছি..লম্বা চওড়া চেহারা, এক মুখ দাড়ি, এলোমেলো চুল, পরণে ময়লা ধুতি জামা, কাঁধে একটা ঝোলা!…আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে তিনি বললেন…”
“কি বললেন তিনি তোকে, খোকা!” চিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু।
“বললেন যে, এই যাত্রায় তোমাকে তোমার বাবার কাছে ফেরত পাঠালাম। তবে বারবার কিন্তু তা করা যাবে না। তাই ফিরে গিয়ে তোমার বাবাকে বোলো এই স্থানে আসতে, কারণ এখানেই আমি লুকিয়ে রেখেছি এমন একটি ‘গুপ্তধন’-কে, যা শুধু তোমার বাবারই প্রাপ্য! তার সাহায্যেই তিনি যোগাতে পারবেন তোমাকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলার খরচ!…ব্যাস, এরপর আর কিছুই দেখতে পেলাম না আমি!”, এতটা বলে থামলো শুভাশিস।
এই শীতের দুপুরেও আতঙ্ক আর উত্তেজনায় অসীম বাবুর সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠলো। তিনি কম্পিত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, “সেটা কোন জায়গা, খোকা? ওই ব্যক্তিই বা কে? আর কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন তিনি গুপ্তধন?”
“তা তো আমি জানিনা, বাবা!” অসীম বাবুকে নিরাশ করে শুকনো গলায় বলে উঠলো শুভাশিস।
(৩)
পরদিন সন্ধ্যা বেলায় সাত পাঁচ নানা কথা ভাবতে ভাবতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন অসীম বাবু। পয়সার অভাবে বাইক কেনা হয়নি, ভরসা শুধু সেই আদ্দিকালের সাইকেলটা। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো নয়, বৃষ্টি এলো বলে, ঝোড়ো হাওয়াও বইতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ ধরে। তাই অল্প সময়ে বাড়ি ফেরার জন্য তিনি একটা শর্টকাট রাস্তা ধরলেন। অন্য সময় হলে তিনি হয়তো এই রাস্তাটা ধরতেন না, কারণ এটা দিয়ে যেতে গেলে একটি ছোটখাটো শ্মশানের মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। মূলতঃ নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা তাদের প্রিয়জনদের শেষ কার্য সমাপন করবার জন্য এখানে আসেন।
চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে, এদিকে হঠাৎ করেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। তার মাঝেই কাকভেজা হয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছিলেন অসীম বাবু। বৃষ্টির জলের ঝাপটার সাথে কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধ আসতে লাগলো তার নাকে। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, এবং তাতেই তিনি দেখলেন যে রাস্তার ওপাশে একটি আধপোড়া চিতা সাজানো রয়েছে। বোধহয় বৃষ্টি হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই জ্বালানো হয়েছিলো মৃতদেহটিকে, এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখে আশে-পাশের লোকজনেরা কেটে পড়েছে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন অসীম বাবু, আরো দ্রুত গতিতে তিনি ঘোরাতে লাগলেন সাইকেলের প্যাডেল।
ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকবার গর্জে উঠলো বজ্রবিদ্যুৎ, আর তার আলোতে পাশের চিতাটির দিকে তাকাতেই ভয়ে আর্তচিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু। তাল সামলাতে না পেরে সাইকেল সমেত পড়ে গেলেন নীচে কাদাজলের মধ্যে। উঠে দাঁড়িয়ে দু’চোখ কোঁচলে আরেকবার ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি চিতাটির দিকে…নাহ, এটা তার দেখার ভুল নয়! ওই তো, এখনো আধ-পোড়া মৃতদেহটা সটান উঠে বসে আছে কাঠগুলির ওপর! ধীরে ধীরে তার কালো ঝলসানো মুখমন্ডলটা যেন ঘুরে যাচ্ছে অসীম বাবুর দিকে…পোড়া ভ্রুর দুই ফাঁকের ভেতর চক্ষু কোটরে দৃশ্যমান তার সাদা মণিহীন চোখ!
ভয়ে অসীম বাবুর স্বরযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ যেন বন্ধ হয়ে এলো, তিনি কোনো রকমে চিতাটির দিকে পেছন ফিরে ছুটতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে একটি গাছের গায়ে এসে হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা খেলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি পেছন ফিরে চেয়ে দেখলেন, যে মাটিতে চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে তার দিকেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে অর্ধ-দগ্ধ মৃতদেহটি। আতঙ্কের চোটে গাছটির গায়ে শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে সিঁটিয়ে রইলেন অসীম বাবু। ততক্ষণে এক লাফে মৃতদেহটি একেবারে তার সামনে চলে এসেছে।
“মাগো!”, বলে তীব্র আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করলেন অসীম বাবু, পোড়া মাংসের গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠলো। ঠিক সেই সময় এক অচেনা পুরুষকণ্ঠের গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলো তার কানে, বলা বাহুল্য তা বেরোচ্ছে সেই মৃতদেহটার মুখ থেকেই!
“এখনো কি তুই অবিশ্বাস করবি যে আমি সব সময় তোর আশেপাশেই আছি? এখনো কি তোর ছেলের মুখ থেকে শোনা কথাগুলোকে উড়িয়ে দিবি কিশোর মনের নিছক কল্পনা ভেবে? তুই কি চাস না, যে সে সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়ে উঠুক?”
“কে তুমি? কেন সাহায্য করতে চাও আমায়? কোন ‘গুপ্তধন’ লুকিয়ে রেখেছো তুমি আমার জন্য? কোথায় গেলে পাবো আমি সেটা?”, চোখ বন্ধ রেখেই কম্পিত গলায় চিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু।
“এই সকল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আসে ইতিহাসের পাতায়! অতীতের কারাগারে যে বন্দি হয়ে রয়েছি আমি! সেখানেই এতো বছর ধরে আগলে রেখেছি সেই ‘গুপ্তধন’-কে। তার সাহায্যে সুস্থ করে তুলতে হবে তোর একমাত্র বংশধরকে, আর মুক্তি দিতে হবে আমায়! সেই বিপুল ধন-সম্পত্তি শুধু যে তোর, কারণ আমি হলাম তোরই এক পূর্বপুরুষ!”
এই কথা শুনেই বিস্মিত হয়ে চোখ খুললেন অসীম বাবু। কিন্তু ততক্ষণে তার সামনে আর কেউই দাঁড়িয়ে নেই! বৃষ্টির তেজও অনেকটা ধরেছে। অদূরেই পড়ে রয়েছে তার সাইকেলখানা। সাইকেলের ওপর বসে আরেকবার চিতাটির দিকে তাকালেন তিনি। সেখানেও কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে পারলেন না তিনি। তাহলে এতোক্ষণ ধরে তিনি যা দেখলেন, যা শুনলেন, সবটাই কি তার মনের ভুল!
(৪)
সেদিন বাড়ি ফিরে সম্পূর্ণ ভেজা শরীরেই অসীম বাবু এগিয়ে গেলেন তার শয্যাশায়ী বৃদ্ধ পিতা কালীপদ বাবুর ঘরে। ঝড় বৃষ্টি হবার দরুণ এখন বোধহয় লোড-শেডিং চলছে। অন্ধকার ঘরে ছোট্ট একটা কুপি জ্বলছে। নিজের বিছানায় শান্ত চিত্তে শুয়ে রয়েছেন বৃদ্ধ।
“বাবা!” অসীম বাবুর ডাক শুনে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলেন কালীপদ বাবু।
“বাবা, ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে অনেকবার যে প্রশ্ন করেও তোমার মুখে কোনো সদুত্তর পাই নি, সেই প্রশ্নই আবার করতে এসেছি! কারণ সেটা যে আজ আমার জানার খুব দরকার, বাবা…দরকার তোমার একমাত্র নাতীকে বাঁচানোর জন্য!” কান্নায় ধরে এলো অসীম বাবুর গলা। এরপর তিনি তার পিতার কাছে সব কথা এক এক করে খুলে বলতে শুরু করলেন। সব শুনে কালীপদ বাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন তার ছেলের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে।
“তোমার বংশ পরিচয় কি, বাবা? তোমার পিতা মাতার নাম কি? কোথায় থাকতেন তারা? কেন তাদের একটিও ছবি এতো বছরেও আমার চোখে পড়েনি…বলো, আজ তোমাকে উত্তর দিতেই হবে এই প্রশ্নগুলোর!”, উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন অসীম বাবু।
জানলার বাইরে থেকে আসা হাওয়ার দাপটে কেঁপে উঠলো কুপির অগ্নিশিখাটি, আলো আঁধারের এক অদ্ভুত রহস্যময়তা খেলে গেল কালীপদ বাবুর মুখে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন কালীপদ বাবু, তারপর ধরা গলায় বলে উঠলেন, “এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যে আমার কাছেও নেই রে! এতদিন তোর খারাপ লাগবে ভেবে কিছু বলিনি, কিন্তু আজ আর কোনো কিছু গোপন করবো না!…আমি যে নিজেও জানিনা আমার পিতৃ মাতৃ পরিচয়, কারণ আমি যে শৈশব থেকে বড় হয়েছি কলকাতার এক অনাথ আশ্রমে!”
গোটা আকাশটা যেন ভেঙে পড়লো অসীম বাবুর মাথায়, তিনি স্তম্ভিত মুখে শুধু চেয়ে রইলেন বৃদ্ধের দিকে। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে চললেন কালীপদ বাবু।
“সেই অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের মুখেই শুনেছি, নদীয়ার বীরনগর গ্রামের এক জঙ্গল থেকে আমাকে খুঁজে পায় এই আশ্রমেরই এক কর্মচারী। তখন কতই বা বয়স হবে আমার, দু-তিন মাস! সারা গ্রামে খোঁজ নিয়েও সে আমার পরিবারের কারোর হদিস পায় না। বাধ্য হয়েই সে আমায় কলকাতা নিয়ে এসে আশ্রমের হাতে সঁপে দেয়। এখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা, লেখাপড়া শেখা। তারপর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চাকরিটা পাবার পর, অনেক কষ্টে এই বাড়িটা তৈরি করলাম। বিয়ে করলাম, তুই এলি আমাদের কোলে…”
আরো কত কিছু নিজের মনেই বলে চললেন কালীপদ বাবু, সে সব কথা যেন অসীম বাবুর কানেই ঢুকলো না। তিনি শুধু অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “নদীয়ার বীরনগর গ্রাম! তার মানে সেখানে গেলেই কি আমি পাবো আমার সকল প্রশ্নের উত্তর?”
ঠিক তখনই তার চোখ চলে গেল অদূরে, ঘরের দেওয়ালের দিকে। সেখানে কুপির কম্পমান আলোয় তার আর কালীপদ বাবুর ছায়া ছাড়াও আরেকটি তৃতীয় পুরুষমূর্তির ছায়া বিরাজমান! মনে হল যে যেন অসীম বাবুর এই নিজের উদ্দেশ্যে করার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো!
(৫)
পরদিন অসীম বাবু শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে রাত নটা নাগাদ পৌঁছলেন বীরনগর স্টেশনে। শুভাশিসের দেখা সেই জঙ্গল, জলাভূমি আর পরিত্যক্ত বাড়িটার বর্ণনা দিতেই, একজন স্থানীয় লোক বলে উঠলেন,
“ওহ বুঝেছি…আপনি বোধহয় সেন বাড়ির কথা বলছেন! দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ওরা এখানকার জমিদার ছিলো। এখন ওদের বংশধরেররা সব অন্যত্র বসবাস করে। তাই ওই বাড়িতে এক বুড়ো কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউ থাকে না… তা আপনি সেখানে কেন যেতে চান মশাই? জায়গাটা ভালো নয়, বুঝলেন!”
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি অসীম বাবু, শুধু সন্দিগ্ধ লোকটির কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন স্টেশন থেকে সেন বাড়ি যাওয়ার পথ-নির্দেশটা। শীতের রাতে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে তিনি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলেন গ্রামের শেষ প্রান্তে, একেবারে সমস্ত লোকালয়ের চিহ্নের অগোচরে।
এই চাঁদের আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাঁচ মহলা জমিদার বাড়িটিকে। এখন এখানে আর তেমন কেউ বসবাস করে না, করার পরিস্থিতিও নেই। সামনের গেটের ওপরের সিংহের মূর্তিটা যেন এখনো জীবন্ত হয়ে তাকিয়ে আছে অসীম বাবুর দিকে। অধিকাংশই ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এই বাড়িটার কোথাও এতটুকু সিমেন্ট-বালি আস্ত নেই, তা কবেই খসে গিয়ে বুকের পাঁজরের মত বেরিয়ে পড়েছে পুরোনো ইঁটের সারি। বিশাল বড় উঠোনের চারিপাশে দোতলা বাড়িটার অধিকাংশ ঘরেরই ছাদ ধসে পড়েছে। সামনের পরিত্যক্ত ঠাকুর দালানটি কত বছর ধরে হয়তো বঞ্চিত ঢাকের আওয়াজ থেকে।
“কাকে চায়!”, পেছন থেকে হঠাৎ এই কথা শুনে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন অসীম বাবু। কুপি হাতে, চাদর গায়ে আর মাথায় মাংকি টুপি পরিহিত এক বৃদ্ধ ব্যক্তি এগিয়ে এলো তার দিকে। এই হল এখানকার কেয়ারটেকার, বুঝলেন অসীম বাবু।
“আসলে বড্ড মুশকিলে পড়েছি, মশাই”, কাকুতির স্বরে বলে উঠলেন অসীম বাবু, “এই গ্রামে এসেছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়িতে, ফিরতি পথে রাস্তা ভুল করে এখানে চলে এসেছি। এখন তো শেষ ট্রেনটারও ছাড়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এই রাতে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে ফিরতেও পারবো কিনা সন্দেহ…যদি কিছু মনে না করেন, আজকের রাতটা কি এই বাড়িতে থাকা যাবে?”
সেই বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন অসীম বাবুর দিকে, তারপর কুপির আলোয় তার মুখটা ভালো করে দেখে বললেন, “ঠিক আছে, আসুন!”
রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে এই জমিদার বংশের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে চলড়ছিলো সেই কেয়ারটেকার। এমনই কথা প্রসঙ্গে সে বলে উঠলো, “আসলে কি জানেন মশাই, এই সব পয়সাওয়ালা মানুষদের পরিবারে কোনো না কোনো পাপ লেগেই থাকে। সেটা কোন সাল ছিলো যেন…হ্যাঁ, ১৯৩৮, তখন এই পরিবারের কর্তা রায়বাহাদুর কৃষ্ণমোহন সেন ছিলেন এই গোটা গ্রামের জমিদার। বলাই বাহুল্য, তিনি ছিলেন ইংরেজদের নেওটা। তার স্ত্রীর নাম ছিলো চারুলতা দেবী। শোনা যায়, যে এই মা ঠাকরুণের কোন এক দূরসম্পর্কের ভাই নাকি যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের দলে! কি যেন নাম ছিলো তার…হ্যাঁ, নিমাইচন্দ্র মিত্র। একবার দলের বেশিরভাগ লোক ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে, নিমাই নাকি এখানে পালিয়ে আসে এখানে। এখানেই কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাকে সে, তার নাকি শারীরিক সম্পর্কও হয় এই বাড়ির এক সুন্দরী কাজের মেয়ের সাথে।”
“তারপর?”, উত্তেজনার পারদ চড়া কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন অসীম বাবু।
“তারপর আর কি! কৃষ্ণমোহনের কোনো এক বিশ্বস্ত লোক নাকি নিমাই-এর অনুপস্থিতিতে তার ঘর থেকে চুরি করে আনে বেশ কিছু চিঠিপত্র, যা থেকে কৃষ্ণমোহনের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিমাই-এর বিপ্লবী হওয়ার কথা! তিনি কিন্তু মাথা গরম করলেন না, শুধুমাত্র চুপিসারে সেই কথা জানিয়ে দিলেন ইংরেজদের কাছে। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, নিমাই-এর অজান্তেই পুলিশরা তাকে ধরতে এসে বিফল হলো, কারণ সেদিন রাত থেকে নিমাই হল নিরুদ্দেশ! সেদিন থেকে আজ অবধি আর কেউ তার কোনো খোঁজ খবর জানে না! কি অদ্ভুত কান্ড বলুন দেখি!”
একটা মস্ত বড় পাথর যেন ধীরে ধীরে টলে উঠতে শুরু করেছে অসীম বাবুর বুক থেকে, তাও নিজের সকল উত্তেজনা যথাসম্ভব লুকিয়ে, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আর সেই কাজের মেয়েটির কি হয়েছিলো, যার সাথে নিমাই-এর শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়?”
“আরে সে আরেক অভাগী, বুঝলেন মশাই”, বলতে লাগলো বৃদ্ধ কেয়ারটেকার, “তার পরিবারে ওই এক মাতাল বাপ ছাড়া আর কেউ ছিলো না। সেই বাপ বলেছিলো, এক রাতে প্রসব করতে গিয়ে মা আর সন্তান দু:জনেরই মৃত্যু হয়েছে। সৎকারের পয়সা না থাকায় দু’জনকেই গ্রামের নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে!…অবশ্য এই সব কথা আমার ঠাকুরদার মুখে শোনা, তিনিও ছিলেন এখানকার এক কর্মচারী…যাক গে, এবার শুয়ে পড়ুন মশাই, রাত অনেক হল।”
বৃদ্ধ সেই ঘর থেকে চলে গেলে, বিস্ফারিত চোখে অসীম বাবু মনে মনে বলে উঠলেন, “না, আর যাই হোক না কেন, সেই সন্তান মরেনি। হয়তো মেয়েটির মৃত্যুর পর, তার মাতাল পিতা এই অবৈধ সন্তানটির দায়িত্ব নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে, তাকে ফেলে এসেছিলো এই গ্রামের কোনো জঙ্গলে! তারপর সকলকে তার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে দেয়…আর সেই সন্তানই হল আমার বাবা!”
জল ভরা চোখে অসীম বাবু আবার দেখলেন দেওয়ালের গায়ে পড়া সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির ছায়াটিকে! এবারও সে যেন তার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো!
(৬)
রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারের বুক চিরে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে শেয়ালের চিৎকার এবং নাম না জানা কোনো রাতপাখির ক্রন্দন ধ্বনি! পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চুপিসারে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অসীম বাবু। তারপর সন্তর্পণে বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। তার সামনে দিয়েই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে সেই অশরীরি ছায়ামূর্তি। তাকে অনুসরণ করতে করতে অসীম বাবু পৌঁছলেন বাড়িটির পেছনে, জঙ্গলের ভেতর।
ছায়ামূর্তিটি এখন অগ্রসর হচ্ছে সেই জলাভূমির মাঝ বরাবর সেই সরু আল দিয়ে, চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার অবয়ব। অসীম বাবুও ছুটে এগিয়ে গেলেন তার পিছু পিছু। কিন্তু সেই আলের কিছুটা পথ অতিক্রম করেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। এই অবস্থায় অবাক হয়ে অসীম বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিকে চাইতে লাগলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে, কেউ যেন সজোরে তাকে পেছন থেকে এক ধাক্কায় ঠেলে ফেলে দিলো পাশের জলাভূমির ভেতর!
জলাভূমিটার জলের গভীরতা খুব বেশি না হলেও, অসীম বাবুর মনে হল কোনো এক অপার্থিব শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই জলকাদার আরো গভীরে। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, তার মানে কি এই সব কোনো অশরীরির প্রতারণা? সেই প্রেতাত্মা কি তাকে মিথ্যা ‘গুপ্তধন’-এর লোভ দেখিয়ে এত দূরে নিয়ে এলো, তাকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে? কিন্তু কেন? চারিদিকে ঘন কালো জল, নাকে মুখে জল ঢুকে যাচ্ছে তার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! এবার কি করবে সে? কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে?
হঠাৎ, তার দু’চোখের অন্ধকারের সামনে একটি অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠলো…পাশ্ববর্তী জমিদার বাড়ির একটি ঘর! তবে সেই ঘরের অবস্থা এখনকার মত নয়! চারিদিকে সাজগোজ আর আভিজাত্যের রমরমা। সেই ঘরের বিছানার উপর শুয়ে আছে এক যুবক! ঠিক যেমনটা শুভাশিস বলেছিলো তেমনই দেখতে তাকে…’লম্বা চওড়া চেহারা, এক মুখ দাড়ি, এলোমেলো চুল, পরণে ময়লা ধুতি জামা’…তার মানে এই কি সেই নিমাই!
ঠিক এমন সময় সেই ঘরের দরজায় তীব্র কড়াঘাতের আওয়াজ শোনা গেল। সেই শব্দ শুনে, ঘুম থেকে উঠে গিয়ে নিমাই ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা খুললো। সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন এক সুন্দরী সুসজ্জিতা নারী। অবাক কণ্ঠে নিমাই বলে উঠলো, “চারু দিদি, তুমি? এই সময়!”
চারুলতা দেবী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো, “পালাও ভাই, পালাও!…উনি কোনো ভাবে জানতে পেরে গিয়েছেন তোমার বিপ্লবী হওয়ার কথা! আজ রাতে বাইজী বাড়ি থেকে মদ্যপ অবস্থায় ফিরে তিনি নিজে মুখে বলে ফেলেছেন আমাকে সেই কথা! আরো বড় উপাধি পাওয়ার লোভে তিনি সেই কথা জানিয়ে দিয়েছেন ইংরেজদের! আজ রাতেই ইংরেজ পুলিশরা তোমায় ধরতে আসছে, ভাই! এতক্ষণে বোধহয় গোটা বাড়িটাকে নিঃশব্দে ঘিরে ফেলেছে তারা…”
এই কথা শুনে আর কোনো কথা না বলে সেই ঘর থেকে ছুটে বেরোতে উদ্যত হল নিমাই। ঠিক সেই সময় চারুলতা দেবী বলে উঠলেন, “দাঁড়াও ভাই…আমি জানি, এই সময় গা ঢাকা দিয়ে থাকতে গেলে তোমার অনেক পয়সার প্রয়োজন। সেই ব্যবস্থা আমি করেছি…গরিব মানুষদের ঠকিয়ে আদায় করা তাদের রক্ত জল করা এই পয়সার কিছু তো কাজে আসুক এই দেশের কাজ!…এই নাও আমার গহনার বাক্স! এতে যা সোনা আছে তা যদি এই দেশকে স্বাধীন করার কাজে লাগে, তাহলে আমি গর্বিত হবো…বন্দে মাতরম!”, এই বলে তিনি শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখা গয়নার বক্সটি ধরিয়ে দিলেন নিমাই-এর হাতে।
দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো নিমাই-এর চোখ থেকে, তিনি মাতৃসম দিদির পায়ে নমস্কার করে বলে উঠলো, “বন্দে মাতরম!” তারপর গহনার বাক্সটিকে নিয়ে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলছিলো নিমাই। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলো না সে, কারণ ইংরেজ পুলিশেরা সত্যিই চারিদিকে ঘিরে ফেলেছে তাকে। মাঝেই দূর থেকে শোনা যাচ্ছে তাদের চিৎকার এবং গুলিবর্ষণের আওয়াজ। নিমাই সেই জঙ্গলের মাঝে থাকা জলাভূমির আল বরাবর গহনার বক্সটি নিয়ে ছুটে চললো। কিছুটা গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নাহ, শেষ রক্ষা বোধহয় হবে না। আজ সে কোনো মতেই এই গ্রাম ছেড়ে বেরোতে পারবে না। ইংরেজদের হাতে তাকে ধরা পড়তেই হবে, তারপর অকথ্য অত্যাচার করে তারা তার মুখ থেকে বার করে নেবে দলের অন্যান্যদের সম্পর্কে আরো খবর! নাহ, এ কিছুতেই হতে দেবে না নিমাই…কিছুতেই না!
গহনার বাক্সটা এক হাত দিয়ে ধরে, ওপর কম্পিত হাতটা দিয়ে যে বার করলো কোমরে গোঁজা গোপন পিস্তলটি! তার কাছে যে বেশি সময় নেই, যদি এই গহনাগুলো তার কাছ থেকে পুলিশ পায়, তাহলে যে তার চারু দিদিকেও তাকে সাহায্য করবার জন্য গ্রেফতার করবে তারা! সেটা কিছুতেই হতে দেবে না সে। বিদ্যুৎ বেগে পিস্তলটি বার করে নিজের কানের পাশে লাগিয়ে গুলিবর্ষণ করে মৃত্যুবরণ করলো নিমাই! রক্তাক্ত অবস্থাতেও দুই বহু দিয়ে গহনার বাক্সটিকে আঁকড়ে ধরে সে শেষবারের মত বলে উঠলো, “বন্দে মাতরম!” তারপর সেই অবস্থাতেই সে ঝাঁপ দিলো জলাভূমির ভেতর!
(৭)
এতটা দেখেই নিজের দুই হাতে কোনো এক অদ্ভুত বস্তুর স্পর্শ পেয়ে চিন্তার ঘোর কেটে গেল অসীম বাবুর। কাদাজলের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, সেটা যেন একটি মানুষের অবয়ব। শুধুমাত্র শরীরের হাড় কঙ্কালের ওপর যেন শক্ত কালচে চামড়া দিয়ে ডাকা একটা পুরোনো দেহাবশেষ! নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তিনি সেই মরদেহটিকে নিয়ে আলের কাছে শক্ত মাটির ওপর সাঁতরে এলেন। সেটাকে ডাঙ্গার ওপর তুলতেই আতঙ্কে কেঁপে উঠলো তার বুক!
এটা তো একটা মমি! তার পূর্বপুরুষ বিপ্লবী নিমাইচন্দ্র মিত্রের মমি! শরীরের কাঠামো এক থাকলেও সংকুচিত হয়েছে শরীরের মাংসপেশী! কুচকুচে কালো চামড়ায় ঢাকা দেহাবশেষটির মুখের আকৃতি এখনো স্পষ্ট, এখনো বোঝা যাচ্ছে তার ডান কানের পাশে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ক্ষতচিহ্নটি! এবং বলা বাহুল্য, আজও সে একই ভাবে দু’টি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তার দিদির দেওয়া গহনার বক্সটি! তাহলে এটাই হল সেই ‘গুপ্তধন’!
চোখে জল এসে গেল অসীম বাবু। তিনি যেটুকু পড়াশোনা করেছেন, তাতে হয়তো তার স্পষ্ট ধারণা নেই, যে যখনই কোনো মানব শরীর জলাভূমি বা ‘Bog’-এর ভেতর পতিত হয় তখন সেখানকার জলের ‘Humic Acid’, কম তাপমাত্রা এবং ‘Oxygen’-এর অনুপস্থিতির জন্য তাতে পচন ধরে না। দেহাবশেষটির ভেতর থেকে মাংসপেশী বা হাড়ের পরিমাণ কমে গেলেও তার আকৃতি অবিকৃত থাকে। শুধুমাত্র শরীরের চামড়াটি গভীর ভাবে ‘Tanned’ হয়ে গিয়ে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রঙ ধারণ করে। আমরা মমি বলতেই হয়তো মিশরের কথা ভাবি, তবে সেই মমিগুলো ছিলো মানুষ দ্বারা করা ক্রিয়াকলাপের ফল। কিন্তু প্রকৃতি যে নিজেও এক অতুলনীয় মমি-কারিগর, সেই কথা প্রমান করে দেশ বিদেশের জলাভূমি থেকে পাওয়া এই মমিগুলি, যাদেরকে বলা হয় “Bog Mummies”.
সেই রাতেই জঙ্গলের ভেতর শুকনো ডাল পালা জমা করে, তাতে লাইটারের আগুন জ্বালিয়ে তিনি সৎকার করলেন তারই পুরপুরুষের আশি বছর পুরোনো এই দেহাবশেষটিকে। তিনি জানেন যে সেই গহনার বাক্সে যে সোনা আছে, তা দিয়ে তার ছেলের হার্ট সার্জারির খরচাপাতি খুব সহজেই চালাতে পারবেন তিনি।
ভোরের সূর্য পুব আকাশে দেখা দিয়েই তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে, সেন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। এখন যে তাকে কলকাতা গিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। সেদিনের কলকাতাগামী প্রথম ট্রেনের জানলার ধারের একটি সিটে বসেছিলেন তিনি। ট্রেন ছেড়ে দিলো, ধীরে ধীরে মুছে গেল বীরনগর স্টেশনের সকল প্রতিচ্ছবি। নিজের ব্যাগের ভেতর রাখা গহনার বাক্সটিকে দুই হাত দিয়ে উপলব্ধি করতে করতে, নিজের সেই অচেনা বিপ্লবী পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাভরে তিনি বলে উঠলেন, “বন্দে মাতরম!”
(সমাপ্ত)