অশ্লীলতা নাকি আধুনিকতা
–রীণা চ্যাটার্জী
অশ্লীলতা! নাকি আধুনিকতা! বুঝি না ঠিক, হয়তো বা বোধের অভাব। ‘আধুনিকতা’ কথাটা দেখেছি, শুনেছি জ্ঞান হওয়ার শুরু থেকেই। সমাজ, মানসিকতা, চলন-বলন, চিন্তা ধারা আধুনিক করতে হবে। ভিন্ন ভাবধারায়- আধুনিকতার বিপক্ষে যাঁরা, তাঁদের কাছে আধুনিকতার আরেক নাম অশ্লীলতা। এগিয়ে চলছে দুই বিপরীত চিন্তা ভাবনা– ‘আধুনিকতা’, ‘অশ্লীলতা’ আবহমান কাল ধরে। পুরোনো কিছু নীতি, কিছু ভাবনা যা কোনো কোনো সময়ের জন্য পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়েছে, করেছেন সমাজের উদারমনস্ক সাহসী প্রতিনিধিরা। প্রতিবাদ হয়েছে, রক্ষণশীলরা বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। আশা-নিরাশায় ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়েছে আধুনিকতা।
অশ্লীলতা, অপরাধ, পাপ এই বোধগুলি একসময় একচেটিয়া ভাবে নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া ছিল সমাজের রীতি নীতি মেনে। বাল্যবিবাহের অবশ্যম্ভাবী ফল অকাল বৈধব্য… নির্যাতনের শিকার নারী (মন বা দৈহিক কারণে হয়তো সেই বালিকা তখনো নারী হয়েই উঠতে পারে নি) তবুও তাকে সারাজীবনের জন্য বৈধব্য আচার আচরণে অভ্যস্ত হতে হয়েছে, পালন করতে হয়েছে একাধিক নিপীড়িত নিয়ম নীরবে। কারণ সমাজের শুচিতা রক্ষা করা। যদিও সমাজের পর্দায় আড়ালে কোনো কোনো নারী ভোগ্যা হয়েছে, কলঙ্কের কালিমা তার আঁচলেই লাগিয়ে তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে– দায় অশ্লীলতা, অশালীন আচরণ। সমাজ শুদ্ধ রাখার দায়ে সতীদাহ হয়েছে, জ্বলন্ত চিতায় নির্মম ভাবে সঁপে দেওয়া হয়েছে জীবন্ত প্রাণ (অবশ্যই নারীর)। পর্দার আড়াল দেওয়া হয়েছে… সমাজ, বংশ আভিজাত্য রক্ষার দায়ে। পুঁথি শিক্ষা থেকে দূরে রাখা হয়েছে.. কুসংস্কারের বশে। মানে নারীরা দূরে থাকলেই, ওদের সরিয়ে রাখলেই সমাজ শুদ্ধ, শুচি, অশ্লীলতা থেকে মুক্ত। এগিয়ে এসেছেন বরেণ্য সমাজ সংস্কারকরা। নির্দ্বিধায় প্রতিবাদ করেছেন। সমালোচনার ঝড় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে সহ্য করে দিয়ে গেছেন নতুন চিন্তার অবকাশ। গড়ে দিয়ে গেছেন আধুনিক মননশীলতার সমাজ।
যদিও সমাজ সংস্কারের এই আধুনিক পর্ব বেশ সমালোচিত ছিল প্রাচীনপন্থীদের কাছে…কিছু স্বার্থের কারণে, কিছু কুসংস্কারবশতঃ। তবুও এই আধুনিকতা ধীরে ধীরে স্থান করে নিয়েছে সমাজে কালের নিয়মে (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)।
পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নারীর পোশাকের আধুনিকীকরণের প্রয়োজন ছিল, তাও হয়েছে এক সাহসী দৃপ্তময়ী নারীর হাত ধরে। সমালোচনা হয়েছে আধুনিক পোশাকের… ‘অশ্লীলতা’ ছিল সেই সময়ে সেমিজ ব্যবহার। পর্দার আড়াল ছিল শালীনতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেঁচে থাকা ছিল শালীনতা। তার বিপরীত চিন্তা ছিল অশালীনতা।
আধুনিক মননশীলতার হাত ধরে আজকের কিয়দংশ নারী, শিশুরা পেয়েছে খানিক মুক্ত আকাশ, সুস্থ পরিবেশ, দেওয়া হয়েছে মতামত প্রকাশের অধিকার।
আমরা আধুনিকতার সাথে হেঁটে স্বাধীনতা পেয়েছি। ইচ্ছে মতন করে ভাবতে পেরেছি, বলতে শিখেছি। পরিধানের স্বাধীনতাও পেয়েছি। তবে কেন আমরা শালীনতা বজায় রাখতে পারছি না? ভাষার মাধুর্য কেন আমরা ভুলে যাই… কেন আধুনিকতার নাম যথেচ্ছাচারিতা ভাবি, প্রতিবাদের ভাষা অশালীন হয়ে যায় অবলীলায়!
স্যোশাল মিডিয়া এর জ্বলন্ত উদাহরণ– কোনো কিছুর প্রতিবাদে অশালীন ভাষার ব্যবহারে প্রতিযোগিতা দেখা যায়, পুরুষ অপেক্ষা নারীদের মধ্যে বেশী। প্রতিবাদ মানেই সমস্ত পুরুষ খারাপ! আমরা ভুলে যাই অনেক পুরুষ আছেন যাঁরা আমাদের সম্মান রক্ষা করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে এসেছেন বারবার, প্রাণ দিয়েছেন। তবুও কেন এই ভেদাভেদ? প্রতিবাদ হোক না একসাথে, আক্রমণ শুধু অপরাধীকে করলে অসুবিধা কোথায়? আর অপ্রয়োজনে অশালীনতার বাতুলতা এড়িয়ে গেলে… যাতে অন্ততঃ ভাষা বা ছবি থেকে যেন চোখ সরিয়ে নেবার প্রয়োজন না পড়ে। অসুবিধা কোথায় মনের এই আধুনিকতায়? মনে তো হয় না খুব পিছিয়ে যাবে তাতে আধুনিকতা।
প্রশ্ন জাগে আমরা কি আধুনিক হবার আকাঙ্খায় শালীনতা বোধ হারিয়ে ফেলেছি? আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারি নি আধুনিকতা আর অশ্লীলতার বিভেদ? জানা নেই– আজকের আধুনিকতার স্বরূপ কতোটা যথাযথ প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।